ফুটপাতে শিক্ষকেরা

f9f1617afec7a6b6a5695db36d84ef60 1অধ্যাপক আসহাবউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের বড় শহরগুলোর ফুটপাতে অসংখ্য মানুষের রাত কাটানোর দৃশ্য বর্ণনা করে বলেছিলেন, ‘যেখানে মানুষ শুয়ে থাকে, ঘুমায়, সে স্থানকে আমরা কী করে ফুটপাত বলি? এগুলোর নাম হওয়া উচিত হেডপাত।’ আসহাবউদ্দীন শিক্ষক ছিলেন, বেঁচে থাকলে দেখতেন, এখন ঢাকা শহরে শিক্ষকেরাও ফুটপাতকে হেডপাত বানিয়েছেন, মাথা পেতে দিয়ে থাকছেন সেখানেই। অভুক্ত, অপমানিত।

১৮ দিন ধরে ঢাকা শহরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক শ শিক্ষক রাস্তায় অবস্থান করছেন বহু বছরের খুবই যুক্তিসংগত দাবি নিয়ে। কিন্তু এখনো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া তাঁরা পাননি। গত ২৬ অক্টোবর এই শিক্ষকেরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁদের অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। চার দিন অবস্থান করেও কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা ৩০ অক্টোবর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনশন কর্মসূচি শুরু করেন। ৪ নভেম্বর অনশন স্থগিত করে সেখানে এখন লাগাতার অবস্থান কর্মসূচিতে আছেন।
কর্মসূচি খুবই শান্তিপূর্ণ বলেই হয়তো সংবাদমাধ্যমেরও যথাযথ মনোযোগ পাচ্ছেন না তাঁরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় যে ভবনে, সেই সচিবালয়ের পাশে প্রেসক্লাবের সামনে ফুটপাতেই ১৬ দিন ধরে দিনরাত কাটাচ্ছেন আট হাজারেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় এক লাখ শিক্ষকের প্রতিনিধি কয়েক শ মানুষ, যুবক, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ। তাঁরা শিক্ষক। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার। তাঁদের প্রতিষ্ঠান সরকারের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, সরকার তাঁদের দিয়ে নির্বাচন, শুমারি, নানা জরিপ সবই করায়। এখানে নিয়মিত ক্লাস হয়; প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি সব পরীক্ষা হয়। শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষকদের কাছ থেকে শিক্ষা অর্জন করে উচ্চতর শিক্ষায় যায়। চাকরি পেয়ে শিক্ষককে পায়ে ধরে সালাম করে, মিষ্টি খাওয়ায়। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে এত সব দায়িত্ব পালন করার পরও মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সরকারের কাছ থেকে তাঁদের বেতন আসে না। আসে না বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা।

এগুলো ছাড়াই এই শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে থাকেন, অন্য সব কাজ করেন বছরের পর বছর। কীভাবে সম্ভব? এক শিক্ষক কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘ঘরে খাওয়ার জোগান দিতে পারি না, নিজেও অনেক সময় না খেয়ে থাকি। সবাই বলেন, ছেড়ে দাও এই কাজ। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি, ছেড়ে দিয়ে নাহয় রিকশা চালাই, মাটি কাটি, তাও তো খেতে পারবে দুই বেলা। কিন্তু গ্রামের ভেতরে যখন হাঁটি, ছেলেমেয়েরা সালাম দেয়, নানা কিছু জিজ্ঞাসা করে, পাস করে মুখে হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়ায়। বুকটা ভরে যায়। আর ছাড়তে পারি না।’ ঠিকই, একজন শিক্ষকের জন্য এটাই তো বড় তৃপ্তি, বড় পাওয়া। শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের আগ্রহ, উৎসাহ, সাফল্য যে একজন শিক্ষকের জন্য কত বড় প্রেরণা আর আনন্দের বিষয়, তা নিজের শিক্ষকজীবন থেকে বুঝি। এর কোনো তুলনা হয় না। শিক্ষকতা ছাড়া আর কোনো কিছু দিয়েই তা পাওয়া সম্ভব নয়।
কিন্তু শিক্ষকদের তো বেঁচে থাকতে হয়, তাঁদের ওপরও নির্ভর করে থাকে আরও কিছু মানুষ। সন্তান, পিতামাতা, স্ত্রী/স্বামী, আত্মীয়স্বজন। সে জন্য বেতন দরকার হয়। একজন শিক্ষক যেমন বললেন, ‘মেয়েটা ক্লাস সিক্সে পড়ে। এত দিন ধরে ওদের ছেড়ে আছি, ওরা কীভাবে চলছে তাও জানি না। মেয়ে ফোনে আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলে, চলে আসো বাবা। ঢাকার লোক ভালো না। ওরা কিছু দেবে না।’

শিক্ষকদের কাছেই শুনলাম কেউ কেউ দিনমজুরির কাজ নিয়েছেন অনাহার থেকে পরিবারকে বাঁচাতে। বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পর্যায়ের বহু শিক্ষক এই বেদনাতেই দিনরাত পার করেন। এমনিতে শিক্ষকদের বেতন সুযোগ-সুবিধা বিশ্বের অন্য সব দেশের তুলনায় কম। আর তাঁদের মধ্যেও নিরাশ্রয় এই বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল বেসরকারি উদ্যোগে। কেউ হয়তো জমি দিয়েছেন, কেউ টাকা দিয়েছেন, কেউ হয়তো সরকারি অনুমোদন এনে দিয়েছেন। কিন্তু সরকারি স্বীকৃতি পেলেই তো হয় না। গ্রামগঞ্জের এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে উচ্চবেতন নেওয়াও সম্ভব হয় না, তার ফলে তাঁদের তাকাতে হয় সরকারের দিকে।

