কয়েক বছরে ষষ্ঠবারের মতো বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রস্তাব নিয়ে, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ৪ থেকে ৬ মার্চ গণশুনানি করেছে। দাম বাড়ার বিষয়ে পিডিবি যে প্রস্তাব দিয়েছে সেটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রস্তাবে যাঁরা কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করেন (৪০০ ইউনিট পর্যস্ত) তাঁদের প্রতি ইউনিট প্রায় দেড় টাকা ও যাঁরা বেশি ব্যবহার করেন (৬০০ ইউনিটের বেশি) তাঁদের দুই পয়সা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কৃষিতেও প্রতি ইউনিট দাম দেড় টাকা বাড়াতে বলা হয়েছে। প্রভাবশালী বিত্তবান অনেকেই আছেন, যাঁদের কাছে বিদ্যুতের দাম বাড়া অর্থহীন, কেননা তাঁরা বিদ্যুতের বিল কমই পরিশোধ করেন। অন্যদিকে যাঁদের ওপর এর চাপ পড়বে তাঁদের শুধু যে বিদ্যুতের বিল বেশি দিতে হবে তা-ই নয়, এর কারণে অন্য অনেক পণ্যও কিনতে হবে বেশি দামে। এর প্রভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী সব ধরনের পণ্য উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। দাম বাড়লে কৃষকসহ মূল উৎপাদকশ্রেণী ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
গণশুনানির ফলাফল কী হবে, তা অবশ্য আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তির বক্তব্যে পাওয়া গেছে। তাঁরা বিদ্যুতের দাম বাড়ার কথাই বলেছেন। এর প্রায় এক সপ্তাহ আগে জাতীয় সংসদে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে তাঁর দুটো যুক্তি গুরুত্বপূর্ণ; প্রথমত, ‘বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়লে তো বিদ্যুতের বেশি দাম দিতেই হবে।’ দ্বিতীয়ত, ‘বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশেই বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে কম। সুতরাং বাড়ালে অসুবিধা কী?’ এগুলো আপাতদৃষ্টে খুবই শক্তিশালী যুক্তি। কিন্তু ঘটনা যদি এমন হয়, প্রধানমন্ত্রীর দুটো যুক্তিই ভুল বা খণ্ডিত তথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তাহলে? জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি ও ভুল নীতির কারণে যদি বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, তাহলে জনগণ কেন তার দায় বহন করবে?
আর ‘বাংলাদেশে বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে কম’ বলার সময় প্রধানমন্ত্রী কি মজুরি, বেতন, অন্যান্য পণ্যের দাম বিচার করেছেন? উপরন্তু যদি দেখা যায়, প্রাথমিক জ্বালানি বাবদ খরচ অনুযায়ী বাংলাদেশে কম দামে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর আপত্তি কী? তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা তো দেখি, সঠিক নীতি গ্রহণ করলে আরও কম দামে নিরবচ্ছিন্নভাবে আরও বেশি বিদ্যুৎ জোগান দেওয়া সম্ভব।
২০১২ সালে যখন পিডিবি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন কয়েক বছরে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণগুলো সম্পর্কে সেখানে যথার্থই বলা হয়েছিল, ‘তরল জ্বালানির ব্যবহার, বেসরকারি খাত হতে বিদ্যুৎ ক্রয় এবং জ্বালানি ব্যয়ের অংশ বৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস বাবদ ব্যয় যেখানে শূন্য দশমিক ৮৩ টাকা, সেখানে ডিজেল বাবদ ব্যয় ১৫ দশমিক ৮০ টাকা। ২০০৯ সালে জ্বালানি তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল শতকরা ৪ দশমিক ৬৮ ভাগ, ২০১৩ সাল নাগাদ তা হয়েছে ২৭ দশমিক ৯৮ ভাগ। এই প্রায় ১৯ গুণ বেশি ব্যয়ের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি উৎপাদন ব্যয় বাড়ানোর একটি বড় কারণ, আরেকটি কারণ অবশ্যই মুনাফামুখী বেসরকারি খাতের অনুপাত বৃদ্ধি। এই দুটো আবার পরস্পর যুক্ত। বিদ্যুৎ যদি ব্যবসার বিষয় হয়, তাহলে মুনাফার চাহিদায় তার দাম বাড়বে, জনগণের ওপরই তার চাপ পড়বে। এতে অধিকাংশ শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সর্বশেষ হিসাবে (১০ মার্চ ২০১৪, ওয়েবসাইট) দিনের বেলা সর্বোচ্চ প্রকৃত উৎপাদন চার হাজার ২১৪, সন্ধ্যায় পাঁচ হাজার ৫৮৮ মেগাওয়াট। গ্যাসস্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না ৭১৯ মেগাওয়াট, তেল জোগান না দেওয়ায় হচ্ছে না এক হাজার ৫০ মেগাওয়াট এবং যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য উৎপাদিত হচ্ছে না এক হাজার ৩০২ মেগাওয়াট।
২০০৯ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল গড়ে দুই টাকা, এখন তা ছয় টাকার বেশি। এই তিন গুণেরও বেশি উৎপাদন ব্যয় বাড়ার পেছনে কারণগুলো অনুসন্ধান করলে বিভিন্ন সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতির খবরই পাওয়া যায়। মোটা দাগে এগুলোর মধ্যে আছে ১. গ্যাসস্বল্পতার অজুহাতে, বিকল্প থাকা সত্ত্বেও, একের পর এক বেসরকারি ভাড়াভিত্তিক (রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল) তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি। এরা সময়মতো বিদ্যুৎ না দিয়েও বিল পাচ্ছে, অনেকের নবায়ন হচ্ছে। কোনো কোনো কোম্পানির প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম কখনো কখনো ১০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এরাই বিদ্যুৎ ভর্তুকির প্রায় পুরো টাকা খেয়ে ফেলছে। ২. গ্যাসপ্রাপ্তির জন্য, স্বল্প মেয়াদেও বিদেশি কোম্পানি যুক্ত করায় কয়েক গুণ ব্যয়বৃদ্ধি, আবার দীর্ঘসূত্রতা তৈরি। ৩. বেশি দামে বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস ক্রয়, তার অনুপাত ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির ফলে ভর্তুকির চাপ বৃদ্ধি। ৪. বহুজাতিক কোম্পানির হাতে বেশির ভাগ ব্লক তুলে দেওয়ার পর বাজারের অভাবের অজুহাতে তাদের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বন্ধ রাখা গ্যাস-সংকটের অন্যতম কারণ। তার ফলে নতুন জোগান কম। ৫. রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো মেরামত ও নবায়ন করলে বিদ্যমান গ্যাস জোগানেই শতকরা কমপক্ষে আরও ২০ থেকে ৩০ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব ছিল, এর জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করা।
