ওয়াসার এমডি ঢাকা শহরে পানি শতভাগ বিশুদ্ধ বলে দাবি করেছেন। তার জবাব দিয়েছেন জুরাইনের মিজান পরিবারসহ ঢাকার কয়েকজন নাগরিক, ওয়াসার পানি নিয়ে তাদের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হয়েছেন। ওয়াসার এমডি একা নন, সরকারের দলিলপত্রেও তথ্য এ রকমই। সারা দুনিয়াকে জানানো হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছেন। অথচ আমরা জানি, দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ আর্সেনিক আক্রান্ত এলাকায়। এ ছাড়া পাইপলাইনে যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা ঢাকায় তো বটেই, দেশের অনেক স্থানেই ফুটিয়ে খাওয়ার পরও নিশ্চিন্ত থাকা যায় না। সমস্যা ওয়াসার একক নয়, এর পেছনে বিদ্যমান উন্নয়ন দর্শন ও সর্বজনের সম্পদে করপোরেট আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নানা জালও দেখতে পাওয়া যায়। শুধু বাংলাদেশেও নয়।
একসময় কোনো কিছুর দাম খুবই নগণ্য হলে আমরা বলতাম ‘পানির মতো দাম‘; কিন্তু এখন তা বলার উপায় নেই। বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পানির দাম এখন কোনো কোনো দেশে জ্বালানি তেলের চেয়েও বেশি। পানি এখন মুনাফার বাণিজ্যে ক্রমান্বয়ে আটকে যাচ্ছে। মাটির ওপরের ও নিচের কোনো পানিই আর সর্বজনের সম্পদ থাকছে না। দখলে চলে যাচ্ছে কিছু কোম্পানির হাতে; কিন্তু একটি সরল প্রশ্ন আমাদের মাথায় রাখতেই হবে। পানি প্রকৃতির অংশ, এটা কেউ তৈরি করেনি। এটি সব মানুষের। প্রয়োজনীয় পানি সবার জন্মগত অধিকার। এই পানি কেন কোম্পানির মালিকানায় যাবে? পানি কেন পণ্যে পরিণত হবে? কেন পানি কিনে খেতে হবে? সবার জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ কেন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে না? ওয়াসার মতো প্রতিষ্ঠান কেন দক্ষ ও সক্ষম হয়ে উঠবে না, কেন দেশি–বিদেশি কোম্পানির রাস্তা পরিস্কার করতে নিয়োজিত হবে?
বেঁচে থাকার জন্য পানি ছাড়া আমাদের উপায় নেই। নাইজেরিয়ার একজন কবির কবিতার বাংলা রূপটি এ রকম হতে পারে– ‘রাজা ছাড়া মানুষ বাঁচে/ মানুষ ছাড়া রাজ্য বাঁচে না। পশু ছাড়া ঘাস বাঁচে/ ঘাস ছাড়া পশু বাঁচে না। পান ছাড়া পানি বাঁচে/ পানি ছাড়া প্রাণ বাঁচে না।‘ পানি শুধু পান করার জন্যই নয়, জগৎ টিকিয়ে রাখার জন্য, অন্য সব খাদ্য উৎপাদনের জন্যও পানি অপরিহার্য। এই অপরিহার্যতাই পানির দিকে কোম্পানির মুনাফার আকর্ষণ তৈরি করেছে আর তাতে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষের বিপদ বেড়েছে।
পৃথিবীর ৪ ভাগের ৩ ভাগই পানি। আমাদের শরীরের পানির অনুপাতও এ রকমই। এই পানি প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করেও আমরা দেখছি, পানি ক্রমেই একটি দুর্লভ ও ব্যয়বহুল পণ্যে পরিণত হচ্ছে। একদিকে খাদ্য নিয়ে বিলাসিতা; অন্যদিকে নূ্যনতম খাদ্যের জন্য হাহাকার। একদিকে পানির অপরিমিত ব্যবহার, পানির যথেচ্ছাচার দূষণ; অন্যদিকে নূ্যনতম পানির জন্য কোটি কোটি মানুষের মরণদশা– এই বৈপরীত্যই বর্তমান বিশ্বের চিত্র।
পৃথিবীর যত পানি তার প্রায় ৯৭.৫ শতাংশই সমুদ্রে; অতএব নোনা। এই পানি ধারণ করে আছে জানা–অজানা অনেক সম্পদ। বাকি ২.৫ শতাংশের দুই–তৃতীয়াংশেরও বেশি জমে আছে বরফ হয়ে, যা জলবায়ুর ভারসাম্য রায় গুরুত্বপূর্ণ। বাকি পানির তিন–চতুর্থাংশই ভূগর্ভস্থ পানি, যা এই পৃথিবীকে শুধু বাঁচিয়ে রাখেনি, তাকে অবিরাম সৃজনশীল রেখেছে। বাকি অর্থাৎ মাত্র ০.৩ শতাংশ পানি আছে নদী, খাল–বিল, জলাশয় ইত্যাদিতে। অতএব, পৃথিবীর মোট পানির ১ শতাংশেরও কম পানযোগ্য। বাংলাদেশের সমতলে বিপুল সুপেয় পানির আধারের মধ্যে বাস করে– এটা কল্পনা করাও কঠিন যে, পৃথিবীর বহু দেশ এই পানযোগ্য পানিরই ভয়াবহ সংকটের মধ্যে বাস করে। কেনিয়ার উত্তরাঞ্চলে খাবার পানি সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয়। একেকজনকে দিনে অন্তত ৫ ঘণ্টা এই কাজে ব্যয় করতে হয়। আর এই কাজ করতে হয় মেয়েদেরই। প্রতিদিন ভারী পাত্র নিয়ে তাদের মাইলের পর মাইল হাঁটার দৃশ্য খুব পরিচিত। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের কোথাও কোথাও প্রায় একই অবস্থা। ভারত–পাকিস্তানেও বহু অঞ্চল আছে, যেখানে একটি জলাশয় বা একটি কূপ থেকে পানি সংগ্রহের জন্য দূর–দূরান্ত থেকে মানুষ আসে, এর কোনো বিকল্প নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অধিকাংশ এলাকাতেও খাবার পানির সংকট প্রকট। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে সমুদ্রের পানি থেকে লবণ দূর করে সুপেয় পানির জোগান দিচ্ছে। বর্তমানে প্রধানত পারস্য উপসাগর–তীরবর্তী দেশগুলোতে প্রায় ১৫ হাজার ডিস্যালিনাইজেশন পল্গ্যান্ট থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি গ্যালন সুপেয় পানি জোগান দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে সুপেয় পানির যখন এ রকম সংকট, তখন বাংলাদেশে সুপেয় নিরাপদ পানির সংকট তৈরি হচ্ছে ‘উন্নয়ন‘ নামের আগ্রাসী তৎপরতার কারণেও। কোম্পানি–নির্ভর কৃষি যান্ত্রিক সেচের মাধ্যমে বিপুল পানির চাহিদা তৈরির মাধ্যমে একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে; অন্যদিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার ভূউপরিস্থ পানি দূষিত করছে। এ ছাড়াও আছে ভবন বাণিজ্যের সম্প্রসারণে নদী, খাল–বিল, জলাশয় ভরাট করার অপ্রতিরোধ্য যাত্রা। ইটভাটা, শিল্পবর্জ্য তো আছেই। আছে সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণ, কোথাও বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে, কোথাও সড়ক পরিবহনের সুবিধার জন্য বাছবিচারহীনভাবে বাঁধ–কালভার্ট নির্মাণ। এগুলোর ফলে কোথাও নদীর অবাধ প্রবাহ বন্ধ হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, কোথাও পানির প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে পানি–মাটি অতঃপর মানুষ বিপর্যস্ত হচ্ছে।
শুধু দেশের ভেতর নয়, ভারতে নির্মিত বাঁধ এবং পানি নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাও বাংলাদেশের জন্য হুমকি। ফারাক্কা বাঁধ গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন, নদীর প্রবাহ, সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, জীববৈচিত্র্য সবকিছুরই অপরিমেয় ক্ষতি করেছে। ভারতের কোনো কোনো অঞ্চলও এখন এর জন্য ক্ষতির শিকার। এর ওপর আবার টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। সম্প্রতি চীনও ব্রহ্মপুত্র নিয়ে যে বাঁধ পরিকল্পনা করছে, তা বাস্তবায়িত হলে ভারত–বাংলাদেশ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সারাবিশ্বেই বাঁধ একটি বড় বাণিজ্যিক তৎপরতা। শুধু বাঁধের কারণে বিশ্বব্যাপী কমপক্ষে আট কোটি মানুষ এখন উদ্বাস্তু।
বিশ্বব্যাপী পানিদূষণের আর একটি বড় কারণ যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা ও তার ব্যবহার। সমুদ্রে, মহাকাশসহ বিভিন্ন স্থানে পারমাণবিক, রাসায়নিক যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা বা প্রয়োগ করতে গিয়ে কিংবা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে বায়ুমণ্ডল থেকে ভূগর্ভস্থ পর্যন্ত সবই বিপজ্জনক মাত্রায় দূষণের শিকার হচ্ছে। সম্প্রতি জাপানে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র একটি পারমাণবিক দুর্ঘটনাতেই বায়ু, পানি, খাদ্য সবকিছুর ওপর যে ভয়াবহ প্রভাবের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিশ্বব্যাপী এগুলোর সম্ভাব্য বিপদ কল্পনা করাও কঠিন। সার্বক্ষণিক বিষাক্ত এসব অস্ত্রের পরীক্ষা–নিরীক্ষার ফলাফল কী হচ্ছে, তার বেশিরভাগই আমাদের অজানা। কেননা যারা এসবের জন্য দায়ী, প্রচারযন্ত্রের ওপরও তাদেরই নিয়ন্ত্রণ।
পানি একদিকে দূষণ ও অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে, অন্যদিকে সৃষ্ট সংকটের সুযোগ নিয়ে মানুষের পানি দখলে নিচ্ছে কোম্পানি। আশির দশকের শুরু থেকেই উন্নয়নের নামে জগতের বাকি সবকিছু ব্যক্তিমালিকানা, বাণিজ্য আর মুনাফার কর্তৃত্বে আনার উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়। সড়ক, রেলপথ, শিক্ষা, চিকিৎসা, খনিজসম্পদ, বিদ্যুৎ শুধু নয়, ক্রমে পানিও এই আগ্রাসনের অধীন। এই কাজে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো পানির বাণিজ্যিকীকরণে সবচেয়ে অগ্রণী। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এডিবির ভূমিকাও সক্রিয়। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯০–এর দশকে যত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যক্তিমালিকানার বাণিজ্যিক তৎপরতার আওতায় আনা হয়েছিল, তার ৮৪ ভাগ ২০০৭ পর্যন্ত টিকে আছে, যদিও ২৪টি দেশ পানি ব্যবস্থার আবারও রাষ্ট্রীয়করণ করেছে।
গত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাংক আইএমএফ–এডিবির ঋণের জালে পানি ব্যক্তিমালিকানায় বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে রূপান্তরের বিষয়টি প্রায় সব দেশেই বিশেষ শর্ত হিসেবে এসেছে। দিনে দিনে এগুলোর চাপ আরও বেড়েছে। কারণ পানি বাণিজ্যের উচ্চ মুনাফার সম্ভাবনা এ খাতে বিনিয়োগও বৃদ্ধি করে। পানি বাণিজ্যে বহুজাতিক কোম্পানির অংশগ্রহণ দ্রুত বাড়ছে। এখন বিশ্বের তিনটি বৃহৎ পানি বহুজাতিক কোম্পানি হলো– সুয়েজ, ভিওলিয়া ভিভেন্দি ও আরডব্লিউই। কোক ও পেপসি, যারা খাবার পানি দখল করে পানীয় বাণিজ্য করছে, তারাও এখন পানি বাণিজ্যে প্রবেশ করেছে। জার্মান কয়লা কোম্পানি আরডব্লিউই এখন পানি বাণিজ্য শুরু করেছে। মধ্য আয়ের দেশগুলোতেও কিছু কোম্পানি এখন তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে আরও বহু দেশের অভিজ্ঞতাই প্রায় একই রকম।
বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী বলিভিয়া নব্বইয়ের দশকের শেষেই পানি বাণিজ্যিকীকরণ করার নীতি গ্রহণ করে। সেই মোতাবেক মার্কিন কোম্পানি বেখটেল বলিভিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর কোচাবাম্বার সব পানি সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব লাভ করে। এমনকি বৃষ্টির পানিও তাদের কর্তৃত্বের আওতায় আসে। পানির দাম পরিশোধে ব্যর্থ হলে নাগরিকদের ঘরবাড়ি বাজেয়াপ্ত করারও অধিকার দেওয়া হয় এই মার্কিন কোম্পানিকে। রাস্তায় প্রতিরোধ তৈরি করা ছাড়া তখন জনগণের সামনে আর কোনো পথ ছিল না। তারা তাই করেছেন। ক্রমে পানি–গ্যাস সম্পদ রক্ষার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বলিভিয়ায় বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনই সংঘটিত হয়। পানির ওপর সবার অধিকার, গ্যাসসম্পদে জনগণের মালিকানা এখন স্বীকৃত।
(০৮ মে ২০১৯ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)