ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা

(এই লেখাটি ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লিখিত, তখনও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল সংস্কৃতিতে, পরে তা অশুচিতে অন্তর্ভূক্ত হয়। সম্প্রতি ফেসবুকে সেই আন্দোলন নিয়ে যে বিতর্ক চলছে তাতে মনে হল ইতিহাসকে স্মরণে আনা বা আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বোঝার জন্য এই লেখাটা আগ্রহীদের জন্য প্রাসঙ্গিক হবে। জাবি শাখা ছাত্র ইউনিয়নের প্রকাশনা ইস্পাত (আগষ্ট ২০১১) এই লেখাটা পুনর্মুদ্রণ করায় এটি এখানে দেয়া সম্ভব হল।)

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২০ আগষ্ট থেকে মাসাধিককাল ধরে ছাত্রী ধর্ষণ বিরোধী যে আন্দোলন চলছে তার প্রতি মনোযোগ প্রদান ও তার পর্যালোচনা কয়েকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ঃ
১. এই প্রথম দেশে কোন প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ বিরোধী একটানা এই রকম আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। যে আন্দোলন ধর্ষণের মত ধামাচাপা দেওয়া অপরাধকে সবার সামনে উপস্থিত করছে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন এবং যৌন নিপীড়ন বিরোধী অবস্থান গ্রহণের প্রশ্নটিও সামনে আসছে।
২. ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীদের বিশেষত ছাত্রীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটেছে।
৩. এই আন্দোলন সরকারি ছাত্র সংগঠন ও সেই সূত্রে শাসক রাজনৈতিক দল ও প্রশাসনের সামগ্রিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করেই গড়ে উঠেছে যখন এর বিরুদ্ধে অন্য কোন ছাত্র সংগঠনের পক্ষে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।
৪. এই আন্দোলন অতীতের অন্য সরকারি ছাত্র সংগঠন ও সরকারি প্রশাসন বিরোধী লড়াই এর ধারাবাহিকতা।
৫. এই আন্দোলন বর্তমান বিদ্যমান বামপন্থী সংগঠনের অবস্থান এবং গড়ে ওঠা ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ ‘সামাজিক’ উদ্যোগের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে প্রচলিত চিন্তা ভাবনার ধরনকে পুনর্বিন্যস্ত করবার চাপ সৃষ্টি করেছে।

ধর্ষণকারী ও তাদের আশ্রয়
গত জুন-জুলাই থেকেই ছাত্রী ধর্ষণের দু’একটি ঘটনা সম্পর্কে ক্যাম্পাসে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। ক্রমে এটি বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন ধরনের সম্পর্কিত ঘটনাবলি থেকে বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে একদিকে আতংক বাড়তে থাকে অন্যদিকে ক্ষোভ জমতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মধ্যে এ নিয়ে কানাঘুষা হয়েছিল, প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত কোন কোন শিক্ষক এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন এ রকমও পরে শোনা গেছে। কিন’ প্রশাসন যেহেতু ‘অভিযোগ কেউ উপস্থাপন করেনি’ এবং যেহেতু ‘এ সম্পর্কে কোন তথ্য প্রমাণ নেই’ সেজন্য কিংবা সেই অজুহাত তুলে এ বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হয়নি।
ধর্ষণের একাধিক ঘটনা সম্পর্কে গুঞ্জন ফিসফিস ক্রমে একটা সরব ক্ষোভের বিষয়ে পরিণত হতে থাকে। একই সময় ধর্ষণকারী হিসেবে যাদের নাম ছাত্রীরা জেনেছে তাদের আচরণের ঔদ্ধত্য ক্রমে অনেকের নজরে পড়ে। দেখা যায়, দল বেঁধে ক্যাম্পাসে ঘুরবার সময় ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অশ্লীল মন-ব্য ছোঁড়া, ভিড়ে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া, অশ্লীল ইঙ্গিত, গান গাওয়া ইত্যাদিতে তাদের ঔদ্ধত্য ক্রমেই বেড়েছে। বোঝানো হয় তাদের ক্ষমতা আছে, খুঁটির জোর আছে, অস্ত্র আছে, সংগঠন আছে, প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। এসব কার্যকলাপে ছাত্রীদের মধ্যে প্রথমে বিরক্তি, অপমানবোধ এবং তার থেকে সংগঠিত প্রতিবাদের ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধর্ষণকারী হিসেবে কিংবা নানাভাবে মেয়েদের উত্যক্ত করবার ক্ষেত্রে যাদের ভূমিকা প্রধান ছিল বলে ছাত্রীরা অভিযোগ করেছে তারা সকলেই সরকারী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে সম্পর্কিত। সবচেয়ে বড় অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সে কদিন আগে পর্যন-ও ছিল ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সম্পাদক, অন্যরা প্রভাবশালী নেতাকর্মী; এছাড়া এদের সঙ্গে বহিরাগত সশস্ত্র ব্যক্তিদেরও ভূমিকা ছিল।
চাঁদাবাজি, টেন্ডার ইত্যাদিতে সরকারি ছাত্র-সংগঠনের নেতাদের ভূমিকা কোন বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। আমাদের সমাজে এখন এটি স্বাভাবিক ব্যাপারেই পরিণত হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন সময় শোনা গেলেও এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা কমিটি কখনও কোন ব্যবস’া নেয়নি। এসব বিষয়ে ব্যবস’া না নেবার ক্ষেত্রেও প্রধান যুক্তিগুলো হল : ‘কেউ অভিযোগ করেনি’, ‘কোন তথ্য প্রমাণ নেই’, ‘এসব ব্যাপারে ব্যবস’া গ্রহণ করতে গেলে শানি- শৃঙ্খলা বিনষ্ট হবে’ ইত্যাদি। অবশ্য যে কেউ সহজ ও যুক্তিযুক্ত ছোট কয়টি প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, ছাত্রনেতা নামের এসব মাস-ান-সন্ত্রাসীদের কার্যক্রমে প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা কতটা জড়িত? কিংবা কি ধরনের স্বার্থের কারণে শিক্ষক নামের প্রশাসনিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি/ব্যক্তিরা ছাত্র নামের সন্ত্রাসী বা মাস-ানদের পৃষ্ঠপোষকতা দান কেের, তাদের প্রতিপালন করে, তাদের বিপদে আপদে রক্ষা করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় ক্ষমতা দিয়ে তাদের আড়াল করে রাখে?
