প্রতিবছরের মতো ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও বাজেটের আকার বাড়ছে। সে জন্য সর্বজনের প্রয়োজনীয় কোনো কোনো খাতে অনুপাতে না বাড়লেও অনেক খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জিডিপি বাড়ছে, অর্থনীতির আকার বাড়ছে, সুতরাং বাজেট অঙ্কও বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। তাই আগের বছরের তুলনায় বড় বলে বাজেট যেমন বিরাট সাফল্যের স্মারক নয়, তেমনি তাকে অস্বাভাবিক বা উচ্চাভিলাষী বলার কিছু নেই। প্রশ্নটা বাজেটের আকার নিয়ে নয়, প্রশ্ন তার গতি-প্রকৃতি নিয়ে; শুধু বরাদ্দ নিয়ে নয়, প্রশ্ন তার গুণগত মান নিয়ে।
বাজেটের আয় তৈরি হয় জনগণের অর্থ দিয়ে। ঘাটতি তৈরি হলে সেটা মেটানো হয় দেশি-বিদেশি ঋণ দিয়ে, যা আবার জনগণকেই শোধ করতে হয়। জনগণের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হয় কর ও শুল্ক হিসেবে। বাজেটের প্রধান অংশ রাজস্ব আয় ও ব্যয়। সরকারের রাজস্ব আয় বলতে যা বোঝানো হয়, তাকে আমরা অন্যদিক থেকে বলতে পারি কর শুল্ক ও ফিসহ নানাভাবে সরকারকে দেওয়া জনগণের অর্থ। আর রাজস্ব ব্যয়? সেটি হলো সরকারি প্রশাসন-প্রতিষ্ঠান চালানোর খরচ। বাড়তি অর্থ খরচ হওয়ার কথা উন্নয়নের জন্য। ঘাটতি হলে নিতে হয় ঋণ।
বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে যে কর–শুল্ক দেন, তা গত ছয় বছরে তিন গুণের বেশি বেড়েছে। তবে জনগণের ওপর বোঝা শুধু কর আর শুল্ক দিয়েই শেষ হয় না; বাড়তি কর–শুল্কের চেয়েও গত কয়েক বছরে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয়কে বাড়িয়েছে অনেক বেশি। শিল্প, কৃষিসহ সব উৎপাদনশীল খাতে উৎপাদন ও পরিবহন ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। জনগণের কাছ থেকে কর শুল্ক সারচার্জ বা বর্ধিত দাম আদায়ের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা দেখা যায় না। সরকার জনগণের কাছ থেকে যা চেয়েছে, তা দিতে তারা কখনো আপত্তি করেনি। কিন্তু জনগণের পাওনা পরিশোধ করেনি কোনো সরকারই। ‘কর-জিডিপি’ অনুপাত নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা সব সময় কথা বলেন। কিন্তু কথা আরও জোরে বলা দরকার ‘কর-পরিষেবা (সার্ভিস)’ অনুপাত নিয়ে। জনগণ কর শুল্কসহ সরকারকে অর্থসম্পদ জোগান দেন তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য, সুস্থ নিরাপদ জীবন ও জীবিকার জন্য, সর্বজনের সম্পদ রক্ষার জন্য, সর্বজনের শিক্ষা-চিকিৎসা সম্প্রসারণের জন্য। এসব ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা সীমাহীন; বরং উল্টো ভূমিকাই দেখা যায় বারবার।
তাহলে এই অর্থ কোথায় ব্যয় হয়? সরকারি, আধা সরকারি প্রতিটি গাড়ি, প্রতিটি ভবন, এসি, সভা, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া, বিলাস, অপচয়, জীবনযাপন, বিদেশ সফর, কেনাকাটা—সবকিছুই আসলে জনগণের দেওয়া অর্থেই পরিচালিত হয়। জনগণ হয়তো খেয়াল করেন না যে তাঁদের ঘরের ওপর বুলডোজার, তাঁদের মাথায় পুলিশ বা র্যাবের লাঠি-গুলি, তাঁদের সামনে মন্ত্রী-এমপি-আমলার চোটপাট কিংবা শানশওকত, নতুন নতুন ভবন, দামি গাড়ি, উৎসব-উল্লাস সবই তাঁদের অর্থ দিয়েই পরিচালিত হয়। সরকার প্রতিশ্রুতি আর বরাদ্দের অঙ্ক দিয়ে সবাইকে কৃতার্থ করে। অথচ ওই টাকা তো সরকারের কারও ব্যক্তিগত নয়, তা মানুষেরই।
যাদের হাতে দেশের আয় ও সম্পদের বৃত্তাংশ তারা প্রধানত করজালের বাইরে। সরকারের সমীক্ষা ও অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যেই বলা হয়েছে বাংলাদেশের বিশাল অংশের অর্থ সরকারের হিসাবে নেই। বিভিন্ন সমীক্ষা অনুযায়ী, টাকার অঙ্কে এটি ৪ লাখ থেকে ১০ লাখ কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। অর্থশাস্ত্রে বা সাধারণ পরিচয়ে এর নাম ‘কালোটাকা’, নরম ভাষায় বলা হয় ‘অপ্রদর্শিত আয়’। এর মধ্যে একটি ক্ষুদ্র অংশ হতে পারে পরিশ্রমলব্ধ বৈধ আয়, বিভিন্ন কারণে কর না দেওয়ায় তা এখন ‘অপ্রদর্শিত’ তালিকাভুক্ত। তবে এটা নিশ্চিত বলা যায় যে এই টাকার বড় অংশের যথার্থ নাম হবে ‘চোরাই টাকা’, যা চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, ক্ষমতা প্রয়োগ, জালিয়াতি, দখল ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে অর্জিত। এগুলোর মধ্যে আছে ঘুষ, নিয়োগ-বাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় বা সর্বজন সম্পদ আত্মসাৎ, চাঁদাবাজি, কাজ না
