নদীনালা, খালবিল দখল ও ধ্বংসের মাধ্যমেও জি ডি পি বাড়তে পারে

105637b4930e8d72f4fbfb6022bad887সাক্ষাৎকার গ্রহণ- সনতোষ বড়ুয়ান, ০১ আগস্ট ২০১৫, ওয়াশিংটন ডি সি।  

প্রশ্ন- সম্প্রতি দেশে যে বিষয়টা নিয়ে খুব আলোচনা চলছে সেটা হল বাংলাদেশ নিন্ম আয়ের দেশ থেকে নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। একথা জানিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। এ বিষয়ে আপনার কী মতামত? এতে আমাদের লাভ ক্ষতিই বা কী?
আনু মুহাম্মদ- বিশ্বব্যাংক সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে তিনটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকে।এগুলো হল:
১। নিম্ন আয়ভুক্ত দেশ (মাথাপিছু ১ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত); ২। মধ্য আয়ভুক্ত দেশ (১ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার থেকে ১২  হাজার ডলার); ৩। উচ্চ আয়ভুক্ত দেশ (১২ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার থেকে ১ লাখ বা তার বেশি ডলার)। মধ্য আয়ের দেশকে আবার দুটি ভাগে ভাগ করা হয়:
১। নিম্ন মধ্যম আয় (১ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার থেকে ৪ হাজার); ২। উচ্চ মধ্যম আয় (৪ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার থেকে ১২ হাজার ডলার)।

বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক গড় আয় মাথাপিছু এক হাজার ডলার অতিক্রম করায় বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। আসলে সঠিকভাবে পরিমাপ করলে বাংলাদেশের জি ডি পি এবং মাথাপিছু আয় আরও বেশি হবে। কারণ বাংলাদেশে হিসাব বহির্ভূত আয়ের অনুপাত হিসাবকৃত জি ডি পির শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি। এর একটি বড় অংশ চোরাই অর্থনীতি, যা তৈরি হয় ঘুষ, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন, রাষ্ট্রীয় প্রকল্প সম্পদ লুণ্ঠন, মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, নিপীড়নমূলক যৌন বাণিজ্য থেকে। এখানে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। জি ডি পি এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিমাপ করার অনেকগুলো সমস্যা আছে। একটি দেশে জি ডি পি অনেক বেশি হলেও টেকসই উন্নয়ন দুর্বল হতে পারে। মাথাপিছু আয় বেশি হলেও মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হতে পারে। আফ্রিকার বহু দেশে যেখানে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়ে বেশি , কিন্তু মানুষের জীবনযাত্রার মান নিম্ন। মিয়ানমারে মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের সমান, মানে তারাও নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। এছাড়া আছে ভারত,পাকিস্তান, সেনেগাল, জিবুতি। নাইজেরিয়া একইগ্রুপে হলেও তাদের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের দ্বিগুণেরও বেশি। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মান বাংলাদেশের চাইতে দ্বিগুণ ভালো, এটা বলা যাবেনা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং আরও খারাপ।

বাsলাদেশ নিম্ন আয়ভুক্ত দেশের তালিকা থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের তালিকায় প্রবেশ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হয়নি। আরও কিছুদিন সময় লাগবে। এটা হলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিয়মকানুন অনুযায়ী সুবিধা অসুবিধার কিছু পরিবর্তন হবে। যেমন নিম্ন আয়ভুক্ত দেশগুলোর জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিশেষ সুবিধা আর পাবে না, এছাড়া স্বল্পসুদে ঋণ পাবার বিবেচনার মধ্যেও বাংলাদেশ আর থাকতে পারবে না। কিন্তু এসব এখনই কার্যকর হচ্ছে না।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বাsলাদেশ এখন যে অবস্থায় আছে, যথাযথ অর্থনৈতিক নীতি দ্বারা পরিচালিত হলে এইসব তথাকথিত বিশেষ সুবিধা ছাড়াও উন্নয়ন গতি আনা সম্ভব।

তবে এটাই বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, মাথাপিছু আয় দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বোঝা যায় না। কোন সমাজে বৈষম্য যদি বেশি থাকে তাহলে গড় আয়ের হিসাব একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। একটি পরিবার যদি দশ লক্ষ টাকা আয় করে, পাশাপাশি অন্য একটি পরিবার যদি দশ হাজার টাকা আয় করে তাহলে উভয় পরিবারের গড় আয় হবে পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার টাকা। এতে কি দুই পরিবারের প্রকৃত অবস্থা বোঝা যায়? বর্তমান মাথাপিছু আয় হিসাবে আমাদের দেশে চার সদস্যের পরিবারের বার্ষিক গড় আয় হয় প্রায় ৪.৫ হাজার মার্কিন ডলার অর্থাৎ মাসে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। অথচ সরকারি পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশের শতকরা ৮০ জন মানুষের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় যত তাঁর ১/৩ ভাগ পায় শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ। একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভুত হবার ফলে এ ধরনের চিত্র আসে।