এই প্রশ্নগুলো আরও জোরালো হয় যখন দেখা যায় ধর্ষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক রেহনুমা আহমেদের উপর হামলা করে তখন। তার বিচার নিয়েও টালবাহানা দেখা যায়। শিক্ষকের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষক প্রধান প্রশাসন থেকে ৩ জন ছাত্র নামের সন্ত্রাসীকে অব্যাহিত দেয়া হয়। আর যাকে দু বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয় তার পড়াশোনা শেষ!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণকারী হিসেবে অভিযুক্ত ছাত্র ও বহিরাগতদের ক্ষমতার চেহারা বোঝার জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর অবস’ানের ধরন এবং তাদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্কটাও বুঝতে হবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর শক্তি ও প্রভাবের কোন ভারসাম্য নেই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ছাত্রদল ছিল সবগুলো হলে ও ক্যাম্পাসে একচেটিয়া ক্ষমতাধর। অন্য কোন সংগঠনের কর্মীরা, এমনকি ছাত্রলীগ পর্যন-, তখন ঠিকমতো সংগঠনের কাজও করতে পারত না। এমনকি মিছিল, সভা করতে গিয়েও তাদের বাধাগ্রস- হতে হত। হলগুলোতে বরাবর একটা ত্রাসের আবহাওয়া বিরাজ করত। যে কেউ যে কোন সময় মার খেতে পারত। অনেক সময় ছাত্রদলের মিছিলে যাবার জন্য জবরদসি- করা হত, হুকুমজারি করা হত।
ছাত্রদলের এই ক্ষমতাগর্বী অবস্থান কালে ছাত্রদলের এক নেতা সীমান্তের বিরুদ্ধে এক ছাত্রীকে উত্যক্ত করা ও অপহরণ করবার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছিল। ‘অভিযোগ’ ও ‘প্রমাণ’ এর অভাবে সবসময় স্থবির থাকে যে প্রশাসন, সেই প্রশাসন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও প্রমাণ সত্ত্বেও তখন স্থবির ছিল। অপরাধীর অবিরাম হেনস্থার কারণে ছাত্রীটি পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অপরাধী সীমান্ত দলবল নিয়ে বুক ফুলিয়ে ডিগ্রি নিয়ে বের হয়। তদন্ত কমিটির তদন্ত কাজও শেষ হয়নি, বিচারের কোন কিছুও আর অগ্রসর হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবার পর, রাতারাতি বললে অত্যুক্তি হবে না, পুরো দৃশ্যপট পাল্টে যায়। যেন ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ নিজেদের স্থান বদলে নেয়। ছাত্রদলের মাস্তান-সন্ত্রাসী বলে পরিচিত একটি বড় সংখ্যা ছাত্রলীগে যোগ দেয় এবং খুব দু্রত তাদের একটি অংশ নেতৃত্বও দখল করে। অন-র্দ্বন্দ্ব ইত্যাদির মধ্যে একজন কর্মী খুনও হয়।
এই নেতৃত্ব দখল, পুনর্দখলের বিষয়টিও খেয়াল করার মতো। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলে কেন্দ্র থেকে অঞ্চল কোন পর্যায়েই সদস্য বা কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্ধারিত হয় না; প্রত্যক্ষ নির্বাচন তো দূরের কথা, মতামত বিবেচনা করবার ব্যাপারটিও হিসেবের বাইরে থাকে। এখানে সিদ্ধান- গ্রহণের মূল ভূমিকা পালন করেন উর্দ্ধতন ব্যক্তি ও এর সঙ্গে জড়িত থাকা অঞ্চলের ক্ষমতা বিন্যাস, জড়িত থাকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাও। সুতরাং বড় সংগঠন হলেও কমিটিগুলোর নেতৃত্ব কোন জনপ্রিয় প্রতিনিধিত্ব নির্ধারণের প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হয় না, ক্ষুুদ্র কোটারি বলবৎ থাকে। অস্ত্র, যোগাযোগ, অর্থ সর্বোপরি সম্পর্কিত ক্ষমতাবানদের সার্ভিস প্রদানই হয়ে দাঁড়ায় নেতৃত্ব প্রাপ্তির প্রধান মাপকাঠি। আর নেতৃত্ব প্রাপ্তি মানে আরও ক্ষমতা, অস্ত্র, আর যোগাযোগের পথ খুলে যাওয়া।