করে উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ ভাগাভাগি, বাণিজ্যে ওভার-আন্ডার ইনভয়েসিং, মাদক-বাণিজ্য, শ্রমিক-নারী-শিশু পাচার ইত্যাদি। সবাই জানেন, এসব কাজ ক্ষমতাবানদের পক্ষেই করা সম্ভব, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া এগুলো টিকতে পারে না। তাই সব সরকারের আমলেই ‘কালোটাকা’ সাদা করা নিয়ে ঢাকঢোল বাজে, কিন্তু এর উৎস বন্ধ করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের হিসাবে দেখা না গেলেও এই অর্থ যেভাবে উপার্জিত হয়, তাতে সন্ত্রাস, দখলদারত্ব আর সন্ত্রাসী বাহিনীর পুনরুৎপাদনই স্বাভাবিক। দেশে অপরাধ, সহিংসতা, যৌন–সন্ত্রাস ইত্যাদির বিস্তৃতি এমনি এমনি ঘটেনি। এই বিশাল সম্পদ ও অর্থ করদানের আওতার বাইরে এবং তা অব্যাহতভাবে ক্রমবর্ধমান। গত কয়েক দশকে যে উন্নয়ন গতিধারা সরকারনির্বিশেষে পুষ্ট হচ্ছে, এটা তারই ফল। অর্থমন্ত্রী গর্বের সঙ্গে যখন ‘এই উন্নয়ন গতিধারা অব্যাহত’ রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, তখন তাই আমরা আতঙ্কিত হই। বুঝি সামনের বছর বাজেট বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে, প্রকল্প-অপ্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে দিয়ে চোরাই টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে। রাজস্ব আয়ের এই সম্ভাব্য বিশাল উৎস শুধু যে সরকারি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে তা নয়, উল্টো এই অর্থ বিভিন্নভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে পাচার হয়। এভাবে দেশি ও প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তৈরি করা বিদেশি মুদ্রার মজুতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ খোরাক হয় চোরাই টাকার মালিকদের।
প্রতিবছর বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে আসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, অনেক প্রকল্পের সমাবেশ। এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে এবারও প্রশ্ন উঠেছে। বাজেট বাস্তবায়ন বলতে যে আলোচনা করা হয়, তাতে বরাদ্দকৃত টাকা খরচই সাধারণত বোঝানো হয়। কিন্তু খরচ করা আর প্রকল্প সম্পন্ন হওয়া এক কথা নয়। প্রতিবছরেই জুন মাসের মধ্যে বরাদ্দ টাকার শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ খরচ হয়, যদিও এপ্রিল মাস নাগাদ খরচ হয় শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ। বহু বছরের বাজেটের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, খরচ পুরো হলেও খুব কম প্রকল্পই পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়। এর ফলে পরবর্তী বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পূর্ণ হয় পূর্ববতী বছরের অসমাপ্ত প্রকল্প দিয়ে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অথচ প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থবরাদ্দ নিয়ে নানাবিধ নীতি, নিয়ম, প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। ‘নজরদারি’র নানা শাখা-প্রশাখা তৈরি হয়েছে, ‘ক্রয়-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ’ জারি হয়েছে, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য দেশে-বিদেশে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। ‘ক্যাপাসিটি বিল্ডিং’, ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স’ নামে বিদেশি ঋণ অনুদান, সেমিনার-ওয়ার্কশপ, বিদেশি কনসালট্যান্ট আনা, গাড়ি কেনা, বিদেশ সফর—সবই হয়েছে। যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর প্রাপ্তি মেটানো হয়, কিন্তু প্রকল্প অসমাপ্ত থাকে। সেতু অসমাপ্ত, রাস্তার খবর নেই, বাঁধ একটু হয়ে পড়ে আছে, ক্ষতিকর বাঁধে জলাবদ্ধতা স্থায়ী, হাসপাতালের ভবন একটু খাড়া কিন্তু যন্ত্রপাতি নেই, বিদ্যালয়ে কম্পিউটার আছে, শিক্ষক নেই, ঘর নেই, গ্যাসের লাইন শুরু, কিন্তু শেষ নেই, গবেষণার ভবন আছে, গবেষণার বরাদ্দ নেই ইত্যাদি।