বস্তুত বাংলাদেশের জি ডি পি এবং মাথাপিছু আয়ের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পেছনে বড় অবদান হচ্ছে প্রবাসী আয়ের। এছাড়া আছে গার্মেন্টস এবং কৃষি । অথচ এই তিন ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমজীবী মানুষের আয় এবং জীবনের নিরাপত্তা দুটিই ঝুঁকিপূর্ণ, অনিশ্চিত। চোরাই অর্থনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের সন্ত্রাসী ও দুনীতিমুলক তৎপরতায় জি ডি পি বাড়ে কিন্তু সমাজের বড় একটা অংশের জীবন জীবিকা বিপদগ্রস্ত হয়। নদীনালা, খালবিল দখল ও ধ্বংসের মাধ্যমেও জি ডি পি বাড়তে পারে, কিন্তু তা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে না, বরং অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। এসব তৎপরতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি পায় না বরং জীবনমান বিপর্যস্ত হয়।

প্রশ্ন- এই যে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে, এক্ষেত্রে কোন খাতের প্রবৃদ্ধি ও অবদান বেশি?

আনু মুহাম্মদ- বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি সেখানে তিনটি খাতের অবদান বেশি। এই তিনটি খাত হল- গার্মেন্টস, প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স এবs ৩। কৃষি। অন্যদিকে জি ডি পির বিভিন্ন খাতের প্রবৃদ্ধি ভেঙে ভেঙে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নির্মাণ খাতে প্রবৃদ্ধির হার বেশ উচ্চ। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে শপিং মল/রিয়েল এস্টেট এবং নির্মাণ কাজ এগুলোই অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক তৎপরতা। নির্মাণ কাজ এবং শপিং মল/রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় অস্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে ঠিকই, জি ডি পিও বাড়ছে, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত এবং নির্বিচার নির্মাণ কাজের কারণে জলাভূমি, বনজঙ্গল, উন্মুক্ত স্থান দখল সহ ভুমিগ্রাসী তৎপরতা আশংকাজনক মাত্রা লাভ করছে।
প্রশ্ন- আমাদের দেশে সরকারি সম্পদের লুটপাট একপ্রকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এতে রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারি আমলা সবাই জড়িত থাকে। রাজনৈতিক পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া লুটপাট সম্ভব কই ?

আনু মুহাম্মদ- না, কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আর এই কারণেই বাংলাদেশে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়াতে পারছে না। ক্ষমতায় থাকার সাথে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন, ব্যাংক ঋণ লোপাট, প্রকল্প ব্যয় অবিশ্বাস্য মাত্রায় বৃদ্ধি করে দুর্নীতি করা, নিয়োগ বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য, দখল এবং সম্পদ পাচার সরাসরি সম্পর্কিত। সেজন্য যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা প্রতিষ্ঠান তৈরিতে খুবই অনিচ্ছুক| স্বচ্ছতা এবং যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া এবং জবাবদিহিতার সকল ক্ষেত্রগুলো বিপর্যস্ত করে তারা এই বিশেষ সুবিধা নিয়ে দ্রুত অর্থ বিত্ত উপার্জন এবং বিদেশে পাচার করায় লিপ্ত হয়। এই কারণে যারাই ক্ষমতায় আসে তারাই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হতে চায়। যতদিন যাচ্ছে সম্পদ লুণ্ঠন, পাচার, প্রতিষ্ঠান নষ্ট করা, প্রতিষ্ঠানের উর্ধ্বে ওঠে ব্যক্তির যথেচ্ছাচারের প্রবণতা দিনে দিনে বাড়ছে। সেকারণে সন্ত্রাস, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, দলীয়করণ, আত্মীয়করণ, অঞ্চলীকরণ এগুলো ব্যাপক আকার নিচ্ছে।

প্রশ্ন- এবার খনিজ সম্পদ বা তেল-গ্যাস প্রসঙ্গে আসি। আপনারা তো দেশে তেল-গ্যাস-বন্দর- বিদ্যুৎ রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কিন্তু দরিদ্র দেশের এসব সম্পদ তো ধনী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্র‡Y রাখতে চায়। এই যে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ দখলে নেবার যে আন্তর্জাতিক বলয়, সেই বলয় থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে পারবে কি ?

