মানুষ ছাড়া বন বাঁচে
বন ছাড়া মানুষ বাঁচে না।
মানুষ ছাড়া নদী বাঁচে
পানি ছাড়া মানুষ বাঁচে না।।
তাই মানুষকে বাঁচাতেই বাংলাদেশের রক্ষাপ্রাচীর সুন্দরবন আর তার নদী বাঁচাতে হবে।
বন বাঁচানোর জন্য সাধারণ ধর্মঘট বা হরতালের পূর্বদৃষ্টান্ত আছে কি না জানি না, তবে এই ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষই তৈরি করছে। করবেই তো, এই দেশ সেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট, যার একটি প্রাণের গান ছিল ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। এখন সেই জাতির গান ‘মোরা একটি বনকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’।
কে অস্বীকার করতে পারে যে লবণ ও মিষ্টি পানির সমন্বিত প্রবাহে, ভূমি ও নদীর সম্মিলিত যোগে সুন্দরবন এক বিশেষ বাস্তুসংস্থান, যা বিশ্বে বিরল এবং সেই কারণে প্রাণবৈচিত্র্যে তার সমাহার অনেক বেশি। পরিবেশদূষণ হ্রাসেও তার ক্ষমতা অনেক। একদিকে তা খুব নাজুক উচ্চ সংবেদনশীলতার কারণে, আবার তা প্রবল শক্তিধর প্রকৃতির দুর্যোগ মোকাবিলায় তার ক্ষমতার কারণে। সে জন্যই বাংলাদেশের সুন্দরবন শুধু এ দেশের নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্যই এক অতুলনীয় সম্পদ। সে কারণেই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এবং বিশ্ব ঐতিহ্য এই সুন্দরবন এক অসাধারণ প্রাকৃতিক সুরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে কাজ করে। সে কারণেই উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবন ও সম্পদ এই সুন্দরবনের অস্তিত্বের ওপর নির্ভরশীল।
আমরা সবাই জানি, বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ অন্যতম বিপদগ্রস্ত দেশ। এই বিপদের মোকাবিলায়ও আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন এই সুন্দরবন। তা ছাড়া ৩৫-৪০ লাখ মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার জন্য সুন্দরবন–সংলগ্ন নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এগুলো বিনষ্ট হলে তাদের উদ্বাস্তু হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। আমাদের হিসাবে প্রতিদিনই ঢাকা শহরে উন্নয়ন-দুর্যোগে বা পরিবেশ উদ্বাস্তু হিসেবে মানুষের ভিড় বাড়ছে। তাদের সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে, যদি সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
শত ব্যাখ্যা, যুক্তি, প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই সুন্দরবনকে হুমকির মধ্যে ফেলে সুন্দরবনের আঙিনায় বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বহু বিশেষজ্ঞ বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন যে এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কয়লা পরিবহন ও কয়লা পোড়ানোতে যে পানি, বায়ু ও মাটিদূষণ হবে, তাতে সুন্দরবনের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে বিপন্ন হবে। পুরো বাংলাদেশ তাতে অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সরকারি ‘উন্নয়ন’ নীতির কারণে সুন্দরবনের ‘ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া’ বলে স্বীকৃত অঞ্চলেও শতাধিক বনগ্রাসী-ভূমিগ্রাসী বাণিজ্যিক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান টেলিটক অবিশ্বাস্য উদ্যোগ নিয়ে সুন্দরবনের ভেতরে আটটি টাওয়ার বসানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বিষাক্ত পণ্যবাহী জাহাজ পরিবহন এখনো অব্যাহত আছে। ১৩ জানুয়ারি সুন্দরবনের কাছে সাগরবক্ষে আবারও একটি এক হাজার টন কয়লাবাহী জাহাজ ডুবে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর আগে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে তেল, কয়লাসহ বিষাক্ত পণ্যবাহী তিনটি জাহাজ পশুর ও শ্যালা নদীতে ডুবেছিল। এর পরিণতিতে দীর্ঘ মেয়াদে সুন্দরবনের