দুনিয়া বদলের ‘বেকার’ তাত্ত্বিক

যখন থেকে বৈষম্য, নির্যাতন, অমানবিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কবলে পড়েছে মানুষ, তখন থেকেই এর থেকে মুক্তির পথও অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। সে হিসাবে মানুষের মুক্তির চিন্তা ও লড়াইয়ে কার্ল মার্ক্স প্রথমও নন, শেষও নন। মার্ক্স মানুষের এই ধারাবাহিক লড়াইয়ের চেষ্টা, দর্শন, সংগঠন, সক্রিয়তার বস্তুগত ভিত্তি অনুসন্ধান করেছেন। পুঁজিবাদের শুরুতেই তার গতিপথ চিহ্নিত করেছেন, বর্তমানের মধ্যে ভবিষ্যৎ অনুধাবনের তাত্ত্বিক বিশ্নেষণ পদ্ধতি নির্মাণ করেছেন। দুনিয়া বিশ্নেষণ ছাড়াও তার বদলের চোখ, মস্তিস্ক ও হৃদয় হাজির করেছেন।

মাত্র দুইশ’ বছর আগে ৫ মে ১৮১৮ কার্ল মার্ক্স জন্মগ্রহণ করেন। দর্শনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেছেন, পিএইচডি করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাই ছিল তার আগ্রহের বিষয়। কিন্তু তৎকালীন স্বৈরতন্ত্র সে সুযোগ দেয়নি, আর তার আরও অনেক বড় কাজের জন্য দুনিয়া অপেক্ষা করছিল। তিনি প্রায় পুরো জীবনই ছিলেন ‘বেকার’, পুঁজিবাদের দৃষ্টিতে ‘অনুৎপাদনশীল শ্রমিক’ মানে বিনা মজুরিতে পূর্ণকালীন গবেষক, লেখক, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী সর্বোপরি বিপ্লবী। বয়স যখন ২৭, তখন ১৮৪৫ সাল থেকে তিনি রাষ্ট্রবিহীন বিশ্ব নাগরিক। বন, বার্লিন, প্যারিস, ব্রাসেলস, কোলনসহ নানা শহর ঘুরে স্থিত হয়েছিলেন লন্ডনে।

মার্ক্সের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ হলো সব শোষণ-বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল, সবচেয়ে শক্তিধর। প্রথম থেকেই এ ব্যবস্থা একটি বিশ্বব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় শক্তি পুঁজির গতি-প্রকৃতি বিশ্নেষণই ছিল মার্ক্সের প্রধান মনোযোগ। দর্শনে হেগেল, ফয়েরবাখ; অর্থশাস্ত্রে স্মিথ, রিকার্ডো, মিল, থমসন; সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় রবার্ট ওয়েন, সা সিমো, চার্লস ফুরিয়াসহ মানুষের পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বিজ্ঞানীর চিন্তা কাজ পর্যালোচনা করেছেন মার্ক্স। খারিজ ও গ্রহণ দুটিই করেছেন একটি দার্শনিক অবস্থান থেকে- অপমান ও শৃঙ্খলের জীবন থেকে মানুষের মুক্তি। সবকিছু সংশয়ের চোখে দেখা, মানুষের সবকিছুই নিজের মনোযোগের বিষয় হিসেবে গণ্য করা, বর্তমানকে শুধু বিশ্নেষণ নয়, তার পরিবর্তনের পথ অনুসন্ধান, মানুষকে সমষ্টির ভেতরে ইতিহাসের ভেতরে বিশ্নেষণ করা, ব্যক্তির স্বাধীনতা ও সমষ্টির মুক্তির বস্তুগত শর্ত শনাক্ত করা, শোষণ-পীড়ন-বৈষম্য থেকে মুক্ত দুনিয়ার স্বপ্নকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দেওয়ার মধ্যে তিনি বিশিষ্ট।

