বাংলাদেশে উর্দু ভাষায় সাহিত্যচর্চা হচ্ছে, গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখা হচ্ছে, এটি আমার বহুদিন জানা ছিল না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উদ্যোগেই নব্বই দশকের প্রথম দিকে যোগাযোগ ও কথাবার্তা হয়। যত দূর মনে পড়ে, কবি আসাদ চৌধুরী ছিলেন যোগাযোগমাধ্যম। তাঁর সঙ্গে উর্দু ভাষার লেখকদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, আশা করি এখনো আছে। আমরা বসেছিলাম ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায়, তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে। উর্দু ভাষার লেখক-কবিদের সবার পুরো নাম সঠিকভাবে মনে পড়ছে না। একজনের নাম মনে আছে, আহমদ ইলিয়াস। তাঁরা নিজেদের লেখালেখির অভিজ্ঞতা বলছিলেন, আলোচনায় এসেছিল ১৯৭১ সালে তাঁদের ভূমিকার প্রসঙ্গও। তাঁরা সবাই নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অনেকে নির্যাতিতও হয়েছেন। বাঙালি মানেই যেমন মুক্তিযোদ্ধা নন, উর্দুভাষী বা বিহারি এমনকি চাকমা মানেই রাজাকার নয়। পাকিস্তানের লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও আমরা এখন অনেকের নাম জানি, যাঁরা পাকিস্তান সামরিক জান্তার গণহত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। বর্তমান সরকার তাঁদের সম্মাননাও দিয়েছে। কাজেই পাকিস্তানের নাগরিক মানেই গণহত্যার সহযোগী নন।
যা-ই হোক, উর্দু ভাষার লেখকদের রচিত গল্প-উপন্যাস-কবিতার কথা শুনেছিলাম সেদিন। জানলাম, বাংলাদেশে এগুলো ছাপার ব্যবস্থা নেই। সুতরাং এগুলো ছাপা হয় মুম্বাই, দিল্লি ও লাহোরে। তবে এসব লেখার বিষয়বস্তু অবশ্যই বাংলাদেশ, তার সমাজ রাজনীতি জীবন আবহাওয়া ফল ফসল। একটা উদাহরণ দিলেন একজন কবি। তাঁর একটি প্রেমের কবিতায় তিনি প্রেমিকার উদ্দেশে যা বলছেন, তার সারকথা হলো, ‘তোমাকে যখন দেখি, তখন আমার হৃদয়ে কালবোশেখির ঝড় বয়ে যায়।’ কবি বললেন, ভারত-পাকিস্তানের উর্দু পাঠকেরা প্রেমের কথা বুঝলেন কিন্তু কালবোশেখির মানে বুঝতে না পেরে চিঠিপত্র পাঠাতে লাগলেন, বহু চিঠি। কালবোশেখি ব্যাপারটা তো একেবারেই বাংলার। বললেন, উর্দু সাহিত্যে বাংলাদেশ এভাবে আগে কখনো আসেনি।
বাংলা ভাষার ওপর উর্দু ভাষা জোর করে চাপানোর পাকিস্তানি নীতির কারণে আমাদের অনেকের মধ্যে এই ভাষার প্রতি প্রচ্ছন্ন বিরাগ তৈরি হয়েছিল ছোটবেলা থেকেই। মাতৃভাষার অধিকার হরণ করার চক্রােন্তর সঙ্গে উর্দু ভাষা এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল যে এই ভাষা আমাদের কাছে শুধুই ভাষা ছিল না, আমাদের জাতিগত অস্বস্তি বিলীন করার অস্ত্র মনে হতো। সে জন্য এই ভাষা শেখা হয়ে ওঠেনি কখনোই। অথচ জানি, উর্দু ভাষায় কত সমৃদ্ধ সাহিত্য তৈরি হয়েছে। নির্মম পরিহাসের বিষয়, উর্দু ভাষা জোর করে চাপানোর জন্য পাকিস্তানিরা এত চক্রান্ত করল, মানুষ হত্যা করল; সেই পাকিস্তানে খুব কমসংখ্যক মানুষেরই মাতৃভাষা উর্দু। ১৯৭১ সালে যে সামরিক বাহিনী এখানে নৃশংসতার ভয়াবহতা তৈরি করেছে, তাদেরও মাতৃভাষা উর্দু ছিল না।
আজ যাদের আমরা ‘বিহারি’ নামে জানি, তারা পাকিস্তান থেকে আসেনি, এসেছে ভারত থেকে, শুধু বিহার থেকে নয়, উত্তর প্রদেশসহ অন্যান্য প্রদেশ থেকেও। ভারত ভাগের সেই রক্তনদীর মধ্যে, সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার কালে তারা এখানে আসে মোহাজির হিসেবে। পাকিস্তান তাদের কখনোই নিজের মধ্যে গ্রহণ করেনি, কিন্তু তাদের অসহায়ত্বকে ব্যবহার করেছে। অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদের লেখা থেকে দেখি, ১৯৬৮ সালেও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির চিকনছড়া থেকে এই মোহাজিরদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। পুরো পাকিস্তান আমলেই তাদের সবার স্থিতি হয়নি। এখনো পাকিস্তানে উর্দুভাষী মোহাজিররা মূলধারা থেকে আলাদা।
বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) মানুষের সহমর্মিতা ও সহযোগিতার কারণে মোহাজিরদের অনেকে বাঙালি সমাজের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছেন। ঈশ্বরদী, রংপুর, সৈয়দপুর, ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুরে তাঁদের অধিক মানুষের আবাস দেখা যায়। রেলওয়ে, কারখানায় এঁদের দক্ষতা-কর্মকুশলতার প্রশংসা অনেক শুনেছি। ষাটের দশকে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনে বাঙালি বিহারি একসঙ্গেই পাকিস্তানিদের শোষণ–নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠন করেছেন। সে জন্যই বৃহৎ পঁুজিপতি ও পাকিস্তানি শাসকদের জন্য বাঙালি বিহারি দাঙ্গা লাগানো ছিল এক ভয়ংকর কূটকৌশল। আদমজীসহ দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে এই দাঙ্গা উসকে দিয়ে শ্রমিক স্বার্থের আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করা হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের লড়াইকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা হয়। বাঙালি বিহারি মুখোমুখি হলে ফায়দা নেয় পাকিস্তানি শাসকেরা। ‘বিহারি’দের মধ্যে বাঙালি ভীতি তৈরি করে সহিংসতার দিকে ঠেলে দেয়, বিদ্বেষ বাড়ে, দূরত্ব বাড়ে। ১৯৭১ সালে এরই ভয়াবহ পর্ব দেখেছি আমরা।
স্বাধীনতার পর, এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন—তাঁরা, সেই সঙ্গে সচ্ছল পরিবারের অনেকে ঝুঁকি বুঝে পাকিস্তানে চলে যেতে সক্ষম হন। প্রধানত রয়ে যায় তুলনামূলকভাবে দরিদ্ররা। আর মধ্যবিত্তদের মধ্যেও কেউ কেউ, যাঁরা এ দেশকেই নিজের দেশ মনে করেন, তাঁরা থেকে যান অনিশ্চয়তা নিয়েই। ‘বিহাির’দের অবস্থা তখন এখানে স্বচ্ছন্দ বা নিরাপদ ছিল না। যারা পাকিস্তানে
( জুন ২১, ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)