বিপর্যয় সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা। এসব জাহাজডুবির পর, প্রতিটি ক্ষেত্রে, সরকারের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এবারের ডুবে যাওয়া কয়লাবাহী জাহাজে কয়লার পরিমাণ ছিল আগেরগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ। সরকারের ভূমিকার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বস্তুত, সুন্দরবনের ঘাড়ে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পক্ষে সাফাই গাওয়া অসম্ভব। বাংলাদেশে সরকার সেই অসম্ভব চেষ্টাই বারবার করছে। একটি ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যদি সুন্দরবনের মতো প্রতিবেশগত দিক থেকে খুবই সংবেদনশীল বনের ‘কোনো ক্ষতি না করে’, তাহলে বলতে হবে যে বিশ্বের কোথাও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কোনোই ক্ষতি করবে না! সেটা বিশ্বের কোনো বুঝদার মানুষই বলবে না। প্রযুক্তিগত উন্নতির পরও এই ক্ষতির বিষয়টি প্রশ্নাতীত বলেই সবচেয়ে অভিজ্ঞ কয়লাবিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ চীন ও ভারত দ্রুত কয়লাবিদ্যুৎ থেকে সরে আসছে। এরপরও এর সপক্ষে কথা বলতে গেলে গোঁয়ার্তুমি আর ভুল তথ্যের বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কোনো পথ নেই। সরকারের এখন অবস্থা তা–ই। তারা একদিকে দাবি করছে, বড়পুকুরিয়ায় কোনো ক্ষতি হয়নি, সেখানে খুব বড় বড় আম হচ্ছে; অন্যদিকে সরকারেরই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সমীক্ষা বলছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বড়পুকুরিয়ায় সব ধরনের ক্ষতিই হয়েছে। আর এই তুলনাও যথার্থ নয়। কেননা বড়পুকুরিয়ায় নদীতে কয়লা পরিবহন, দুর্ঘটনার ঝুঁকি নেই, এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় রামপালের তুলনায় ১০ ভাগের ১ ভাগ এবং সর্বোপরি এখানে সুন্দরবন নেই। অন্য কোথাও সব নিয়মকানুন মেনে এগোলে হয়তো কয়লাবিদ্যুতের ক্ষতি কমানো সম্ভব, কিন্তু সুন্দরবনের জন্য এই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণযোগ্য নয়।
আমরা এসব বিষয়ে অনেক দলিলপত্র বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছি, প্রধানমন্ত্রীর কাছেও এ বিষয়ে খোলা চিঠিতে সরকারি দাবির অসাড়তা খণ্ডন করে বিস্তারিত জানিয়েছি। এসবের কোনো জবাব আমরা পাইনি। উল্টো সরকার থেকে একই ভুল বারবার বলা হচ্ছে। ইউনেসকোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা একই বৈজ্ঞানিক তথ্য-যুক্তি দিয়ে একই ধরনের উপসংহারে আসছে বারবার। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প এবং তার টানে আরও শত শত লোভী আয়োজনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে অনেক আগেই, এখন এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক ঐকমত্যও তৈরি হয়েছে। জলজ্যান্ত সত্য অস্বীকারের সংস্কৃতি, ক্রমাগত ভুল তথ্য উপস্থাপন আর আত্মঘাতী একগুঁয়েমির কারণে সরকার সমস্যা আরও জটিল করছে। যত দিন যাচ্ছে সুন্দরবনের ক্ষতি হচ্ছে, দেশের ক্ষতি হচ্ছে, সরকার ও দেশের ভাবমূর্তিও কলঙ্কিত হচ্ছে।
সবার জানা কথা, আমরা বারবারই বলি যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুই থেকে রকেট—সবই আমরা বানাতে পারব, কিন্তু সুন্দরবন আর বানাতে পারব না। দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর অর্বাচীন ও লোভী তৎপরতায় এই সুন্দরবনের সর্বনাশ তাই আমরা কীভাবে মেনে নিতে পারি? বরং সুন্দরবন যেহেতু সমগ্র বাংলাদেশকে রক্ষা করে, সে জন্য সুন্দরবন রক্ষা করা আমাদের সবার অবশ্যকর্তব্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটা আমাদের দায়। সেই দায় থেকেই সাত বছর ধরে আমরা সুন্দরবনবিনাশী প্রকল্প বাতিল করার জন্য সরকারকে বারবার অনুরোধ করছি। বিদ্যুৎসংকটের সমাধানে বহু বিকল্প