সেজন্য আওয়ামী লীগ বিএনপির মতোই ছাত্রলীগ ছাত্রদলেও হঠাৎ করে কেউ এসে নেতা হয়ে যেতে পারে এসব যোগ্যতা বলেই, আবার একই যোগ্যতার অভাবে দীর্ঘদিন সংগঠনে কাজ করেও কেউ কোণঠাসা হয়ে পড়ে থাকতে পারে। নেতৃত্বের জন্য এমনকি নিজ নিজ দলের রাজনীতি বোঝাও এসব সংগঠনে জরুরী বিষয় নয়। সুতরাং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও একইভাবে ছাত্রলীগে ছাত্রদল থেকে আগতদের একাংশ প্রভাবশালী হয়ে উঠল, নেতৃত্বও দখল করল। আকারে বড়সড় হয়ে ছাত্রদলের পুরনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হল ছাত্রলীগ। ছাত্রীদের উপর নানা মাত্রায় হামলার বিষয়টিও এতে আরও হিংস্রতার সঙ্গে যুক্ত হল। সীমান্তের ঘটনায় প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা আরও বেশি অপরাধে উৎসাহী করল দুর্বৃত্তদের।
এখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে এই সন্ত্রাসী নেতৃত্বের সম্পর্কটাও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট ও উপাচার্য নির্বাচন ক্ষমতার বিন্যাসের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সরকারে ভূমিকা বা অবস্থান এখানে নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। সেজন্য প্রশাসনের ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতায় যাবার ব্যাপারে সচেষ্ট-ব্যক্তিরা সবসময়ই সরকারের সঙ্গে সম্পর্কিত ছাত্রসন্ত্রাসীদের হাতে রাখতে চেষ্টা করেন। তোয়াজ, লেনদেন, প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি দিয়েই তারা এই কাজটি করে থাকেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই উপাচার্য মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ছাত্র সমাজ (এরশাদ), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তিনটি সংগঠনের নেতৃবৃন্দেরই উদ্যোগী ভূমিকা দেখা গেছে। একই রূপে এদের প্রতি ঠিক সেই সেই সময়ের প্রশাসনের তোয়াজকারী ভূমিকাও খুব পরিষ্কারভাবেই দেখা গেছে।

ধর্ষণ : প্রচলিত ধারণা, প্রচারণা ও আসল চেহারা
আমাদের সমাজে ধর্ষণকারীকে সমর্থন করেন বা ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করেন না এরকম লোক কমই পাওয়া যায়। কিন’ ধর্ষণের কার্যকারণ, ধর্ষণের দায়দায়িত্ব, ধর্ষণের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে এমন সব বদ্ধমূল বিশ্বাস, ধ্যানধারণা আমাদের মগজে শক্তিশালীভাবে রয়ে গেছে। ধর্ষণকারীর বিচার চাইবার চাইতে ধর্ষিতাকে হেনস’া করবার দিকেই তাই সমাজের মনোযোগ বেশি দেখা যায়। নানারকম প্রশ্ন বারবার উঠতে থাকে :
ক্স ঐ সময় মেয়েটি বের হল কেন?
ক্স ছেলেরা ওর উপর ক্ষেপলো কেন?
ক্স মেয়েটি কি কারো সাথে প্রেম করতো?
ক্স ওর কাপড় চোপড় কেমন ছিল?
কিংবা মন্তব্য আসতে থাকে :
ক্স অন্যদের ক্ষেত্রে তো হয় না ওর হয় কেন?
ক্স এক হাতে তালি বাজে না।
ক্স এ নিশ্চয়ই আগে কোন ঝামেলা করেছে।
ক্স মেয়েদের থাকতে হয় ঘরে। ওর এত লাফালাফির কি দরকার?
ক্স যাই বলেন এই মেয়েদের কথাবার্তা চলাফেরাতেই গণ্ডগোল।
ক্স এরকমভাবে চলাফেরা করলে ছেলেদের আর কি দোষ!