আনু মুহাম্মদ- পারা তো খুবই সম্ভব। আমরা যদি নব্বই দশকের প্রথম থেকে খেয়াল করি, এই জাতীয় সম্পদ নিয়ে সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, বহুজাতিক কোম্পানির তৎপরতার একটা বিশেষ ধরন ছিল । তারা চেয়েছিল বাংলাদেশের তেল-গ্যাস সহ সকল প্রকার খনিজ সম্পদের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব তৈরি এবং দ্রুততম সময়ে তা উত্তোলন করে বিদেশে রপ্তানী করতে। এতে খুব কম সময়ে তাদের মুনাফা নিশ্চিত হত। কমিশনভোগী মন্ত্রী, আমলা, কনসালটেন্ট তারাও কিছু সুবিধার বিনিময়ে দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের মুনাফা নিশ্চিত করার কাজকে দেশের উন্নয়ন হিসেবে প্রচার করছিল। আফ্রিকার অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, এই পথে বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বেশি সম্পদ নিয়ে আফ্রিকার বহু দেশ এখন দারিদ্র, সহিংসতা এবং অপশক্তিতে বিপর্যস্ত। এদেশগুলো এখন অভিশপ্ত সম্পদের দেশ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশকে এই মডেলে নিয়ে যাবার সকল আয়োজন সম্পন্ন হয়েছিল।

আফ্রিকার বহুদেশের সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য তৈরি হয়েছে জনগণের প্রতিরোধের মাধ্যমে।যার ফলে তারা তাদের পরিকল্পনা মত গ্যাস রপ্তানী, বন্দর ইজারা, উন্মুক্ত কয়লা খনি করে কয়লা পাচার সহ অনেকগুলো সর্বনাশা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাতীয় কমিটির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের মধ্যে এই সম্পদ সম্পর্কে মনোযোগ বেড়েছে। জাতীয় সম্পদের ওপর সর্বজনের মালিকানার গুরুত্ব জনগণের বোধে অনেকখানি যোগ হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার যদি জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে, যদি কমিশনভোগী ভূমিকা থেকে সরে এসে জাতীয় উন্নয়নের প্রতি ন্যুনতম মনোযোগী হয়, তাহলে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় মালিকানা নিশ্চিত করে শতভাগ সম্পদের সর্বেোত্তম ব্যবহার করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড়ধরনের উল্লম্ফন খুবই সম্ভব।
আমাদের দেশে সবসময় সরকার প্রচার করে সক্ষমতা নাই, পুঁজি নাই। সক্ষমতা আকাশ থেকে পড়ে না। বাংলাদেশে যখন পেট্রোবাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়, সেই একই সময় মালয়েশিয়ায় ‘পেট্রোনাস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। পেট্রোনাস এখন শুধু তাদের দেশের সম্পদ নয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে সাফল্য দেখাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় টুইন টাওয়ার’ সেই পেট্রোনাসের শক্তির নিদর্শন। অন্যদিকে বাংলাদেশে পেট্রোবাংলার সক্ষমতাকে সম্প্রসারণ না করে পরিকল্পিতভাবে তাকে পঙ্গু করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা, বাপেক্স এর অনেক দক্ষ মানুষকে কাজের সুযোগ না দেওয়ায় তারা এখন প্রবাসী। সুযোগ সুবিধা অনেক কম পাওয়া সত্বেও ‘বাপেক্স’ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে অনেক সাফল্য দেখিয়েছে। বাপেক্স যে কাজ একশ টাকায় করতে পারে সেকাজ ১০/২০ গুন বেশি দামে বিদেশী কোম্পানি দিয়ে করানো হয়। পুঁজির অভাবের যুক্তি তুলে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলেও বিদেশী কোম্পানীকে তার চাইতে বহুগুণ বেশি অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। বিদেশী কোম্পানির হাতে টেংরাটিলা ও মাগুড়ছড়ায় আমাদের গ্যাসসম্পদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তাঁর অর্থনৈতিক মূল্য কম করে হলেও ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর একাংশ কোন ক্ষতিও বাপেক্স করে নাই। এই অর্থের পরিমাণ দেশে বিদেশী বিনিয়োগের চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। অথচ কোন সরকারই এই ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করেনি। অতএব পুঁজি বা সক্ষমতার অভাব সমস্যা নয়, সমস্যা হল সরকারের ভুল নীতি ও দুর্নীতি।

প্রশ্ন- এবার আমরা দেশের বিদ্যুৎ খাত বিষয়ে জানতে চাইব। বি এন পি সরকারের আমলে এই খাতে অনেক দুর্নীতির কথা আমরা জানি। তারা বিদ্যুৎ উৎপাদন না বাড়িয়ে শুধু সঞ্চালনের জন্য নাকি খাম্বা কিনেছিল। এখন বিদ্যুৎ খাতের অবস্থা কেমন?

