ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে জনগণের ওপর ভর না করে ক্রমে সরকার দৃশ্যত তিনটি শক্তির ওপর নির্ভর করছে বেশি। এর মধ্যে আছে প্রথমত, পুলিশ, র্যাব ও সামরিক-বেসামরিক আমলা; দ্বিতীয়ত, ইসলামপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং তৃতীয়ত, ভারত। এর প্রতিফলন পড়েছে সরকারের বিভিন্ন নীতি, উন্নয়ন কার্যক্রম, চুক্তি ও ভূমিকায়।
পুলিশ ও র্যাবকে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া হলেও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা এ বছর আরো কমেছে। বছরের পর বছর বিনা বিচারে খুন, আটক, গুম নিয়ে তাদের বক্তব্য এতই অন্তসারশূন্য যে তা কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না। নারায়ণগঞ্জে সাত খুন ঘটনার পর এসব বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সমাজে অবিশ্বাস ও আতঙ্ক বেড়েছে। এ বছর খুন, সন্ত্রাস ছাড়া ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। এ ছাড়া বিদেশি হত্যা এবং শিয়া ও আহমদিয়াদের ওপর হামলা নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
যৌন হয়রানি, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণও বেড়েছে। দেশে কোনো সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই সিসিটিভি ক্যামেরা বসানোর ধুম পড়ে। কিন্তু এ রকম বেশ কয়েকটি ক্যামেরায় অপরাধীরা চিহ্নিত হওয়ার পরও বর্ষবরণ উত্সবের যৌন সন্ত্রাসীদের পাকড়াও করার ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা এবং ছলচাতুরী ছিল দৃষ্টিকটু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকাও ছিল তা-ই। এতটুকু বোঝা গেছে যে এসব কর্তা অপরাধীদের চেনে বলেই তাদের রক্ষা করতে কাজ করছে। মা দিবসে নারী নিপীড়কদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ছাত্রী ও ছাত্রদের ওপর আক্রমণ করে পুলিশ বিষয়টি আরো নিশ্চিত করেছে।
ভর্তি, নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ বছরে বছরে বাড়ছেই। এবারে মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরাই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে গণতদন্ত কমিটি তার সত্যতা উদ্ঘাটন করে। প্রকৃতপক্ষে ভর্তি থেকে নিয়োগ—সবই এখন বাণিজ্যের বিষয়। বাংলাদেশে সরকারি, আধা সরকারি, এমনকি বেসরকারি বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য এখন লাখ লাখ টাকা ঘুষ জোগাড়ে নামতে হয় মানুষকে। দুর্নীতি, কোটা আর অঞ্চল দিয়ে যোগ্য তরুণদের সামনে তৈরি করা হয়েছে শক্ত প্রাচীর। অদক্ষ, অযোগ্য, চাটুকার, সন্ত্রাসীতে সব প্রতিষ্ঠান ভরে ফেলার তত্পরতা ২০১৫ সালে আরো বেড়েছে।
এগুলোর মধ্য দিয়ে সর্বজন বা পাবলিক সব প্রতিষ্ঠান দলীয় ও গোষ্ঠীগত সম্পত্তি বানানোর অপচেষ্টা এই বছরে অনেক জোরদার হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়—সবই অন্তর্ভুক্ত। এ ক্ষেত্রে সরকারি ছাত্র-যুবসহ বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অন্যদিকে ফুটপাতে প্রায় দুই সপ্তাহ কাটিয়ে এক লাখ শিক্ষকের প্রতিনিধি কয়েক শ স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক ব্যর্থ-মনোরথ হয়ে এ বছরও ঘরে ফিরে গেছেন। বেতন দেওয়ার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করার দাবি নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই শিক্ষকরা এর আগে ঢাকায় এসেছিলেন ২০১৩ সালে। পুলিশের লাঠি, স্প্রে, মরিচের গুঁড়া দিয়ে তাঁদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী তখন তিন মাসের মধ্যে সব দাবি মেনে নেবেন বলেছিলেন, সেই আশা নিয়ে শিক্ষকরা আবার ক্লাসে ফিরেছিলেন; কিন্তু তিন বছরেও সেই দাবি পূরণ হয়নি। এবারও পূরণ হলো না।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেক সাফল্যের পরিসংখ্যান আছে, বিপদেরও। জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয়ে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের তালিকাভুক্ত হয়েছে দেশ। এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষক, গার্মেন্ট শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকদের। এই তিন গোষ্ঠীই সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়। বেশির ভাগ শ্রমজীবী মানুষের আয় এখনো দারিদ্র্যসীমার আয়ের নিচে। অন্যদিকে সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের পরিসংখ্যান আছে বহুবিধ।
রানা প্লাজা ধসের ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল ২০১৩ সালে। গত বছরও অপরাধীদের বিচার অগ্রসর হয়নি। ক্ষতিপূরণ নীতিমালা প্রণয়ন ও সম্পর্কিত বিষয়ও নিষ্পত্তি করেনি সরকার।
