দুর্ঘটনার পর গার্মেন্টখাত ধ্বংসের ‘ষড়যন্ত্রে’র কথা বলা মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ এবং তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব। গার্মেন্টস শিল্পের নানা সমস্যা নিয়ে তিনি কথা বলেছেন আমাদের বুধবার-এর সঙ্গে।

আমাদের বুধবার: একের পর এক গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ড ও ভবন ধসের ঘটনা ঘটছে। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হচ্ছেন। এসব ঘটনা বন্ধ করা যাচ্ছে না কেন?
আনু মুহাম্মদ: অগ্নিকান্ডের ঘটনা প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালের দিকে। একটা কারখানা চললে সেখানে আগুন লাগতেই পারে। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমস্যাটা হচ্ছে, অগ্নিকান্ডের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা নিয়ে। আগুন লাগে যে সব কারণ সেগুলো বলবৎ আছে কিনা যেমন- ইলেকট্রিক ওয়ারিং সিস্টেম ঠিকঠাক মতো রাখা, দাহ্যপদার্থ সঠিক জায়গায় রাখা। এরপরও দুর্ঘটনাবশত আগুন লাগতে পারে। আগুন লাগার পর সেটি নেভানোর যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে কিনা তাও দেখতে হবে। অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র সঠিক জায়গায় রাখা, ওয়ার্নিং সিস্টেম উন্নত করা, অগ্নিনির্বাপকযন্ত্র চালাতে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক রাখা, শ্রমিকদের ঠিকমতো মহড়া দেয়া, আগুন লাগার পর বের হওয়ার রাস্তা আছে কিনা সেটাও দেখতে হবে। জরুরি বর্হিগমনের ব্যবস্থা আছে কিনা, সিঁড়ির পর্যাপ্ত প্রশস্ততা, দরজা খোলা রাখা, কারখানায় তালা না মারা- এ বিষয়গুলো দেখতে হবে।

ভবনধস হচ্ছে আগুন লাগার মতোই। প্রথমত, ভবনটি বিল্ডিং কোড মেনে করা হচ্ছে কিনা, বিল্ডিং কোড মানার পর সেটি কারখানার মতো উপযুক্ত কিনা তাও দেখতে হবে। কারণ সব ভবনে কারখানা করা যায় না। যদি কোথাও ফাঁটল দেখা যায় সঙ্গে সঙ্গে তদারকি পদ্ধতির বিষয়টি দেখতে হবে। এতে দুর্ঘটনা ঘটলেও ক্ষতি হয় সর্বনিম্ন।

ভবন নির্মাণে বিধিমালা যদি না মানা10538615 918317191527495 6888173848013366468 n হয়, কারখানার জন্য ভবন উপযুক্ত না হয়- বুঝতে হবে, এটি দুর্ঘটনা নয়; স্রেফ হত্যাকান্ড। মালিকের অধিক মুনাফা লাভের জন্য খরচ বাঁচানোর চেষ্টায় ওই ব্যবস্থাগুলো রাখা হয়নি। ফলে এ দুর্ঘটনাকে মালিকের মুনাফা লোভের ‘পরিণতি’ বলতে হবে। এটাই হত্যাকান্ড এবং দুর্ঘটনার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য। তাজরিনের অগ্নিকান্ড কিংবা রানা প্লাজার ভবনধস- এগুলোকে কিছুতেই দুর্ঘটনা বলা যায় না। মালিক পক্ষের কারণে পুরো কারখানা

 জেলখানায় পরিণত করা হলো। চূড়ান্তভাবে মৃত্যুকূপে পরিণত হলো তাজরিন ফ্যাশনস।অন্যদিকে রানা প্লাজার ক্ষেত্রে ভবন নিয়ম মেনে করা হয়নি। পুরো ভবনটি বেআইনিভাবে – যা কারখানার জন্য উপযুক্ত নয়। এতে ফাটল ধরল। ফাটল জানা সত্ত্বেও অতি মুনাফার লোভে সেখানে জোর করে শ্রমিকদের ঢোকানো হলো। এরপর কলাপসিবল গেট আটকে দেয়া হলো। এটি পরিষ্কার হত্যাকান্ড বৈ কিছু নয়।