বেশ কয়েকটি প্রশ্ন বিশ্বজুড়ে বিতর্কের বিষয়। মার্ক্সের বিশ্নেষণ পদ্ধতি, বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি কি কাঠামোবদ্ধ, না উন্মুক্ত? তিনি কি অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদী? তিনি কি মানুষকে কোনো সক্রিয় সত্তা হিসেবে গুরুত্ব দেন, নাকি বস্তুজগতের স্বয়ংক্রিয়তার ওপরই মানুষের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেন? প্রশ্নগুলোর উত্তর এসেছে চলমান দুনিয়া থেকেই। উন্মুক্ত বলেই মার্ক্সের নতুন নতুন জন্ম হয়, নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়। ইউরোপের ঔপনিবেশিক শক্তির ভেতরে শ্রেণিসংগ্রাম, আর তার বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে ঔপনিবেশিক শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিশ্ব নাগরিকের মুক্তসমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা ও কর্মজগতে প্রবল সক্রিয়তার শক্তি তৈরি করেন ইউরোপে জন্ম নেওয়া মানুষ কার্ল মার্ক্স। মার্ক্স-পরবর্তী মুক্তির চিন্তা ও লড়াইয়ের ভেতর মার্ক্সের পুনঃ পুনঃ অভ্যুদয় এসব সমালোচনার অন্তর্নিহিত ভ্রান্তি স্পষ্ট করে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার বহু দেশে মার্ক্স তাদের মতো করে হাজির হয়েছেন, হাজির করা গেছে। তাই কারাকাসে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের লেখক-শিল্পীদের এক আন্তর্জাতিক সভায় দেখেছিলাম, বুশের যুদ্ধ হুঙ্কারের জবাবে হুগো শাভেজ বলেছেন, ‘আমার হাতেও তোমাদের ধ্বংস করার মতো বড় দুটি বোমা আছে।’ তিনি দেখালেন এক হাতে মার্ক্সের ক্যাপিটাল, আরেক হাতে সাইমন বলিভারের বই।

মার্ক্স জীবদ্দশায় দেখেছিলেন প্যারি কমিউনের অসম্ভব সাহসী বিপ্লবী অভ্যুত্থান ও তার ওপর বর্বর গণহত্যার অধ্যায়। দমন-পীড়ন দিয়ে মানুষকে থামানো যায় না। মানুষের অন্তর্গত প্রবণতা হলো তার সীমা অতিক্রম করার চেষ্টা। এ জন্য তার দরকার হয় স্বপ্ন, কল্পনাশক্তি, বিশ্নেষণ ক্ষমতা, সাহস, ঔদ্ধত্য ও সংহতি। এগুলো দিয়েই মানুষ অতিক্রম করে বর্তমানে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থা। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্বে নতুন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু হয়। ইউরোপ ছাপিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনের বাস্তব অবস্থা, সমস্যার ধরন একরকম নয়, একরকম নয় জনগণের চিন্তা, সংহতি সংগঠনের অবস্থান। সে জন্য মার্ক্সও নতুন নতুনভাবে পঠিত, গৃহীত ও উপস্থাপিত হতে থাকেন। পর্যালোচনা ও সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে মার্ক্সের বিকাশ ঘটে। যারা তা করতে পেরেছেন, তারাই সফল হয়েছেন। সে জন্য রুশ বিপ্লবের মতো চীন বিপ্লব হয়নি, চীন বিপ্লবের মতো কিউবা বিপ্লব হয়নি, কিউবা বিপ্লবের মতো ভিয়েতনাম বিপ্লব হয়নি। পূর্ব ইউরোপ আরেকভাবে নিজেদের পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে। আবার ইউরোপ-আমেরিকার পুঁজিবাদী জগৎও আগের মতো থাকেনি, সেখানে আজ জনঅধিকারের যতটুকু স্বীকৃত, তাও মানুষের লড়াইয়েরই ফসল। এসব চেষ্টা স্থায়ী সাফল্য আনতে পারেনি, পরাজয় এসেছে। ব্যর্থতা ও সাফল্যের মধ্য দিয়ে মানুষের লড়াই নতুন নতুন বাঁক নিচ্ছে, চিন্তাজগতেও নতুন যোগ হচ্ছে।

বস্তুত মার্ক্সের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থেকেছে পরের আরও অসংখ্যজনের মধ্যে। মার্ক্সের মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই ১৯০২ সালে প্রকাশ হয় জন হবসনের বই ‘ইম্পেরিয়ালিজম’, ১৯১৩ সালে রোজা লুক্সেমবুর্গের বই একুমুলেশন অব ক্যাপিটাল এবং ১৯১৬ সালে লেনিনের বই ‘ইম্পিরিয়ালিজম :দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার গতি-প্রকৃতির সর্বশেষ প্রবণতা, সাম্রাজ্যবাদের স্বরূপ বিশ্নেষণ করে। বিশ্বজুড়ে পুঁজির ধ্বংস, আগ্রাসন এবং দ্রুত বিস্তারের নিয়মগুলো আরও স্পষ্ট হয়। আন্তনিও গ্রামসির কাজও মার্ক্সের কাজেরই ধারাবাহিকতা।