এসব প্রশ্ন ও কথাবার্তার ভেতরের সুরটি গুরুত্বপূর্ণ। সুরটি হলো ধর্ষণের জন্য দায়ী ধর্ষিতাই। ধর্ষণকারীর অপরাধ গৌণ। এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ ঠেকানোর প্রধান রাস-া হল মেয়েদের ঘরে থাকা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্রীরা যখন দিনের পর দিন ধর্ষণকারীদের বিচার চেয়ে আন্দোলন করেছে তখন অনেকের মুখেই এসব কথা শোনা গেছে; অনেক পত্রপত্রিকায় ধর্ষণকারীদের আড়াল করবার জন্য সচেতনভাবেই এসব প্রশ্ন বা মন-ব্য সামনে আনা হয়েছে। বলা হয়েছে : ‘এগুলো সব গুজব’, কিংবা ‘কোন প্রমাণ নেই’। বলা হয়েছে ‘ছাত্রীরা সন্ধ্যার পর বের হয় বলেই এসব ঘটনা ঘটেছে’। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের চরিত্রহনন করে আন্দোলনকে বিকৃত করে বিভিন্ন পত্রিকায় সাজানো খবর, আলোচনা ছাপা হয়েছে। অনেকেই ধর্ষণকারীদের অপরাধকে আড়াল করে ছাত্রীদেরকেই অপরাধী বানানোর চেষ্টা করেছে কিংবা বলতে চেয়েছে ‘মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করাই আসল কাজ’।
কিন্তু এসব বক্তব্য ও প্রশ্ন যারা তোলেন তাদের মধ্যে যারা ধর্ষণকারী কিংবা বুঝে শুনে ধর্ষণকারীদের পৃষ্ঠপোষক বা যারা বুঝে শুনে নারীর উপর নিপীড়নকে মহিমান্বিত করতে আগ্রহী তাদের কিছু বোঝানোর চেষ্টা বৃথা। কিন্তু বাকি যারা তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই:
১. ধর্ষণ হচ্ছে নারীর উপর পুরুষের আক্রমণ। এটি হচ্ছে ক্ষমতাবানের ক্ষমতার আগ্রাসন। এটি হল নারীর উপর, নারীর শরীরকে কেন্দ্র করে যৌন আগ্রাসন। নিপীড়নের সবচাইতে কুৎসিত, বীভৎস এবং বর্বর রূপ। ধর্ষণ অনেক ক্ষেত্রে শ্রেণী নিপীড়ন, অনেক ক্ষেত্রে জাতিগত নিপীড়নের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। ধর্ষণকারীর অবস’ান তাই সবসময়, আপেক্ষিক অর্থে, ক্ষমতার মধ্যে। বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ, আইনব্যবস্থা এবং শোষণ পীড়নমূলক সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধর্ষণকারীদের একেকটি অস্ত্র।
২. যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক নারী বা পুরুষের যৌন আকাঙ্খা থাকবারই কথা। যৌন সম্পর্ক আর ধর্ষণ এক কথা নয়। ধর্ষণ বস্তুত নারী পুরুষের স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ককে খারিজই করে, স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে যে পারস্পরিক সম্মতি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মানবোধের দাবি করে তার জায়গায় ধর্ষণ তৈরি করে অশ্রদ্ধা, বলপ্রয়োগ ও অসম্মানের সম্পর্ক। যৌন সম্পর্কের মধ্যে কোনরকম বলপ্রয়োগ বা প্রতারণার উপাদান থাকলে তা ধর্ষণের শামিল, তা প্রেম বা বৈবাহিক কাঠামোর মধ্যে হলেও। আর আমরা যে ধর্ষণ চারদিকে দেখছি তা হল আরও হিংস্র, দলবদ্ধ নিষ্ঠুর বর্বরতা।
৩. বাংলাদেশে যে ধর্ষণের ঘটনাগুলি পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে তার উল্লেখযোগ্য আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ঘরে। ঘরে নারীর অবস্থান তাই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না। ঘর ছাড়াও নারী ধর্ষিতা হয়েছে, হচ্ছে কর্মস্থলে। গার্মেন্টস কারখানায় মালিক ও তার মাস্তানদের দ্বারা গার্মেন্টস এর নারী শ্রমিকদের ধর্ষণের ঘটনা পত্রিকার পাতাতেই একাধিকবার এসেছে। যতগুলো ধর্ষণের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে তার অনেকগুলো ঘটনার সময়ই দিনের বেলা। কিছুদিন আগে তানিয়া ও মৌসুমী নামে দুই শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল সকাল বেলা। তানিয়া ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল আদালতের ভবনের মধ্যে, আদালত চলাকালীন সময়ে। এছাড়া অনেকগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পুলিশি হেফাজতে।
কাজেই ধর্ষণের অজুহাত হিসেবে যারা নারীর স্বাভাবিক চলাফেরাকে নির্দেশ করেন তারা ধর্ষণকারীদেরই আড়াল করেন। আর রাতে পুরুষের চলাফেরার প্রয়োজন থাকলে নারীর থাকবে না কেন? নারী স্বাভাবিক প্রয়োজনমত চলাফেরা করলে তার উপর হামলা, নির্যাতন, ধর্ষণ, আগুনে পুড়িয়ে মারা, এসিড মারা যারা যৌক্তিক করতে চায়, তাদের সাথে এই দুর্বৃত্তদের তফাৎ কী?
