বাংলাদেশ নদী-নালা, খাল-বিল ভরা একটি দেশ। আরো সঠিক হবে বললে যে, ভরা ছিল একটি দেশ। এখন যেভাবে আছে নদী-নালা, খাল-বিল, তাতে অনেক নদ-নদীই শুকিয়ে গেছে কিংবা আধমরা হয়ে আছে। একের পর এক পাকা বাঁধ বা বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প আটকে দিয়েছে অনেক প্রবাহ। অনেক খাল-বিলও হয় শুকিয়ে গেছে, নতুবা যাওয়ার পথে। ডোবা জলাশয় যেগুলো আবার নানাভাবে পানিপ্রবাহের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে কাজ করে, সেগুলোর অনেকগুলোই এখন অট্টালিকার নিচে হারিয়ে গেছে কিংবা সড়ক বা আশপাশের কোনো নির্মাণকাজের জন্য মুচড়ে গেছে।
নদী-নালা খাল-বিল ডোবা-জলাশয়ের এ অকালমৃত্যু কিংবা হাত-পা বাঁধা পঙ্গু অবস্থার কারণে তার প্রতিক্রিয়াও হয়েছে ভয়াবহ। বন্যা আর ভাঙন দুটোই বেড়েছে। বেড়েছে জলাবদ্ধতাও। এ রকম যুক্তি আসতে পারে যে, বন্যা ও ভাঙন আজকের ঘটনা নয়। যখন নদীর
ওপর বা পানির স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর মানুষ কোনো হামলা করেনি, যখন মানুষ সেই ঔদ্ধত্য দেখানোর মতো ক্ষমতা অর্জন করেনি বা প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারেনি, তখনো বন্যা হয়েছে, ভাঙন হয়েছে, নদীর গতিপথ বদলে গেছে, নদী মরেছেও। তাহলে? এখান থেকে সিদ্ধান্ত একটাই আসতে পারে যে, এসব ঘটনা নিছকই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাকৃতিক ঘটনা এবং মানুষের দুর্ভাগ্য। মানুষের এখানে কিছু করার নেই।
বিশেষভাবে খেয়াল করার ব্যাপার হলো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও নিজেদের অসহায়ত্ব ও কথিত ‘দুর্ভাগ্য’ দূর করার জন্য মানুষ নানা পথ অনুসন্ধান করেছে, নানা রকম যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার বয়স দীর্ঘ। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে এসব উদ্যোগ মানুষকে অনেক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার পথ দেখিয়েছে, অনেক ‘দুর্ভাগ্য’ মানুষ অতিক্রম করেছে। কিন্তু সে উদ্যোগ যখন হস্তক্ষেপের আকার নিয়েছে, যখন তা বোঝাপড়ার সীমা অতিক্রম করেছে, তখন তার ফল হয়েছে উল্টো। দুর্যোগ আর দুর্ভাগ্য আরো বেড়েছে। বাংলাদেশে গত পাঁচ দশকে যা হয়েছে, তা এর প্রমাণ।
আমরা পর্যালোচনা করলে দেখব যে, বিশেষত নদীর আর সেই সঙ্গে বন, পাখি জগতের বিষণ্ন কিংবা বিপর্যস্ত চেহারা লাভ এ দেশের সামগ্রিক উন্নয়নপ্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কিত। যারা এ দেশের গত কয়েক দশকের উন্নয়নপ্রবাহের শারীরিক বা জ্ঞানগত অংশীদার এবং দেশী-বিদেশী যারা এর সুফলভোগী, তারা বলে থাকেন যে, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদী শাসন দরকার ছিল, কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য এবং খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নদী নিয়ন্ত্রণ ও বাঁধ দরকার ছিল। বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বাঁধ দরকার ছিল। বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বাঁধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা অপরিহার্য ছিল। বলেন, বসতির প্রয়োজনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য বন ধ্বংস না করে, পানি লবণাক্ত না করে উপায় কি ছিল? এগুলো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি। আমাদের সব মানুষের জন্য খাদ্য দরকার, আমাদের জীবন আরো গতিশীল করার জন্য বিদ্যুৎ দরকার, আমাদের বন্যার প্রকোপ থেকে বাঁচা দরকার, আমাদের সীমা বাড়ানো দরকার, যোগাযোগ বাড়ানো দরকার, আমাদের বসতি দরকার। আমরা তো অযান্ত্রিক যুগে ফিরে যেতে পারি না। পারি কি? অনেকে রোমান্টিকভাবে সে যুগে ফিরে যাওয়ার জন্য পেছন ফিরে বসে আছেন, কল্পনায় সৃষ্টি করছেন এক সুখময় স্বর্গজগৎ, আক্ষেপে কাতর হচ্ছেন। কিন্তু প্রথমত ইচ্ছা করলেই পেছনের জগতে যাওয়া যাবে না; দ্বিতীয়ত মানুষ সেই জগতের অসম্পূর্ণতা সীমাবদ্ধতা বৈরিতা শোষণ নিপীড়ন বঞ্চনা ও অপমানের ভয়াবহতা থেকে মুক্তির