বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীনের প্রবেশ

৫ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়েছে। এর আগে-পরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও স্নাতক পর্যায়ে বিভিন্ন কলেজে ক্লাস শুরু হয়েছে, হচ্ছে। সারা দেশে কয়েক লাখ পরিবার ছেলেমেয়েদের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, শুরু হয়েছে নতুন পর্যায়ের উদ্বেগ আর লড়াই। এক মহাযুদ্ধ পার হয়েই তাঁরা এই পর্বে প্রবেশ করেছেন। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর থেকেই শুরু হয় ভর্তির যুদ্ধ। কোন বিষয়ে ভর্তি হওয়া যাবে, কোন কোচিং সেন্টার ভালো হবে, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে? দূর-দূরান্তের সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য খরচের মেলা হিসাব। যাদের আয় কম তাদের আবার খরচ বেশি। বড় শহরে সন্তানকে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করতে হবে, তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আত্মীয়স্বজনের বাসায় থাকার অবস্থা না থাকলে মেসে থাকতে হবে। সন্তান যদি মেয়ে হয়, উদ্বেগ আরও বেশি। কোচিং সেন্টারের ব্যয়, বইপত্র, থাকা-খাওয়া-যাতায়াতের ব্যয়।

এরপর শুরু মূল পর্ব। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হবে, হয়তো একাধিকবার। যাতায়াত খরচ তো বেড়েই যাচ্ছে, তারপরও ঠিকমতো টিকিট পাওয়া, সময়মতো পৌঁছাতে পারা-সবই অনিশ্চিত। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কোথাও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। দিন, মাস, বছরের যুদ্ধ। অর্থব্যয়। শারীরিক পরিশ্রম। দোয়া তাবিজ। তারপরও অনিশ্চয়তার শেষ নেই। সব মিলিয়ে যদি বেশ কয়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দৌড়ের ওপর থাকতে হয় তাহলে মোটা অঙ্কের বাজেট হাতে রাখতেই হবে। এটা অনেকের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। টাকাপয়সার চাপ তো আছেই, ভর্তি প্রার্থীর সঙ্গে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটে যাওয়ার মতো অতিরিক্ত মানুষ কয় পরিবারে আছে? বাংলাদেশে কত পরিবার এতসব বাধা অতিক্রম করতে পারে? যারা পারে তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

আর্থিক, পারিবারিক এ রকম ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও বহুজনকে অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলে আসার ঘটনা আছে। আমাদের বিভাগে এ রকম ছাত্রছাত্রী প্রায় প্রতিবছরই বেশ কয়েকজন পাই। পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতা নেই বললেও কম বলা হয়, টিকে থাকা প্রতিদিনের যুদ্ধ। পড়াশোনা অনামী স্কুল-কলেজে, কোচিং সেন্টারে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। নিজেরাই পড়াশোনা করেছেন। কোচিং গাইডসহ বিপুল অর্থব্যয়ের দাপটের মধ্যে এসবের বাইরে থেকে যখন কোনো শিক্ষার্থীকে দেখি ‘মেরিট লিস্ট’-এ স্থান করে নিয়েছে, তখন খুবই ভরসা পাই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো ভর্তি ফি অন্যগুলোর তুলনায় কম। এর মধ্যে অবশ্য বিভাগগুলো নানা ‘উন্নয়ন’ ফি বাড়িয়েছে। এই টাকা জোগাড় করাও অনেকের জন্য খুব কঠিন। এক ছাত্রী দূর থেকে ভর্তি হতে এসেছেন। সঙ্গে কেউ নেই। কেন? বললেন, বাসভাড়া জোগাড় করা যায়নি বলে বাবা আসতে পারেননি। আরেকজনের উপার্জনক্ষম বাবা নেই, আরেকজনের বাবা দিনমজুর, আরেকজনের মা অসুস্থ, বাবা দূরে কাজ করেন। কেউ কোনোভাবে ভাই বা বোনের সংসারে আছেন। ভর্তি হওয়ার পর নিজেদের লেখাপড়ার খরচ তো বটেই, সংসারেও কিছু দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিয়ে দিনরাত অতিক্রম করে, এ রকম শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম নয়। টিউশনি করে শিক্ষাজীবনে টিকে থাকার চেষ্টা অনেকের।

ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এই যে মহাযজ্ঞের পরিবর্তন হওয়া দরকার। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে ভোগান্তি কিছুটা কমতে পারে। তবে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়েও প্রশ্ন আছে, এগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শহর, ইংলিশ মাধ্যম, এলিট শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়েই প্রণয়ন করা। তবে প্রশ্ন আর ভর্তিপদ্ধতি যা-ই থাক বর্তমানে অবাধ প্রশ্নপত্র ফাঁস যে মহামারি আকার নিয়েছে এবং তা নিয়ে সরকারের যে রকম নমনীয়তা ও প্রশ্রয় দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রকৃত শিক্ষার্থীদের যন্ত্রণা আর হতাশার সুরাহা হওয়ার আশু কোনো সম্ভাবনা নেই।

