চলমান গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে কোন এলাকায় কত সময় লোডশেডিং দেওয়া হবে, তার একটি রুটিনের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লোডশেডিংয়ের বিষয়ে সবার সহযোগিতাও চেয়েছেন তিনি। তাই আপাতত লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই। এসি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আনা, সারা দেশে আলোকসজ্জা বন্ধ করাসহ সমস্যা সমাধানে নানা কথা বলা হচ্ছে। এখন দেশজুড়ে যে লোডশেডিং চলছে, তা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটসহ জ্বালানি খাতের নানা বিষয়ে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ–বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সাবেক সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মহিউদ্দিন।
প্রথম আলো: সংকটের মধ্যে পড়েছে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। এটা কি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, নাকি এ খাতের ভুল পরিকল্পনাও দায়ী? আপনারা তো বিভিন্ন সময় সতর্ক করে আসছিলেন।
আনু মুহাম্মদ: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে দেশের জ্বালানিসংকটের আসলে তেমন সম্পর্ক নেই, এটাকে স্রেফ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ এখন এটা করছে, বাংলাদেশ একটু বেশি করে করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ না থাকলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের এই সংকট সামনে আসতই। যুদ্ধ শুধু এটাকে ত্বরান্বিত করেছে। যুদ্ধ না বাধলে হয়তো কিছুদিন পরে হতো এবং সামনে এ সংকট আরও ভয়াবহ হবে।
প্রথম আলো: এ সংকটের পেছনে আপনি কী কী কারণ দেখছেন?
আনু মুহাম্মদ: এ সংকটের মূলে হচ্ছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের মহাপরিকল্পনা। এর বাইরে সরকারের সব নীতিমালা, কর্মসূচিও একই রকম। এ মহাপরিকল্পনা করেছেন বিদেশিরা এবং এর পুরোটাই ঋণনির্ভর ও আমদানিনির্ভর। এক দিকে বিদেশি ঋণ ও বিদেশি কোম্পানি, আরেক দিকে কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ। পাশাপাশি গ্যাসের কথা যা বলা হয়েছে, তা হলো তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি); এটাও আমদানি করতে হবে। কয়লা ও পারমাণবিক দুটোই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের। সব কটির সঙ্গেই বিদেশি কোম্পানি এবং দেশীয় কিছু সহযোগী আছে। তার মানে দেশি–বিদেশি কিছু করপোরেট গ্রুপের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে মহাপরিকল্পনায়। দেশের বিদ্যুৎ–সংকটের প্রকৃত সমাধানের বিষয়টি কখনোই এতে ছিল না। এতে করে উৎপাদনের সক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় গুরুত্ব পায়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি নিয়ে ভাবা হয়নি। সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়ন হয়নি। তাই লোডশেডিং সব সময়ই হতো; কম বা বেশি।
প্রথম আলো: আপনারা তো বিকল্প মহাপরিকল্পনা প্রস্তাব করেছিলেন ২০১৭ সালে। এ ছাড়া অনেক দিন ধরেই জাতীয় সক্ষমতা ব্যবহারের কথা বলছেন…
আনু মুহাম্মদ: কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ করে বাংলাদেশ ভয়বাহতার দিকে যাচ্ছে। তেল, গ্যাস কমিটির পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে একটি বিকল্প মহাপরিকল্পনা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ২০ বছর ধরেই জাতীয় সক্ষমতা ও সার্বভৌম জ্বালানিতে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আমাদের মহাপরিকল্পনায়ও জাতীয় সক্ষমতার ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছিল। দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন বাড়িয়ে তা ব্যবহার করা আর জাতীয় সক্ষমতা ব্যবহার করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো—এ দুটো করেই সুলভে বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব। বিদেশ ও ঋণনির্ভরতা থাকত না।
প্রথম আলো: আপনাদের প্রস্তাব কি সরকার আমলে নিয়েছে?
আনু মুহাম্মদ: সরকার আমাদের দেখানো পথে যায়নি। সমুদ্র ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে সরকার কখনোই জোর দেয়নি। একসময় যারা গ্যাস রপ্তানির কথা বলেছে, তারাই আবার গ্যাস নেই বলে আমদানির দিকে নিয়ে গেল। কয়লা ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কথা বলতে লাগল। সরকার ওই ধারাতেই অগ্রসর হয়েছে। এতে লাভবান হয়েছে দেশের কিছু গোষ্ঠী এবং চীন, ভারত, রাশিয়া। এতে আর্থিক বোঝা ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের মতো দুটো জিনিসই নিশ্চিত হচ্ছিল। এ দুটোর বিষয়ে সরকারকে নানাভাবে সতর্ক করা হয়েছে, তারা শোনেনি। সরকার বুঝেশুনেই বিপজ্জনক পথ বেছে নিয়েছে।
প্রথম আলো: সরকারের নতুন মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি গুরুত্ব পাচ্ছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?
আনু মুহাম্মদ: নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর কথা ২০১৬ সালের মহাপরিকল্পনায়ও বলা হয়েছিল। ওইটা তেমন কাজের কিছু হয়নি। এবারও বলছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সনদে সই, প্যারিস চুক্তি মিলে একটা চাপ আছে। এ কারণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির কথা বলছে সরকার। তবে বাস্তবে এটা কার্যকর করায় তেমন মনোযোগ নেই। তাদের প্রধান মনোযোগ কয়লা ও পারমাণবিকে। এ থেকে সরকার সরেনি।
বাংলাদেশে মূলত সিদ্ধান্ত হয় লবিস্টদের শক্তিমত্তার ওপর নির্ভর করে। কয়লা, পারমাণবিক ও এলএনজির লবি এখন সরকারের জ্বালানিনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এখানে জাতীয় স্বার্থ বা টেকসই উন্নয়নের ধারণা সরকারকে প্রভাবিত করতে পারছে না। তারা প্রভাবিত হচ্ছে লবিস্টদের মাধ্যমে। এখানেই সমস্যা হচ্ছে।
প্রথম আলো: বর্তমান সংকট ঘিরে কোন ধরনের তৎপরতা হতে পারে? কী করণীয় আছে?
আনু মুহাম্মদ: যেকোনো সংকটে দুটো সম্ভাবনা তৈরি হয়। একটা হলো, জনস্বার্থ রক্ষা করে দীর্ঘমেয়াদে সমাধানের পথ তৈরি করা যায়। এবারের সংকট যেমন পরিষ্কার বোঝাচ্ছে, গ্যাসের মতো জাতীয় সম্পদের উৎপাদন বাড়ানো ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যেতে হবে। আর দ্বিতীয় হলো, আর্থিক বোঝা বাড়ানো বিদেশি ঋণের দিকে যাওয়া যাবে না। শ্রীলঙ্কা হোক বা বৈশ্বিক সংকট হোক, সবকাছু থেকেই এটা বোঝা যাচ্ছে।
প্রথম আলো: দেশীয় কয়লা উত্তোলনের বিষয়টিও সামনে আসছে, এটাকে কীভাবে দেখছেন?
আনু মুহাম্মদ: কয়লাবিদ্যুৎ আর্থিকভাবেও এখন সবচেয়ে ব্যয়বহুল। পরিবেশগত ঝুঁকি এড়ানোর প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সামাজিক ব্যয় হিসাব করলে এটা সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এসব বিপজ্জনক পথে না গিয়ে নিরাপদ পথে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হয় সংকটের সময়। গ্যাস অনুসন্ধান ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর দিকে যেতে পারে বাংলাদেশ।
সংকটের মধ্যে আরেকটা সম্ভাবনাও থাকে, সুবিধাভোগীরা সংকটের সুযোগ নিতে চায়। সংকটে পড়েও কয়লা, এলএনজি, পারমাণবিকের মতো ভুল সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা নিয়ে তা শোধরানোর চেষ্টা হচ্ছে না। বরং আরও বড় বিপর্যয়ে দেশকে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে সংকটকে ব্যবহার করে। কয়লাবিদ্যুৎ বন্ধ না করে দেশীয় কয়লা তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এটা আরও ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে। ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প ও এশিয়া এনার্জিকে নিয়ে যেসব গ্রুপ তৎপর ছিল, তারা সংকটের সুযোগ নিয়ে আবার নড়াচড়া শুরু করেছে।
প্রথম আলো: সংকট সমাধানে সরকার কী করতে পারে?
আনু মুহাম্মদ: আমদানিভিত্তিক, ঋণভিত্তিক তৎপরতা থেকে সরে এসে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা ও জ্বালানি–সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও নবায়যোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। কয়লা উত্তোলন তো দূরে থাক, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও সরে আসতে হবে। এলএনজি থেকেও সরে আসতে হবে। এর মধ্য দিয়ে আর্থিক বোঝার চাপ থেকে মুক্তি মিলবে। বিদেশি ঋণের দিকে যেতে হবে না। এর মধ্য দিয়ে নিরবিচ্ছিন্ন ও নিরাপদ বিদ্যুৎ–সরবরাহ সম্ভব হবে এবং এতে দামও ক্রমেই কমে আসবে।
[১১ জুলাই ২০২২ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত]