ফুলবাড়ী: অব্যাহত প্রতিরোধের শক্তি

২৬ আগষ্ট ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থানের নবম বছর পূর্তি হচ্ছে। ২০০৬ সালে লক্ষ মানুষের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে, সরকারি বাহিনীর মাধ্যমে হামলা ত্রাস চালিয়ে, গুলি করে মানুষ হত্যা করেও টিকতে পারেনি ব্রিটিশ-অস্ট্রেলিয়ান-মার্কিন কোম্পানি এশিয়া এনার্জি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে গভীর রাতে কোম্পানির সকল কর্মকর্তা ফুলবাড়ী ছেড়ে পালিয়েছিলো তখন। এই কোম্পানি দেশের আবাদী জমি পানি ও মানুষের সর্বনাশ করে শতকরা মাত্র ৬ ভাগ রয়্যালটি দিয়ে দেশের কয়লা বিদেশে পাচার করতে চেয়েছিলো। ২৬ আগষ্ট তার প্রতিবাদে আহুত শান্তিপূর্ণ সমাবেশে সরকারি বাহিনীর পাইকারি গুলিবর্ষণে শহীদ হন ৩ জন, গুলিবিদ্ধ হন ২০ জন, আহত হন দুইশতাধিক। ৩০ আগষ্ট ‘ফুলবাড়ী চুক্তি’ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয় সূচিত হয়। চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব নিয়ে একালের ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা’ বাবলু রায়, শরীরে জখমচিহ্ন নিয়ে প্রদীপসহ আরও অনেকে লড়াকু চেতনায় এখনও জাগ্রত আছেন। তাঁদের সাথে প্রতিনিয়িত যোগ দিচ্ছে নতুন প্রজন্ম। সেজন্য গত নয় বছরে এই প্রতিরোধে কখনোই ভাটা পড়েনি। ভাটা পড়লে চলবে না, বরং আরও ছড়িয়ে দিতে হবে।

কিন্তু বিশাল সম্পদ লুন্ঠনের লোভে চক্রান্ত কখনোই থামেনি। ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্বাধীন তত্তাবধায়ক সরকারের সময়ে জরুরি অবস্থার সুযোগে কোম্পানি আবারো এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা চালায়। প্রকাশ্য বাজারে ফুলবাড়ীর অন্যতম নেতা এস এম নূরুজ্জামানকে বর্বরভাবে নির্যাতন করে কতিপয় সেনাসদস্য। পাশাপাশি ফুলবাড়ী আন্দোলন সংগঠকদের ওপর হামলা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা, গ্রেফতার, হুমকি, হয়রানি এবং সেইসঙ্গে সংগঠিত মিথ্যা প্রচারণা চলতে থাকে। কিন্তু এর কোনকিছুই জনগণকে হঠাতে পারেনি। কিন্তু বারবার নানামাত্রার চক্রান্ত মোকাবিলা করতে হয়েছে। বড়পুকুরিয়ায় কোম্পানি-মন্ত্রীর যৌথ উদ্যোগে হামলা চালিয়ে এস এ খালেককে গুরুতর আহত করা হয়েছে, আমিনুল ইসলাম বাবলুসহ অনেক নেতাকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন।

গত ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে দিনাজপুর জেলা ও ফুলবাড়ীসহ ৬ থানায় এশিয়া এনার্জি যাতে নির্বিঘ্নে ‘জরীপ কাজ’ চালাতে পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রশাসন ও পুলিশ কেন্দ্রগুলোতে নির্দেশ পাঠায়। এর প্রতিবাদে ২৩ নভেম্বরে ফুলবাড়ীতে জাতীয় কমিটির উদ্যোগে সমাবেশ ডাকা হয়। সরকার দশ থানার পুলিশ আনিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে কোম্পানির প্রবেশের রাস্তা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করে। জনপ্রতিরোধ সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। একটি সমাবেশ বন্ধ করতে গিয়ে জন্ম নেয় দশটি সমাবেশ। মিছিলে মিছিলে পুরো অঞ্চল আবার জেগে ওঠে। বেশি সময় লাগে নি। ঘন্টাখানেকের মধ্যে সবগুলো খন্ড খন্ড মিছিল একসঙ্গে হয়। প্রায় ১৫ হাজার মানুষ রাস্তায় রাস্তায় মিছিলে। হাতে লাঠি ও ঝাঁটা নিয়ে মেয়েদের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। জনগণের হাতে দখলমুক্ত হয় সভামঞ্চ ও শহর। সমাবেশ হয়। পরেরদিন হরতালও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রার। জনশুণ্য, সন্ত্রাসনির্ভর আর ক্ষমতালোভের মহড়া হিসেবে বিভিন্নকালে লুটেরাদের হরতাল দেখে দেখে আমরা অতীষ্ট। কিন্তু ফুলবাড়ীর হরতাল ছিল প্রকৃতই জনগণের হরতাল। জীবন, সম্পদ ও দেশকে দেশি বিদেশি লুটেরা দখলদারদের হাত থেকে রক্ষার জন্য স্বতস্ফুর্ত মানুষের প্রতিরোধের ভাষা এই হরতাল। রাস্তায় সারাক্ষণই হাজার হাজার মানুষ। ২৫ তারিখ দিনাজপুর জেলা প্রশাসকসহ সরকারের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসে সকল দাবীদাওয়া মেনে নেবার প্রতিশ্রুতি দেবার পর হরতাল স্থগিত করা হয়।
২০১৩ সালে বস্ত্র বিতরণের প্রতারণামূলক প্রচার করে গ্যারী লাই গং আবারো এলাকায় প্রবেশ করতে চেষ্টা করে, তখনও জনপ্রতিরোধের মুখে পুলিশের আশ্রয়ে পালাতে বাধ্য হয়। ফুলবাড়ী বিরামপুর পার্বতীপুর এলাকায় বেআইনী অনুপ্রবেশ, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস বিস্তারের অপচেষ্টার মাধ্যমে এভাবে বারবার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে জনপ্রত্যাখ্যাত কোম্পানি এশিয়া এনার্জি (জিসিএম)। সর্বশেষ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সূত্রপাত গত ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। ঐদিন গোপনে ফুলবাড়ীতে প্রবেশ করতে গিয়ে জনতার প্রতিরোধের মুখে পড়ে এশিয়া এনার্জির প্রধান গ্যারী লাই। পরে পুলিশ তাকে জনরোষ থেকে রক্ষা করে নিয়ে আসে ঢাকায়। তার ভাড়া করা সহযোগীদেরও জনতাড়া খেয়ে পালাতে হয়েছে।

(২৫ আগষ্ট ২০১৫ তারিখে প্রিয় ডট কম এ প্রকাশিত)