২৬ আগষ্ট ‘ফুলবাড়ী দিবস’। ৭ বছর আগে এইদিনে ফুলবাড়ী-বিরামপুর-পার্বতীপুর-নবাবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গের মানুষেরা ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। জীবন দিয়েছিলেন শুধু দেশের সম্পদ রক্ষার জন্যই নয়, দেশের নিশানা বদলে দেবার জন্য। ফুলবাড়ী গণঅভ্যূত্থান দেশ ও দেশের সম্পদের ওপর লুটেরাদের থাবা মুচড়ে দিয়েছিল। তাদের বার্তা এখনও ধরে আছেন মানুষেরা: এদেশের সম্পদ এদেশের মানুষের। দেশি-বিদেশি লুটেরাদের স্বার্থে নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে তার শতভাগ ব্যবহার করতে হবে।
এখনও কেউ কেউ নানাভাবে এ কথা বলতে চান যে অনভিজ্ঞ বিদেশি কোম্পানি এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প– যা একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য মাত্র শতকরা ৬ ভাগ রয়্যালটি, শতকরা ৮০ ভাগ রফতানি ও মাটি-পানি-মানুষবিনাশী উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি সম্বলিত বিদেশি বিনিয়োগ– সে প্রকল্পই বাংলাদেশের কয়লা সম্পদ ব্যবহারের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট অবধারিত পথ। এ প্রকল্প যে উন্নয়নের নামে ধ্বংসের একটি প্রকল্প, তা যে শুধু ফুলবাড়ী-বিরামপুরসহ ছয়থানা নয়, দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জন্যই, সেটি আমরা বহুবার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছি। আর দেশের খনিজ সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্ব ছাড়া কোনো দেশের সার্বভৌমত্বই অচল। এ কর্তৃত্ব ছাড়া দেশের জ্বালানি-নিরাপত্তা সম্ভব নয়, সম্ভব নয় অন্যান্য ক্ষেত্রেও যথাযথ বিকাশ।
ফুলবাড়ী-বিরামপুর-পার্বতীপুরসহ ছয়থানা অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম বলে জমি তিনফসলী এবং বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার বলে এ অঞ্চল পরিচিত। যখন দেশের খাদ্য-নিরাপত্তা বিপর্যস্ত, দেশের ভেতরে ও বিশ্বব্যাপী খাদ্যঘাটতি বাংলাদেশে এক ভযংকর অবস্থার সৃষ্টি করছে তখন এ বিশাল অঞ্চল উর্বর তিনফসলী কৃষিজমির ধ্বংসের দীর্ঘমেয়াদে মূল্য চিন্তাও করা যায় না।
শুধু খাদ্য উৎপাদন নয় পানিও এ অঞ্চলে এক বিরাট সম্পদ। বাংলাদেশের আর অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র পানিতে আর্সেনিক থাকলেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানি সম্পূর্ণ আর্সেনিকমুক্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্মুক্ত খনি হলে এ পানিও আর পানযোগ্য থাকবে না, বিষাক্ত হয়ে যাবে।
ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বিচার বিশ্লেষণ করে মত দেবার জন্য সরকার থেকে প্রফেসর নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটির রিপোর্টে পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতামত সংকলিত করা হয়। সেখানে প্রকল্পটি বিচার-বিশ্লেষণ করে পানি প্রত্যাহারের সম্ভাব্য যে কুফলগুলোর কথা বলা হয়েছে তার সারকথা হল– বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের ফলে খনি এলাকা ঘিরে বহুদূর পর্যন্ত পানির স্তর এমনভাবে নেমে যাবে যা উত্তরবঙ্গ জুড়ে আবাদ সংকট ও খাবার পানির সংকট তৈরি করবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপকভাবে আর্সেনিক ও অন্যান্য বিষাক্ত রসায়ন দূষণের শিকার হবে যা বিস্তৃত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে। উপরের মাটির আবরণ সরাবার ফলে বৃষ্টি ও জালের মতো ছড়ানো নদনদী, খালবিল দিয়ে দূষণ পুরো উত্তরবঙ্গ তো বটেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলকেও আক্রান্ত করবে, পুরো উপত্যকা দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যস্ত হবে। (বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৬)।
পরবর্তী সময়ে পাটোয়ারী কমিটি (২০০৭-৮) ও মোশাররফ কমিটি (২০১১-১২)ও প্রায় একই সিদ্ধান্ত টেনেছেন।
১৯৮৭-১৯৯১ সময়কালে যুক্তরাজ্যের খনিজ অনুসন্ধান ও কনসালট্যান্সি ফার্ম হিসেবে খ্যাত মেসার্স ওয়ার্ডেল আর্মস্ট্রং বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উপর আর্থ-প্রাযুক্তিক একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সমীক্ষা শেষে তারা বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি কারিগরি কারণেই সম্ভব নয বলে সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। তাদের হিসেব অনুযায়ী ৩০ বছরের খনিজীবনে প্রতি সেকেন্ডে সেখানে ৮ থেকে ১০ হাজার লিটার পানি প্রত্যাহার করতে হবে। এত দীর্ঘ সময় ধরে এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের যে ফলাফল তা যে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করতে পারে সেটা কোনো খনির জন্যও অনুকূল নয়।
এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পেও এ হারেই ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহার, মানে দিনপ্রতি ৮০ কোটি লিটার পানি তুলবার কথা বলা হয়েছিল। বর্তমানে উত্তরাঞ্চলে কৃষি আবাদের জন্য বছরে এর একশতমাংশেরও কম পানি তোলা হয়, এটিকে কৃষি ও ভূবিজ্ঞানীরা সে অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন।
এর ফলে এখনই এ অঞ্চলের শতকরা ৩০ ভাগ টিউবওয়েল অচল হয়ে পড়েছে। সেখানে দিনপ্রতি ৮০ কোটি লিটার পানি উঠালে প্রতিক্রিয়া কী হবে তা চিন্তা করতেও ভয় হয়। কৃষকেরা আরও ভালো বোঝেন। দিনাজপুরের এক গ্রামে একজন প্রবীণ কৃষক এসব কয়লাখনির কথা তুলে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কয়লারই কি কেবল দাম আছে? পানির কি কোনো দাম নাই? পানি যদি না থাকে আমরা কী করে থাকব, আবাদই-বা কী হবে, আর আপনারাই-বা কী করে বাঁচবেন?’
পেট্রোলিয়াম ও খনিজ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী একেএম শামসুদ্দীন উত্তরাঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও পানির স্তর পরীক্ষা করে বলেছেন, ‘এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারে আকুইফার বা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবস্থাকে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, পুরো এলাকা বিপর্যস্ত করে এর মরুকরণ ঘটাবে।’
পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো) মহাপরিচালক প্রকৌশলী ইনামুল হকও বিশ্লেষণ করে একই সিদ্ধান্তে এসেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ড. বদরুল ইমাম, ও ড. আফতাব আলম খান, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. রফিকুল ইসলাম এই বিষয়ে একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তাদের বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্যে।
তাছাড়া খনি অঞ্চলে বিপুল জনবসতি। দেশের গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০৭৯, যেখানে তা অস্ট্রেলিয়ায় ৩, যুক্তরাষ্ট্রে ৩২, ইন্দোনেশিয়ায় ১২০, চীনে ১৩৯, জার্মানিতে ২৩৭ এবং ভারতে ৩৬৩। সারাদেশে জনঘনত্ব এত বেশি থাকবার ফলে এক অঞ্চল থেকে সরিয়ে বসতি এবং সমাজজীবন প্রতিস্থাপন একেবারেই অসম্ভব।
বিষয়টা শুধু ফুলবাড়ী অঞ্চলের নয়, সমগ্র উত্তরবঙ্গে যদি কৃষিআবাদ ও পানিব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয় তাহলে এ পুরো অঞ্চলই মানুষের বসবাস ও আবাদের অযোগ্য হয়ে যাবে। তাদের সবার জন্যই ভিন্ন আবাস, কৃষিআবাদ আর সমাজজীবন প্রতিস্থাপন করতে হবে। সেটা কোথায়? আর অবিরাম খাদ্য উৎপাদনের এলাকা ধ্বংস হয়ে খাদ্য উৎপাদনের যে ঘাটতি হবে তার সমাধান কী হবে?
উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি একের পর এক দেশে হয় জনপ্রতিরোধের মুখে অথবা রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান দ্বারা নিষিদ্ধ অথবা সীমিত হচ্ছে। কোস্টারিকা, ইকুয়েডর, অর্জেন্টিনা, এমনকি ভারতেও অনেক প্রকল্প বাতিল হয়েছে। ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট সংবিধান সংশোধন করে প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকায় উন্মুক্ত খনন নিষিদ্ধ করবার জন্য সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকছেন। অন্যদিকে হন্ডুরাসের ন্যাশনাল কংগ্রেস দেশের খনি আইন পরিবর্তন করছে যেখানে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধ হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, তবে কয়লা সম্পদ ব্যবহার হবে কীভাবে? কোন ব্যবহার দরকার, কোন পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য তা নির্ভর করে কার স্বার্থ সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে তার উপর। বিদেশি কোম্পানির জন্য যত তাড়াতাড়ি তুলে দেশি বা বিদেশি বাজারে নেওয়া যায় ততই লাভজনক; মানুষ-প্রকৃতি-খাদ্য-বাসস্থান নিয়ে তার কী?
আর দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাইব অ-নবায়নযোগ্য এ সম্পদের প্রতিটি বিন্দু আমাদের কাজে লাগাতে। যতদিন সম্ভব এর ব্যবহার করব আমরা এবং তা করব এমনভাবে যাতে মাটির নিচের সম্পদ তুলতে গিয়ে মাটি ও তার উপরের সম্পদ নষ্ট না হয়, পুরো অঞ্চল ধ্বংসস্তূপ, বিরান বিষাক্ত অঞ্চলে পরিণত না হয়। মানুষই যদি না থাকতে পারে তাহলে বিদ্যুৎ কে ভোগ করবে?
ওই অঞ্চলে মানুষ, পশু, পাখি, গাছপালা, পুকুর, নদী, খাল, মাছ, হাঁস-মুরগী, কৃষিজমি, ফল-ফুল, সবজি, পুরাকীর্তি আছে, আছে কয়লা। ব্যবসায়ী কোম্পানির চোখে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে বিপুল মুনাফার উৎস কয়লায় গিয়ে চোখ আটকে থাকতেই পারে। স্বাধীন মানুষের তা হবে কেন? মানুষ তো সবকিছু দেখে-বুঝেই বিচার-বিবেচনা করবে।
তাহলে পথ কী? ভূমি, মাটি, পানি, পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে কয়লা সম্পদ কীভাবে ব্যবহার করা যায় তার জন্য অনেকদিন থেকেই গবেষণা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশে গ্যাসে রূপান্তরিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিই কয়েক দশকের মধ্যে কয়লা ব্যবহারের প্রধান পদ্ধতি হয়ে উঠবে।
তবে এটাই শেষ কথা নয়, এটি নিয়েও প্রশ্ন আছে, আরও নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকঠাকমতো অগ্রসর হতে গেলে এদেশেও গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে।
সবকিছু বিবেচনায় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, নিজেদের কর্তৃত্বে যদি কয়লা সম্পদ থাকে এবং নিজেদের জাতীয় সক্ষমতা তৈরির ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে বাংলাদেশের জন্য কয়লা সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ বের করা ঠিকই সম্ভব হবে। কিন্তু এ জন্য দরকার জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা ও চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ।
আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মও যে এ সম্পদের মালিক, সেটাও মনে রাখতে হবে। ঘাড় থেকে দুর্বৃত্ত না সরালে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে না। সেজন্য ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ দেখাতে পারে।
ফুলবাড়ীর মানুষ রক্ত দিয়ে এ বার্তাই দিয়ে গেছেন যে, জনগণের সম্পদ জনগণের মালিকানায়, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে শতভাগ ব্যবহার হতে হবে। দুর্বত্ত লুটেরাদের লুট আর পাচারের কোনো প্রকল্প মানুষ গ্রহণ করবে না। তাহলেই প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে।
(আগস্ট ২৬, ২০১৩ bdnews24.com এ প্রকাশিত)