৪. ধর্ষণকে প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, ব্ল্যাকমেইল, ব্যবসা ইত্যাদির মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত আছে অনেক। অনিচ্ছুক, প্রতিবাদী নারীকে শাস্তি দান, কোন পুরুষের উপর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য তার প্রিয় নারীর উপর আক্রমণ, কোন নারীকে ধর্ষণ করে তারপর তাকে ব্ল্যাকমেইল করা, কোন নারীকে ধর্ষণ করে তাকে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিত হতে বাধ্য করা, কোন নারীকে ধর্ষণ করে সমাজ বিচ্যুত বানিয়ে তাকে পাচার, তাকে যৌন ব্যবসায় ব্যবহার করা ইত্যাদি অজস্র্র ঘটনা প্রতিদিন আমাদের সমাজে ঘটছে।
পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোর অস্ত্র হিসেবে ধর্ষণ যখন পুঁজিবাদী মুনাফা কেন্দ্রিক তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়, কিংবা পুঁজিবাদী ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে যখন তা অবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন তা হয় আর ভয়ংকর। ধর্ষণকারী তখন আইনকে পকেটে ভরে, আইনরক্ষাকারী বাহিনী তখন ধর্ষণকারীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীতে পরিণত হয়। ধর্ষণকারী আরও সামাজিক অর্থনৈতিক মোড়ল তখন একাকার।
৫. ধর্ষণকে প্রায়শ:ই বলা হয় পাশবিক ব্যাপার। ধর্ষণকারীকে বলা হয় পশু। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে এই বর্ণনা খুবই ভুল।
এটি হচ্ছে নিপীড়নের একটা বর্বর চেহারা। একজন নারীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে নির্যাতন-নিপীড়নে তার কান্না, যন্ত্রণা, অপমান, কষ্ট, রক্তপাত, জ্ঞান হারানো এমনকি মৃত্যু দেখে এক বা একাধিক দুর্বৃত্তের উল্লাসই হল ধর্ষণের আসল চেহারা। পশু জগতে নিজ প্রজাতির একজন সদস্যের কষ্ট সৃষ্টি করে উল্লাস করতে দেখা যায় না। পশু দল বেঁধে হিংস্র বলপ্রয়োগ করে উৎসব করে না। ধর্ষণ পাশবিকতা নয়, আরও অনেক বর্বর নিপীড়ন; ধর্ষণকারী পশু নয়, নিকৃষ্টতম বর্বর প্রাণী।

‌’সাধারণ ছাত্র ঐক্য’ ঃ আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও তার গতিশীলতা
ধর্ষণ এবং তারপর নানাভাবে ছাত্রী উত্যক্ত করবার ঘটনাবলি ফিসফিস ও গুঞ্জনের মধ্যে থাকতে থাকতেই এক পর্যায়ে আগষ্ট মাসের ১৭ তারিখ একটি দৈনিকে তিনটি ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত হয়। ১৯ আগষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করে ৪০/৫০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে প্রথম মিছিল করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করে একই দিনে পোস্টার লাগায়। ২০ আগষ্ট ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে সামষ্টিক প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের এক অভূতপূর্ব অধ্যায়ের সূচনা হয়। প্রায় আটশো মেয়ে, যাদের মধ্যে সাতশোরও বেশি কোন সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সরব শ্লোগানসহ ধর্ষণকারীদের বিচার দাবি করে এইদিন মিছিলে শামিল হয়। যে ছাত্রীরা অনেকটা প্রতিবাদের গুরুত্ববোধ থেকে এই মিছিলের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের কাছেও এই মাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল অবিশ্বাস্য। সেদিন নামও ঠিক হয়নি। নাম ঠিক হয় দুদিন পর : ‘সাধারণ ছাত্র ঐক্য’।
এরপর থেকে একমাসেরও অধিক সময় পার হয়েছে। মিছিলে অংশগ্রহণে উঠানামা হয়েছে কিন্তু আন্দোলন থামেনি। একটানা এই আন্দোলন যেভাবে অব্যাহত থেকেছে তা অভূতপূর্ব। এই মাসাধিককালের আন্দোলন প্রবাহের সময়কালে বন্যা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু আন্দোলনের ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন্ন থেকেছে।
আন্দোলনে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রধান ধরনটি ছিল নীরব মিছিল। এছাড়া মুখে কালো কাপড় বেঁধে শোভাযাত্রা, লিফলেট, সমাবেশ, সিন্ডিকেট সভা ঘেরাও, অবস’ান ধর্মঘট, উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও ইত্যাদিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। সিন্ডিকেট সভা ঘেরাও থেকে ছাত্রীরা একদিন সারাদিন সারারাত শেষে ভোরে হলে ফিরেছে, একদিন ফিরেছে রাত সাড়ে ৩টায়, আরেকদিন সারা রাত শেষে পরের পুরো দিন উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করে রেখেছে।