পাশাপাশি এই বছরও রাষ্ট্রীয় ব্যাংক সোনালী ও বেসিক ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে যাওয়া প্রায় আট হাজার কোটি টাকার আর কোনো সমাধান হয়নি। উপরন্তু বৃহত্ ঋণখেলাপিদের পুনরর্থায়ন বা রিশিডিউল করার সময়সীমা আরো ১২ বছর বাড়ানো হয়েছে। বেক্সিমকোর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া ঋণ নিয়ে করা আবেদন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত। শেয়ারবাজারে লাখ লাখ মানুষকে ডুবিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা কারচুপির অভিযোগ ওঠার পরও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বছরই আন্তর্জাতিক সমীক্ষা জানিয়েছে, বছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পাচার হচ্ছে দেশ থেকে।
কৃষিও এক অজানা বিপদের মধ্যে প্রবেশ করছে। বাংলাদেশের কয়টি বেগুনের জাতকে জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত করার পর এসব জিএম জাতের মালিকানা নিয়ে নিয়েছে মার্কিন কম্পানি মনসান্টো এবং তার ভারতীয় অংশীদার মাহিকো। এই বেগুন বীজের বাজারজাতকরণ ভারত ও ফিলিপাইনে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশের জমি ও মানুষকে বিপদগ্রস্ত করে এই বেগুনের চাষাবাদ হচ্ছে। এরপর তুলা ও ধানের ক্ষেত্রেও এর সম্প্রসারণ ঘটানো হচ্ছে।
বিশাল প্রকল্প নিয়ে সরকার অপ্রতিরোধ্য এখন। সড়ক, সেতুসহ বিভিন্ন নির্মাণকাজে বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রূপপুর ঝুঁকিপূর্ণ পারমাণবিক বিদ্যুেকন্দ্রের ব্যয় ইতিমধ্যে চার গুণ বেড়েছে। সব পর্যায় থেকে বিরোধিতা সত্ত্বেও সুন্দরবন বিধ্বংসী রামপাল বিদ্যুেকন্দ্র নিয়ে সরকার এখনো এগিয়ে যাচ্ছে।
এই বছরেই নরেন্দ্র মোদির বিজয়ী সফর হয়েছে বাংলাদেশে। মোদির সফরের সপ্তাহখানেক আগে থেকে যা কিছু ভারতের চাহিদা, সেগুলোই প্রচার হয়েছে বাংলাদেশের অর্জন বা সাফল্য হিসেবে। এর মধ্যে ট্রানজিট ছিল, ছিল আম্বানি-আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ পরিকল্পনা, ছিল সুন্দরবন বিধ্বংসী প্রকল্প। ভিন্ন ভিন্ন চুক্তির মধ্য দিয়ে ট্রানজিট চুক্তির সব কিছু এগিয়ে গেছে, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রেল, সড়ক, সমুদ্রবন্দর—সব কিছুর ওপর ভারতের কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা হলেও জনগণ তো দূরের কথা, তথাকথিত সংসদ সদস্যরাও এর বিস্তারিত জানেন বলে মনে হয় না। এতে বাংলাদেশের কী লাভ কী ক্ষতি তা নিয়ে বিশ্লেষণ, আলোচনা, স্বচ্ছতা, সর্বোপরি জনসম্মতি ছাড়াই হচ্ছে সব কিছু। অভিন্ন সব নদীর ওপর বাংলাদেশের অধিকার নিয়ে দুই দেশের আলোচনার কোনো লক্ষণই নেই, কেননা ভারতের তাতে আগ্রহ নেই। কাঁটাতার ঘিরে আছে বাংলাদেশ। তা নিয়েও সরকারের কোনো গ্লানি নেই। সীমান্ত হত্যাও অব্যাহত আছে।
তবে স্থল সীমান্ত চুক্তি দুই পক্ষের জন্যই স্বস্তিকর হয়েছে। কয়েক হাজার একর জমি নিয়ে বিরোধ জিইয়ে ছিল ৬৮ বছর। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও ভারত এত দিন এটা আটকে রেখেছিল। এর জন্য দুই দেশের ছিটমহলে আটকে থাকা মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এত বছর।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অর্ধেকেরও বেশি কমা সত্ত্বেও সরকার তেলের দাম কমায়নি, তাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একটি বড় সুযোগ হারাল বাংলাদেশ। উপরন্তু সরকার অযৌক্তিকভাবে আবারও বিদ্যুত্ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। তাতে উত্পাদন ব্যয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
এই বছরের দুটি বৈশ্বিক সম্মেলন ছিল বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়নের বৈশ্বিক লক্ষ্য নির্ধারণী একটি, আর দ্বিতীয়টি জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির পাশাপাশি দেশের ভেতরে নদী বন খুন হচ্ছে সরকারি ভুল প্রকল্প বা দখলদারিত্বের জন্য। এর সঙ্গে ভারতের ফারাক্কা, গজলডোবা ও চীনের বাঁধ যোগ করছে অপূরণীয় ক্ষতি। দেশে সাধারণের জমি, বন, পাহাড় চলে যাচ্ছে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দখলে। বাতাস, পানি, খাদ্য বিষাক্ত হচ্ছে মুনাফার উন্মাদনায়। কৃষি জমি অকৃষি দেখিয়ে ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ করা হচ্ছে। দেশের প্রাণপ্রকৃতি ও মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন বিভিন্ন তথাকথিত ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের কারণে। এই বছর প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ পদক পেয়েছেন বটে; কিন্তু দেশে পরিবেশ বিধ্বংসী উন্নয়নের ধারাই আরো গতি পেয়েছে।
সব মিলিয়ে দেশে জৌলুস বেড়েছে; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও মানুষের বিপন্নতা বেড়েছে।
[লেখাটি ৫ জানুয়ারী ২০১৬ তারিখে কালের কন্ঠে প্রকাশিত]