আজকে যখন আমরা এই সমাবেশ করছি এর মধ্যে কয়েক দফা সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে, গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। সরকার সবসময়ই যুক্তি দেয় যে গ্যাসের দাম, তেলের দাম, বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হচ্ছে এই কারণে যে অনেক টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বলা হয়, যেহেতু এই ভর্তুকি জনগণের টাকা থেকে দিতে হচ্ছে, সেহেতু এগুলোর দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কমালে সেটা জনগণেরই লাভ। এর চেয়ে বড় তথ্য বিকৃতি কিংবা মিথ্যাচার আর হতে পারেনা। আমরা সবসময়ই ব্যাখ্যা করে বলেছি, ভর্তুকি যে কারণে দেয়া হচ্ছে সেই কারণ দূর না করলে জনগণের উপর এই বোঝা বাড়তেই থাকবে।
কেন ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে? কারণ নিজেদের ক্ষমতাকে পঙ্গু করে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে ৩০ গুণ বেশি দামে গ্যাস কেনা হয়েছে। জাতীয় সংস্থা যদি আজকের সারাদেশের সকল গ্যাস সরবরাহ করার সুযোগ পেত তাহলে গ্যাস খাতে কোন ভর্তুকি থাকত না। যদি রাষ্ট্রীয় প্ল্যান্ট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হত, তাহলে বিদ্যুৎ খাতে কোন ভর্তুকি থাকত না। যদি এই গ্যাস দিয়ে বিদ্যুত প্ল্যান্ট চালানো হত, যদি রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো প্রয়োজনীয় নবায়ন ও মেরামত করা হত, যদি মেরামত করা হত গ্যাসকূপ, যদি তিতাস এবং হবিগঞ্জ থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো হত তাহলে কোন গ্যাস সংকটই থাকতো না, আর তেল ভিত্তিক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বা কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট করতে হত না, এত ঋণ কিংবা এই বারবার দামবৃদ্ধির যুক্তিও থাকতো না।
সুতরাং এই কাজগুলো করলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি দিতে হত না, অতিরিক্ত তেলের আমদানি করে বহু হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির চাপ বাংলাদেশের মানুষের ওপর পড়ত না। কিন্তু এই সহজ সমাধানগুলি থাকা স্বত্বেও, এবং আমরা বহুবছর যাবত এই সমাধানগুলি বলা সত্বেও সরকার এই সহজ সমাধানের পক্ষে যায় নাই। কারণ, যদি জাতীয় সংস্থা গ্যাস উত্তোলন করে তাহলে শত কোটি-হাজার কোটি টাকার কমিশন পাওয়ার সুযোগ থাকেনা। যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় রাষ্ট্রীয় বিদ্যুত প্ল্যান্ট থেকে তাহলে কমিশন পাওয়ার সুযোগ থাকেনা। সেই কারণে, দুর্নীতির কারণে ও ভুল নীতির কারণে, বাংলাদেশের ওপর বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ আর বহুজাতিক কোম্পানী আর লুটেরাদের আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়ার কারণে আজকে বাংলাদেশে বহু খাতে অস্থিরতা, অপচয়, ঋণ আর ভর্তুকি বেড়েছে। আর এসব কারণে সরকার ঋণগ্রস্থ, রাষ্ট্র ঋণগ্রস্থ, আর ভর্তুকি কমাতে গিয়ে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোতে ব্যক্তি-পরিবার সকলেই ঋণগ্রস্ত। মানুষের ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। দারিদ্র বিমোচনের কথা আমরা সরকারের মুখে শুনতে শুনতে হয়রান, কিন্তু এসব নীতির কারণে সেই দারিদ্র বেড়েছে। সুতরাং আমরা যে আন্দোলন করছি এই আন্দোলন শুধু তেল-গ্যাস-কয়লা রক্ষার আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন হচ্ছে এমন একটি নীতি-রাজনীতি এবং এমন একটি ক্ষমতার প্রশ্ন যা নিশ্চিত হলে বাংলাদেশের মানুষের পকেটের টাকা বিদেশী কোম্পানির জন্য, কমিশনভোগীদের জন্য নিশ্চিত করতে যেয়ে দেশের মানুষের সর্বনাশ হয়না। আপনারা জানেন বাংলাদেশে জাতীয় কমিটি আন্দোলন করার ফলে বিদেশি কোম্পানী, বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল চাপ থাকা সত্বেও তৎকালীন বেশ কয়েকটি সরকার চেষ্টা করা সত্বেও গ্যাস রফতানি করতে পারে নাই। আজকে তেলের জন্য ভর্তুকি দিতে হচ্ছে প্রায় ২০,০০০ কোটি টাকা, আর যদি তারা সেই সময়ে গ্যাস রফতানি করতে পারত, তাহলে সেই গ্যাসের বিকল্প হিসেবে আরও অনেক তেল আমদানী করতে হত, তার জন্য অতিরিক্ত ভর্তুকি দিতে হত প্রায় আরো ২০,০০০ কোটি টাকা। সুতরাং সেই আন্দোলন শুধু গ্যাস সম্পদ রক্ষা করেছে তাই নয়, মানুষের প্রতিদিনের জীবনকে আরও ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে। আপনারা জানেন আন্দোলন করে ঠেকানো না হলে চট্রগ্রাম বন্দর আজ জালিয়াত মার্কিন কোম্পানির দখলে থাকত। আমরা এতদিন নৌ-বন্দর নিয়ে চিন্তিত ছিলাম, চিন্তিত আছি, নৌ-বন্দরের বিষয়ে আমাদের অনেক কর্মসূচী সামনে আসবে। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি বিমান বন্দরও হুমকির মুখে। বাংলাদেশের সরকার দাবী করছে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিদেশি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হবে। যদি বিমান বন্দরের নিরাপত্তাই সরকার নিশ্চিত করতে না পারে, যদি বিমান বন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিদেশি কোম্পানীর কাছে বিমান-বন্দর লিজ দিতে হয়, তাহলে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার কী করবে? বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কি পুরো দেশকেই বিদেশিদের কাছে এই সরকার লিজ দেবে?
