ফুলবাড়ীর একটি বিয়ে এবং মানুষের ইজ্জত

২৬ আগষ্ট এবং পরবর্তী কয়েকদিনে ফুলবাড়ী অঞ্চলের মানুষ রক্ত দিয়ে যে ইতিহাস লিখেছিলেন তা শুধু বাংলাদেশে নয বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষা এবং তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইএ এখন নতুন সাহস আর নিশানা, দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের লড়াইএ ফুলবাড়ী এখন নতুন প্রতীক হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। ৩০ আগস্ট সরকার মাথানত করেছিল জনগণের সেই শক্তির কাছে যা অপরাজেয় অপ্রতিরোধ্য। এই শক্তির কথা বলতে গিয়ে ফুলবাড়ীর একটি বিয়ের খবর আমি সবাইকে জানাতে চাই। কেননা এরকম অসংখ্য ছোট ছোট অধ্যায় সৃষ্টি করেই এই অঞ্চলের মানুষ অসাধারণ ঐক্য আর দৃঢ়তার শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাই এটি শুধু বিয়ে নয়, এটি তার থেকেও অনেক বেশি।

এই বিয়েতে আমরা উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলাম খুবই। কিন্তু প্রশাসনের আপত্তির কারণে আর তাদের নানা অতি সতর্কতায় বিয়েতে জটিলতার সৃষ্টির আশংকায় আর যাইনি। পরে ছবি দেখেছি। এক ভাঙা ঘরের সামনে প্রায় কিশোরী মেয়ে জবারাণীর নতুন জীবন শুরুর ছবি।

জবারাণীর বাবা বিজয় আর মা ডালিমাবালার সংসার কখনোই স্বছল ছিল না। মেয়ের বিয়ে দেয়ার বোঝা বহন করা তো দূরের কথা মেয়ের খাওয়া পরার ন্যূনতম চাহিদা পূরণও তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়নি। দিন মজুরিই বিজয়ের পেশা। এই পেশায় কোন নিশ্চয়তা থাকে না। সবসময় কাজও থাকে না। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতো বিজয়ের জীবনও তাই অনিশ্চয়তাতেই কাটে বছরের বেশিরভাগ সময়। সরকারি দলিলপত্র বছরের পর বছর দেখায় বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের আয় বেড়েছে, তাদের দারিদ্র কমেছে, এসব খবরের কোন চিহ্ন বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের গায়ে নেই। তাদের সবসময়ই বাস করতে হয় শীর্ণ সুতার উপর। একটু অসুস্থতা, কদিনের কাজের সংকট, দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি সবকিছুই তাদের জন্য বড় ঝড় হয়ে আসে। আর যদি সত্যিই ঝড় আসে, আসে বন্যা তাহলে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে হয়।

এখন তো আমরা দেখছি স্বল্পস্থায়ী বন্যার পরেই কীভাবে সেই ভেসে যাওয়া মানুষেরা ঢাকা শহরে আসছে। নারী-পুরুষ শিশুবৃদ্ধ, এক একটি দলে জড়োসড়ো হয়ে। তাদের সহায়ম্বল টানার তেমন ঝামেলা নেই, একটা পোটলার মধ্যেই সব এটে যায়। এক কোলে শিশু আর এক কোলে পোটলা। মুখে ত্রস্তভাব। কোথায় যে পরিণতি তা কেউ বলতে পারে না। কাজ ঢাকাতেই বা কোথায়? ঢাকায় তাদের শোবার জায়গাই বা কোথায়? এতবড় ঢাকা শহর। এদিক সেদিক তাকিয়ে তাদের বসে যেতে হবে কোথাও। পুলিশের তাড়া শুরু হবে অচিরেই। শহর পরিচ্ছন্ন রাখতে গিয়ে ফুটপাত, রেলধার থেকে উচ্ছেদ হবে তারা। পরিবার ভেঙ্গে তছনছ হবে। বাবা মা ছেলে মেয়ে কে কোথায় যাবে তার হদিস থাকবে না। কেউ পাচার হবে, কেউ পঙ্গু হবে, কেউ ভাসমানই জীবন কাটাবে। জাকজমকপূর্ণ দারিদ্র বিমোচনের উৎসব, প্রতিশ্র“তি আর বরাদ্দ বৃদ্ধির উর্ধ্বরেখা এদের এই জীবন প্রবাহে টোকাও দিতে পারবে না।

এরকম আরও লক্ষ মানুষের স্রোত ঢাকা শহরের দিকে আমরা আসতে দেখতাম যদি বিজয়ের মতো নিঃস্ব মানুষেরা ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প রুখে না দাড়াঁতেন। শুধু ফুলবাড়ী অঞ্চল নয়, মরুকরণ, মাটিধ্বস আর পানিদূষণের কারণে পুরো উত্তরবঙ্গ থেকেই উঠে আসতে হতো আরও কয়েক লক্ষ মানুষের। এরকম রুখে দাড়াঁতে আতœমর্যাদা লাগে, গুলি খাওয়া প্রদীপের ভাষায় ‘ইজ্জত লাগে’। আর লাগে নিজের সঙ্গে অন্য আরও অনেকের যোগ বোঝার ক্ষমতা। যে ৭০/৮০ হাজার গরীব মানুষ ২৬ আগষ্ট ইজ্জত নিয়ে নিজেদের জীবন জীবিকা, ভুমি, গাছপালা তরুলতা, পুকুর খাল নদীনালা, পশুপাখি, ঘরবাড়ি আর মাটির নীচের সম্পদ রক্ষায় বুক পেতে দাঁড়িয়েছিলেন তাদের সেই ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। সেই কারণে এখনও তারা নিজেদের মত গাছ পাতা ক্ষেতখামার নদীনালার মধ্যে থাকতে পারছেন। উন্মুল মানুষের স্রোতে যোগ দিতে হয়নি। এই ক্ষমতা নষ্ট করতে চেষ্টা এশিয়া এনার্জি কম চেষ্টা করেনি। বিজয় আর ডালিমাবালা তার স্বাক্ষর, তার প্রতিরোধের চিহ্ন। ওর সাথেই সেই বিয়ের কাহিনীর কথা।

মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করবার কৌশল হল তার দুর্বল জায়গা খুঁজে বের করা আর সেখানে আঘাত করা। বিজয়ের দুর্বল জায়গায় ছিল তার মেয়ে। আমাদের বিবেচনায় মেয়ের বিয়ের বয়স তখনও হয়নি। কিন্তু গ্রামে সেই মেয়ের বিয়ে নিয়েই তখন অনেক কথা, ‘মেয়ের বিয়ের বয়স পার হয়ে গেল। এখনও কেন দাও না? পরে আর ছেলে কোথায় পাবা?’ বিজয় কথা বলে না কিন্তু চিন্তা বাড়ে। মেয়ের বিয়ে যে সে ভাবে দিলেও পণ লাগবে। কোথায় পাবে সে টাকা? এমনিতেই তো ঋণ। এমন তো নয় যে, মেয়ের পড়াশোনা চালানো যাচ্ছে। বা সহায়সম্বল অনেক আছে, মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তা নেই।

এসব খবরাখবরের উপরই একদিন এলো এশিয়া এনার্জি বা কোম্পানির লোক। ভাঙাঘরের সামনে নানাকিছু জোড়াতালি দিতে তখন ব্যস্ত বিজয়। এসে বলে,
‘ কি গো, মেয়ের বিয়া দিবা না? ’
‘ দিব তো, মুখের কথায় তো হবে না।’ তিক্ত কন্ঠে বলে বিজয়।
‘ কোম্পানি তো তোমার কথা খুব ভাবে।’
‘ মানে? ’
‘ মানে আর কী? তোমার মেয়ের বিয়ে দিবা। আর ঘরটা ঠিক না করলেও তো চলে না। সে ব্যবস্থা করবে কোম্পানিই।’
‘ পরিস্কার করে বলো।’
‘ শোন তবে। কোম্পানি তোমার জন্য ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছে। ২০ হাজার টাকা আজকেই পাবা। লোক দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে একটু দূরে। বাকি টাকা পাবা পরে।’ ৬০ হাজার টাকা বিজয়ের জন্য অনেক টাকা। এই টাকা সারাজীবনেও তার পক্ষে জমানো সম্ভব না। কয়েক বছরের মোট আয়ের চাইতেও বেশি এই টাকা। অথচ এই টাকা এমনি এমনি পাওয়া যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে দেওয়া আর ঘর ঠিক করা দুটো জরুরী কাজ হয়ে যায়। আর কোন পথই তো খোলা নেই।

হাতের কাজে আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে গেল বিজয়। কয়েক মিনিট গেলো চুপচাপ। কোম্পানির লোক উৎসাহিত হয়ে বলে:
‘ জীবনে সুযোগ দুইবার আসে না। এরকম সুযোগ আসে, বল?’
বিজয়ের গলা উঠতে গিয়েও নামে। বলে,
‘ তা কী করতে হবে আমার এর বদলে? ’
কোম্পানির লোক হাঁফ ছেড়ে বাঁচে । বলে,
‘ তেমন কিছুই না। মিছিল টিছিলে যাওয়া বন্ধ করবার দরকার নাই। বন্ধ করলে আবার নানা কথা উঠবে। মিটিং এও যাও, তবে অত বেশি যাওয়ার দরকার নাই। আর মানুষ জনরে জড়ো করবার এত কাজ তোমার নেওয়ার দরকার কী? সেটা আর করো না। আর মিটিং টিটিং এর খবর টবর একটু দিবা। এই তো।’
আরও কয়েক মিনিট যায়। ঘরের বেড়ায় গুনা বাধাঁর কাজে বিজয়ের হাত একটু জোরে জোরে চলতে থাকে। তারপর তা থামে । বিজয় মুখ তুলে বলে, ‘বাড়ির উঠানে এসব কথা বললা। তোমারে যা করার দরকার তা করতে পারলাম না। এবার তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আমার মাথা কখন কী হয় বলতে পারি না।’

কোম্পানির লোক কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করে। উঠে পড়বে নাকি আরেকবার বোঝাবে তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে কিছু বলতে যেতেই ভাঙা ঘরের ওপার থেকে রণমূর্তি নিয়ে ছুটে আসে বিজয়ের বউ ডালিমাবালা। হাতে ঝাটা, মাটির দিকে নয় আকাশমুখি থেকে কোম্পানিমুখি হচ্ছে।

বিজয়ের মতো ঠান্ডাভাবে নয়, চিৎকার তখন ডালিমার কন্ঠে, ক্রোধ শরীরের গতিতে।
‘ ঐ গোলামের পুত গোলাম। নিজে গোলাম হইছস আমাদেরও গোলাম বানাতে চাস। বাইর হ । বাইর হ।’
আর দ্বিধা থাকে না কোম্পানির। ছুটে বের হয়ে যায়। সেই যে কোম্পানির লোক তাড়া খেল, তা আর থামলো না, একবারে ২৭ আগষ্ট গভীর রাতে পুরো কোম্পানিই এলাকা থেকে পালাল।

এরকম ঘটনা ফুলবাড়ী অঞ্চলে আরও অনেক ঘটেছে। হামিদপুর ইউনিয়নের একজন ছোট ব্যবসায়ী ৫ লাখ টাকার ব্যবসা প্রত্যাখ্যান করে নিজের পুঁজি ভেঙে টাকা খরচ করেছেন আন্দোলনের সময়, এরকমও আছে।

সেই মেয়ের বিয়ে নিয়ে বিজয়ের তখন আর চিন্তা করবার ফুরসুৎ মেলেনি। কারণ এই ঘটনার পর তার দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। তার কাছে পরিষ্কার হয় যে, কোম্পানির মতলব খুব খারাপ, যে কোন সময় সবকিছু দখল করে নিতে পারে। দালাল তৈরির চেষ্টা সফল হলে তো সর্বনাশ। লোক জড়ো করা, মিছিল মিটিং করা এসব কাজে বিজয়ের সময় বেড়ে গেলো অনেক। ঘরে খাবার নেই। তারপরও ডালিমাবালা জবারাণীও বিজয়ের সাথে কাজে নেমে পড়ে।

এসময়ে এশিয়া এনার্জি এলাকায় বিশ্বকাপ ফুটবল দেখার জন্য রঙিন টিভি দিতে থাকে। গোটা ৩৫টি দেবার পর যে টিভিছাড়া মানুষদের আগ্রহভরে টিভি নেবার কথা তারাই পন্ড করে দিয়েছে এই ‘দয়ার’ কার্যক্রম। ২৬ আগষ্টে কোম্পানি বিরোধী জমায়েতে গুলির পর থামার বদলে আন্দোলন যখন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয় তখন এই অঞ্চলের মানুষ দালাল বলে পরিচিত ব্যক্তিদের বাসা থেকে এই টিভিগুলো বের করেন। ঘৃণা এতটাই যে, কোন গরীব মানুষ যাদের জীবনেও এরকম রঙীন টিভি কেনার সাধ্য হবে না তারা কেউই এই টিভি ঘরে নেবার বিন্দুপরিমাণ আগ্রহ দেখায়নি, বরঞ্চ সেগুলো সব টুকরো টুকরো ভেঙেছে।

কোথা থেকে বিজয় ডালিমাবালার মতো ‘গরীব’ মানুষদের এই তেজ আসে? দূর্বল অনাহারী শরীরের মানুষেরা কী করে এক বছরে যা তাদের আয় করা সম্ভব তার কয়েকগুন বেশি অর্থ থু থু মেরে ঝাটা মেরে উড়িয়ে দিতে পারে? ব্যাখ্যা একটাই, ইজ্জতের বোধ। তাহলে শহরে, এই রাজধানী ঢাকায় যাদের সহায়সম্বল আছে, অনেক টাকা পয়সা আছে, কনসালট্যান্ট সাংবাদিক আমলা আইনজীবী মন্ত্রী, তাদের কাউকে কাউকে যে নানাজাতের কোম্পানি নাকে দড়ি দিয়ে অপকর্মে ব্যবহার করে, তারা যে বলে ‘আমাদেরও তো খেয়ে পড়ে বাঁচতে হবে’ তাদের ইজ্জতের বোধ কোথায় গেল? ফুলবাড়ী গণঅভ্যুত্থান এই প্রশ্নটাই হাজির করে সবার সামনে, ঘৃণা আর ধিক্কার ছুঁড়ে দেয় বেইজ্জৎ ‘ভদ্রলোক’দের উদ্দেশ্যে।

সেই জবারাণীর বিয়ে হল সহযোদ্ধাদের সমর্থনে কোম্পানিমুক্ত পরিবেশে গত জুন মাসে। ঘর এখনও ভাঙা। কিন্তু সেই ঘর ছাপিয়ে বিজয় ডালিমাবালা জবারাণী অনেক উপরে।

২৬ আগষ্ট ২০০৭