(প্রথম আলো বর্ষসেরা বই: ১৪২১-এর মননশীল শাখায় এবার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর গবেষণাগ্রন্থ জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি: ১৯০৫-৪৭ ও সৃজনশীল শাখায় পুরস্কার পেয়েছে ইমতিয়ার শামীমের গল্প সংকলন শীতের জোৎস্নাজ্বলা বৃষ্টিরাতে। আজ বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হবে এই পুরস্কার)
ইতিহাস মানে কিছু তারিখ নয়, ইতিহাস মানে স্থির অপরিবর্তনীয় ঘটনা আর চরিত্রও নয়। সে কারণেই একটি নির্দিষ্ট সময়ের ‘ইতিহাস’ এক জায়গায় আটকে থাকে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, বর্তমান সময়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, পুরোনো কাল, পাত্র-পাত্রীর চেহারাও নতুন নতুনভাবে নির্মিত হতে থাকে। মানুষ বর্তমানে দাঁড়িয়েই তার অতীতকে বিশ্লেষণ করে। অতীত তাই বর্তমানের জ্ঞান, মতাদর্শ, ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান দ্বারা সজ্জিত হয়।
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে লেখা, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি: ১৯০৫-৪৭ ইতিহাসের উপাদানে সাজানো হলেও তাই প্রথাগত ইতিহাসগ্রন্থ নয়। ১৯০৫ ও ১৯৪৭—এই দুই পর্বের বঙ্গভঙ্গের মধ্যবর্তী সময়কালের ঘটনাবলির বিকাশধারা এবং এই সময়ের রাজনৈতিক নেতা, লেখক, চিন্তাবিদদের ভূমিকার ওপর বিশদ পর্যালোচনা দিয়ে সমৃদ্ধ এই বই। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, হিন্দু মহাসভা, কমিউনিস্ট পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপ; গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, সুভাষ, মাওলানা আজাদ, ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, শরৎ বসু, হবীবুল্লাহ বাহার, মাওলানা আকরাম খাঁসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সংগঠক; বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ইকবাল, শরৎচন্দ্র, মীর মোশাররফসহ বিভিন্ন লেখক-শিল্পীর কাজের পর্যালোচনা বইটিকে একটি সামগ্রিক রূপ দিয়েছে। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন সংবাদপত্র, সাময়িকীর প্রসঙ্গ।
আমাদের এই অঞ্চলে ভক্তির আতিশয্য একটু বেশি, ফলে কোনো ব্যক্তি যদি শ্রদ্ধা অর্জনের মতো কিছু করেন তাহলে তাঁকে দেবতার আসনে বসানোর প্রবণতা থাকে, কারও কাজে যদি সমালোচনা থাকে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে শয়তানের জায়গায় নামানো হয়। বিশেষণের রক্ষাব্যূহ তৈরি করে ব্যক্তিকে সবরকম পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে রাখার চর্চার কারণে ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায় ইচ্ছাপূরণের গল্প। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এই গল্প-ফাঁদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার বিষয়ে বরাবর সচেতন থেকেছেন এই বইয়ে। সে জন্য আলোচ্য বইটিতে মহাত্মা, দেশবন্ধু, নেতাজি, শেরেবাংলা, পণ্ডিত ইত্যাদি বিশেষণের আড়ালে কেউ ঢাকা পড়েননি। সাদা ও কালো বিভাজন নয়, শুধু প্রশস্তি বা নিন্দা নয়, নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে বিভিন্নজনের কথা ও কাজ, ভূমিকার স্ববিরোধিতা, ভ্রান্তি, সুবিধাবাদিতা, সাহসিকতা ইত্যাদি তাই তথ্য-যুক্তি বিশ্লেষণ আকারে হাজির হয়েছে।
আট শ পৃষ্ঠার এই বইয়ে প্রারম্ভিক ও উপসংহার ছাড়া মোট ১৪টি পরিচ্ছেদ বা অধ্যায় আছে। এগুলো হলো: ‘বঙ্গভঙ্গ এবং তারপর’, ‘জাতীয়তাবাদের ধারণা ও প্রবণতা’, ‘গান্ধীর চিন্তা ও ভূমিকা’, ‘জিন্নাহ, দ্বিজাতি তত্ত্ব এবং সংখ্যালঘুর ভাগ্য’, ‘দেশভাঙার তৎপরতা ও দায়দায়িত্ব’, ‘স্বাধীনতা বনাম ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন’, ‘সুভাষ বসুর রাজনীতি এবং জাতীয়তাবাদের সীমা’, ‘তিনদল, আবার একদলও’, ‘দেশভাগের প্রক্রিয়া’, ‘ইতিহাসের কৌতুক এবং পরাজিতের স্বাধীনতা’, ‘বাংলাভাগ’, ‘মঞ্চে, মঞ্চের পেছনে এবং বাইরে’, এবং ‘জনগণের মুক্তির প্রশ্ন’।
