
এক দশক ধরে বিজয়ের ওপর দাঁড়িয়ে জনগণের প্রতিরোধ জারি থাকার পেছনে অসংখ্য মানুষের ভূমিকা আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছেন ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুর, নবাবগঞ্জ থানাসহ দিনাজপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। পাশাপাশি এর সপক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন মানুষের সক্রিয়তা, ছোট-বড় অসংখ্য প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ, লেখালেখি, গবেষণা, একের পর এক চক্রান্ত মোকাবেলা, বুদ্ধিবৃত্তিক ও মাঠের অবিরাম লড়াই সবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
এ রকম প্রশ্ন আমরা প্রায়ই শুনি যে, ‘আপনারা কয়লা উত্তোলন করতে দিচ্ছেন না, গ্যাস উত্তোলন করতে দিচ্ছেন না। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের বিরোধিতা করছেন, পারমাণবিক বিদ্যুতের বিরোধিতা করছেন। তাহলে বিদ্যুৎ কীভাবে হবে? উন্নয়ন কীভাবে হবে?’ কেউ কেউ প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করেন, ‘আপনারা আসলে কী চান? আপনারা তো সবকিছুরই বিরোধিতা করেন। আপনারা টিকফার বিরোধিতা করেন, তেল-গ্যাস নিয়ে চুক্তির বিরোধিতা করেন, গ্যাস রফতানির বিরোধিতা করেন, উন্মুক্ত খনির বিরোধিতা করেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করেন, রেন্টাল-কুইক রেন্টালের বিরোধিতা করেন, বিশ্বব্যাংকের বিরোধিতা করেন, ট্রানজিটের বিরোধিতা করেন। বাংলাদেশকে আসলে আপনারা কোথায় নিতে চান?’ আমি এসব ভদ্রলোকের উদ্দেশে বলি, আপনারা প্রশ্নটা আরো সংক্ষেপে এভাবে করতে পারতেন যে, ‘আপনারা কেন জনগণের সম্পদ ডাকাতি, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা আর জনবিরোধী চুক্তির বিরোধিতা করেন? কেন প্রাণ-প্রকৃতি-দেশকে বিপন্ন করার প্রকল্পের বিরোধিতা করেন?’
হ্যাঁ, আমরা এগুলোর বিরোধিতা করি। আমরা এগুলোতে না বলি, কেননা আমাদের মধ্যে জনগণের পক্ষে এক প্রবল হ্যাঁ-র শক্তি আছে। আমরা চাই, দেশের সব সম্পদ জনগণের, তার মালিকানায় তার স্বার্থে এগুলোর সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা চাই, দেশের সীমিত সম্পদ দেশী-বিদেশী কতিপয় লুটেরার স্বার্থে রফতানির নামে পাচার না হোক। এর শতভাগ দেশের কাজে লাগুক। আমরা চাই, বর্তমানের জন্য ভবিষ্যেক ধ্বংস না হোক। আমরা চাই, দেশের উন্নয়ন নীতির কেন্দ্রে থাকবে মানুষ, কতিপয় গোষ্ঠীর মুনাফা নয়। উন্নয়নের নামাবলি গায়ে দিয়ে এ ভদ্রলোকেরা দেশের প্রধান আশ্রয় সুন্দরবনকেও ধ্বংস করে দখল, লুণ্ঠন ও মুনাফার জন্য উন্মাদ হয়ে ওঠে। আমাদের দায়িত্ব প্রবল ‘না’ দিয়ে সুন্দরবন রক্ষা করা।
উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়েই তারা বারবার ভয়ঙ্কর প্রকল্প নিয়ে এসেছে। মার্কিন কোম্পানির মালিকানায় দেশের গ্যাসসম্পদ ভারতে রফতানির জন্য একসময় শোরগোল তুলেছিল সরকারের মন্ত্রী, আমলা, কনসালট্যান্ট, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, বিভিন্ন দূতাবাস। এরা সবাই মিলে হই হই করছিল এই বলে যে, দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে, অতি শিগগির এ গ্যাস রফতানি না করলে দেশের সর্বনাশ হবে। রফতানি করলে দেশ উন্নয়নে ভরে যাবে। তখন দেশের ব্যবসায়ীদের কতিপয় নেতা মার্কিন কোম্পানির কমিশনভোগী হিসেবে এ প্রচারে যোগ দিয়েছিল। এমন প্রচারও হয়েছিল যে, গ্যাস রফতানি না করলে মার্কিন বাজারে গার্মেন্ট প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাবে, গার্মেন্ট শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে এবং বেকার হয়ে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। আমরা তখন এই প্রবল আওয়াজের বিরুদ্ধে না বলেছিলাম, জনগণ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এবং গ্যাস রফতানির ভয়াবহ আয়োজন পরাস্ত হয়েছিল। এটা হয়েছিল বলে দেশে এখনো গ্যাস আছে, বাতি জ্বলে, কারখানা চলে, ব্যবসা চলে, সিএনজির কারণে ঢাকা শহরে এখনো শ্বাস নেয়া যায়। যদি তখন এ গ্যাস রফতানি হতো, তাহলে আজ অর্ধেক বিদ্যুৎও উত্পাদন করা সম্ভব হতো না।
যারা তখন গ্যাস রফতানির জন্য লম্ফঝম্ফ করছিল, তারাই কয়েক বছর পর শুরু করল বিদেশী আনাড়ি কোম্পানির মাধ্যমে উন্মুক্ত খনি, কয়লা রফতানির পক্ষে প্রচার। উত্তরবঙ্গে গ্যাস না দিয়ে বিদেশে রফতানি করতে চেয়েছিল যারা, তারাই প্রচার করতে থাকল উন্মুক্ত খনি ছাড়া উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের জন্য, বিদ্যুতায়নের জন্য আর কোনো পথ নেই! তাদেরই কেউ কেউ এখন সুন্দরবনধ্বংসী প্রকল্পের পক্ষে ভাড়া খেটে যাচ্ছে।
কী ছিল ফুলবাড়ী প্রকল্প, যার বিরুদ্ধে জনগণকে ১০ বছর পরও একটানা প্রতিরোধ জারি রাখতে হয়েছে? এই ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প অনুযায়ী বাংলাদেশের জন্য মাত্র ৬ শতাংশ রয়্যালটি দিয়ে নতুন গঠিত অনভিজ্ঞ একটি বিদেশী কোম্পানি এশিয়া এনার্জি (এখন নাম জিসিএম) পুরো খনির স্বত্ব লাভ করতে চেয়েছিল, ৮০ শতাংশ কয়লা রফতানি করে মুনাফা নিশ্চিত করার আয়োজন করেছিল। সুন্দরবন পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করে সুন্দরবন বিপর্যস্ত করে সেই কয়লা রফতানি হতো, তার মালিকানা পুরোটাই কোম্পানির। আর রেললাইন নির্মাণের খরচ জোগাতে হতো বাংলাদেশের ভাগের সেই ৬ শতাংশ রয়্যালটি থেকে! ফুলবাড়ী, বিরামপুর, পার্বতীপুরসহ ছয় থানা অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম বলে জমি তিন ফসলি এবং বাংলাদেশের শস্যভাণ্ডার বলে এ অঞ্চল পরিচিত। শুধু খাদ্য উত্পাদন নয়, পানিও এ অঞ্চলে এক বিরাট সম্পদ। দেশের আবাদি জমি, পানিসম্পদ ও মানুষের সর্বনাশ করে মাত্র ৬ শতাংশ রয়্যালটি দিয়ে দেশের কয়লা বিদেশে পাচারের এ প্রকল্পকেই ‘উন্নয়ন প্রকল্প’ বলে ঢোল পেটানো হয়েছিল।
এ প্রকল্প একটু খেয়াল করলে তাই এটা পরিষ্কার হয় যে, জনগণ খুবই ন্যায্যতার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছে এবং ২০০৫ সাল থেকে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর এক বিপদ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছে জনগণই। এজন্য জীবনও দিয়েছেন অনেকে। জীবন দিয়েছিলেন শুধু দেশের সম্পদ রক্ষার জন্যই নয়, দেশের নিশানা বদলে দেয়ার জন্য। ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থান দেশ ও দেশের সম্পদের ওপর লুটেরাদের থাবা মুচড়ে দিয়েছিল। তাদের বার্তা এখনো ধরে আছে মানুষেরা: এ দেশের সম্পদ এই দেশের মানুষের। দেশী-বিদেশী লুটেরাদের স্বার্থে নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে তার শতভাগ ব্যবহার করতে হবে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে তত্কালীন সরকার বাধ্য হয়েছিল দেশ থেকে এশিয়া এনার্জি বহিষ্কার ও উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ জনগণের দাবিনামা মেনে চুক্তি স্বাক্ষর করতে। কিন্তু সেই চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে এখনো চক্রান্ত চলছে, প্রতিরোধও জারি আছে।
কোনো বৈধ অনুমোদন না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ফুলবাড়ী কয়লাখনি দেখিয়ে এশিয়া এনার্জি (জিসিএম) লন্ডনে শেয়ার ব্যবসা করছে প্রায় ১২ বছর ধরে। এর মধ্যে চারটি সরকার ক্ষমতায় থেকেছে, কোনো সরকারই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এ পর্যন্ত সরকারের উদ্যোগে বেশ কয়টি কমিটি করা হয়েছে— ড. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছিল ২০০৬ সালে, ২০০৭ সালে আবদুল মতিন পাটোয়ারির নেতৃত্বাধীন এবং ২০০৮ সালে সেটির পর্যালোচনা কমিটি, ২০১১ সালের মোশাররফ হোসেন কমিটি। বিভিন্ন ধরনের চাপ ও কূটকৌশল থাকা সত্ত্বেও কোনোটিই এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের পক্ষে দাঁড়ানোর যুক্তি পায়নি, বরং কোম্পানি বা উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধেই মত দিয়েছে।
এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, কয়লাসম্পদ ব্যবহার হবে কীভাবে? আসলে কোন ব্যবহার দরকার, কোন পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য, তা নির্ভর করে কার স্বার্থ সেখানে গুরুত্ব পাচ্ছে তার ওপর। বিদেশী কোম্পানির জন্য খনিজসম্পদ যত তাড়াতাড়ি তুলে দেশী বা বিদেশী বাজারে নেয়া যায় ততই লাভজনক; মানুষ, প্রকৃতি, খাদ্য, বাসস্থান নিয়ে তার কী? আর দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাইব এই অনবায়নযোগ্য সম্পদের প্রতিটি বিন্দু আমাদের কাজে লাগবে। যত দিন সম্ভব এর ব্যবহার করব আমরা এবং তা করব এমনভাবে যাতে মাটির নিচের সম্পদ তুলতে গিয়ে মাটি ও তার উপরের সম্পদ নষ্ট না হয়, পুরো অঞ্চল ধ্বংসস্তূপ, বিরান, বিষাক্ত অঞ্চলে পরিণত না হয়। মানুষই যদি না থাকতে পারে তাহলে বিদ্যুৎ কে ভোগ করবে? ওই অঞ্চলে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, পুকুর, নদী-খাল, মাছ, হাঁস-মুরগি, কৃষিজমি, ফল-ফুল, সবজি, পুরাকীর্তি আছে, আছে কয়লা। ব্যবসায়ী কোম্পানির চোখে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে বিপুল মুনাফার উত্স কয়লায় গিয়ে চোখ আটকে থাকতেই পারে। স্বাধীন মানুষের তা হবে কেন? মানুষ তো সবকিছু দেখে বুঝেই বিচার-বিবেচনা করবে।
তাহলে পথ কী? ভূমি, মাটি, পানি, পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে কয়লাসম্পদ কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার জন্য অনেক দিন থেকেই গবেষণা হচ্ছে। আরো নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিকঠাকমতো অগ্রসর হতে গেলে এ দেশেও গবেষণার সুযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে। সবকিছু বিবেচনায় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, নিজেদের কর্তৃত্বে যদি তেল-গ্যাস, কয়লাসম্পদ থাকে এবং নিজেদের জাতীয় সক্ষমতা তৈরির ব্যবস্থা যদি করা যায় তাহলে বাংলাদেশের জন্য সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ বের করা ঠিকই সম্ভব হবে। আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মও যে এই সম্পদের মালিক, সেটাও মনে রাখতে হবে। জাতীয় কমিটির সাত দফায় বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে যে রূপরেখা দেয়া হয়েছে, তাতে স্পষ্ট হয় যে, সমাধান খুবই সম্ভব। ফুলবাড়ী, রামপাল, রূপপুর, বাঁশখালীর মতো প্রাণ-প্রকৃতি সম্পদ ধ্বংসকারী ঋণনির্ভর প্রকল্প মোটেই সমস্যা সমাধানের পথ নয়, বরং মহাবিপদের আয়োজন। সমাধানের পথ— স্থলভাগ ও বঙ্গোপসাগরের গ্যাসসম্পদ, কয়লা ও বিদ্যুৎ নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী তত্পরতা ও চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ, জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়িয়ে নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য জ্বালানির সমন্বয়ে সমাধানের পথনকশা তৈরি। ঘাড় থেকে দুর্বৃত্ত না সরালে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হবে না।
সেজন্য ভুইফোঁড় প্রতারক কোম্পানি বহিষ্কারসহ ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নই সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পথে একটি সঠিক পদক্ষেপ হতে পারে।
ফুলবাড়ীর মানুষ রক্ত দিয়ে এ বার্তাই দিয়ে গেছেন যে, জনগণের সম্পদ জনগণের মালিকানায়, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে শতভাগ ব্যবহার হতে হবে। ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থান বার্তা দেয়, দুর্বৃত্ত-লুটেরাদের লুট, ধ্বংসযজ্ঞ আর পাচারের কোনো প্রকল্পই মানুষ গ্রহণ করবে না। এ বার্তা ১০ বছর ধরে জারি থাকা এই প্রতিরোধ, জনগণের এই শক্তির প্রকাশ শুধু বাংলাদেশকে নয়, সারা বিশ্বের মানুষকেই অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা রাখে। সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষ যে প্রতিরোধে শামিল হয়েছেন, তা এ শক্তিকে আরো বিস্তৃত করছে।
[লেখাটি ২৬ আগস্ট ২০১৬ তারিখে বণিকবার্তায় প্রকাশিত]