গত ৩ এপ্রিল আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক, সংগঠকদের পক্ষ থেকে দেয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে সরকারের করণীয় বলে ছয়টি কাজ নির্দেশ করেছিলাম।
এগুলো হল: (১) অন্তত তিনমাসের জন্য এক কোটি পরিবারকে বিনামূল্যে খাদ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির যোগান। (২) বিনামূল্যে সকলের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। (৩) কৃষকের ফসল, সবজি, ফলের সঠিক দাম নিশ্চিত করার জন্য সরকারের কৃষিপণ্য ক্রয়ব্যবস্থা সম্প্রসারণ। (৪) সকল প্রতিষ্ঠানে বেতন মজুরি নিশ্চিত করা। (৫) ক্ষুদে উদ্যোক্তা ও কৃষকদের জন্য সহজশর্তে ঋণ সহজলভ্য করা। এবং (৬) পাহাড় ও সমতলে আদিবাসি জনগোষ্ঠী এবং উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সহায়তা প্রদান করা, চিকিৎসা নিশ্চিত করা।
আজ ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী যে ‘৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছেন তার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন, উপরের প্রায় কোনো করণীয়ই এই প্যাকেজে আসেনি। তিনি যে পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন সেগুলো হলো:
আজ ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী যে ‘৭২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছেন তার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন, উপরের প্রায় কোনো করণীয়ই এই প্যাকেজে আসেনি। তিনি যে পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন সেগুলো হলো:
প্যাকেজ-১: বিভিন্ন শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণসুবিধা, যা ব্যাংকগুলোকে দিতে হবে। এর সুদের অর্ধেক সরকার ভর্তুকি হিসেবে প্রদান করবে।
প্যাকেজ-২: ক্ষুদ্র (কুটিরশিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একইভাবে ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণসুবিধা। যাতে ৯ শতাংশ সুদের ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
প্যাকেজ-৩: বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সুবিধা বাড়ানো। এতে অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা তহবিলে যুক্ত হবে।
প্যাকেজ-৪: রপ্তানি ‘প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম’ নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণসুবিধা চালু করবে। এ ঋণসুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।
প্যাকেজ-৫: রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ‘শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনভাতা পরিশোধ করার জন্য’ পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ অব্যাহত থাকবে।
তারমানে রপ্তানিমুখি শিল্প যা প্রধানত তৈরি পোশাক শিল্প তার জন্য, ব্যাংকগুলো যাতে ঋণবরাদ্দ করে প্রধানত তার জন্য সরকারের ভর্তুকি বরাদ্দ নিয়েই এই প্যাকেজ। এতে সুদের ভর্তুকি পেয়ে ব্যাংকগুলোর লাভ হবে, কম সুদে ঋণ পেয়ে যেসব ব্যবসায়ীর ব্যাংকের সাথে ভালো যোগাযোগ তাদেরও লাভ হবে। এই পোশাক কারখানার অধিকাংশ খোলা ছিল কদিন আগে পর্যন্তও, যেগুলো বন্ধ সেগুলোর মজুরি সবার পরিশোধ হয়নি। সামনে কতোজন ছাঁটাই হবে সেটা নিয়ে সকলেরই উদ্বেগ। পোশাক কারখানাতে এর আগের কয়েক মাসের বেতন মজুরি তো মালিকদেরই দেবার কথা, তার জন্য জনগণের টাকায় কেন সরকারের ভর্তুকি দিতে হবে তার কোনো ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
অথচ এদিকে শ্রমিকদের নিয়ে যা খুশি তাই করছে মালিক-সরকার। গণপরিবহণ বন্ধ থাকা অবস্থায় একবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় ডাকা হয়েছে কারখানা খোলা বলে, শ্রমিকেরা অবর্ণনীয় কষ্টে এসেছেন। ঢাকায় আসার পরে আবার মজুরি না দিয়ে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের এভাবে সীমাহীন ভোগান্তি সৃষ্টি করার জন্য কোনো জবাবদিহি নেই।
রপ্তানিমুখি শিল্পের বাইরে যে হাজার হাজার ছোট, মাঝারি ও কুটির শিল্প আছে, যেগুলো দেশের চাহিদা মেটায় এবং যাদের এখন পথে বসার দশা তাদের অধিকাংশের জন্য ঋণের এই প্যাকেজ কোনো কাজে লাগবে বলে আশা করা কঠিন। কেননা যেহেতু ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণের কথা বলা হয়েছে তাতে অধিকাংশ ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের পক্ষে ব্যাংকের সাথে বোঝাপড়া করা সম্ভব নয়। করোনা আক্রমণের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাফীদের জন্য সুবিধা ঘোষণা করেছে। এদের হাতেই সরকারি বেসরকারি ব্যাংক। সুতরাং তারাই এই প্যাকেজে, সরকারের ভর্তুকির বিশেষ সুবিধা নিতে পারবে। প্রধানমন্ত্রীর প্যাকেজে যারা দিন আনে দিন খায় ধরনের পেশা বা ব্যবসায় যুক্ত সেই কোটি কোটি মানুষের জন্য ঋণ বা বরাদ্দ কিছুরই সন্ধান পাওয়া গেলোনা।
আমরা বলেছিলাম, বাংলাদেশে নিয়মিত বেতন ও মজুরি পেয়ে কাজ করেন এরকম মানুষ সংখ্যায় খুবই কম, যথাযথ মজুরি আরও কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই স্বনিয়োজিত; অনিশ্চিত, অনিয়মিত পেশাই বাংলাদেশের প্রধান জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার অবলম্বন। কৃষি শিল্প আর পরিষেবা খাতে প্রায় ৬ কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ৫ কোটিরও বেশি সংখ্যক মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে প্রতিদিনের হাড় ভাঙা কাজের ওপর। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে এই কোটি কোটি মানুষ এখন বেকার এবং দিশেহারা।
আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনা ছাড়াই তাদের জীবন ক্ষুধা এবং অনিশ্চয়তায় বিপন্ন। এদের বিপুল অধিকাংশের এমন কোনো সঞ্চয়ও নেই যা তাদের অনিশ্চিত সময় পার হতে সাহায্য করবে, বরং তাদের আরও ঋণগ্রস্ত হবার আশংকা তৈরি হয়েছে। সরকারের দৃষ্টিতে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই!
আমাদের প্রস্তাব এদের ঘিরেই ছিল। তা বাস্তবায়ন করতে, আমরা হিসাব করে দেখেছি, ৭০ থেকে ৯০ হাজার কোটি টাকার একটি প্যাকেজ বরাদ্দ প্রয়োজন। আমরা এও বলেছিলাম যে, সরকার এই বরাদ্দ ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নের জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করলে এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন খুবই সহজ হবে। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করলে বহু সামাজিক শক্তি এতে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে রাজি থাকবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
আমরা গুরুত্বের সঙ্গে আরও বলেছিলাম যে, এই বরাদ্দের জন্য জনগণের ওপর নতুন বোঝা চাপানোর দরকার হবে না। কয়েকটি গোষ্ঠীর কাছ থেকে জনগণের লুন্ঠিত সম্পদের কিয়দংশ উদ্ধার করলেই এই বিপদ থেকে জনগণকে উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ গত দশ বছরে দেশ থেকে বাইরে পাচার হয়েছে কমপক্ষে ৭ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাফী ঋণ প্রায় দেড় থেকে দুই লক্ষ কোটি টাকা, এর মধ্যে দশটি গ্রুপের হাতেই আছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।
সরকারের পক্ষে এদের চিহ্নিত করা খুবই সহজ, এদের অর্থ বিদেশ থেকে ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ হলে দেশে তাদের সম্পদ বাজেয়াফত করে সরকার এই বিপদকালীন তহবিল গঠন করতে পারে। কিন্তু আমরা বারবার দেখতে পাচ্ছি যে, সরকারের অবস্থান হলো এর বিপরীত, এদের কাছ থেকে সর্বজনের সম্পদ উদ্ধারের বদলে এদের হাতে আরও সম্পদ তুলে দেওয়াই লক্ষ্য।
আমরা লক্ষ্য করেছি যে, করোনা বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা ও বিশেষ বরাদ্দ ঘোষণা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকার সেই পথে যেতে রাজি না। আমরা জানি দেশে বৃহৎ ঋণখেলাফী, সম্পদ পাচারকারী আর বিজিএমইএ-র দাপট। প্যাকেজ দেখে মনে হয়, সরকারের দৃষ্টিতে এরাই সবচাইতে দুর্দশাগ্রস্ত। সুতরাং কয়েক কোটি নিরন্ন কর্মহীন মানুষের প্রাপ্য এদের হাতে তুলে দেওয়াই সরকার তার দায়িত্ব বলে গ্রহণ করেছে।
(০৫ এপ্রিল ২০২০ তারিখে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলায় প্রকাশিত)