বেতন নিশ্চিত করতে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিওভুক্ত করার দাবি নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই শিক্ষকেরা ঢাকায় এর আগে এসেছিলেন ২০১৩ সালে। পুলিশের লাঠি, স্প্রে, মরিচের গুঁড়া—সবই প্রয়োগ করা হয়েছে এই অভুক্ত শিক্ষকদের ওপর। শিক্ষামন্ত্রী তিন মাসের মধ্যে সব দাবি মেনে নেবেন বলেছিলেন, সেই আশা নিয়ে শিক্ষকেরা আবার ক্লাসে ফিরেছিলেন, কিন্তু এত দিনেও সেই দাবি পূরণ হয়নি। শিক্ষামন্ত্রীর কথার এমনই দাম! কয়েক শ কোটি টাকা হলে সব শিক্ষকের ন্যূনতম দাবি পূরণ হয়, সরকার তাঁদের শ্রম নেবে কিন্তু বেতন দেবে না। কারণ, ‘সরকারের টাকা নেই’! বটেই তো, কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হলে যদি অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কোনো ব্যাপারই না’, তিনি কী করে বহু লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষকদের পাওনা কয়েক শ কোটি টাকা খুঁজে পাবেন!!

উল্লেখ্য, বর্তমানে ২৮ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক তাঁদের মূল বেতনের শতভাগ সরকার থেকে পাচ্ছেন। সরকারি ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থাও যে খুব সম্মানজনক তা নয়। কম হলেও বেতন তাঁরা পান, তবে অবসর গ্রহণের পর তাঁদের দুনিয়া আন্ধার হয়ে যায়। অবসর ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ডসহ যা কিছু তাঁদের জীবনে শেষ পর্যায়ে প্রধান অবলম্বন, সেগুলো অধরা হয়ে যায়। তাঁদেরই টাকা তহবিলে জমা হওয়ার পর সরকার এখানেও বলে ‘টাকা নেই’। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর শিক্ষকেরা ঘুরতে থাকেন, শরীর চলে না, তাও এসে শিক্ষা ভবনে মাথা পেতে দিতে হয়। আমলা-কর্মচারীরা তাঁদের ভিক্ষুক গণ্য করেন, দূর দূর করেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, শিক্ষকদের মর্যাদা সবার ওপরে। কিন্তু শিক্ষকদের পাওনা টাকা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।

সরকারের নিজের টাকা বলে তো কিছু নেই, সবই তো জনগণের টাকা। জনগণের স্বার্থে বিশেষত শিক্ষার কাজে সরকার জনগণের টাকা খরচ করবে না কেন? নিজেদের বিলাসিতা আর কিছু গোষ্ঠীর বিত্তগঠনে কেন জনগণের টাকা শেষ হবে? গত ২৯ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষা বাজেট বাড়ানো ছাড়া এমপিও ব্যবস্থায় নতুন স্কুল অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা বাজেটের অজুহাত দিচ্ছেন, যা বছরের পর বছর অনেক নিম্ন মাত্রায় আটকে আছে। জাতিসংঘের সুপারিশ অনুসারে বাংলাদেশে শিক্ষা বাজেট প্রয়োজনের নিরিখে তিন ভাগের একভাগ। অর্থাৎ শিক্ষা বাজেট আরও অনেক বৃদ্ধি খুবই যৌক্তিক। অথচ এ বছর অনুপাত আরও কমেছে।

আমরা প্রতিবছর দেখি, বাজেটের শৃঙ্খলা ভেঙে সরকার অনেক কিছুই করছে। বাজেটের পরে ভ্যাটসহ নতুন কর বসায়, প্রত্যাহার করে; উন্নয়ন বাজেট বাড়ায়-কমায়। এ ছাড়া ঋণ মওকুফ বা বিলোপ করে হাজার হাজার কোটি টাকা অদৃশ্য করে দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ফ্লাইওভার দুই হাজার কোটি থেকে ছয় হাজার কোটি টাকায় পৌঁছে যায়, রূপপুর প্রকল্পের ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে পাঁচ গুণ বেড়ে লাখ কোটি টাকায় দাঁড়ায়, সব প্রকল্পে ভূতের জোগান দিতে হাজার লাখ কোটি টাকা গায়েব হয়ে যায়। কেবল কিংবা সেই কারণেই জনস্বার্থের কাজে, শিক্ষকদের দাবি ও পাওনা পরিশোধে কয়েক শ কোটি টাকার সংস্থান হয় না।
মন্ত্রী, এমপি, আমলাসহ যাঁরা সরকার চালান, যাঁরা দেশের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা সবাই শিক্ষাজীবন পার করেছেন। তাঁরা আর কত দিন শিক্ষকদের অপমান করেন কিংবা তা সহ্য করেন, সেটাই কি আমাদের দেখতে হবে?

(লেখাটি ১৩ নভেম্বর ২০১৫ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)