নতুন নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে, নতুন নতুন স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতে চিন্তা ও বিশ্নেষণ যোগ হয়, এখনও হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে নতুন তাত্ত্বিক হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হন মাও সে তুং, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা, হো চি মিন। তারা নিজ নিজ সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরও ঘটান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আরও অনেকে কাজ করতে থাকেন। ক্লারা জেটকিন, আলেক্সান্ড্রা কোলন্তাই, এমেলকার ক্যাব্রেল, পল ব্যারেন, পল সুইজি, হ্যারি ম্যাগডফ, জোয়ান রবিনসন, মরিস ডব, আর্নেস্ট ম্যান্ডেল, ডেভিড হার্ভে, প্রভাত পাটনায়েক, আইজাজ আহমেদ, আনোয়ার শেখ, সমির আমিন, আরিঘি ইমানুয়েল, ফ্রেডরিখ জেমসনসহ অনেকে। নারীর মুক্তির লড়াই মার্ক্সীয় চিন্তার জগতে খুব গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা যোগ করেছে, অনেক দুর্বলতা দূর করতে কাজ করেছে, তাকে আরও শক্তিশালী করেছে। প্রাণ প্রতিবেশের বিনাশ সাধন করে পৃথিবীর অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে, তখন প্রকৃতি ও মানুষের ঐক্য সন্ধানেও মার্ক্সীয় বিশ্নেষণ পাওয়া যাচ্ছে, তৈরি হচ্ছে।

পুঁজির জন্ম ও বিকাশ পর্যালোচনা করে মার্ক্স দেখিয়েছিলেন পুঁজি কোনো পবিত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটি হলো মৃত বা অতীত শ্রমের পুঞ্জীভূত রূপ, যা বিভিন্নভাবে কিছু ব্যক্তির মালিকানায় নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কের রূপ নিয়েছে। পুঁজিবাদ তাই এক কথায় বর্তমান বা জীবন্ত শ্রমের ওপর অতীত বা মৃত শ্রমের আধিপত্য। আর মার্ক্স যে মুক্তসমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা মূর্ত করেছেন, সেখানে মৃত শ্রমের ওপর আধিপত্য করে বর্তমান শ্রম। অর্থাৎ মানুষের ওপর যন্ত্র বা পুঁজি নয়; বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ অতীতের অর্জিত সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ মানুষের এ রকম একটি সমাজ।

অর্থশাস্ত্রের ইতিহাসের শক্তিশালী বিশ্নেষক মার্ক ব্লগ লিখেছেন, ‘মার্ক্স এখনও যেভাবে প্রাসঙ্গিক আছেন, সেভাবে আর কোনো অর্থনীতিবিদই নন। মার্ক্স বারবার মূল্যায়িত হয়েছেন, সংশোধিত হয়েছেন, তাকে খণ্ডন করে কবর দেওয়া হয়েছে হাজারো বার; কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস থেকে তাকে খারিজ করা যায়নি। ভালো-মন্দ যে চিন্তার জগতে আমরা আছি, সেখানে মার্ক্স কোনো না কোনোভাবে জীবন্ত সত্তা হিসেবেই উপস্থিত থাকেন। এখন আর অ্যাডাম স্মিথ বা রিকার্ডোকে নিয়ে কেউ যুদ্ধ করে না; কিন্তু মার্ক্স নিয়ে আলোচনা উঠলেই এখনও অনেকের রক্তচাপ বেড়ে যায়।’ মার্ক্সকে ‘বাতিল’ ঘোষণা করেও তাকে বাতিল করার জন্য আয়োজনের কমতি নেই। কারণ তিনি, তার চিন্তা ও বিশ্নেষণ পদ্ধতি বরাবরই মানুষ-প্রকৃতিবিনাশী ক্ষমতার জন্য হুমকি।

( ২০ মে ২০১৮ তারিখে দৈনিক সমকালে প্রকাশিত)