২০১৬ সালে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রতারিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ-ক্ষোভ-প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা একটি গণতদন্ত কমিটি করেছিলাম। বেশ কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ডাক্তার, আইটি বিশেষজ্ঞ, গবেষক এই কমিটিতে ছিলেন। আমরা কয়েক মাসের পরিশ্রমে নিশ্চিত হয়েছিলাম প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সত্য, কীভাবে হয়েছে, তা-ও চিহ্নিত করেছিলাম। সরকার নিজে কোনো তদন্ত করেনি, বরং অস্বীকার করেছে, এই কমিশনের রিপোর্টেও গুরুত্ব দেয়নি। নাগরিকদের পক্ষ থেকে এ রকম সফল উদ্যোগ নিয়ে গণমাধ্যমগুলোও বিশেষ উৎসাহ দেখায়নি। এরপরের দুই বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁস অবিশ্বাস্য মাত্রা নিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে বা মেডিকেলে ভর্তি হতে পারা তাই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জন্য এক বিশাল স্বপ্নের পথে যাত্রা। কিন্তু এই স্বপ্ন ধারণ করার মতো পরিস্থিতি কি উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে আছে? নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশই শিক্ষক, ক্লাসরুম, আবাসনের সংকট নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। প্রায় বিশ্ববিদ্যালয়েই সরকার মনোনীত উপাচার্য নিয়ে অভিযোগ, জটিলতা। নতুন অনেক বিভাগে ক্লাসরুম, শিক্ষকের সংকট। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন বাড়ছেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে গত কয় বছরে বেশ কয়টা নতুন হল হয়েছে, তার ফলে প্রতি ব্যাচে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদের হলের সংখ্যা বাড়ার ফলে ছাত্রী অনুপাতের উন্নতি হয়েছে। এখনো প্রতিবছর হলের আসনসংখ্যা অনুযায়ী ভর্তিসংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ও তা বিভিন্ন বিভাগে বণ্টন করা হয়। তার মানে যে শিক্ষার্থীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য একটি আসন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে থাকার কথা। কিন্তু তারপরও দেখা যায় প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার মহাযুদ্ধের পর যাঁরা উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করছেন, তাঁদের জায়গা হয় গণরুমে কিংবা তাঁদের আসা-যাওয়া করতে হয় দূর থেকে, কিংবা আবারও আর্থিক চাপ নিয়ে বাসা ভাড়া করে থাকতে হয়।

কেন? কারণ, তাঁদের জন্য নির্ধারিত আসনগুলো এখনো অন্যদের দখলে। প্রথমত, সেশনজটের জন্য অনেক বিভাগের শিক্ষার্থীরা ঝুলে থাকায় হল খালি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক বিভাগে এখন বাণিজ্যিক প্রাইভেট উইকেন্ড ইভনিং বিভাগ খোলা হয়েছে। সেখানে নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা, ফল প্রকাশ হলেও মূল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্লাস, পরীক্ষা, ফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকেন অনিশ্চয়তায়। দ্বিতীয়ত, সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ক্ষমতাবলে তাঁদের প্রয়োজনমতো হলে থেকে যান, অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের আশ্রিত অন্য লোকজনও হলে থাকেন। এখানে প্রশাসন নীরব!

বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলোতে সরকারপন্থী ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং তার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নির্ভরশীলতার যে ধারা চলে আসছে, তার প্রধান শিকার হন অনুজ শিক্ষার্থীরা। জোর করে নিজেদের মিছিল-সমাবেশে নেওয়া, অন্য সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক কার্যক্রমে বাধা দেওয়া, হেনস্তা-নির্যাতন ইত্যাদি বহু অভিযোগ আমরা শুনি। সর্বশেষ নিজের ক্যালকুলেটর ফেরত চাইতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী ছাত্র কীভাবে ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন, তার চিত্র সংবাদপত্রে এসেছে। বেশির ভাগই আসে না। এই নিপীড়ন-সংস্কৃতির আরেকটি ভয়াবহ প্রকাশ ঘটে প্রতিবছর ‘র‍্যাগিং’-এর মাধ্যমে, যার প্রত্যক্ষ শিকার হন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এই সময়ে সেই যন্ত্রণার পর্বই চলছে অনেকের জন্য।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনন্দ, উত্কণ্ঠা আর স্বপ্ন নিয়ে প্রবেশ করেন নতুন শিক্ষার্থীরা। সাধারণভাবে প্রত্যাশা হলো তাঁদের এই নতুন যাত্রায় সহমর্মী হিসেবে পাশে দাঁড়াবেন পুরোনো শিক্ষার্থীরা, স্নেহ ও অভিভাবকের হাত এগিয়ে দেবেন শিক্ষকেরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হবে ক্লাস, পাঠ, হাসি, আনন্দ, গান, লেখা, খেলা, আড্ডা আর নতুন চিন্তায় সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্র। কিন্তু এই স্বাভাবিক প্রত্যাশা বারবার মার খায় ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের বর্বর আঘাতে। সে জন্য অনিশ্চয়তার মধ্যে, বড় স্বপ্নের কাছে পৌঁছেও নতুন শিক্ষার্থীদের আরেক যুদ্ধ শুরু করতে হয়। হয়তো এই অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনাও তাঁরাই বহন করেন।