এমনও হয়েছে রাতে একদিকে ছাত্রীরা মাসত্মান সন্ত্রাসী ধর্ষণকারীদের বিরম্নদ্ধে শেস্নাগান দিচ্ছে, ঠিক পাশেই অভিযুক্ত ধর্ষণকারীদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ হুমকি দিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে শ্লোগান দিয়েছে- অস্ত্রের হামলার ভয় দেখিয়েছে। কিন’ মিছিল ও প্রতিবাদী শ্লোগান অব্যাহত থেকেছে। প্রধানত ছাত্রীদের এই সাহসী ও ধারাবাহিক লড়াই যেমন নিছক সংগঠন নির্ভর ছিল না তেমনি এটি শুধু স্বতঃস্ফূর্তও নয়। এই আন্দোলন অনৈতিহাসিকও নয়, শুধু জাহাঙ্গীরনগরের বিষয়ও নয়। এই আন্দোলন অনেকগুলো মাত্রার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে এবং প্রতিরোধ নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। অন্যদিকে এই আন্দোলনের মধ্যে পুরো বাংলাদেশের সমাজে প্রতিরোধ আন্দোলনের কিছু সাধারণ এবং নতুন প্রবণতারও আভাস পাওয়া যায় সেজন্য এই আন্দোলন থেকে শিক্ষিত হবার অনেক উপাদানও আছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের ব্যাপক ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিভিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গত কয়েক বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা অনেকগুলো মাইলফলক স্থাপন করেছে। ক্রমাগত একের পর এক আন্দোলনের ঘটনা অধিকতর জোরদার, অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, অধিকতর বড় শত্রুর মুখোমুখি আন্দোলনে মেয়েদের সমবেত করেছে। একজন ছাত্রের তস্কর আচরণের বিরুদ্ধে অপমানিত ছাত্রীর ভার নিজের ঘাড়ে নিয়ে রাত দুপুরে শত ছাত্রীর মিছিল নিয়ে তার প্রকাশ্য যাত্রা শুরু। এরপর সূর্যাস্ত আইনের বিরুদ্ধে লড়াই, সীমান্ত নামক দুর্বৃত্তের হামলার বিরুদ্ধে লড়াই…। বিজয় কোনটিতেই পরিষ্কারভাবে ঘটেনি, কিন্তু এসব আন্দোলনের বিজয়ের দিকটিই যে ভারী তা ক্রমান্বয়ে অধিক থেকে অধিকতর আন্দোলন সৃষ্টির, শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা তৈরি থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এবারের আন্দোলনের সাধারণ ছাত্র ঐক্য ব্যানারে ছাত্রীদের বিপুল অংশগ্রহণ এবং অপমান, চরিত্রহনন, হামলা এমনকি ধর্ষণের হুমকি সত্ত্বেও একটানা আন্দোলনে লেগে থাকার পেছনে আগের আন্দোলনগুলো থেকে পাওয়া শক্তিও সাহস যুগিয়েছে, আত্মসম্মানবোধ ক্রমে প্রবল হয়েছে, নিজেদের আত্মসমর্পণ মেনে নেয়া অপমানে মুখ বুঁজে থাকার অবস্থার ক্রমাগত ক্ষয় ঘটেছে।

আন্দোলন সংগঠন ও এর রাজনৈতিক চেহারা
এই আন্দোলনে আপাতঃদৃষ্টিতে স্বতঃস্ফূর্ততার অংশ ছিল বেশি, কিন্তু এটাকে পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বলা যায় না। হঠাৎ করে জ্বলে উঠে শেষ হয়ে যাওয়ার মতো নয়, এর ধারাবাহিকতা আছে, বুঝেশুনে প্রবল বাধার মুখেও লেগে থাকার ব্যাপার আছে।
এই আন্দোলনে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছাত্র সংগঠনের কর্মীদের চাইতে সংগঠন বহির্ভূত ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক গুণে বেশি। কিন্তু এটা অরাজনৈতিক আন্দোলন নয়, বরং এর রাজনৈতিক মাত্রা অনেক স্পষ্ট। এর ব্যানার কোন একক রাজনৈতিক সংগঠন বা কয়েকটি সংগঠনের যৌথ প্লাটফর্ম নির্দেশ করে না; কিন্তু এজেন্ডা, আন্দোলনের স্পষ্ট আশু ও অস্পষ্ট দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য-কর্মসূচীর কারণে এটা অতি অবশ্যই রাজনৈতিক।
আন্দোলনে সংগঠন হিসেবে আমরা যাদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখি তারা হল সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য’ ব্যানারে এই দুটি ছাত্র সংগঠন কাজ করে। এছাড়া বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, দুর্বলতর হলেও, আন্দোলনে সক্রিয় আছে। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সংগঠনের নামে এর সাথে না থাকলেও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও এর মধ্যে কাজ করেছে। এছাড়া সংগঠনের কর্মী হিসেবে ছাত্রলীগের কিছু সদস্য বিশেষত ছাত্রী কর্মীরা এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। ‘৮ই মার্চ পর্ষদ’ নামে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একটি যৌথ সংগঠন, যেটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের নামে নারী প্রশ্ন নিয়ে কাজ করার জন্য ক্যাম্পাসে গড়ে উঠেছে, তার ছাত্রী কর্মীরাও আন্দোলনে হয় ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে কিংবা সাধারণ ছাত্রী হিসেবে সক্রিয় ছিল।