চেষ্টা করতে করতেই এ পর্যন্ত এসেছে। অতীতের সে ভয়াবহতা রোমান্টিকতা দিয়ে তাকে ঢেকে ফেলা যায় না। বর্তমানের নতুন অসঙ্গতি দেখে পেছনে যাওয়ার ঘোর সৃষ্টি করে বসে থাকার চেয়ে দরকার এ অসঙ্গতি বোঝা এবং তা দূর করার রাস্তা খোঁজা। গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, প্রকৃতি ও তা থেকে কৃত্রিমভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের সৃজনশীল এবং গতিময় ভারসাম্য কেন সম্ভব হবে না? বাধাটা কোথায়? এত দিনের অভিজ্ঞতা থেকে এবং ক্ষমতাবান আন্তর্জাতিক সংস্থা-গবেষক-সরকার বৃহৎ মালিক প্রভৃতির কথাবার্তা যুক্তিবিন্যাস থেকে তো এ প্রশ্নই প্রবল হয়ে ওঠে যে, মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য, তার জীবনে আয়েশ আনার জন্য, মানুষের জীবন সম্প্রসারণের জন্য, নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য কি তবে নিজের জীবনের প্রাণই বিনাশ করতে হবে? প্রকৃতি ধ্বংস হবে, নদী-নালা খাল-বিলসহ
পানিপ্রবাহ বিষাক্ত হবে, সবুজ গাছপালা হলুদ হবে কিংবা শুষ্ক কাষ্ঠে পরিণত হবে, পাখি ছটফট করতে করতে মরবে কিংবা পালাবে, নতুন সাজে সজ্জিত ফসল ফল ভেতরে বিষ নিয়ে হাজির হবে চোখ হারানো মানুষের সামনে। এছাড়া আর কোনো গতি নেই? তবে কি জ্ঞানার্জন করল মানুষ লক্ষ লক্ষ বছরে? এটাই তবে উন্নয়ন? বটেই, বর্তমান অধিপতি জ্ঞান অনুযায়ী এটাই উন্নয়ন। কিন্তু এটা আসলে কী?
২. বন্যার ইতিহাস যেমন প্রাচীন, বাঁধের ইতিহাসও তেমনি প্রাচীন। বাঁধ ছাড়াও অন্য নানা ব্যবস্থা মানুষ গ্রহণ করেছে জমির ফসল ঘরবাড়ি বসতি রক্ষা বা ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টায়। সেসব চেষ্টার মধ্যে নানা পরিবর্তন সংশোধন ও পরিমার্জন দেখা যায়। তবে এসবের একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল অস্থায়িত্ব ও স্থানিকতা। নিয়ন্ত্রণ যেহেতু স্থায়ী ছিল না এবং যতটুকু ছিল তাও ছিল স্থানিক, তার ফলে নদীর প্রবাহের ওপরও কোনো স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়নি। ফলে প্রতিক্রিয়া হয়েছে এখনকার তুলনায় অনেক কম, যখন বাঁধ মানেই একটি স্থায়ী প্রতিরোধ।
বাংলাদেশে স্থায়ী বাঁধসহ ব্যাপকভাবে কংক্রিটের নানা কাঠামো নির্মাণের শুরু পঞ্চাশের দশকে। শুধু পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশসহ) নয়, ভারতসহ আরো অনেক দেশেই আমরা এ দশকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমধর্মী উদ্যোগ দেখি। প্রকৌশল দৃষ্টিভঙ্গিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এটি ছিল অভিন্ন অপরিহার্য ব্যবস্থা। তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত উন্নয়ন চিন্তার সঙ্গেও এ হস্তক্ষেপমূলক আক্রমণাত্মক ব্যবস্থাবলি ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। কারণ
১. যান্ত্রিক প্রকৌশল দৃষ্টিভঙ্গি নদীকে পানি হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত, জীবন্ত নদী হিসেবে নয়, সমগ্র প্রকৃতির অংশ হিসেবে নয়।
২. তার ফলে এ দৃষ্টিভঙ্গি নদীর সঙ্গে অন্য আরো হাজারো জীবন্ত সত্তার যোগ দেখতে ব্যর্থ হয়।
৩. এ দৃষ্টিভঙ্গি নদীর বিভিন্ন অংশকে কম্পার্টমেন্ট হিসেবে দেখে, দেখে খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন আকারে। তার ফলে তার কর্মপদ্ধতি উপেক্ষা করে অখণ্ড ও অবিচ্ছিন্ন নদীর প্রবাহকে।
৪. এ দৃষ্টিভঙ্গি হিসাব করে ওই কম্পার্টমেন্টে এবং স্বল্পমেয়াদে (কিংবা স্বল্পমেয়াদ থেকে প্রজেকশন করে দীর্ঘমেয়াদে) কত ব্যয় হলো কত লাভ হলো। এ লাভ- ক্ষতির যে আরো এলাকা আছে, আরো লম্বা মেয়াদ আছে, তা হিসাবে আসে না।