আমাদের বুধবার: এসব ঘটনার জন্য দায়ী কারা?
আনু মুহাম্মদ: এখানে প্রথমত দায়ী মালিক। মালিকের কারখানায় যদি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে, তবে সেটার জন্য প্রথমে দায়ী করা হবে ভবন এবং গার্মেন্টস মালিককেই। দেশের সবকিছুর কর্তৃত্ব সরকারের। এসব দুর্ঘটনার সকল দায়-দায়িত্বও সরকারের। কোন ভবনে কোন কারখানা হবে তার নীতিমালা প্রণয়ন করবে সরকার। নীতিমালা তদারকির দায়িত্বও সরকারের। কোন ভবনে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে সেটি দেখার দায়িত্ব সরকারের। এর জন্য শিল্প, শ্রম, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া বিজিএমইএ’রও দায়িত্ব রয়েছে এখানে। এটি হচ্ছে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন। এটি হচ্ছে বৈশ্বিক শিল্প। বিশ্বব্যাপী এর যারা অংশীদার অর্থাৎ যারা এর ক্রেতা সেখানেও এর জবাবদিহিতার ব্যাপার থাকে। এ কারণে বিজিএমইএ’র গুরুদায়িত্ব রয়েছে। মোদ্দা কথা, মালিক পক্ষ, বিজিএমইএ এবং সরকার- তিনজনেরই দায়িত্ব রয়েছে। এর বাইরে আরেকটি দায়িত্ব রয়েছে বিদেশি ক্রেতাদের (বায়ার এবং রিটেইলার)। একটি পোশাক যে দামে ইউরোপ-আমেরিকায় বিক্রি হয় তার ৬০ থেকে ৮০ ভাগ লাভ নেয় বায়ার ও রিটেইলার। তাদের দায়িত্ব, যেখান থেকে পোশাকটা তৈরি হচ্ছে সেখানে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ আছে কিনা তা দেখা। এটা সাধারণত দেখা হয় না। বায়াররা মুনাফা বাড়ানোর জন্য দরকষাকষি করে দাম বাড়াতে থাকে কারখানার মালিকদের সঙ্গে। মালিকরা দাম কমাতে গিয়ে একইসঙ্গে নিজের লাভ ধরে রাখতে শ্রমিকদের ঠকায়। শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরি, ওভারটাইম- এগুলো থেকে বঞ্চিত করে নিজের মুনাফা নিশ্চিত করে। কিংবা এমন সাব-কন্ট্র্যাক্টরের কাছে কাজটা দেয় যার ন্যূনতম যোগ্যতা নেই। পুরো প্রক্রিয়ায় বিদেশি ক্রেতা কিংবা আমাদের দেশের মালিক- কারো মুনাফা কমে না, সবার মুনাফাই উচ্চ পর্যায়ে থাকে। তাদের সহযোগী হয়ে কাজ করে যেমন- থানা, পুলিশ, আমলা, চাঁদাবাজ সবাই। তাদের লোভ-ক্ষমতার পুরো চাপটাই পড়ছে শ্রমিকদের ওপর। এ নিষ্ঠুর ব্যবস্থাপনার কারণে এ খাতের শ্রমিকদের অবস্থা অনেকটা দাসশ্রমের মতো।

আমাদের বুধবার: এখান থেকে বের হয়ে আসার পথ কি?
আনু মুহাম্মদ: মুনাফা লোভে যারা উন্মত্ত থাকে তাদের স্বাভাবিক মানুষে পরিণত করা সম্ভব নয়। কিন্তু মোকাবিলা করার শক্তি অর্জন করতে পারলে তাদের পথে আনা সম্ভব। শ্রমিক যত দুর্বল থাকে তার মুজুরি তত কম থাকে। শ্রমিক যত সংগঠিত থাকে, তার লড়াই তত শক্তিশালী হয়। যদিও সামগ্রিক ব্যবস্থার কারণে মুজুরিটা কখনই পুরোপুরি শ্রমিকের পক্ষে যায় না। তবে আপেক্ষিকভাবে তার মুজুরিটা বাড়ানো সম্ভব, যদি শ্রমিক সাংগঠনিকভাবে সংঘবদ্ধ থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের যত ধরনের সংস্থা আছে, এর মাত্র তিনভাগ শ্রমিকের সংগঠন রয়েছে বাকি ৯৭ ভাগের নেই। শ্রমিক সংগঠন না থাকার ফলে প্রতিনিধিত্বকারী করার মতো, কথা বলার মতো কেউ নেই। এর বাইরে যদি জাতীয় সংগঠন দেখি যারা শ্রমিকের স্বার্থে কথা বলতে চায়, তাদের দুর্বলতা এত বেশি যে, তারা কোন ‘শক্তি’ হিসেবে দাঁড়ায় না। ওইসব সংগঠনের মধ্যে অনেকগুলোকে আবার শ্রমিক প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বলা যায় না। এর মধ্যে কিছু মালিকদের সংগঠনও রয়েছে। কোন কোন সংগঠন আর্ন্তজাতিক ইকুয়েশন অনুযায়ী কাজ করে, ফলে তারা শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে না। তবে কিছু সংখ্যক সংগঠন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে বটে তবে তাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। এরমধ্যে বিজিএমইএ মালিকদের সংগঠন। তাদের শক্তিই বেশি। তারা দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ। সরকারে যেই থাকুক না কেন, বিরোধী দলে যেই থাকুন না কেন; বিজিএমইএ’এর তাতে কোন অসুবিধা নেই। সব দলের প্রতিনিধি বিজিএমইএতে আছে। ফলে সরকারই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। এতে করে তারা ‘যা ইচ্ছে তা করা’র ক্ষমতা অর্জন করে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে শ্রমিকদের সাংগঠনিক শক্তি বিকাশের বিকল্প নেই। আরেকটা হচ্ছে, এটা যেহেতু বৈশ্বিক শিল্প। ফলে অনেকেই শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারে অনেকে মনযোগী রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রিটেইলারদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। প্রায় সব দেশেই শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। ফলে এখানে আন্তর্জাতিক ঐক্য বা যোগসূত্র তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা প্রয়োজন।

আমাদের বুধবার: কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়নে গড়িমসি লক্ষ্য করা যায় কেন?
আনু মুহাম্মদ: কমপ্লায়েন্সের ব্যাপারটি আমাদের জন্য মোটেও প্রাসঙ্গিক হতো না যদি আমাদের বিদ্যমান শ্রম আইন (দুর্বল হলেও) বাস্তবায়ন হতো, সঙ্গে সঙ্গে আইএলও’র কনভেনশনগুলো অনুসরণ করা হতো। এগুলো বাস্তবায়নের জন্য ক্রেতাদের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করার কথা নয়। জনগণের প্রতি সরকার যদি ন্যূনতম প্রতিশ্রুতি থাকত তাহলে শ্রম আইন, আইএলও কনভেনশনের বিধি বাস্তবায়ন করা কঠিন কিছু হতো না। সরকারের যথেষ্ট সংখ্যক কারখানা পরিদর্শক (ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর) থাকার কথা। কিন্তু আছে কি? বাংলাদেশে বেকারত্ব হার উর্দ্ধমূখী হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জায়গায় মানুষকে নিয়োগ দেয়া হয় না। কারখানা পরিদর্শক তার মধ্যে একটি। দেশের প্রায় ৪ হাজার ফ্যাক্টরির জন্য মাত্র ১০-১২ জন লোক রয়েছে- এটা কি বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে? এটাকে কেন যেন গুরুত্বই দিচ্ছে না সরকার। কোথায় কারখানা হবে, কোন ভবনে কারখানা হবে, শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তা, কর্মপরিবেশ- সব কিছু নিশ্চিত করতে সরকারকে কমপ্লায়েন্সের জন্য অপেক্ষার দরকার নেই।

আমাদের বুধবার: দোষীদের শাস্তি না হওয়ার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
আনু মুহাম্মদ: আসল অপরাধীরা শাস্তি পায় না। পূর্বেই বলেছি মালিকের লোভ, অবহেলা-দায়িত্বহীনতার কারণে যদি শ্রমিকের মৃত্যু হয় তবে তা হত্যাকান্ডই। এবং সেখানে দায়ী হচ্ছে মালিক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ। জাতীয় আইনেই তাদের শাস্তি হওয়ার কথা। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের ভেতর যারা দায়ী থাকবে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা। ’৯০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যত শ্রমিক মারা গেছে তাদের জন্য কেউ শাস্তি পায়নি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, একজন মানুষকে হত্যা করা হলেই তার মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। অথচ হাজার মানুষ মারা গেল সেখানে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলো না।

আমাদের বুধবার: দুর্ঘটনার পর ষড়যন্ত্র খোঁজা হয়। আপনি কী মনে করেন সবগুলো ঘটনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র রয়েছে?
আনু মুহাম্মদ: দুর্ঘটনার পর গার্মেন্টখাত ধ্বংসের ‘ষড়যন্ত্রে’র কথা বলা একটি মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। কেবল বিজিএমইএ নয়, সরকারের মধ্যেও এ ধরনের কথা শোনা যায়। আগুন বা ভবনধসের ঘটনা ঘটলেই সরকার একে ‘নাশকতা’ বলে চালাতে চায়। নাশকতা এ দেশে ঘটতেই পারে। একটি দরিদ্র দেশ হিসেবে জাতীয়-আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এমনকি মালিকদের মধ্যে বিরোধের কারণেও নাশকতা হতে পারে। ঝুট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দ্বন্ধের কারণেও হতে পারে। তবে কোথাও কিন্তু পরিকল্পিতভাবে আগ্নিকাণ্ড বা ধসের ঘটনার সৃষ্টি হয় না। এসব ব্যাপারে কিন্তু অনুসন্ধানের কোন আগ্রহ কারো ভেতর দেখা যায় না। উল্টো শ্রমিকদের অভিযুক্ত করা হয়। আসল কারণটা লুকোনোর জন্যই এটি বলা হয়। যদি অনুসন্ধান করে নাশকতা সৃষ্টিকারীকে শনাক্ত করা হতো এবং তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হতো তবেই এটি বিশ্বাসযোগ্য হতো। তা না করে প্রতিবারই একই কথা আওড়ানো হয়। নাশকতার কথা বলে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের দায়, আসল অপরাধীদের আড়াল করা ও নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করা হয়। সময়ের সঙ্গে মানুষ এসব ভুলে যায়, সংবাদমাধ্যমও তেমন উচ্চবাচ্য করে না। তখন তারাও নাশকতা নিয়ে কথা বলে না। এটি তাদের কৌশল মাত্র; দুর্বৃত্তকে রক্ষার উত্তম কৌশল।

আমাদের বুধবার: আপনাকে ধন্যবাদ।।

(মে ০৮, ২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)