প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। এই দাবিতেই গত ২৬ নভেম্বর ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ শেষে ঢাকায় মহাসমাবেশ হয়েছে, ৭ জানুয়ারি আমাদের জানামতে, বিশ্বের অন্তত ১৯টি দেশে সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্ব প্রতিবাদ ও সংহতি দিবসে অংশ নিয়েছেন দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ। গত কয় মাসে বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ২০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনমত জরিপ হয়েছে, এতে অংশ নিয়েছেন ৪১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। ভয়ভীতি ও বাধাবিপত্তির মধ্যেও শতকরা ৯২ জন সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিলের পক্ষে স্পষ্ট রায় দিয়েছেন। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এখনো এই প্রকল্প বাতিল হয়নি। উল্টো সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর নানা তৎপরতা চালানো হচ্ছে।
কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন হরতাল কেন? সাত বছরের মাথায় এসে সরকারের একগুঁয়ে মনোভাবের কারণেই আমরা বাধ্য হয়েছি ২৬ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার রামপাল প্রকল্পসহ সুন্দরবনধ্বংসী সব তৎপরতা বন্ধ করার দাবিতে ঢাকা মহানগরে সকাল ছয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সবার অংশগ্রহণে সাধারণ ধর্মঘট, যা হরতাল নামে পরিচিত তা পালনের সিদ্ধান্ত নিতে। তবে এখানে বড় পার্থক্য আছে প্রচলিত ধরনের হরতালের সঙ্গে। এ–যাবৎকালে বাংলাদেশের মানুষ জনবিচ্ছিন্ন সহিংস, জ্বালাও-পোড়াও, সম্পদ ধ্বংসের আর ক্ষমতার সংকীর্ণ সংঘাতের অনেক হরতাল দেখেছেন। ২৬ জানুয়ারির হরতাল এর সম্পূর্ণ বিপরীত, এটি ক্ষমতার সংকীর্ণ সংঘাতে সম্পদ ধ্বংসের নয়; বরং সম্পদ রক্ষা, সম্পদ সৃষ্টি এবং বাংলাদেশ রক্ষার। এই হরতাল জ্বালাও-পোড়াওয়ের নয়, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের। যে আন্দোলনে জনভিত্তি শক্তিশালী, তার ভয়ভীতি দেখানোর দরকার হয় না, সেই আন্দোলন ভয়ভীতিতে কাবুও হয় না। আসলে এই ধর্মঘট সর্বজনের, কেননা এর আর্তি সর্বজনের স্বার্থ রক্ষার।
এই হরতালে তাই স্বতঃস্ফূর্ত মানুষেরা রাস্তায় থাকবেন, হাতে বা শরীরে বা কণ্ঠে সুন্দরবন রক্ষার দাবি রাখবেন, ভয়ভীতি, দ্বিধা-সংকোচ দূরে রেখে এই আন্দোলনে নিজ নিজ অবস্থান থেকে শরিক হবেন। হরতালের আহ্বানে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ‘এই দিন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য সুন্দরবন নিয়ে শ্রেণিকক্ষ হোক রাস্তায়; লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের নতুন সৃষ্টির স্থান হোক সুন্দরবন রক্ষার মিছিলে; মা-বাবার জন্য সন্তানকে প্রাণ প্রকৃতি শিক্ষাদানের সুযোগ করে দিক সুন্দরবন নিয়ে হরতাল। এই হরতাল শ্রমজীবী, পেশাজীবী, শিক্ষার্থীসহ সব মানুষের, আরও লক্ষ কোটি মানুষকে উদ্বাস্তু বানানোর বিরুদ্ধে এই হরতাল। দেশকে অরক্ষিত করার বিরুদ্ধে এই হরতাল। দেশের ও বিশ্বের এমন এক সম্পদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ, যা নষ্ট হলে আর বানানো যাবে না।’
বন রক্ষা তথা মানুষ রক্ষার এই লড়াই শুধু নতুন ইতিহাস তৈরি করবে না, উন্নয়নকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনাও দেবে। এর বার্তা হলো: যা দেশকে, দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বিপন্ন করে, তা উন্নয়ন নয়। গায়ের জোরে নয়, জনসম্মতি ও স্বচ্ছতা; কতিপয়ের সংকীর্ণ স্বার্থ নয়, সর্বজনের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি যা নিশ্চিত করতে সক্ষম, বাংলাদেশ সেই উন্নয়নই চায়।
(25 জানুয়ারী 2017 তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)