আন্দোলনের মূল নিয়ন্ত্রণ বরাবর ছাত্রীদের হাতেই, ছাত্রী হলের মাধ্যমেই সমন্বয়কারী নির্বাচন করা হয়েছে, সেখানেই সমন্বিত সাধারণ সভা হয়েছে। কিন্তু ছাত্ররাও এতে অংশ নিয়েছে। অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের একটি অংশ ছাত্রসংগঠনগুলোর কর্মী, অন্যরা সংগঠনবহির্ভূত। ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছাত্রীদের তুলনায় সবসময় অনেক কম।
ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক ভূমিকা কিংবা ছাত্রছাত্রীদের লড়াই বলতে এক সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর কথাই কেবল বোঝাতো। কিন্তু ক্রমে এই অবস্থার পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এটা শুধু ছাত্র রাজনীতির বেলাতেই নয় শ্রমিক আন্দোলন, এমনকি পুরো দেশকে নাড়া দেবার মতো অনেক আন্দোলনও এখন সবক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিচিত রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।
বিষয়টি অন্যভাবে বললে এভাবে বলা যায় যে, বর্তমান সমাজের শ্রেণী লিঙ্গ জাতিগত নিপীড়ন বৈষম্যবিরোধী বিভিন্ন ইস্যু যেভাবে উত্থাপিত হচ্ছে সেগুলোকে ধারণ করতে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর ব্যর্থতা বা দুর্বলতার মুখে সমাজে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আপাতঃ বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব উদ্যোগ, সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার জোরেই পুরনো সংগঠনগুলোকে ছাপিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিদ্যমান বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনে তার কর্মসূচি, তার অগ্রাধিকার, তার কর্মপদ্ধতি পর্যালোচনা ও ক্ষেত্র বিশেষে পুনর্বিন্যাসের তাগিদ এসব থেকে তৈরি হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্যের কথা আগে বলেছি। এই আধিপত্যের ধরন এমনই যে অন্য কোন ছাত্র সংগঠন এমনকি সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষেও তাদের আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ উত্থাপন তো দূরের কথা, রুটিন কাজ অব্যাহত রাখাও অসম্ভব ব্যাপার। এরকম পরিস্থিতিতে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের পক্ষে সরকারি ছাত্র সংগঠনের বিরম্নদ্ধে কোন ন্যূনতম প্রতিরোধ রচনাও সম্ভব হয়নি।
কিন্তু তারপরও উল্লেখযোগ্য এই যে, গত ৫ বছরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ এই দুটো সরকারি ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিংবা তাদের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে বেশ বড় আকারে বেশ কয়েকটি ছাত্র আন্দোলন হয়েছে। এসব আন্দোলনের মধ্যে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণ ছিল কিন্তু এগুলোর সম্মিলিত রূপ ছিল ছাত্রসংগঠনগুলোর সম্মিলিত শক্তির চাইতেও অনেক বড়। আর সবগুলোতে ছাত্রীদের ভূমিকা ছিল মুখ্য এবং সবগুলোতেই সংগঠন বহির্ভূত ছাত্রীদের অংশগ্রহণ ছিল অনেক বেশি।
এই আন্দোলনগুলোর আপাত সাফল্যের মাত্রা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে কিন্তু সরকারি ছাত্রসংগঠন, সরকারি যন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে এগুলো একের পর এক যে ধাপ তৈরি করেছে তার প্রভাব থেকেছে সুদূরপ্রসারী।
সীমান্তের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রীদের ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের হুমকি, ত্রাস মোকাবিলা করতে হয়েছে; সূর্যাস্ত আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে চরিত্রহনন কুৎসার ঝুঁকি নিতে হয়েছে, পুরো প্রশাসন ও সামাজিক অধিপতি মূল্যবোধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে; আরিচা রোডে গুণ্ডাদের হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রথমে পুলিশ পরে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে সরাসরি জখম হতে হয়েছে ছাত্রী ও ছাত্রদের আর সবশেষে ধর্ষণ বিরোধী লড়াই করতে গিয়ে কুৎসা থেকে ধর্ষণের হুমকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে ছাত্রীদের।