কয়েক বছর ধরে সরকারের বিশাল অর্থের প্রকল্প নেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকল্প শুরুর আগেই ব্যয় আরও বাড়তে থাকে। কেন বাড়ে তার পরিষ্কার চিত্রও পাওয়া যায় না। বড় বড় প্রকল্পের অর্থের বরাদ্দ বেশি, অস্বচ্ছতাও বেশি। আর লাভ-ক্ষতি হিসাবের চেয়ে বৃহৎ প্রকল্প নেওয়ার উৎসাহী লোকজনই এখন বেশি। জনগণের অর্থ খরচ করে উন্নয়নের নামে দেশ ও মানুষের দীর্ঘ মেয়াদে সর্বনাশ করার প্রকল্পও তাই নির্দ্বিধায় পাস করা হয়। সুন্দরবনধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্প তার একটি।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানামুখী চিৎকার এবারও চলছে। কিন্তু এ চিৎকারে এই সত্য আড়াল হয় যে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হিসাব দিয়ে সব সময় জনগণের জীবনের গুণগত মান পরিমাপ করা যায় না। প্রবৃদ্ধিই শেষ কথা নয়, কী কাজ করে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি, কৃষিজমি নষ্ট করে ইটখোলা বা চিংড়িঘের, জলাভূমি ভরাট করে বহুতল ভবন, নদী দখল করে বাণিজ্য, পাহাড় উজাড় করে ফার্নিচার, শিক্ষা ও চিকিৎসাকে ক্রমান্বয়ে আরও বেশি বেশি বাণিজ্যিকীকরণ, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, সুন্দরবন ধ্বংসকারী বাণিজ্য—এর সবই জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়াতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এগুলো জনগণের জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে। এগুলো আবার চোরাই টাকার আয়তনও বাড়ায়। দখলদারি অর্থনীতি, আতঙ্কের সমাজ, আর সন্ত্রাসের রাজনীতি—সবই পুষ্ট হয় উন্নয়নের এই ধারায়।
বাংলাদেশের জিডিপি, টাকার অঙ্কে সরল হিসাবে, গত ৪৩ বছরে বেড়েছে ২০০ গুণেরও বেশি। এই জিডিপিতে বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর অবদান ও তার প্রাপ্তির তুলনামূলক চিত্র আমরা সরকারের দলিলপত্র থেকে পাই না। কিন্তু বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত মিলিয়ে বিশ্লেষণ করলে চিত্র ঠিকই ধরা যায়। দেশের কৃষি, শিল্প ও অশিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয় হিসাব করে দেখা যায়, জিডিপিতে তাঁদের সম্মিলিত অংশীদারত্ব কমেছে। মানে তাঁদের শ্রমে দেশ চললেও তাঁদের আপেক্ষিক অবস্থান দুর্বলতর হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যাঁদের শ্রমে দাঁড়িয়ে আছে, তাঁরা হলেন প্রধানত কৃষক ও কৃষিশ্রমিক, গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কারখানা ও অশিল্পশ্রমিক এবং প্রায় লক্ষাধিক প্রবাসী শ্রমিক। লক্ষ করলে দেখা যাবে, যাঁদের অবদান অর্থনীতিতে বেশি, তাঁরাই রাষ্ট্রের অমনোযোগ ও বৈরিতার শিকার। কৃষকেরা বিশাল উৎপাদন করেও ভারত থেকে গুদাম খালি করা চালের মুখে দামপতনে বিপর্যস্ত। পোশাকশ্রমিকদের প্রায়ই দেখা যায় বকেয়া মজুরির জন্য রাস্তায় নামতে, রানা প্লাজা ধসের ২৫ মাস পরও নিহত-আহত শ্রমিকদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ ও কর্মসংস্থানের নিষ্পত্তি হয়নি। আর প্রবাসী শ্রমিক? হিসাবে দেখা যায়, গত ১০ বছরে প্রায় ২০ হাজার লাশ এসেছে দেশে। আর এখন প্রবাসী শ্রমিক হওয়ার পথে গিয়ে সমুদ্রে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন অনেকে। দাসশ্রমের জাল কাজ করছে, জিডিপি বাড়ছে।
শত লুণ্ঠন, অনিয়ম, সম্পদ পাচার সত্ত্বেও যাঁদের জন্য অর্থনীতি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, যাঁদের মৃত-অর্ধমৃত শরীরের ওপর অর্থনীতির জৌলুশ, সেসব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি বা সংগঠনের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী কখনো প্রাক্-বাজেট সংলাপে বসেন না। কেন তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
(২৫ মে ২০১৪ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)