বাঁধ, দখল ও ‘উন্নয়ন’ নদী খুনের তিন ধারা

1463325390আজ ১৬ মে ফারাক্কা দিবস। ৪০ বছর আগে এই দিনে মওলানা ভাসানী ‘মরণ বাঁধ ফারাক্কা’-র বিরুদ্ধে এক বিশাল জনযাত্রা কর্মসূচি নিয়েছিলেন। ফারাক্কার অভিমুখে ডাকা লংমার্চে অসংখ্য মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে ভারতের যে নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন যাত্রা শুরু তা গত ৪০ বছরে এমনস্থানে পৌঁছেছে যে, বাংলাদেশের বৃহত্ নদী পদ্মা ও সম্পর্কিত অসংখ্য ছোট নদী খালবিলও এখন বিপর্যস্ত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর বড় অংশ এখন শুকিয়ে গেছে। ভারসাম্যহীন পানি প্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত উত্তরবঙ্গের বিশাল অঞ্চলের কৃষি। সেচের জন্য চাপ বাড়ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর, যা দীর্ঘমেয়াদে আরও জটিল পরিস্থিতি তৈরি করছে।

শুধু তাই নয়, পদ্মা নদীর এই ক্ষয় তার সাথে সংযুক্ত নদীগুলোকেও দুর্বল করেছে। এই প্রভাব গিয়ে পড়ছে সুন্দরবন পর্যন্ত। সুন্দরবনের কাছে নদীর প্রবাহ দুর্বল হয়ে যাওয়ায় লবণাক্ততা বেড়েছে আর তাতে ক্রমাগত ক্ষয়ের শিকার হচ্ছে পানিনির্ভর বনের জীবন। অন্যদিকে ফারাক্কার বিষক্রিয়া পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশেপাশেও পড়ছে। একদিকে পানিশূন্যতা অন্যদিকে অসময়ের বন্যা এবং অতিরিক্ত পলি। সম্প্রতি বিহারের মানুষ শাবল নিয়ে মিছিল করেছেন ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেবার দাবিতে।

কিন্তু এসব অভিজ্ঞতা ভারতের বাঁধকেন্দ্রিক উন্নয়ন চিন্তা ও বাঁধব্যবসায়ীদের থামাতে পারেনি। তাছাড়া ভারতের শাসকদের চিন্তা পদ্ধতিতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকার বিষয় একেবারেই অনুপস্থিত। মণিপুরে টিপাইমুখ বাঁধের প্রস্তুতি পুরোটাই চলেছে একতরফাভাবে। এখনো এর হুমকি চলে যায়নি। এই বাঁধ বাংলাদেশের আরেক বৃহত্ নদী মেঘনার জন্য যে বড় হুমকি হবে তা বাংলাদেশ ও ভারতের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন। শুধু সরকারের গলাতেই আমরা পেয়েছি এই বাঁধের প্রতি সমর্থনের সুর।

ম্যাপ দেখলে দেখা যায়, ভারত থেকে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীগুলোর উপর বিভিন্ন স্থানে কাঁটার মতো সব বাঁধ। তিস্তা নদীর ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ভাটির দেশকে না জানিয়ে গজলডোবা বাঁধ দিয়ে যেভাবে একতরফা পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে তা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের লংঘন। গ্রীষ্মে তাই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বিশাল অঞ্চল পানির অভাবে খাঁ খাঁ করছে। তিস্তা নদীর প্রবাহ এখন শতকরা ১০ ভাগে নেমে এসেছে। ফারাক্কা ও গজলডোবা ছাড়াও মনু নদীতে নলকাথা বাঁধ, যশোরে কোদলা নদীর উপর বাঁধ, খোয়াই নদীর উপর চাকমা ঘাট বাঁধ, বাংলাবন্ধে মহানন্দা নদীর উপর বাঁধ, গোমতি নদীর উপর মহারানি বাঁধ এবং মুহুরি নদীর উপর কলসী বাঁধসহ আরও ১৫/২০টি অস্থায়ী কাঁচা বাঁধ কার্যকর রয়েছে।

এখানেই শেষ নয়। ভারত পৃথিবীর বৃহত্তম নদীসংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার পানি ১৪টি নতুন খননকৃত খালের মাধ্যমে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রবাহিত করা হবে। এটি কার্যকর হলে অন্যান্য নদীর সাথে বাংলাদেশের আরেকটি বৃহত্ নদী যমুনা আক্রান্ত হবে। শুকিয়ে যাবে অধিকাংশ নদী, উপ-নদী। 

ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন নদী ৫৪টি। এগুলোর সাথে সম্পর্কিত ছোট নদী, শাখা নদীর সংখ্যা বাংলাদেশে আগে ছিল সহস্রাধিক। এখনও ২ শতাধিক নদী কোনোভাবে বেঁচে আছে। কংক্রিটকেন্দ্রিক তথাকথিত ‘উন্নয়নের’ বড় শিকার বাংলাদেশ ও ভারত দুইদেশেরই নদীমালা। বাংলাদেশ অংশে নদীর বিপন্নতা ঘটেছে তুলনায় অনেক বেশি। একতরফা আক্রমণে বাংলাদেশের অসংখ্য ছোট নদী এখন একেকটি মৃতদেহ, কিংবা মুমূর্ষু। বাংলাদেশের বৃহত্ চার নদী পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তাও এখন বিপর্যস্ত এবং আরো আক্রমণের মুখে।