আনু মুহাম্মদ- এখন দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। তবে অনেক ব্যয়বহুল দুর্নীতির রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে। দুর্নীতি ও অনিয়মকে দায়মুক্তি দিয়ে আইন করা হয়েছে। সরকার দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নের কাঠামো বিবেচনায় নিলে আরও কম খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব ছিল। বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎপাদনশীল ভিত্তি, পরিবেশ বান্ধব নীতি ও প্রতিষ্ঠান এবং জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব ছিল।বিএনপি আমলে বিদ্যুৎ খাতকে ক্রমশ দেশি বিদেশি লুটেরাদের হাতে তুলে দেবার নীতি এই সরকার জোরদারভাবে অব্যাহত রেখেছে।

প্রশ্ন- এবার সুন্দরবনের পাশে রামcvলে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করার কারণে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে আপনাদের অন্দোলন বিষয়ে কথা বলব। এই সুন্দরবন শুধু আমাদের নয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। সরকার এই সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপালে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছেন। এতে করে বিপর্যস্ত হতে পারে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই আপনারা সেখানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন না করার জন্য আন্দোলন করছেন। এই রামপাল ছাড়া কি আর কোন সুবিধাজনক স্থান ছিল না বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালনের জন্য?

আনু মুহাম্মদ- ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই প্ল্যান্ট না হয়ে যদি ১৩ হাজার মেগাওয়াটও হয় কিংবা আরও বেশিও হয়, যে কোন পরিমাণ বিদ্যুতের জন্যই সুন্দরবন ধবংস করা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিদ্যুতের অনেক বিকল্প আছে, সুন্দরবনের কোন বিকল্প নাই।
আর এই বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রথম থেকেই অস্বচ্ছতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও জবরদস্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রকৃত পক্ষে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা চিন্তা করলে, নিয়ম নীতি অনুসরন করলে এই স্থানে সুন্দরবন ধবংসী তৎপরতা চালানো থেকে সরকার বিরত থাকতো। ভারতীয় কোম্পানি একাজে যুক্ত, কিন্তু ভারতীয় আইন অনুযায়ী এটা অবৈধ। প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবনের ভূমি দখল এবং উচ্চ মুনাফা লাভের লোভে দেশী ও বিদেশী কতিপয় গোষ্ঠী এই সর্বনাশা কাজে যুক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় নিয়ম নীতি অনুসরণ ও পরিবেশ রক্ষা করে সরকার যে কোন স্থানে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করতে পারে। এখানে বাধা দেওয়ার কোন কারণ নাই। কিন্তু যে সুন্দরবন প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা করে, যে সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট হিসাবে আমাদের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য এবং জীববৈচিত্রের অসাধারণ আধার তাকে আমরা কিছু লোকের লোভের বলি হতে দিতে পারি না।

প্রশ্ন – এবার একটু রাজনৈতিক প্রসঙ্গে আসি। বিরোধী দল বি এন পির নেতিবাচক এবং অপরিণামদর্শী রাজনীতির ফলে মনে হয় দেশের জনগণ তাদের উপর আস্থা হারিয়েছে। ফলে কার্যত দেশে এখন শক্তিশালী কোন বিরোধী দল নাই। কিন্তু আমাদের মত দেশে শক্তিশালী গণতন্ত্রের ভীত তৈরি এবং গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজন। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বিষয়টা সরকারী দলের জন্য বিপজ্জনক নয় কি ?

আনু মুহাম্মদ- সামগ্রিকভাবে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকা পুরো দেশের জন্যই আত্মঘাতি। আওয়ামী লীগকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণ যে বিপুল সমর্থন দিয়েছিল তার ফলে আওয়ামী লীগ সংসদে একক কর্তৃত্ব পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে তখন সম্ভব ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কে শক্তিশালী ভিত্তি প্রধান করা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সঠিক ভাবে বিকশিত করা, বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করা, এবং ধর্ম, জাতিবিদ্বেষ, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা সহ বিভিন্ন রকম অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক ধারাবাহিকতা থেকে দেশকে মুক্ত করা। কিন্তু ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার বাসনায় আওয়ামী লীগ সেপথে যায় নাই। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীর ক্লেদ গায়ে নিয়ে বি এন পি আপন অপরাধে ধরাশায়ী হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য এখন ভর করছে বিভিন্ন অনির্বাচিত প্রতিষ্ঠানের উপর। সংবিধানকে আরও অগণতান্ত্রিক এবং সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর করেছে। এখন দেশের চাইতে দল বড়, দলের চাইতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বড়। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে।

(০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ তারিখে সাপ্তাহিক নতুনদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত)