নির্বাচন স্বচ্ছ না হলে আগামী রাজনীতি আরো সহিংস হবে

সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনেক বিলম্বিত নির্বাচন। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ হলো ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঝুলে ছিল। অনেকবারই নির্বাচন করার পরিকল্পনা হয়েছে; কিন্তু সরকারের উৎসাহ না থাকায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সিটি করপোরেশন নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এখন আকস্মিকভাবে সরকার নির্বাচনের ঘোষণা দিলে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উৎসাহ দেখা দেয়। তবে নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে এসেছে, ততই নানা অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটছে। এসব অস্বস্তিকর ঘটনার বিপরীতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা সন্তোষজনক নয়। সবার আস্থা অর্জনের জন্য যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনের যে দৃঢ়তা, তার কোনোটাই দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের নির্বাচনে বরাবরই কিছু সমস্যা থাকে। সেটা জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় নির্বাচন- দুই ক্ষেত্রেই। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে প্রধান সমস্যাই হলো নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ। নির্বাচনের যেসব বিধিমালা, প্রার্থীদের ব্যয়সীমা, আচরণবিধি, নিয়মকানুন আছে- সাধারণভাবেই এ নিয়মগুলোর মধ্যে অনেক ফাঁকফোকর আছে। এর পরও নির্বাচনী যে নিয়মাবলি নির্বাচন কমিশনের আছে, তা পালন করার জন্য যথাযথ তদারকি, দৃঢ়তা নির্বাচন কমিশনের নেই। এ ছাড়া বাংলাদেশের নির্বাচনে চোরাই টাকা, সন্ত্রাস, অপপ্রচার, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি চিহ্নিত করা ও যথাযথভাবে তা মোকাবিলা করার মতো অবস্থা নির্বাচন কমিশনের নেই। সরকার বা যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের অগ্রাহ্য করে নিজের ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করা, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা- সাধারণভাবে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনোটাই সম্ভব হয় না। এসব দুর্বলতা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা বা চট্টগ্রাম মহানগরে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচিত হবেন, তাঁদের কাছে জনগণের আশা থাকলে তাঁরা তার কতটুকু পূরণ করতে পারবেন! করতে না পারার বা দুর্বলতার অনেক কারণ আছে। প্রকৃতপক্ষে এখনো বাংলাদেশে কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনে নানা প্রতিশ্রুতির কথা আমরা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমরা জানি, সিটি করপোরেশন বা মেয়রের ক্ষমতা ও এখতিয়ার সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারও খুবই কেন্দ্রীভূত রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতার হাতে জিম্মি। এ রকম কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা কাঠামোর কারণে কোনো পর্যায়েই প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে বিশাল এ ঢাকা মহানগরীর যেসব বড় সমস্যা আছে, তা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সমাধান হবে- সে প্রত্যাশা করার কোনো উপায় নেই।

সমস্যাবহুল মহানগরীর বড় পরিবর্তন আনতে গেলে ক্ষমতা কাঠামো একটি বড় প্রশ্ন। উদাহরণ হিসেবে বলতে চাই, ঢাকা মহানগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো দখল। কিছু ক্ষমতাবান গোষ্ঠী রেললাইনের জমি, উন্মুক্ত স্থান বা জনগণের সম্পদ, যেমন- বিল-ঝিল, নদী-জলাশয়, খেলার মাঠ ইত্যাদি দখলে নিয়ে রাজত্ব করছে, ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী চোরাই টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। দখল, লুণ্ঠন সারা দেশেই হচ্ছে, রাজধানী ঢাকায় তা কেন্দ্রীভূত হয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে, ছলে বা বলে, যদি এই গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাই ক্ষমতায় আসেন, তাহলে এই দখল ও লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া আরো বাড়তে থাকবে।