১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ করে আসামসহ পূর্ববঙ্গকে একটি ইউনিট ঘোষণা করা হয়েছিল, যার রাজধানী ঢাকা; পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা মিলে আরেকটি ইউনিট তার রাজধানী কলকাতা। এই বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্যোগী ছিলেন লর্ড কার্জন। একটি চিঠিতে তাঁর অতি আগ্রহের কারণ স্পষ্ট হয়, ‘১৯০৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যাওয়ার পথে ট্রেনে বসে কার্জন ভারত সচিবকে এই চিঠি লেখেন’। গ্রন্থকার চিঠিটির অনুবাদ করেছেন। চিঠিতে কার্জন লিখছেন, ‘বাঙালিরা, নিজেদেরকে যারা একটি জাতি বলে ভাবতে পছন্দ করে, এবং যারা এমন একটি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যখন ইংরেজদেরকে বিদায় করে দিয়ে কলকাতার গভর্ণমেন্ট হাউজে একজন বাঙালি বাবুকে অধিষ্ঠিত করবে…। আমরা যদি তাদের হৈচৈ-এর কাছে নতি স্বীকার করার মতো দুর্বলতা প্রকাশ করি, তাহলে আগামীতে বাংলাকে কখনোই খণ্ডিত বা দুর্বল করতে পারব না, এবং ভারতের পূর্বপার্শ্বে আপনি এমন একটি শক্তিকে সংযুক্ত ও দৃঢ় করবেন যেটি ইতিমধ্যেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতে তা ক্রমবর্ধমান গোলযোগের নিশ্চিত উৎস হয়ে দাঁড়াবে।’ (পৃ. ১৫)
তবে একই ঘটনার বিবিধ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। বাঙালি সমাজের মধ্যেই সে সময় এর পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান তৈরি হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের কারণে কলকাতাকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, ওকালতি, প্রকাশনা ও বিদ্যাচর্চা—সবই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। সে জন্য বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল কলকাতা। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের ফলে দীর্ঘদিন পর ঢাকা চাঙা হয়ে উঠেছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, আইন–আদালত ও প্রশাসনিক তৎপরতা বাড়ে, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটে। এ কারণে ঢাকা থেকেই এই বঙ্গভঙ্গ বেশি সমর্থন পায়। এই সমর্থন আসে প্রধানত ঢাকাকেন্দ্রিক নবাব, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে।
আন্দোলনের প্রবল চাপে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ১৯১১ সালে। কিন্তু একবার ভঙ্গ একবার রদ—এর মধ্যবর্তী ঘটনাবলির মধ্যে বাংলার মানুষের মধ্যকার চাপা থাকা বিরোধ প্রকাশ্য হয়ে পড়ে। ভারতের বিভিন্ন ধর্ম ও জাতি, বিভিন্ন শ্রেণির সব বিরোধ একদিকে হিন্দু ও অন্যদিকে মুসলমান—এইভাবে কেন্দ্রীভূত হয়। সাম্প্রদায়িকতা হয়ে দাঁড়ায় রাজনীতির প্রধান পরিচালিকা শক্তি, জাতীয়তাবাদী রাজনীতি অধীনস্থ হয় প্রকাশ্য বা প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িকতার। যে সমাজ ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল, ১৯৪৭ সালে তার বৃহৎ অংশ বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই দাঁড়িয়েছিল।ভারতে ব্রিটিশবিরোধী জাতীয় আন্দোলনে বিলাত-শিক্ষিত রাজনীতিবিদদেরই প্রাধান্য ছিল। শীর্ষ পর্যায়ে ছিলেন গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, সুভাষ। এঁরা সবাই কংগ্রেস দিয়েই রাজনীতি শুরু করেন; কিন্তু রাজনীতি, মতাদর্শিক অবস্থান, কর্মসূচি, কাজের ধরনে পার্থক্য থেকে একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যান। গান্ধী রামরাজ্য লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছিলেন। নেহরুর অবস্থান ভিন্ন ছিল, তবে ‘মতপার্থক্য সত্ত্বেও নেহরু গান্ধীকে ছাড়তে পারেননি। নেহরু গান্ধীর রাজনীতির সমালোচনা করেছেন, তবে সেটা প্রকাশ্যে নয়, গান্ধীর কাছে পত্র লিখে।’ অন্যদিকে সুভাষ গান্ধীর সমালোচনা করেছেন প্রকাশ্যে, সর্বোপরি কংগ্রেসের সভাপতি হয়ে তিনি বললেন সমাজের বৈপ্লবিক পুনর্গঠনের কথা। বললেন, ‘ভূমিব্যবস্থার সংস্কার এবং জমিদারি প্রথার উচ্ছেদের’ কথা। (পৃ. ৩৯০) গান্ধীর সমর্থন পাননি সুভাষ, তৈরি করেছেন নিজের বিদ্রোহী ট্র্যাজিক চরিত্র।