বিদ্যুৎ একদিকে যেমন চূড়ান্ত পণ্য, অন্যদিকে তেমনি আরও অনেক পণ্য ও সেবার প্রাথমিক শর্ত। সুতরাং বিদ্যুৎ যদি সুলভে সবার কাছে পৌঁছানো যায়, তাহলে সমগ্র অর্থনীতিই অনেক অপ্রয়োজনীয় বোঝা থেকে মুক্ত হয়, অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থান বাড়ে। তাহলে সবগুলোর মূলে হলো প্রাথমিক জ্বালানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, এবং তা যাতে সুলভে ও বেশি দিন পাওয়া যায়, তা নিশ্চিত করা। ভুল নীতির কারণে এই কাজ নানাভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
ভুল নীতির বিষয়টি এই সরকারের একক নয়, এটি ধারাবাহিকভাবে চলছে। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আনা হয়। আশির দশক থেকে বিশ্বব্যাংক, ইউএসএআইডি, এডিবি প্রভৃতি এই পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করেছে। আর এসব পরিবর্তিত নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে ক্রমান্বয়ে বহুজাতিক ও বেসরকারি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া। এই নীতি অনুযায়ী, বিদ্যুৎ আর গণপণ্য নয়, অন্য সব পণ্যের মতোই মুনাফামুখী বাণিজ্যিক খাত। বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের এতে লাভ হলেও অন্য সবার জন্যই তা উৎপাদন ব্যয় বাড়াতে থাকে, এই খাতে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিও দিন দিন বাড়তে থাকে। এ ভর্তুকি কমানোর যুক্তিতেই প্রতিবার দাম বাড়ানো হয়।
তবে বাংলাদেশের তেলনির্ভরতা বাড়ানো হলেও গত দুই বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়েনি, বরং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা তেলের মূল্য হ্রাসের সম্ভাবনাই প্রাক্কলন করেছেন। তার পরও মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকারের এ মুহূর্তে এত গরজ কেন? এর দুটো কারণ পাওয়া যায়: ১. সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত পূরণ, এবং ২. দেশি-বিদেশি বিদ্যুৎ ব্যবসায়ী ও কমিশনভোগী, বিদ্যুতের দাম যত বাড়ে তত যাঁদের লাভ, তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বার্থ রক্ষা করা।
সরকারের বিদ্যমান নীতি, কমিশননির্ভর তৎপরতা, দুর্নীতির এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে কিছুদিন পর পরই আমরা দেখব, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সরকার জোরদারভাবে এই ধারাতেই অগ্রসর হচ্ছে। তার দৃষ্টান্ত—১. রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল চুক্তির মেয়াদ ২০২০ পর্যন্ত বৃদ্ধি ২. বঙ্গোপসাগরে আরও বেশি দামে গ্যাস কেনার শর্তসহ চুক্তি সম্পাদন ৩. রামপালে উচ্চ আর্থিক মূল্যে এবং অত্যধিক অপূরণীয় ক্ষতি অনিবার্য করে কয়লাভিত্তিক প্ল্যান্ট চুক্তি এবং ৪. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে সব দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িত অপরাধীদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ২০১০ সালে প্রণীত দায়মুক্তি আইন অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বহাল রাখা।
তাই সমাধান আছে, কিন্তু বর্তমান পথে তা আসবে না। তেলভিত্তিক রেন্টাল পাওয়ারের চুক্তি বাতিল, রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়ন করা, ‘খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ আইন’ গ্রহণ করে দেশের কাজে শতভাগ সম্পদ বাংলাদেশের শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে ব্যবহার নিশ্চিত করা, পিএসসি-প্রক্রিয়া বাতিল করে স্থলভাগে ও সমুদ্রে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে জাতীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সুযোগ, ক্ষমতা ও বরাদ্দ প্রদান, বিদ্যুৎকে গণপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বৃহৎ বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপনে অগ্রাধিকার এবং নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানি মিলিয়ে বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা পুনর্বিন্যাস করে অগ্রসর হলে সমাধান অবশ্যই সম্ভব।
সরকার ও কোম্পানিমুখী লোকজনের মুখে শুনি, ‘বিদ্যুৎও চাইবেন আবার বেশি দামও দেবেন না, তা কী করে হয়?’ উত্তরে বলব, ‘হ্যাঁ, বিদ্যুৎও চাইব আবার বেশি দামও দেব না। কারণ, কম দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ খুবই সম্ভব।’ তবে নিশ্চয়ই, কমিশনভোগী তৎপরতা দিয়ে এটি সম্ভব হবে না।
(মার্চ ১৩, ২০১৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)