যে উন্নয়ন দর্শন সে সময় বাংলাদেশসহ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উত্তর-উপনিবেশ দেশগুলোয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিল, তা ছিল এ দৃষ্টিভঙ্গিরই সহযোগী। এ উন্নয়ন দর্শন ছিল উপনিবেশ থেকে সদ্য ‘স্বাধীনতাপ্রাপ্ত’ দেশগুলোয় পুঁজিবাদী সম্পর্ক ও প্রতিষ্ঠান বিকশিত করা, একই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী কেন্দ্র বা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এগুলোকে নতুনভাবে সমন্বিত করা এবং এমন একটি সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করা, যারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার যুক্তি হিসেবে লর্ড কর্নওয়ালিস যা বলেছিলেন, ‘নিজেদের স্বার্থেই আমাদের টিকাইয়া রাখিবে’। এ উন্নয়ন দর্শন আবার যে অর্থশাস্ত্রীয় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেটি এখন বিশ্বক্ষমতায়। এ অর্থশাস্ত্র প্রথমত সব তত্পরতার প্রাণ এবং শেষ গন্তব্য হিসেবে মনে করে মুনাফা। যা কিছুই মুনাফার মাধ্যমে মূলধন সংবর্ধন করতে পারে, সেটাই এ অর্থশাস্ত্র ধন্য ধন্য রব দিয়ে গ্রহণ করে। দ্বিতীয়ত এ শাস্ত্রে ব্যক্তিই মূল ইউনিট। সমষ্টি ব্যক্তির যোগফল ছাড়া আর কিছু নয়। তৃতীয়ত প্রকৃতি এখানে মুনাফা অর্জনের ক্ষেত্র ভিন্ন কিছু নয়। চতুর্থত দুনিয়ার সবকিছুই বিক্রয়যোগ্য। পঞ্চমত দুনিয়ার সবকিছুই ব্যক্তিগত মালিকানার অধীন আনা সম্ভব এবং ষষ্ঠত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন ও বিতরণ সবচেয়ে দক্ষ ও কাঙ্ক্ষিত ব্যবস্থা।
আমরা বর্তমানে উন্নয়নতত্ত্ব বা আধুনিকতার তত্ত্ব হিসেবে যেগুলোকে দেখি, সেগুলোর উদ্ভব চল্লিশের দশকের শেষ দিকে বা পঞ্চাশের দশকে। সময়টি তাত্পর্যপূর্ণ। বহু দেশ তখন ঔপনিবেশিক কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসছে এবং প্রয়োজন গুরুতর এসব দেশকে বৈশ্বিক অভিন্ন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে সজীব রাখা। সেই নিয়তেই এসব তত্ত্বের উদ্ভব এবং কেন্দ্র সংস্থাগুলো কর্তৃক
আদৃত হওয়া। বলাই বাহুল্য যে, সব তত্ত্ব এক কথা বলে না বা একইভাবে ‘অনুন্নত’ দেশগুলোর ‘উন্নয়ন যাত্রা’ বিশ্লেষণও করে না। কিন্তু তার পরও এসব তত্ত্বের কেন্দ্রীয় সুরের মধ্যে অভিন্ন তাল-লয় পাওয়া যায়। অভিন্ন তাল-লয় আসে অভিন্ন মতাদর্শিক অবস্থান— অভিন্ন অনুমিতি, লক্ষ, অগ্রাধিকার ও অভিন্ন কেন্দ্রের কারণে।
সব তত্ত্বেই কমবেশি বলা হচ্ছে: ১. উত্তর-উপনিবেশ দেশগুলো অনুন্নত বিভিন্ন দিক থেকে। এর কেন্দ্রীয় সমস্যা হচ্ছে ‘পুঁজি’র অভাব, দক্ষতার অভাব, অধিক জনসংখ্যা। ২. কেন্দ্র থেকে যদি পুঁজি ও বুদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন নেয়া হয়, তাহলেই কেবল সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। ৩. এ পুঁজি ও অন্যান্যের জোগান হতে পারে দুটো পথে— এক. ‘বিদেশী সাহায্য’ ও দুই. ‘বিদেশী বিনিয়োগ’। বিশ্বাসটা এভাবেই দাঁড়ায় বা দাঁড় করানো হয় যে, যেকোনোভাবে এগুলোর প্রবাহ হোক না কেন, তা এসব দেশের মূল সমস্যা দূর করবে এবং এর মধ্য দিয়ে ‘অনুন্নত’ দেশ শনৈ শনৈ উন্নতি করতে থাকবে। ৪. বাজার ও ব্যক্তিগত মালিকানাভিত্তিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও বিকাশই উন্নয়নের পথ। ৫. জ্ঞানের কেন্দ্র যেহেতু ঔপনিবেশিক কেন্দ্র, আর ‘উন্নয়ন’ যেহেতু তাদেরই মস্তিষ্কপ্রসূত, সুতরাং এ বিষয়ে শিক্ষা জ্ঞান বুদ্ধি পরামর্শ তারাই দেবেন, সেক্ষেত্রেও ‘বিশেষজ্ঞ’ ‘তদারককারী’ প্রধানত সেসব অঞ্চল থেকে আসবেন। ক্রমে তাদের মতো জ্ঞানী-গুণী বিশেষজ্ঞরা এসব দেশেও তৈরি হবে, তখন আরো সুবিধা হবে।
‘অনুন্নত’ দেশ শনৈ শনৈ উন্নতি করতে থাকবে মানে হতে থাকবে ক্রমান্বয়ে শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী কেন্দ্র দেশগুলোর ‘মতো’। অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি যে, ‘মতো’ মানে বাস্তবে যা দাঁড়িয়েছে তা হলো পোশাক, ভাষা, ভবন, শোয়া, খাওয়া, গাড়ি-বাড়ি, চিন্তা…। আর অর্থনৈতিক ক্ষমতা কিংবা শিল্পভিত্তি কিংবা শিক্ষা-স্বাস্থ্যভিত্তি? দূর-অস্ত! এবং অনাবশ্যক!! ক্রমে এসব তত্ত্ব আরো সমৃদ্ধ হয়েছে, সংযোজিত হয়েছে নতুন অনেক কিছু। বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যবস্থাপক-তদারককারী ও বহুজাতিক সংস্থার রাস্তা পরিষ্কারকারী ও লবিস্ট হিসেবে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধর সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গে আছে বা আগে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউএসএইডসহ তার যাবতীয় প্রতিষ্ঠান এবং এডিবিসহ বিবিধ আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক ঠিকাদার কিংবা লবিস্ট সংস্থা। একে একে এসেছে কাঠামোগত সমন্বয় কর্মসূচি (স্যাপ), বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার নানা কর্মসূচি (ফ্যাপ) ও দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা হ্রাসকরণের নানা আয়োজন (প্যাপ)। শেষে আগের সবকিছু মিলিয়ে স্যাপ, ফ্যাপ ও প্যাপ মিশিয়ে নতুন চিনিমাখা মোড়ক লাগিয়ে আবির্ভূত হয়েছে পিআরএসপি। তার পর? একই বস্তু নানাভাবে পরিবেশন।
৩. পঞ্চাশের দশক থেকে বাংলাদেশে তৎকালীন পাকিস্তানের কাঠামো থেকে শুরু করে বাংলাদেশ পর্যন্ত উন্নতি কম হয়নি। এর মধ্যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ‘পুঁজি’ এসেছে, তার সঙ্গে অসংখ্য ‘বিশেষজ্ঞ’ এসেছেন, আর দেশের মধ্যে সেই জ্ঞান, দৃষ্টি, ভাব দ্বারা আচ্ছন্ন একটি ‘সিভিল সোসাইটি’ গড়ে উঠেছে। আর এদের দেশী-বিদেশী সম্মিলিত মহিমায়, কাজ, উন্নয়ন, জ্ঞান, কর্মের ফলাফল আমাদের সামনে। এসবের একটি বড় ক্ষেত্র ছিল এবং আছে বাংলাদেশের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ।
১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে (পূর্ব পাকিস্তানে) ব্যাপক বন্যা হয়। পাকিস্তানে সে সময় প্রবল দাপটে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় জনশক্তি তৈরি এবং প্রতিষ্ঠান নির্মাণে মার্কিন বিভিন্ন সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা কাজ করছিলেন। বস্তুত এ বন্যার পর বাংলাদেশে পানিসম্পদ নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ তৈরি হয়। জেএ ক্রগের নেতৃত্বে একটি কমিশন এসে বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে অনুসন্ধান ও সুপারিশ করেন। রিপোর্টে সর্বব্যাপী একটি প্রস্তাবনা উপস্থিত করা হয়। বস্তুত এ প্রস্তাবনাই বাংলাদেশে পানিসম্পদের ওপর একদেশদর্শী যান্ত্রিক আগ্রাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ শুধু নয়, এর সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হয় সেচ প্রকল্প। বিশ্বব্যাপী ‘সবুজ বিপ্লব’-এর মাধ্যমে প্রান্তস্থ অর্থনীতিতে বাণিজ্যিক কৃষির প্রবর্তন, ষাটের দশকে যার শুরু, তার সঙ্গে এর যোগাযোগ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুতরাং এটা ধারণা করা খুবই সঙ্গত যে, আন্তর্জাতিক মনোযোগ বন্যা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সামগ্রিক কৃষি ব্যবস্থার দিকেই ছিল। আর এ মনোযোগ নিছক বন্যা সমস্যার সমাধান নয়, প্রান্তস্থ দেশগুলোয় নতুন পর্বের ভিত্তি স্থাপনই বটে।
ক্রুগ কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) প্রতিষ্ঠিত হলো ১৯৫৯ সালে। পানি বিষয়ে একটি মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করার জন্য এ সংস্থার সঙ্গে প্রথম থেকেই কনসালট্যান্ট হিসেবে সংযুক্ত ছিল একটি মার্কিন প্রকৌশল কোম্পানি, যার নাম ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। ২০ বছরের মাস্টারপ্ল্যান তৈরি শেষ হলো ১৯৬৪ সালে। ১৯৮৫-এর মধ্যে ৩২ লাখ একর জমিতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিনিষ্কাশন ছিল এর লক্ষ। এ উদ্দেশ্যে ৫১টি বড় প্রকল্প নেয়া হয়, যার মধ্যে বড় বড় নদ-নদীর সবই ছিল। একদিকে হলো বিভিন্ন ধরনের নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে হলো ভূউপরস্থ পানিপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা, বাধাগ্রস্ত করা। নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন। খরস্রোতা নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন একটি পরিচিত পদ্ধতি। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়; কিন্তু এতে যাদের লাভ হয় আর যাদের ক্ষতি হয়, তারা যদি ভিন্ন হয় এবং যে লাভ হয় আর যে ক্ষতি হয়, তার হিসাবে ক্ষতি যদি বেশি হয়, তাহলে তা ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ বর্তমান রাঙ্গামাটি জেলার চন্দ্রঘোনা থানার কাপ্তাই গ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত কাপ্তাই বাঁধ। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে এর নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৯৬২ সালের জানুয়ারিতে। এ বাঁধের ঘোষিত লক্ষ ছিল বিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ ও পানিনিষ্কাশন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নৌ-পরিবহনের সুবিধা বৃদ্ধি, পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম অঞ্চলে প্রবেশ সুবিধা এবং পরে যুক্ত করা হয়েছিল মত্স্য চাষ। লক্ষ আংশিক পূরণ হয়েছে, তবে এখন আবার বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রচলিত লাভ-ক্ষতির হিসাবে প্রকল্পের শুরুতে এখান থেকে যত লাভের কথাই বলা হয়েছে, সেটিও ঠিক প্রমাণ হয়নি। দেখা গেছে, লাভের দিক কমে গেছে, ব্যয়ের দিক বেড়েছে। কিন্তু এ হিসাবের বাইরেও এর তত্ক্ষণাৎ ও দূরবর্তী ফলাফল হয়েছে ভয়ঙ্কর।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্ণ সমর্থন ও জ্ঞান-ঋণ (পুঁজি) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এ বাঁধ, যা বিশাল উন্নয়ন হিসেবে চিহ্নিত, তা খোলা চোখে দেখলে উপস্থিত হবে শুধু মানববিধ্বংসী বা প্রকৃতি বৈরী নয়, বর্ণবাদী জাতিবিদ্বেষী একটি প্রকল্প হিসেবেই। বাঁধের মাধ্যমে কাপ্তাই লেক নামে যে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করা হয়, তাতে পুরনো রাঙ্গামাটি বিলুপ্ত হয়। এক লাখ একর আবাদি জমি ডুবে যায়। এক লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। আর বিদ্যুৎ যা হয়, চলে যায় বাইরে। কাপ্তাই লেক হয় পর্যটন স্পট! এটি নিয়ে আরো বৃহৎ পর্যটনকেন্দ্র দাঁড় করানোর জন্য দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ হতে যাচ্ছে। এ বাঁধ পুরো অঞ্চলে জাতিগত অবিশ্বাস, দূরত্ব, বিদ্বেষ ও সহিংসতার রক্তাক্ত অধ্যায়ের যে একটি কারণ, তা কে অস্বীকার করতে পারে? এর মূল্য কত? পরিমাপ করাই খুব কঠিন। সমতল এলাকার বাঁধগুলোর অভিজ্ঞতাও বিভিন্ন দিক থেকে কথিত ‘লাভ’-এর ব্যাখ্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
৪. বাংলাদেশের জমিতে সেচ আজকের কথা নয়। বিশেষ করে ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে সেচ প্রয়োজন হয়ই। হাজার বছরের এ সেচ ব্যবস্থা বরাবরই ছিল অনাড়ম্বর এবং এতে ভূউপরস্থ পানিই ব্যবহার হতো। তার মানে নদী, নালা, খাল, বিলের পানিই বিভিন্ন অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে জমি পর্যন্ত নেয়া হতো। এসব পদ্ধতির মধ্যে খাল খনন, নালা কাটা, পানি জমিয়ে রাখা, সেখান থেকে পানি জমিতে দেয়ার জন্য মাটি কাঠ বাঁশের নানা মাধ্যম (দোন, সেউতি, কলসি) ব্যবহার করা ছিল অন্যতম।
বাংলাদেশে যেসব প্রজাতির ধান চাষ হতো, তার সঙ্গে এ ধারার সেচ ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে ভূউপরস্থ পানি সুলভ করে বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতিতে তাকে ধানের গোড়ায় পৌঁছে দেয়ার এ কাজে সামগ্রিক পানি জমি প্রাণী ভারসাম্যে কোনো বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা ছিল না। এ সেচ পদ্ধতি অকার্যকর হয়ে গেল নতুন ‘উচ্চফলনশীল (উফশী)’ বীজের চাষের ক্ষেত্রে। হাজার বছরের জৈব সার পদ্ধতিও অকার্যকর হয়ে গেল এ বীজের ক্ষেত্রে।