আমাদের এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের যে শক্তি গড়ে উঠছে তার খন্ড খন্ড বিজয় দেশকে অনেক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে। কয়েকদিন আগে ঢাকা-সুনেত্র লংমার্চ করেছি আমরা, লংমার্চ শেষ হওয়ার পরে পেট্রোবাংলা একটা প্রেস-বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে তারা বলেছে সুনেত্রকে তারা কোন বিদেশি কোম্পানির হাতে দেবে না। আমরা বলতে চাই সরকারের এই ঘোষণা আমাদের লংমার্চ এবং আন্দোলনের বিজয়। আন্দোলনের কারণেই তারা বাধ্য হয়েছে এই ঘোষণা দিতে। কারণ ঢাকা থেকে সুনেত্র পর্যন্ত লংমার্চের মধ্য দিয়ে জনগণের যে সমর্থন আমরা লক্ষ করেছি তাতে আমরা স্পষ্ট বুঝেছি এই অঞ্চলটি ক্রমে দুর্গ হয়ে উঠছে, কোন সরকারের ক্ষমতা নাই ঐ গ্যাসক্ষেত্রকে কোন বিদেশি কোম্পানির হাতে দেয়। কিন্তু চক্রান্ত থামে নাই। পিএসসি ২০১১ নিয়ে ফাইল চালাচালি হচ্ছে। এই সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র যদি জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে ঠিকমত উত্তোলন করা হয়, এইখানে যে গ্যাস সম্পদ আছে সেই গ্যাস দিয়ে সারা বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। তিতাস ও রশিদপুরে যে বাড়তি গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, সর্বোপরি বঙ্গোপোসাগরে যে বিশাল গ্যাসের মজুদ আছে এইসমস্ত গ্যাস সম্পদ যদি জাতীয় সংস্থার নেতৃত্বে, তাদের শতভাগ মালিকানা, রফতানি নিষিদ্ধ করে দেশের কাজে ব্যবহার হয় তাহলে বাংলাদেশে আগামী ৪০ বছর বিদ্যুতের কোন সংকট থাকবে না, গ্যাসের কোন সংকট থাকবে না। এজন্য আমাদের এই আন্দোলন শুধুমাত্র সম্পদ রক্ষার আন্দোলন নয়, এই আন্দোলন ঘরে ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার আন্দোলন, দেশের গ্যাস সম্পদ দেশের সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার আন্দোলন, কয়লা সম্পদ যাতে দেশের মানুষের কাছে শতভাগ লাগে তার আন্দোলন।
কিন্তু আপনারা জানেন বঙ্গোপসাগর কনকো ফিলিপসের হাতে তুলে দেওয়ার চুক্তি হয়েছে, তারা দুটো ব্লক দিয়েছে, আরো অন্যান্য ব্লক তাদের হাতে যাওয়ার নানারকম ফন্দিফিকির চলছে। এতে শতভাগ গ্যাস রফতানির আশংকা আছে। তাই বঙ্গোপসাগর, সমুদ্র এবং ভূমি সমগ্র ক্ষেত্রে তাদের এসব অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনকে শক্তিশালী ও অপ্রতিরোধ্য জায়গায় আমাদের নিতে হবে। কারণ তা না করলে লুন্ঠনকারী, কমিশনভোগী, বিদেশি কোম্পানিগুলোর যে মাত্রায় দখল-লুন্ঠনের মতলব আছে তা সম্পন্ন হলে এই দেশের কোন অস্তিত্ব থাকবে না।
সরকারের পক্ষ থেকে অনেকসময় আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়, বলা হয় আপনাদের কি এখতিয়ার আছে? বলা হয় আওয়ামী লীগ নির্বাচিত সরকার, বিএনপি জোট নির্বাচিত সরকার, নির্বাচিত সরকার হিসেবে তারা জনগণের প্রতিনিধি তারা যা খুশি তা করতে পারেন। আমাদের জবাব হচ্ছে, নির্বাচনের আগে জনগণকে আপনারা এক কথা বলবেন আর নির্বাচনের পরে বলবেন আরেক কথা, জনগণ এটা কোনভাবেই মেনে নেবে না। জনগণের পরিষ্কার কথা, তাঁরা আপনাদেরকে ভোট দিতে পারে, কিন্তু যাখুশি তাই করবার জন্য আপনাদের হাতে এই দেশকে তুলে দেয় নাই। দেশ নিয়ে যা খুশি তাই করার এখতিয়ার আপনাদের নাই। আপনারা যদি নির্বাচনের আগে জনগণের কাছ থেকে অনুমুতি নিতেন যে, আমরা উন্মুক্ত খনি করতে চাই, জনগণ যদি আপনাদের অনুমতি দিত তাহলে আপনারা বলতে পারতেন আপনারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে আপনারা কথা দিয়েছেন যে আপনারা উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধ করবেন, আপনারা কথা দিয়েছেন ফুলবাড়ী চুক্তির পুর্ণ বাস্তবায়ন করবেন, নির্বাচনের পরে এসে আপনারা বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত খনি করার চক্রান্ত করছেন। আমরা বলছি বড়পুকুরিয়ার কৃষকেরা ক্ষতিপূরণ নেবে কিন্তু কোনভাবেই সেখানে উন্মুক্ত খনি হতে দেবে না। আপনারা নির্বাচনের আগে জনগণের স্বার্থ দেখার কথা বলেছেন, নির্বাচনের পরে এসে কনকো ফিলিপসের কাছে গ্যাস সম্পদ রপ্তানি করার চুক্তি করেছেন। এবং এখন মার্কিন কোম্পানির পাশাপাশি চাইনিজ কোম্পানি, ভারতীয় কোম্পানি, রাশিয়ান কোম্পানিকেও আপনারা যুক্ত করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের আগে আপনারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছেন, আর নির্বাচনের পরে বঙ্গোপোসাগরকে মার্কিন কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।
আজকে আমাদের দেশে একের পর এক সরকার আসে, আমরা দেখি প্রতিটি সরকার মুচলেকা দেয়া সরকার, প্রতিটি সরকার কমিশনভোগী সরকার, প্রতিটি সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিপক্ষ সরকার। সরকার যখন জনগণের সম্পদ জনগনের শত্রুদের হাতে তুলে দেয়, জনগণকে দারিদ্র-সহিংসতা এবং ভয়াবহ বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিয়ে এই সম্পদ লুটেরাদের হাতে তুলে দেয় তখন জনগণকেই পাহারাদার হিসেবে ভূমিকা পালন করতে হয়। আমাদের এই আন্দোলন জনগণের সেই পাহারাদারের ভূমিকার সরব উচ্চারণ। আর জনগণ এই দেশের মালিক, জনগণ এই সম্পদের মালিক, জনগণের মধ্যে এই মালিকানার বোধ নিয়ে আসাটাই হচ্ছে আমাদের আন্দোলনের মূল কথা। এই আন্দোলন জনগণের মধ্যে টিকিয়ে রাখা হীনমন্যতা দূর করার আন্দোলন, এই আন্দোলন জনগণকে মালিকের জায়গায় প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলন, এই আন্দোলন তার দাসত্বের বোধকে, দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত করার তাগিদকে বিস্তৃত করার আন্দোলন।
এ পর্যন্ত আমরা যে আন্দোলন করেছি, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণ প্রমাণ করেছেন তারা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকেন, তারা যদি যথাযথভাবে তথ্য এবং যুক্তি নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়ান তাহলে সরকার যতই দানবীয় শক্তি নিয়ে তাদের সামনে আসুক না কেন তাদের কোন ক্ষমতা নাই যে ন্যায্যতা নিয়ে দাঁড়ানো ঐক্যবদ্ধ মানুষকে পরাজিত করে। সেই অপরাজেয় জনগণের শক্তির উপর দাঁড়িয়েই আজকে আমাদের লড়াই বিস্তৃত হচ্ছে। আগামী মাস বিজয়ের মাস হিসেবেই আমরা জানি। এই মাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এই বাংলাদেশের সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার নতুন আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষিত হবে, সেই কর্মসূচীতে সারাদেশের সকল পর্যায়ের মানুষকে আপনারা যুক্ত করবেন, যারা এইখানে এসেছেন তাদের কাছে আমাদের আহবান আপনারা ফিরে গিয়ে জেলা কমিটির পরে উপজেলা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি, গ্রাম কমিটি গঠন করবেন এবং এই আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য শক্তি তৈরী করে এই দেশে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার যে রাজনৈতিক শক্তি, যে সামাজিক শক্তি, যে সাংস্কৃতিক শক্তি সেই শক্তিকে বিকশিত করবেন। আপনাদের আবারো অভিনন্দন জানিয়ে আপাতত শেষ করছি।
(নভেম্বর ২৬, ২০১১ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জাতীয় কমিটির মহাসমাবেশে প্রদত্ত বক্তব্য)