সংগঠন করতে অনভ্যস্ত বড় অংশ ছাত্রী কীভাবে এতসব প্রতিকূলতা মোকাবেলায় মনোবল গড়ে তুলতে পারল, এতকিছুর পরও আন্দোলনে টিকে থাকতে পারল সেটা একটা প্রশ্ন এবং খুবই বড় একটি ইতিবাচক শিক্ষা।
ধর্ষণ, সূর্যাস্ত আইন, কিংবা বিভিন্ন মাত্রার যৌন নিপীড়ন ইত্যাদি কখনো এর আগে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর এজেন্ডা ছিল না। কিন্তু এগুলো যে বর্তমানে সমাজে বৈষম্য নিপীড়নের একেকটি বড় পাথর এবং এগুলো যে বৈষম্য নিপীড়ন বিরোধী লড়াই এর বড় ক্ষেত্র তা প্রতিষ্ঠা করেছে রাজনৈতিক সংগঠনের একক নিয়ন্ত্রণের বাইরে ক্রমে বিকশিত হওয়া এসব আন্দোলন। আমরা ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যা নিয়ে সারা দেশব্যাপী যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটাকে যদি বিবেচনায় আনি তাহলে জাতীয় পর্যায়ে একই ঘটনার আরেকটি রূপ দেখব।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও মজুরি, কাজের নিরাপত্তাহীনতা থেকে মালিকদের ধর্ষণ নিপীড়ন পর্যন্ত ইস্যুকে আন্দোলনের কেন্দ্রে স্থাপন না করলে তাদের দৈনন্দিন জীবনের ক্ষোভ/ প্রতিবাদ/ দুঃখ স্পষ্ট করা যাবে না। আর এসব ইস্যু পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে একাকার করে দেয়। বর্তমান সময়ে পুরুষতন্ত্র ও পুঁজিবাদ পরস্পর পরস্পরের ভেতর কীভাবে বসবাস করে সে সম্পর্কে বাম সংগঠনগুলোর যথেষ্ট মনোযোগ আছে একথা বলা যাবে না। কিন্তু বৈষম্য নিপীড়ন বিরোধী লড়াইয়ে শ্রেণী, লিঙ্গ, জাতিগত বৈষম্য নিপীড়নকে উপলব্ধি করা ছাড়া অগ্রসর হবার রাস্তা নেই।

রাস্তা বহুদূর
মাসাধিককাল ধরে একটানা আন্দোলন ঘেরাও নিদ্রাহীন মিছিল শ্লোগান অবরোধ ইত্যাদির পর অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গঠিত কমিটির মাধ্যমে মানিক, মিরাদুল, বরকত, ডালাস, নাঈম, আনিস, রনিসহ ১৩ জন দুর্বৃত্তের নাম ধর্ষণকারী ও সহযোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। প্রমাণিত হয়েছে এতদিন প্রশাসন, সরকারি মহল, কতিপয় শিক্ষক, সরকারি ছাত্রসংগঠন ‘তথ্য নেই’, ‘গুজব’, ‘চক্রান্ত’, ইত্যাদি বলে এদেরকেই রক্ষা করতে চেয়েছে।
এই ধর্ষকদের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি দেয়ার আইনি এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। তাছাড়া ক্ষমতাবানদের মধ্যে ধর্ষণকারীদের রক্ষাকর্তাদের কুৎসিত ভূমিকা তো আছেই। আর আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনের যে চেহারা তাতেও এদের যথার্থ বিচার হবার সম্ভাবনা নেই। সেই হিসেবে এই দুর্বৃত্তরা অধিকতর দুর্বৃত্ত শাসকশ্রেণীর মধ্যে ক্রমে একীভূত হবে সন্দেহ নেই। তাছাড়া ভোল পাল্টিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টাও হবে।
কিন্তু এদের শনাক্ত করা যে একটানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সম্ভব হল তার গুরুত্ব ও সাফল্যকে আমাদের হিসাবে রাখতে হবে। আর তার কাজ তো এখানেই শেষ হবে না। এই আন্দোলনের কেন্দ্রে নিপীড়ন-নির্যাতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে উপলব্ধি, সজাগ বোধ জায়গা তৈরি করেছে তার যাবার রাস্তা তো আরও বহুদূর।
‘আইনের শাসন’ আওয়াজ দিয়ে অনেকে প্রতারণা করতে চায়, কিন্তু আন্দোলনগুলো থেকেই বোঝা যায় একে তো যে আইন প্রচলিত আছে সেগুলো বৈষম্যমূলক, প্রতারণামূলক, নিপীড়নমূলক। তারপরও এগুলো থেকে কিছুটা বিচার পেতে গেলেও দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ছাড়া অগ্রসর হওয়া যায় না। এটা ইয়াসমিনের ক্ষেত্রে প্রমাণিত। প্রমাণিত এমনকি ‘শিক্ষিত’দের জায়গা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও। আইন নিজের গতিতে চলে না, তাকে চালাতে গেলেও জনগণের শক্তি প্রদর্শন করতে হয়। আর যথেষ্ট শক্তি গড়ে উঠলে জনগণ এই বৈষম্য পীড়নমূলক ও আইনি কাঠামো মেনে নেবে কেন?
২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮
(সংস্কৃতি, অক্টোবর ’৯৮)