চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলীয় এলাকা গন্ডামারা বড়ঘোনায় ৭ হাজারেরও বেশি বসতবাড়ি, কৃষিজমি, লবণ চাষের জমি ও চিংড়ি ঘের সমৃদ্ধ অঞ্চলে সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমতি দিয়েছে সরকার ঘনিষ্ঠ দেশের দ্রুত বিকাশমান ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপকে। এর সাথে যুক্ত আছে চীনা কোম্পানি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে এস আলম গ্রুপ সেপকো ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন নামে একটি চীনা কোম্পানির সাথে এই কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকার এস আলম গ্রুপের দুটো সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে ১২২৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতি কিলোওয়াট ৬.৬১ টাকা দরে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর জন্য ৬০০ একর জমি দেখানো হয়। বিনিয়োগের শতকরা ৭৫ ভাগ চীনা কোম্পানি বহন করবে বলে জানানো হয়।
এসব চুক্তি সম্পাদিত হলেও কোন পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষার কথা শোনা যায়নি।পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা ছাড়া এরকম কোনো প্রকল্প কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, এই সমীক্ষা থেকেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব কোনো প্রকল্প আসলে কতটা ক্ষতি করবে, আর কতটা লাভজনক হবে, আদৌ তা গ্রহণযোগ্য কিনা। বস্তুত, প্রথম থেকেই অনিয়ম, অস্বচ্ছতা, জোরজবরদস্তি, ত্রাস দিয়ে এই প্রকল্পের যাত্রা শুরু। ৭ হাজারের বেশি বসতবাড়ি ছাড়াও এলাকায় আছে ৭০টি মসজিদ, মক্তব, কবরস্থান, শ্মশান, ১টি কারিগরী শিক্ষা বোর্ড, ২০টি ছোটবড় আশ্রয় কেন্দ্র, ১টি উচ্চবিদ্যালয়, ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি আলিয়া মাদ্রাসা, ৫টি কওমী মাদ্রাসা, ৫টি বাজার, ১টি সরকারি হাসপাতাল। এগুলি থাকার পরও স্থানীয় প্রশাসন মাত্র ১৫০টি বসতবাড়ি দেখিয়ে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্যগন্ডামারা বড়ঘোনায় ভূমি এস আলম গ্রুপের কাছে হস্তান্তর করতে প্রতিবেদন প্রেরণ করে। জমি ক্রয় নিয়েও নানা অনিয়ম, ভয়ভীতির অভিযোগ অনেকদিনের। অনেকেই জমির যথাযথ দাম পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
তাই প্রকল্পের স্থান নির্বাচন, জমি ক্রয় ও অধিগ্রহণসহ নানা অনিয়ম ও প্রতারণার বিরুদ্ধে এলাকার মানুষ প্রতিবাদ করে আসছিলেন গত বেশ কিছুদিন ধরে। সন্ত্রাসী ও দালালদের দাপটে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন মানুষ। এর আগেও হামলা হুমকির ঘটনা ঘটেছে। এলাকার মানুষ ঘনজনবসতিপূর্ণ এলাকা বাদ দিয়ে স্থান নির্বাচন, দালালদের বাদ দিয়ে জমির দাম সুষ্ঠুভাবে পরিশোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামতও দিয়েছিলেন। গত ২৩ মার্চ এএসপি, ইউএনও এবং ওসির উপস্থিতিতে গন্ডামারা ইউনিয়নের বাজারে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সেই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা বাঁশখালীর জনবহুল এলাকা বাদ দিয়ে বিদ্যুৎ প্রকল্প করবার দাবি জানান। কিন্তু গত ২ এপ্রিল এস আলম গ্রুপের লোকজন আবারো এলাকায় গিয়ে হাজির হলে গ্রামবাসী তাদের বাধা দেন। এর সূত্র ধরে মামলা হয়, ৩ এপ্রিল ৭জন এলাকাবাসীকে গ্রেফতার করা হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৪ এপ্রিল এর প্রতিবাদে ‘বসত-ভিটা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে সমাবেশ আহবান করা হয়। সমাবেশ বানচাল করবার জন্য পাল্টা সমাবেশ ডাকে কোম্পানি পক্ষের লোকজন। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। বিক্ষুব্ধ জনগণ সমাবেশ করতে গেলে প্রথমে পুলিশ পরে ৩০/৪০টি মোটরসাইকেলে সন্ত্রাসীরা এসে নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। এতে অনেকে গুলিবিদ্ধ হন, আহতদের হাসপাতালে নিতেও বাধা দেয়া হয়। এইদিনই একজন নারীসহ কমপক্ষে ৫জন নিহত হয়েছেন। আশংকা, এই সংখ্যা আরও বাড়বে। স্থানীয় লোকজনের মতে, এই সংখ্যা ৯ জন পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এই হত্যাকান্ডের দায় সরকার ও এস আলম গ্রুপের।
প্রশ্ন হলো, ‘উন্নয়ন’ যদি সত্যিকারের উন্নয়নই হয় তাহলে পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা না করে জবরদস্তি কেনো? তা নিয়ে মানুষের কথা শুনতে অসুবিধা কী? মানুষের প্রতিবাদে সরকারের ভয় কোথায়? খবর প্রকাশে এতো বাধা কেনো? খোলাখুলি কথা বলতে অসুবিধা কী? না, কেউ কথা বলতে পারবে না, কোনো সভা সমাবেশ করা চলবে না। সন্ত্রাসী আর পুলিশসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী লাগানো হবে জনগণের বিরুদ্ধে। এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে তথাকথিত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে। কারণ সরকার ঠিকই জানে এগুলো উন্নয়নের মুখোশ পরানো ধ্বংস, দখল আর লুন্ঠনের প্রকল্প। একই চেহারা আমরা দেখেছি ফুলবাড়ীতে; এখন দেখছি রামপাল, রূপপুর, মাতারবাড়ীতেও।
পাশাপাশি নানাকিছু দিয়ে বা ধমক দিয়ে মিডিয়া থেকে গায়েব করা হয় জনগণের প্রতিবাদ, যুক্তি, তথ্য। বাঁশখালীতে বেশ কিছুদিন ধরে প্রতিবাদ চললেও এতোদিন তাই কোনো খবরই আসেনি সংবাদপত্রে, টিভিতে। বস্তুত জোরজবরদস্তি, প্রতারণা, ভয়ভীতি, দুর্নীতির ওপর ভর করে ‘উন্নয়ন’ নামের দখল, লুন্ঠন ও ধ্বংসের তৎপরতা চললে তা নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হবেই। যথাযথ স্বচ্ছতা, জনসম্মতি এবং জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত না হলে জনগণ কোনো প্রকল্পই গ্রহণ করবে না।ভয়ভীতি কতোদিন মানুষকে চুপ করিয়ে রাখতে পারবে?
[লেখাটি ৫ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে আমাদের বুধবারে প্রকাশিত]