আমি মনে করি, মহানগরীকে সবার জন্য বাসযোগ্য করতে গেলে সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো ভূমি সংস্কার। ঢাকার অধিবাসীদের ফ্ল্যাট বা জমি একটির মধ্যে সীমিত রাখা ও তার আয়তন নির্দিষ্ট করে দেওয়া। বাকি জমি ও ফ্ল্যাট আবাসন সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করা। সব জমি দখলমুক্ত করে সবার জন্য আবাসন গড়ে তোলাটা জরুরি। বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাণ ফিরিয়ে আনা ঢাকা মহানগরীর প্রাণ রক্ষার জন্য অপরিহার্য। এ জন্য বুড়িগঙ্গায় অবৈধ দখলদারি, নদীভাঙা, নদীদূষণ ইত্যাদি বন্ধ করা জরুরি। দীর্ঘদিন থেকে এসব নিয়ে কথা হয়েছে, নানা সময়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে; কিছু লোকের পকেট ভারী হয়েছে, বুড়িগঙ্গা উদ্ধার হয়নি। দখলদার ও লুটেরাদের তৎপরতা অব্যাহত থেকেছে। তাই এসব লুটপাট বন্ধ করে নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা, নদী সংস্কার করতে হবে। ঢাকা শহরে বা তার চারপাশে যেসব উন্মুক্ত স্থান রয়েছে, খেলার মাঠ আছে সেগুলো দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।

জনস্বার্থ বিবেচনা করলে ঢাকা মহানগরীতে এত শপিং মলের কোনো দরকার নেই, দরকার সর্বজনের হাসপাতাল, দরকার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মতো আরো ১০টা হাসপাতাল। দরকার সর্বজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঢাকা মহানগরীর একটা বড় সমস্যা যানজট। অনেক মেয়র পদপ্রার্থীই এটা দূর করার কথা বলেছেন। কিন্তু যানজট দূর করার জন্য অবৈধ দখলদার থেকে সম্পত্তি, জমি উদ্ধার করার পাশাপাশি আরেকটি বড় বিষয় হলো প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা। প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করা না হলে যতই ফ্লাইওভার হোক না কেন, কোনোভাবেই যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ করে গণপরিবহন বাড়াতে হবে। একসঙ্গে অনেক মানুষ যাতে চলাচল করতে পারে, সে ব্যবস্থা করতে হবে। জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করলে এ কাজগুলো করতেই হবে। কিন্তু নির্বাচিত মেয়ররা এই কাজে উদ্যোগ নিতে পারবেন কি না তা নির্ভর করে তিনি দখলদার-লুটেরাদের সমর্থনে ক্ষমতায় যাচ্ছেন, নাকি জনগণের স্বার্থের রাজনীতি নিয়ে যাচ্ছেন তার ওপর।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সিটি করপোরেশন নির্বাচন হওয়ায় মানুষ নির্বাচনমুখী। তাদের মধ্যে উৎসাহ দেখা দিয়েছে। এই নির্বাচনে যাতে জনগণ স্বচ্ছন্দে-নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, এটা নিশ্চিত করা প্রধানত সরকারের দায়িত্ব। নির্বাচন কমিশন যদি এটা নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে শুধু প্রার্থীরাই যে বৈষম্যের শিকার হবেন তা নয়, যারা ভোটার, নাগরিক তাদের অধিকারও হরণ করা হবে। ভোটাররা তাদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারলে নির্বাচিত ব্যক্তিকে জনপ্রতিনিধি বলা যায় না। আজকের নির্বাচনে যাতে জনগণের সেই অধিকার সংরক্ষিত হয়, জনগণ যেন নির্ভয়ে তার প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে, সেই নিশ্চয়তা বিধান করা এখন নির্বাচন কমিশনের কাজ। যদিও এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে নির্বাচন কমিশন এই দায়িত্ব পালন করতে পারবে সেই ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না।

যদি সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্বচ্ছ না হয়, তাহলে তা ভবিষ্যতের রাজনীতিকে আরো সহিংস করে তুলবে। রাজনীতিতে অদৃশ্য বিভিন্ন শক্তির অপতৎপরতা বাড়বে; অনিশ্চয়তা, ভীতি ও সহিংসতা সমাজ অর্থনীতিকে আরো বিপর্যস্ত করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা সরকারেরই ব্যর্থতা। আজকের নির্বাচন তাই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য পরীক্ষা।

(২৮ এপ্রিল ২০১৫ কালের কন্ঠে প্রকাশিত)