ভারত যেভাবে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ নদীগুলোর জীবন সংশয় ঘটাচ্ছে তা শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতের জনগণের এবং সর্বোপরি সমগ্র মানবসমাজের বড় ক্ষতি। বাংলাদেশ যারা চালান তারা জনগণের স্বার্থ কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন নীতি সাজালে এই নদী ও খালবিলগুলোর জীবনও সচল করতেন, এবং ভারতের এসব আগ্রাসী তত্পরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভূমিকা গ্রহণ করতেন। আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশন অবলম্বন করে সরব হতেন। না, সেসব ভূমিকা নেই। উল্টো তারা নদ নদী, সুন্দরবন সবই ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। ভারতের পণ্য-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য তিতাস নদীর উপর আড়াআড়ি বাঁধ দেবার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে। 

দ্বিতীয়ত: এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দেশের ভেতরের তত্পরতা। বাংলাদেশের নদনদী খাল অর্থাত্ সামগ্রিকভাবে পানি প্রবাহের উপর ৫০ দশক থেকে ধারাবাহিক আক্রমণ এসেছে ‘উন্নয়ন’ নামক বিভিন্ন প্রকল্পের সুবাদে। এই প্রকল্পগুলো করা হয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ সুবিধা সম্প্রসারণে বাঁধসহ নির্মাণমুখী কর্মসূচি হিসেবে। দেখা গেছে, এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলেও একপর্যায়ে গিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হয়নি, সেচসুবিধা কাজ করেনি এবং সর্বোপরি মূল লক্ষ্য খাদ্য উত্পাদনেও ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এখানে শুধু একটি দৃষ্টান্ত দেই, যার ফলে বড়াল নামে একটি নদী এখন মৃতপ্রায়।

বড়াল নদী বাংলাদেশের দুই প্রধান নদী পদ্মা এবং যমুনার সংযোগ নদী।  দৈর্ঘ্যে প্রায় ২০৪ কিলোমিটার, ১২০ মিটার প্রস্থ, এর অববাহিকা ৭৭২ বর্গকিলোমিটার। এর সাথেই চলনবিল। ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত এই নদীর মুখে স্লুইস গেট, ক্রসড্যাম, বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। অন্য প্রকল্পগুলোর মতো এটিও সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্য উত্পাদন বৃদ্ধি, পানি প্রবাহ বৃদ্ধি, নৌপথ সম্পসারণ লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রথম তিনবছর উত্পাদন ভালই দেখা যায়। এরপরে শুরু হয় বিপর্যয়। ফারাক্কার কারণে এমনিতেই পদ্মা নদীর প্রবাহ কম ছিল, উপরন্তু বড়াল নদীর মুখে স্লুইস গেট বসানোতে পদ্মা থেকে আসা পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সে াত কমে যায়, বহু জায়গায় জলাবদ্ধতা দেখা যায়। যমুনায় যেখানে গিয়ে বড়াল গিয়ে মেশে সেখানে পানিপ্রবাহ খুবই নিম্নস্তরে নেমে যাওয়ায় যমুনা নদীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ভাঙ্গন বিস্তৃত হয়। অববাহিকার প্রায় এক কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা এখন হুমকির মুখে। বড়াল শুকিয়ে যে জমি উঠেছে তা এখন নানাজনের দখলে।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন নদীর এই পরিস্থিতি সৃষ্টির সুবিধাভোগীও আছে। এদের প্রধান অংশ সম্পদ ও ক্ষমতায় শক্তিশালী। নদী দুর্বল হয়ে গেলে নদী ক্রমাগত জমিতে রূপান্তরিত হয়। তখন তা দখল করা অনেক লাভজনক। নদী বাঁচলে তার মূল্য/টাকার অংকে পরিমাপ করা যায় না, কিন্তু মরলে তার দাম শত/হাজার কোটি টাকা হয়ে যায়। সেজন্যই যারা এর ভাগীদার তারা নদীবিধ্বংসী উন্নয়ন ধারা বহাল রাখতে অনেকেই আগ্রহী। তাছাড়া এসব বাঁধ বা নির্মাণ কাজ প্রধানত বিদেশি ঋণের টাকায় হয়। ফলাফল যাই হোক, ঋণদাতা, কনসালট্যান্ট, ঠিকাদার, আমলা এবং ভূমিদস্যুদের লাভ অনেক।  

দেশের ভেতরের দখলদারদের জমির ক্ষুধা বাড়ছেই। বাংলাদেশের সীমিত জমি তাদের ক্ষুধা পূরণে সক্ষম নয়। সেজন্য তাদের দখলের আওতায় ক্রমে ক্রমে যাচ্ছে বন, জঙ্গল, পাহাড়, জলাভূমি, উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ, বিল, খাল এমনকি নদী। সারাদেশেই এই ঘটনা ঘটছে। খোদ রাজধানীতে বুড়িগঙ্গা, পাশে তুরাগ, বালু নদীর পাশ দিয়ে যাবার সময় এই দৃশ্য আমাদের সবাইকে  জানিয়ে দেয়, এই দেশে হয় সরকার নাই, থাকলে তার কাজ দখলদারদের সমর্থন দেয়া, জনপ্রতিরোধের মুখে তাকে রক্ষা করা। এছাড়া নদীদূষণের মাধ্যমে তাকে মেরে ফেলার হাজার আয়োজন চলছে সরকারি বা ব্যক্তি গোষ্ঠীর মাধ্যমে।

বিভিন্ন নদীর আজকের এই হাল সৃষ্টিতে যারা সুবিধাভোগী দখলদার, তাদের মধ্যে বিভিন্ন আমলের সংসদসদস্য এবং সহযোগী আমলা ব্যবসায়ী অনেককে পাওয়া যাবে। তাই দেশি দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতা দান যেমন একদিকে সরকারের ভূমিকা, অন্যদিকে নিজের অবস্থান পরিষ্কার না করে, প্রস্তুতি না নিয়ে, বিশেষজ্ঞ মতামত তোয়াক্কা না করে ‘ভারত কোনো ক্ষতি করবে না’ সেটাই বারবার মুখস্থ বলে যাওয়া সরকারের একমাত্র কাজ মনে হচ্ছে। ‘কোনো ক্ষতি হবে না’ এটা যদি বাংলাদেশ সরকারই আগে থেকে বলতে থাকে তাহলে দরকষাকষি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, জনগণের উদ্বেগ বিবেচনার আর জায়গা থাকে কোথায়? এটা শুধু তিস্তা চুক্তির বিষয় নয়, সামগ্রিকভাবে অভিন্ন নদী নিয়ে, বিদ্যুত্ করিডোর নিয়ে, ট্রানজিট নিয়ে। সব বিষয়েই বাংলাদেশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক আইনগত অবস্থান গ্রহণের প্রয়োজন আছে। এরজন্য বাংলাদেশের প্রস্তুতি দরকার, নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা দরকার। বাংলাদেশের যা চাওয়া উচিত তা পরিষ্কার করে কোনো অবস্থাপত্র আছে? নেই। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকারের কোনো প্রস্তুতি আছে? নেই। মন্ত্রণালয়ে কিছু খুঁজে পাওয়া যাবে? না। দেশি বিদেশি দখলদারদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের ফলেই তৈরি হয়েছে এই অক্ষমতা, এই অপ্রস্তুতি, এই মুখস্থ অর্বাচীন কথা।

বাংলাদেশের নদীগুলো যেভাবে খুন হচ্ছে সেগুলোকে তাই তিনভাগে ভাগ করা যায়। কারণ হিসেবে ভাগ করলে এর পেছনে আছে প্রথমত, ভারতের অন্যায় একতরফা আগ্রাসী তত্পরতা। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নদী বিদ্বেষী উন্নয়ন কৌশল। এবং তৃতীয়ত, নদী দখলদারদের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনসহ রাজনৈতিক ক্ষমতার যোগসাজশ। 

নদীর পানি প্রবাহের উপরই বাংলাদেশের জন্ম। নদী বিপন্ন হলে তাই বাংলাদেশের অস্তিত্বও বিপন্ন হয়। নদী হারানোর সর্বনাশ ১/২  বছরে,  ১/২ দশকে বোঝা যায় না। গত কয়েকদশকে বাংলাদেশে জিডিপি যে বহুগুণ বেড়েছে তার হিসেব আমাদের কাছে আছে, কিন্তু একইসময়ে বাংলাদেশের প্রাণ এই নদীমালার কতটা জীবনহানি ও জীবনক্ষয় হয়েছে তার ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যানগত হিসাব আমাদের কাছে নেই।

নদী বিপন্ন হলে মানুষের জীবন কি করে স্বচ্ছন্দ হয়? হয় না বলেই কোটি মানুষ আজ দিশেহারা। বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ এখন ভয়াবহ আশঙ্কায় ঘেরা। যারা নদীর লাশ খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠে তাদের ওপর ভরসা করার উপায় নেই। অথচ এই নদী বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান ও ভবিষ্যতের অস্তিত্বের অবলম্বন। চোখের সামনে খুন হচ্ছে নদী। চোখ বন্ধ করে থাকলেই জীবন বাঁচবে না। এগুলো কেবল নদী নয়, আমাদের সবার, দেশ ও মানুষের প্রাণ। আমাদের ভূমিকাই আমাদের জীবন বা মরণ নির্ধারণ করবে। সর্বজনের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় একমাত্র উপায় তাই উন্নয়ন চিন্তায় নদীর জীবনকে গুরুত্ব দেয়া, রাজনৈতিক এজেন্ডায় নদীরক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা, সর্বোপরি বিভিন্ন স্তরের সজাগ মানুষের সক্রিয় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

[লেখাটি ১৬ মে ২০১৬ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত]