ঐতিহাসিক ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থানের সাতবছর পূর্তি হলো। এর স্মরণে এবছরও দেশজুড়ে পালিত হলো ২৬ আগষ্ট ‘ফুলবাড়ী দিবস’। ২০০৬ সালের এইদিনে পানিসম্পদ, আবাদী জমি ও মানুষ বিনাশী ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্পের বিরুদ্ধে বাঙালি আদিবাসী নারী পুরুষ শিশু বৃদ্ধসহ সকল মানুষের প্রতিবাদ বিশাল আকার নিয়েছিলো। লক্ষ মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ সমাপ্তি ঘোষণার পরও সরকারি বাহিনীর পাইকারি গুলিতে তিনজন তরুণ নিহত হন, গুলিবিদ্ধসহ আহত হন দুই শতাধিক। এরপর পুরো অঞ্চলের নারীপুরুষেরা গণঅভ্যুত্থানের এক অসাধারণ পর্ব তৈরি করেন, সারাদেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ৩০ আগষ্ট ২০০৬ সরকার জনগণের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তি ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ হিসেবে খ্যাত। এইদিনটি এইবছর আবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, রক্তে লেখা ‘ফুলবাড়ি চুক্তি’র পূর্ণ বাস্তবায়ন না করে বাংলাদেশের জ্বালানী নিরাপত্তার কোনো স্বচ্ছ ও টেকসই পথ নির্মাণ করা যাবে না।
ঘটনার শুরু ১৯ বছর আগে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়লা কোম্পানি অস্ট্রেলিয়ার বিএইচপি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে ফুলবাড়ীতে কয়লা সম্পদ অনুসন্ধানের লাইসেন্স সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯৯৪ সালের ২০ আগষ্ট। একপর্যায়ে ফুলবাড়ীতে সমৃদ্ধ কয়লা খনির অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হয়। রহস্যজনক ঘটনা ঘটে এইসময়, ‘এশিয়া এনার্জি’ নামে লন্ডনে তালিকাভুক্ত একটি নতুন কোম্পানি গঠিত হয়। ১৯৯৭ সালে, রহস্যজনকভাবে গঠিত সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ নতুন এই কোম্পানি, এশিয়া এনার্জির হাতেই বিএইচপি তার লাইসেন্স হস্তান্তর করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। দুটো প্রশ্ন এখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কেনো এরকম সমৃদ্ধ খনির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও কয়লা খনি সম্পর্কে অভিজ্ঞ বিএইচপি বড় ব্যবসার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করলো? দ্বিতীয়ত, কারা ঠিক ঐসময়েই ফুলবাড়ী কয়লা খনি লক্ষ্য করে একটি নতুন কোম্পানি খুললো? কেনো বিএইচপি তার হাতেই নিজের লাইসেন্স হস্তান্তর করলো? সরকারই বা কেনো এটা অনুমোদন করলো?
প্রথম প্রশ্নটির স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় অস্ট্রেলিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশি ভুতত্ত্ববিদ নজরুল ইসলামের কাছ থেকে, যিনি বিএইচপির কনসালট্যান্ট জিওলজিস্ট হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বাংলাদেশে এই কোম্পানির আসার ব্যাপারে যিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছিলেন। ২০০৮ সালের জুন মাসে সিডনীতে তাঁর সাথে আমার দেখা হলে তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের কথা ভেবেই বিএইচপিকে নিয়ে গিয়েছিলাম দেশে। কিন্তু এখন এশিয়া এনার্জির প্রকল্প দেখে আমি আতংকিত। এটা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের সর্বনাশ হবে এবং আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না’। কেনো বিএইচপি চলে গেলো সেটা তিনি খুব ভালো করেই জানেন, এনিয়ে তিনি লিখেছেন (নিউএজ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮; ডেইলি স্টার ৩০ মে ২০১০)। ‘গ্রামের নাম ফুলবাড়ী’ নামে এক ছোট্ট তথ্যচিত্রেও তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন (http://www.youtube.com/watch?v=huFnWBkuQP4)।
নজরুল ইসলামের বক্তব্যের সারকথা হল, ‘উন্মুক্ত খনি বিএইচপির জন্য নিশ্চয়ই অনেক লাভজনক হতো। কিন্তু তার জন্য যে গভীরতায় কয়লা স্তর থাকা দরকার ফুলবাড়ীর কয়লা তার চাইতে অনেক গভীরে, ১৫০ থেকে ২৬০ মিটার। বিএইচপি খুব ভালো করেই জানতো, এরকম গভীরতায় উন্মুক্ত খনি করতে গেলে ভূতাত্ত্বিক ও কারিগরী সমস্যা মোকাবিলা ছাড়াও বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অসংখ্য নদীনালা খালবিল, মৌসুমী ভারী বৃষ্টি, বন্যাপ্রবণ এই অঞ্চলে অস্ট্রেলীয মান তো দূরের কথা যেকোন দেশের বিধি রক্ষা করে উন্মুক্ত খনি পরিচালনা সম্ভব হবে না। তাছাড়া বিএইচপি চায়নি পাপুয়া নিউ গিনির ওক – টেডি কপার খনির মতো আরেকটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দায় নিতে, যেখানে খনির বিষাক্ত পানি নিকটবর্তী নদীতে ভযাবহ দুষণের সৃষ্টি করেছিল এবং নীচের বিশাল অঞ্চল ধক্ষংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। বিএইচপিকে অল্পদিন পরেই প্রকল্প বাতিল করে ফিরে আসতে হয়েছিল এবং বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশের পানির আধার ও অন্যসবকিছু মিলে পরিস্থিতি আরও অনেক জটিল।’ বিএইচপি তাই বুঝেশুনে আগেভাগেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল।
তবে দ্বিতীয় প্রশ্ন ও রহস্যের কিনারা আজও হয়নি। বিএইচপির মতো অভিজ্ঞ সংস্থা যা সাহস করেনি তা করবার কথা বলে নতুন কোম্পানি কীভাবে লাইসেন্স পেয়ে গেলো? পরিবেশগত সমীক্ষা করবার আগেই তারা ছাড়পত্রও পেল! পরে তাদের করা সমীক্ষা আর পুনর্বাসন পরিকল্পনা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করেছেন স্বাধীন আন্তর্জাতিক খনি বিশেষজ্ঞ রজার মুডি ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ জেনিফার কেলাফাত। অসঙ্গতি, অস্বচ্ছতা আর প্রতারণার দৃষ্টান্ত তাঁরা হাজির করেছেন পাতায় পাতায় (২০০৮)। এর আগে এশিয়া এনার্জি জমাকৃত ‘খনি উন্নয়ন পরিকল্পনা’ পরীক্ষা করে মতামত দেবার জন্য সরকার বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল ইসলামকে প্রধান করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন। কমিটি তাঁদের রিপোর্টে এই প্রকল্প অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও আইনগত বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য বলে সিদ্ধান্ত দেন (বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৬)। পরবর্তী সময়ে পাটোয়ারী কমিটি (২০০৭ – ৮) ও মোশাররফ কমিটি (২০১১ – ১২)ও প্রায় একই সিদ্ধান্ত টেনেছেন। কিন্তু কোনো সরকারই এবিষয়ে আর কোন সিদ্ধান্ত জানায়নি।
এখানে বলা দরকার যে, অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের কয়লাসম্পদ দখল – লুন্ঠনের নানা আয়োজন চলছে। তার অংশ হিসেবে কোনরকম সমীক্ষা ও আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের আগেই বিশ্বব্যাংক সমর্থিত আইআইএফসি নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কয়লা নীতি প্রস্তুত করে, যেখানে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া যথাক্রমে এশিয়া এনার্জি ও টাটার নামে দেখানো হয় (২০০৫ – ০৬)। টাটা তখন বাংলাদেশে বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে টাটা গ্রুপের আবাসিক পরিচালক মানজের হুসেন বলেন, এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প যে শর্তে দেয়া হচ্ছে তাঁরাও একই শর্তে বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনি করতে আগ্রহী (প্রথম আলো, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)।
তারমানে ঘটনাবলী যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিলো তাতে জনগণ যদি নিষ্ক্রিয় থাকতেন, এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে ফুলবাড়ী ও বড়পুকুরিয়া দুক্ষেত্রেই উন্মুক্ত খনি হতো। এমনিতেই উত্তরবঙ্গের বহুস্থানে এখন পানির সংকট, এতদিনে তা হাহাকার পর্যায়ে যেতো। বহু নদীনালা খালবিলের দশা বুড়িগঙ্গার চাইতে ভয়াবহ হতো। খনি ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলের আবাদী জমি নষ্ট ও অনাবাদী হবার কারণে খাদ্য উৎপাদনে ভয়াবহ নিম্নগতি সৃষ্টি হতো। জীবিকা ও ঘরবাড়ি হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ নতুন করে ঢাকার রাস্তায় আশ্রয় নিতেন।
এসব ধক্ষংসযজ্ঞের পরও এরকম কথা কেউ বলতে পারেন, ‘এতো সামান্য ক্ষতি! আমরা তো কয়লা পাচ্ছি, আমাদের বিদ্যুৎ দরকার!!’ না, পরিকল্পনা যা ছিল তাতে কয়লা সম্পদও পাওয়া যেতো না। কারণ বাংলাদেশ শুধু ৬ ভাগ রয়ালটি পেতো, তাও রেলওয়ে উন্নয়ন করে এই কয়লা রফতানির ব্যবস্থা করতে সেখান থেকেই ব্যয় করতে হতো। কয়লা রফতানির আয় পুরোটাই, মালিকানার কারণে, কোম্পানির বিদেশি কোন একাউন্টে জমা হতো। শতকরা ৮০ ভাগ রফতানির পর বাকিটা আন্তর্জাতিক দামে কিনতে হতো। আবাদী জমি, মাটির ওপরের ও নীচের পানি সম্পদ, বসতভিটা সবকিছু ধক্ষংস করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বাস্তু করে, উত্তরবঙ্গকে অনুর্বর বিরানভূমিতে পরিণত করে, দেশের কয়লা সম্পদ দ্রুত বিদেশে পাচারের এসব প্রকল্পই ‘উন্নয়ন’ নামে চালু করবার চেষ্টা হয়েছিল। আমাদের ভয়াবহ সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা করেছেন মানুষ, তাদের জীবন দিয়ে।
২০০৬ সালের ৩০ আগষ্ট যে ঐতিহাসিক ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়, তার প্রতি পূর্ণ সংহতি জানান তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ৪ সেপ্টেম্বর ২০০৬ ফুলবাড়ীসহ ৬ থানার মানুষদের অভিনন্দন জানিয়ে তৎকালীন ৪ দলীয় জোট সরকারের উদ্দেশ্যে অবিলম্বে সেই চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন। একই ভাষণে তিনি তৎকালীন সরকারের উদ্দেশ্যে আরও বলেছিলেন, ‘এই চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ’ (প্রথম আলো, ৫ সেপ্টেম্বর ২০০৬)। এটা আমাদের সকলেরই কথা। চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বিএনপি (৪ দলীয় জোট) এবং প্রকাশ্য অঙ্গীকারের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ এই চুক্তি বাস্তবায়নে দায়বদ্ধ। এর অন্যথা করার কোনো পথ নাই।
কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাড়ে চার বছর পার হলেও এখনও সেই চুক্তির মূলধারাগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। বরং উল্টো দেশের জন্য সর্বনাশা প্রকল্পের পক্ষে সরকারের ভেতর থেকেই নানা আয়োজন চলছে। উইকিলিকস এর মাধ্যমে আমরা জেনেছি, সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরজন্য তদ্বির করেছেন, তার কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে জনমত তৈরির চেষ্টা চলছে। বর্তমান রাষ্ট্রদূতও একইসুরে কথা বলছেন।
কোন বৈধ অনুমোদন না পেলেও ফুলবাড়ীর কয়লা খনির ওপর লন্ডনে এখনও শেয়ার ব্যবসা করছে এশিয়া এনার্জি (বর্তমান নাম গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট বা জিসিএম)। দেশে সরকার থাকতে কী করে একটি বিদেশি কোম্পানি দেশের সম্পদ নিয়ে বিদেশে অবৈধভাবে শেয়ারব্যবসা করতে পারে? কোনো সরকারই এটা বন্ধ করবার উদ্যোগ নেয়নি। বরং দেখা যাচ্ছে শেয়ার ব্যবসার মুনাফার একাংশ ছড়িয়ে দেশে সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির চেষ্টা চলছে। এই অর্থ দিয়েই কোম্পানিমুখি কিছু ব্যক্তিবর্গ নিয়ে সেমিনার, ওয়ার্কশপ, টকশো, বিজ্ঞাপন, বিদেশ সফর ইত্যাদি আয়োজন করা হচ্ছে।
কোন ‘বিশেষজ্ঞ’ যখন কোম্পানির স্বার্থে কাজ করেন, তখন যতই ডিগ্রী থাকুক, বিশেষজ্ঞ নয় কোম্পানির প্রচারক হিসেবেই তাকে বিবেচনা করতে হবে। এরাই ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’ আওয়াজ তুলে দেশের গ্যাস ভারতে রফতানির জন্য ওঠে পড়ে লেগেছিল। এরাই বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদ নিয়ে রফতানিমুখি চুক্তি করতে প্রচারণার কাজ করেছে। উন্মুক্ত খনি করতে গিয়ে দেশের অমূল্য আবাদি জমি, পানি সম্পদ, মানুষের জীবন জীবিকা ধক্ষংস হোক, উত্তরবঙ্গ মরুভূমি হোক, দেশ ও দেশের মানুষের ধক্ষংসযজ্ঞ করে কয়লা বিদেশে পাচার হোক তাতে তাদের কিছু আসে যায না। কোম্পানির মুনাফা আর নিজেদের সুবিধা বা কমিশনই তাদের লক্ষ্য। ‘নয়াউদারনৈতিক’ এই কালে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে ফরাসী সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিক পিয়েরে বুর্দো এই ধরনের ’বিশেষজ্ঞ’, মিডিয়া প্রচারক ও পরামর্শকদের সঠিকভাবেই জনশত্রু হিসেবে অভিহিত করেছেন (পলিটিক্যাল ইন্টারভেনশনস, ২০১০)।
বিদ্যুতের কথা বলেই এসব সর্বনাশা প্রকল্প জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করবার চেষ্টা চলে। প্রকৃতপক্ষে জ্বালানী সম্পদের ওপর শতভাগ মালিকানা, রফতানি নিষিদ্ধ ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে তার বাস্তবায়নে স্বল্প দামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যোগান ও জ্বালানী নিরাপত্তা খুবই সম্ভব। প্রমাণিত হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নীতি ও সম্পদের ওপর দেশি বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব থাকলে এটা কখনোই সম্ভব নয়। সেজন্যই ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের সম্ভাবনা মুক্ত করবার জন্য অপরিহার্য।
সরকার যখন জনগণের সম্পদ ও স্বার্থ রক্ষার বিপরীতে অবস্থান নেয় তখন জনগণকেই সজাগ সক্রিয় পাহারাদারের ভূমিকা নিতে হয়। বাংলাদেশের জনগণ বারবার এই ভূমিকা নিয়েছেন বলেই বাংলাদেশ নিয়ে উজ্জল ভবিষ্যতের স্বপ্ন আমরা এখনও দেখতে পারি। ফুলবাড়ীর মানুষ রক্ত দিয়ে এই বার্তাটিই দিয়ে গেছেন যে, জনগণের সম্পদ জনগণের মালিকানায়, দেশ ও জনগণের প্রয়োজনে শতভাগ ব্যবহার হতে হবে। দুর্বত্ত লুটেরাদের লুট আর পাচারের কোন প্রকল্প মানুষ গ্রহণ করবে না। এই দেশ ও দেশের সম্পদের মালিক জনগণ, দেশি বা বিদেশি লুটেরা – দখলদার কোন গোষ্ঠী নয়। ফূলবাড়ী গণঅভ্যুত্থান এবং এখনও পর্যন্ত জনগণের সজাগ অবস্থান এই পথে তাই আমাদের সাহস ও নিশানা।
২০০৬ সালের ২৬ আগষ্ট ফুলবাড়ীতে যে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিলো তা শুধু লুটেরাদের হাত থেকে কয়লা, পানিসম্পদ, আবাদী জমি ও জনবসতি রক্ষার লড়াই ছিলো না, তা একইসঙ্গে প্রচলিত উন্নয়ন দর্শন নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই আন্দোলন দুর্নীতি, গোপনীয়তা, জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির বিপরীতে জনগণের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা, জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের তাগিদ উপস্থিত করেছে। উন্নয়নের কেন্দ্র হতে হবে মানুষ, দেশি বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠীর মুনাফা নয় সেটাই এই অব্যাহত জনপ্রতিরোধের কেন্দ্রীয় বার্তা।।
(আগষ্ট ২৮, ২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)