এ বীজের চাহিদা ভয়ঙ্কর। আর কথিত সবুজ বিপ্লবের কেন্দ্র হচ্ছে এ বীজ। এ বীজের উদ্ভাবন ঘটেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সমর্থিত ম্যানিলায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা ইরিতে। সেজন্য এ বীজের নাম মূল নাম ‘ইরি’। এখন এর নানা ধরন অনেক নম্বর দিয়েও প্রকাশ করা হয়। এ বীজ উদ্ভাবন ও বিভিন্ন দেশে তার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার, ঋণ সম্প্রসারণ, কনসালট্যান্ট ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা ছিল মার্কিন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ইউএসএইডের। ইউএসএইডের এ আগ্রহের রহস্য হলো এ পুরো প্যাকেজে কৃষিভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থাগুলোর বিশাল বাণিজ্যের সম্ভাবনা। এছাড়া রাজনীতিও ছিল। ‘লাল বিপ্লব’ ঠেকানো তখন খুবই জরুরি ছিল! সবুজ বিপ্লবের প্যাকেজে ছিল চারটি উপাদান, যা একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। এগুলোর কোনোটিই এ দেশের কৃষিতে পরিচিত নয় এবং সবই ছিল আমদানি করার পণ্য। এ চারটি উপাদান হলো ১. উফশী বীজ; ২. রাসায়নিক সার; ৩. যান্ত্রিক সেচ; ৪. কীটনাশক। উফশী বীজ উৎপাদনের জন্য মাটিতে জৈব সার মেশানো মোটেই যথেষ্ট নয়। এর জন্য দরকার রাসায়নিক সার ইউরিয়া, পটাশ, সুপার ফসফেট ইত্যাদি। পরিমাণও লাগে বেশি। এ বীজের পানির চাহিদাও খুবই বেশি আর তা অযান্ত্রিক পদ্ধতিতে জোগান দেয়া সম্ভব নয়। আর ভূউপরস্থ পানি দিয়েও এ জোগান সম্ভব নয়। সুতরাং এল যান্ত্রিক পদ্ধতি, গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ; আর পানি তোলা শুরু হলো মাটির নিচ থেকে। নলকূপ আমদানি আর পাতালের পানি ভূমির উপরে টেনে আনা শুরু হলো। কিন্তু আরো এক সমস্যা দেখা দিল কীটপতঙ্গ নিয়ে। কীটপতঙ্গ সবসময়ই ছিল, দেশী বীজের ধান উৎপাদনের অভিজ্ঞতায় কৃষককে কম কীটপতঙ্গ মোকাবেলা করতে হয়নি। এ মোকাবেলার পদ্ধতি ছিল এখানকারই, গাছ-রস, লতাপাতা ইত্যাদি, অজানা অতীত থেকে যার চর্চা ও বিকাশ। এসব কীটপতঙ্গ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ছিল নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কিন্তু ইরি ধান গাছের পাতাই দেখা গেল এ রকম যে, তা অনেক বেশি কীটপতঙ্গ আকর্ষণ করে। এসব কীটপতঙ্গ আরো বিপজ্জনক। সংখ্যাও বেড়ে গেল অনেক। দেশী পদ্ধতি দিয়ে এসব কীটপতঙ্গ থেকে ধান রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সুতরাং প্রয়োজন পড়ল রাসায়নিক কীটনাশক ওষুধ। বিষ। বিপুল পরিমাণ এ বিষও শুরু হলো আমদানি।
এ সবকিছু কেন গ্রহণ করবেন বাংলাদেশের কৃষক? করার কথা নয়। তারা গ্রহণ করেনওনি। প্রত্যাখ্যান ছিল সে সময় কৃষকদের সাধারণ প্রতিক্রিয়া। কৃষকদের এ সময়কার এ প্রত্যাখ্যান এবং এক্ষেত্রে তাদের যুক্তির কোনো প্রামাণ্য দলিল পাওয়া কঠিন। কিন্তু অভিজ্ঞতা এখনো শোনা যায়। আর তার জোর অনুমান করা যায় সরকারি ক্যাম্পেইন বিশ্লেষণ করলে। ব্যাপক সরকারি প্রচারণা হয় তখন। রেডিও, তথ্যচিত্র, পোস্টার, লিফলেট, আলোচনা, নাটক, প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী খামার, এমনকি ঘরে ঘরে গিয়ে সারের গুণাগুণ বর্ণনা ও লোকশিল্পীদের অনেক অর্থ দিয়ে ইরির পক্ষে গান লেখা ও গাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল এর অন্তর্ভুক্ত। সে সময় পাকিস্তানের লৌহমানব বলে কথিত সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ছিলেন ক্ষমতায়। ক্ষমতায় এ রকম শাসক থাকায় পুরো কর্মসূচি বাস্তবায়নে খুবই সুবিধাজনক হয়েছিল। এসব কাজ হয়ে দাঁড়ায় পরে জাতীয়ভাবে উদযাপিত আইয়ুবী ‘উন্নয়ন দশক’-এর একেকটি সাফল্যের ভিত।
৫. পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (ইপিআইডিসি) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৬১ সালে। এ রকম একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা ছিল এসব আমদানিকৃত পণ্য গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য অপরিহার্য। সে কারণেই বিশ্বখাদ্য সংস্থার পরামর্শে এবং ইউএসএইডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় এ সংস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। এ সংস্থার কাজ ছিল একদিকে জনমত গঠন করা, অন্যদিকে আমদানিকৃত রাসায়নিক সার, গভীর নলকূপ, অগভীর নলকূপ, কীটনাশক বাজারজাতকরণে নেটওয়ার্ক তৈরি করা। যেহেতু এসব নিয়ে কৃষকদের কোনো আগ্রহ ছিল না, বরং প্রতিরোধ ছিল, সেহেতু এ কাজে রাষ্ট্রের নানা উদ্যোগ ও লোভনীয় প্রস্তাবনা হাজির করতে হয়। বিনা পয়সায় চা খাইয়ে একসময় চায়ে অভ্যস্ত করে তার পর চায়ে দাম বসানোর কাজ সফলভাবেই করেছিল চা কোম্পানিগুলো। উফশী বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ, গভীর-অগভীর নলকূপ বাজারজাতকরণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নিজেকে এসে এসব কাজ করতে হয়নি, এ কাজ করার জন্য ঋণের টাকা আর জনগণেরই করের অর্থে প্রতিষ্ঠা হয়েছে অনেক রকম প্রতিষ্ঠান। ইপিআইডিসি, পরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থা বা বিএডিসি এসব সংস্থার মধ্যে প্রধান। সার বিতরণ প্রথমে নমুনা হিসেবে বিনা অর্থেই দেয়া হয়।
বাণিজ্যিকভাবে যখন বিতরণ শুরু হয়, তখন ছিল উচ্চভর্তুকি। ষাটের দশকের মাঝামাঝির পরও বিএডিসি ইউরিয়া ও পটাশের ওপর শতকরা ৬০ ভাগ ও ফসফেটের ওপর প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ ভর্তুকি দেয়। একই সময় কীটনক ওষুধও বিতরণ শুরু হয়। ১৯৭৪ পর্যন্ত কোনো কোনো কীটনাশক ওষুধ শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। পরে কৃষক অভ্যস্ত হয়ে গেলে ধীরে ধীরে সর্বক্ষেত্রেই ভর্তুকি প্রত্যাহার করা হতে থাকে। এমনিতেই সব কীটনাশকই বিষ, তার পরও ভয়ঙ্কর ফলাফলের কারণে অনেক দেশে নিষিদ্ধ ‘ডার্টি ডজন’ বলে কুখ্যাত ১২ ধরনের কীটনাশক বাংলাদেশের পানি ও মাটিকে দীর্ঘদিন বিষাক্ত করেছে।
ইপিএডিসি প্রতিষ্ঠাকালে কিছু লো লিফট পাম্প দিয়ে পানি ক্ষেত্রে তাদের যাত্রা করে। এগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল প্রধানত নিচু ও হাওড় এলাকায়। ১৯৬৭-৬৮ সালে এ প্রতিষ্ঠান গভীর নলকূপ কার্যক্রম দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন শুরু করে। গভীর ও অগভীর নলকূপ দীর্ঘদিন সরকারি ব্যবস্থাপনার অধীন পরিচালিত হতো। গভীর নলকূপ দেয়া হতো সমবায় গঠনের ভিত্তিতে, বড় আকারের ভর্তুকির মাধ্যমে। ক্রমে আগ্রহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকি কমতে থাকে এবং বেসরকারীকরণ ঘটতে থাকে। একপর্যায়ে সারা দেশে যখন রাসায়নিক সার-কীটনাশক-যান্ত্রিক সেচ-উফশী (বর্তমানে হাইব্রিড) নির্ভর কৃষির একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হলো, তখন বিএডিসি পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। সারা দেশে রাসায়নিক সার-কীটনাশক-যান্ত্রিক সেচ-বীজ বিতরণ তত্পরতা এখন নিজেই একটি বিরাট বেসরকারি অর্থনৈতিক তত্পরতা। শুধু ধান নয়; সবজি, ফল, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল সবক্ষেত্রেই ‘মোটাতাজাকরণ’ কর্মসূচি এখন বাজারকেন্দ্রিক তত্পরতা। ষাটের দশকের শেষে চালুকৃত গভীর নলকূপের সংখ্যা ছিল ১০২, ১৯৯১-৯২ সালে এ সংখ্যা ২৫ হাজার ৫০০তে পৌঁছে; কিন্তু পরে আবার চালু গভীর নলকূপের সংখ্যা কমে যায়। অগভীর নলকূপের সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৭১ পর্যন্ত এর সংখ্যা ছিল ৩০০-এর মতো, এখন এর সংখ্যা ৪ লাখেরও বেশি। রাসায়নিক সার আর কীটনাশক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ভূউপরস্থ পানি ক্রমান্বয়ে পানের অযোগ্য হতে থাকে। নলকূপের চাহিদা বাড়তে থাকে। রাষ্ট্র থেকেও নলকূপ বসানোর ব্যাপারে বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয়। সারা দেশে নলকূপ ছড়িয়ে পড়ে। এর জোরেই সারা বিশ্বকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশের মানুষ নিরাপদ পানি পান করে। সেচসহ ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের ব্যাপক উন্নয়ন তত্পরতা পানের নিরাপদ পানির মিথ ভেঙেচুরে চুরমার করে দেয়। বহুদিন গোপন রাখা হলেও একসময় আর্সেনিকের খবর প্রকাশ হয়। একই সময় অর্থাৎ ষাটের দশকের মধ্যেই শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন হয়, যেগুলোর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ইউএসএইড, বিশ্বব্যাংক ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল। স্থাপিত হলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের বিভিন্ন প্রকল্প, উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন বৃত্তি পরীক্ষা করলে এটা খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়বে যে, উপরে বর্ণিত ‘সবুজ বিপ্লবের’ মতাদর্শিক জ্ঞানগত ভিত্তি এবং সমর্থক গোষ্ঠী দেশের ভেতর কীভাবে দাঁড় করানো হয়েছে। এ কাঠামোর মধ্যে থাকাই শিক্ষক, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের ক্যারিয়ার গঠন, স্বীকৃতি লাভ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসন্ধিত্সা পূরণের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। খাদ্যোৎপাদন বৃদ্ধির জন্য অন্যান্য শর্ত ঠিক রেখে দেশীয় বীজ ও জৈব সার ব্যবস্থার উন্নয়ন, বন্যা মোকাবেলার জন্য পাকা কাঠামো ভিন্ন অন্যান্য পথ অনুসন্ধান সেজন্য মূলধারার গবেষণায় কখনই জায়গা পায়নি। ব্যক্তিগবেষক কেউ কেউ দেশীয় বীজ, জৈব সার ইত্যাদি নিয়ে যে গবেষণার উদ্যোগ নেননি তা নয়: কিন্তু খুব বোধগম্য কারণেই তা সরকারি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে কোনো সহায়তা পায়নি।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাক্ষেত্র এবং অধিপতি প্রকৌশল দৃষ্টিভঙ্গিও এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবেই গড়ে ওঠে। সুতরাং বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রেও সেসব পদ্ধতি গ্রহণযোগ্যতা পায়, যেগুলো এ দেশের পানি, নদী এবং তার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য মানুষ, পশু-পাখি, গাছপালা সম্পর্কে অজ্ঞ কিংবা অনীহ। বাংলাদেশে স্থাপত্যবিদ্যার প্রয়োগ থেকে এ রকম স্থানিক বৈশিষ্ট্য অনীহ জ্ঞানের প্রকাশ অনেক নগ্ন। অর্থশাস্ত্রসহ জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য অঞ্চলও এ রকম আধিপত্যের মধ্যেই আছে। এ আধিপত্যই ধ্বংসাত্মক বিষময় ‘উন্নয়ন’কে অপরিহার্য, অগ্রগতি ও উন্নয়ন হিসেবে সমাজে গ্রহণ করানোর জ্ঞান, বিদ্যাচর্চা, চিন্তা, গবেষণা ও মিডিয়ার ভাষা গঠন করেছে।
৬. ‘সবুজ বিপ্লব’ অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষি, কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ, সার ও কীটনাশক দিয়ে মাটি ও পানি বিষাক্তকরণ, বাজারজাতকরণে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক তত্পরতা, উপরের সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচের পানিসম্পদ ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান মাত্রা, যোগাযোগ সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিকাশ, নতুন নতুন পেশার উদ্ভব, নতুন নতুন বিনিয়োগ ইত্যাদি শুধু কৃষি নয়, সমাজ অর্থনীতি ও পরিবেশ ক্ষেত্রে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে, তার একমাত্র তুলনা হতে পারে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সঙ্গে।
হাত-পা বেঁধে পুঁজিবাদ দাঁড় করানোর উন্নয়ন কৌশল, অর্থশাস্ত্রের নয়া-ক্ল্যাসিক্যাল দর্শন, পশ্চিমের আধুনিক যন্ত্রমুখী প্রকৌশল চিন্তা ও বিদ্যার যথেচ্ছ প্রয়োগ এবং সর্বোপরি পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্র বিন্যাস একে অন্যের সঙ্গে খুব ভালো মিলে যায়। এসব ক্ষমতা ও উন্নয়নচর্চা মিলে যায় এ সমাজের ক্ষমতাবান শ্রেণীগুলোর বিকশিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে, নয়া উদ্ভূত শ্রেণীগুলোর বিকলাঙ্গ লুম্পেন ধাঁচের সঙ্গে। তাই এ সম্মিলিত ‘উন্নয়ন’চর্চায় এ দেশে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানিসম্পদ, নদীপ্রবাহ, বন্যার গতি, বনসম্পদ ও জ্বালানি সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি। বলাই বাহুল্য, বিশেষত অর্থশাস্ত্র, কৃষি ও প্রকৌশল শাস্ত্রসহ ‘শিক্ষিত’ ও অশিক্ষিত দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সমাবেশ এ ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
(২৯ জুন ২০১৫ বণিকবার্তায় প্রকাশিত)