রুশ বিপ্লবের বহুমুখী প্রভাব বইটির নানা চরিত্র বিশ্লেষণের মধ্যে পাওয়া যায়। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট সরকারকে বলশেভিকবাদের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছে। সে জন্য ‘ব্রিটিশ আমলারা কংগ্রেসের ভয়ে ততটা ভীত ছিল না যতটা উৎকণ্ঠিত ছিল বলশেভিক প্রভাবের সম্ভাব্য বিস্তার নিয়ে। আর সে জন্যই খুবই ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টিকে তার যাত্রা শুরুর মুহূর্ত ১৯২০ সাল থেকেই নানা রকম নিপীড়নের মুখে পড়তে হয়েছে।’ (পৃ. ১১৩)। নিপীড়ন আর তার সঙ্গে নিজেদের আত্মঘাতী ভ্রান্তি দুর্বল করে দিয়েছে জনপন্থী রাজনীতির ভিত্তি।
সব গণতান্ত্রিক, সমাজবাদী, কল্যাণকামী চিন্তা ও তৎপরতাকে পরাজিত করে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, বিদ্বেষ ও রক্তক্ষয়ের ওপর দাঁড়িয়েই বাংলা, পাঞ্জাব ও কাশ্মীরকে ক্ষতবিক্ষত করে ভারত ভাগ হয়। এর জন্য শুধু মুসলিম লীগ এবং জিন্নাহ নন, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার দায়িত্বও যে অনেক তার বহু তথ্যপ্রমাণ-সংবলিত লেখালেখি ক্রমেই সুলভ হচ্ছে। বিজয়ের নামে ‘পরাজিতের মানসিকতা’ নিয়ে সবাই ‘স্বাধীনতা’ গ্রহণ করেছেন। কারণ ‘গান্ধী, জিন্নাহ, নেহরু—কারও পক্ষেই প্রসন্ন হওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁরা বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিলেন মাত্র।’ শুধু প্রসন্ন ও নিরাপদ ছিল ব্রিটিশরা।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একে আখ্যায়িত করেছেন ‘ইতিহাসের কৌতুক’ বলে। লেখক আরও জানিয়েছেন, ‘মাওলানা আবুল কালাম আজাদ পরাজিতের মানসিকতা পরিহার করে একটি ফেডারেল কাঠামোর মধ্যে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা স্থাপনের ভেতর দিয়ে ভারতবর্ষকে বিভাজনের সর্বনাশা পথ পরিহারের জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন ১৯৪৬-এর ১৫ এপ্রিল প্রদত্ত একটি বিবৃতিতে। অপরদিকে অখণ্ড হিন্দুস্তানের বিরোধী বাংলার আবুল হাশিম যখন দেখলেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বাংলা ভাগ হয়ে যাচ্ছে তখন তিনিও, মাওলানার বিবৃতির এক বছর পরে প্রদত্ত এক জরুরি বিবৃতিতে পরাজিতের মানসিকতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বাংলাকে স্বাধীন ও অখণ্ড রাখার জন্য সকল বাঙালির প্রতি আকুল আবেদন জানান।’ (পৃ. ৪৯১)। লাভ হয়নি কোনো। এসব কথা শোনার মতো পরিস্থিতি ছিল না তখন।
লেখক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঠিকই ‘১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়কাল’ অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং ‘বিভিন্ন রকমের প্রবণতা’, ‘দ্বন্দ্ব এবং স্ববিরোধিতা’য় পূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটির পক্ষে একই সঙ্গে পুঁজিবাদবিরোধী ও সামন্তবাদবিরোধী হওয়া দরকার ছিল, হয়নি বলে সে লড়াই জনমুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি।’ (পৃ. ৮০০)। কেন পারেনি তার অনুসন্ধান চেষ্টাই জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি: ১৯০৫-৪৭ শিরোনামের এই গ্রন্থের মূল মনোযোগের বিষয়।
[লেখাটি ১৫ জানুয়ারী ২০১৬ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত]