আনু মুহাম্মদ। অধ্যাপক মুহাম্মদ আনিসুর রহমান। সবার কাছে যিনি আনু মুহাম্মদ নামেই পরিচিত। তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব। আনু মুহাম্মদ মুখোমুখি হয়েছেন পরিবর্তন ডটকমের। দেশের রাজনীতি, শেয়ারবাজর কেলেঙ্কারি, কুইকরেন্টাল, কয়লা খনি, রামপালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে খোলাখুলি কথা বলেছেন তিনি। সাথে ছিলেন পরিবর্তন ডটকমের স্টাফ রিপোর্টার যাকারিয়া ইবনে ইউসুফ।
পরিবর্তন : বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনগুলোতে বড় দলগুলোর কোনো অংশ গ্রহণ নেই। অথচ আপনারা বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন করে চলছেন। সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে কিছু বলুন।
আনু মুহাম্মদ : জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনগুলোতে বড় দল তো থাকবে না। বড় দল বলতে আমাদের দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতকেই বোঝায়। এরা বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় ছিলো। এরা সরকারে থাকা অবস্থাতেই সরকারের স্বার্থ রক্ষায় যে চুক্তিগুলো হয়েছে, এ যাবৎকালে জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তির কারণে দেশের জ্বালানি খাত, শিক্ষা খাত, চিকিৎসা খাতসহ সামগ্রিকভাবে জনগণের জীবন জীবিকা শঙ্কার মধ্যে আছে কিংবা বিপন্ন হয়ে আছে। সেটার জন্য বড় দলগুলোই দায়ি। তারা কিভাবে আন্দোলনে থাকবে। আমাদের আন্দোলনই তাদের বিরুদ্ধে। বড় দলের পেছনে জনগণ আছে সত্যি, তবে তারা জনগণের সাথে প্রতারণা করে। মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাদের অর্থ-মিডিয়া বা রাজনৈতিক দাপটে নানাভাবে জালের মধ্যে ফেলে দলকে বড় রাখে। পেছনে যে জনগণ আছে, তাদের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েই কিন্তু তাদের রাজনীতি। জনগণের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রাসাদ তৈরি করে।
পরিবর্তন : আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক সময় আপনারা ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে পড়ে রাজপথে লাঞ্ছিত হয়েছেন। আপনাদের মিছিলে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ।
আনু মুহাম্মদ : আমাদের শাসক শ্রেণীর যারা-তারা বড় দলগুলো থেকেই আসে। এদের পরিচয়, এরা লুটেরা। তারা লুট করে। ব্যাংক লুট করে, জনগণের সম্পদ লুট করে। বাংলাদেশের সম্পদ, যাতে অন্যরা লুট করে সে ব্যবস্থা করে। সুতরাং এরা প্রকৃত অর্থেই লুটেরা। একেবারে গ্রামীণ পর্যায় থেকে শুরু করে শহর পর্যায়, এমনকি তাদের ব্যাক্তিগত দর্শনটাই হলো লুট করা। তারা হচ্ছে দখলদার; নদী-খাল-বিল, বন-জঙ্গল, জমি-জায়গা, মানুষের সম্পদ এবং আরো সমস্ত কিছু লুট করে। তারা হচ্ছে কমিশনভুক্ত। কমিশনের বিনিময়ে দেশের যে কোনো সর্বনাশ বা ক্ষতি দ্বিধা করে না। পিছপা হয় না। সুতরাং লুটেরা, দখলদার ও কমিশনভোগী; এ তিনটা যে শ্রেনীর বৈশিষ্ট, আমরা যখনই জনগণের সম্পদের উপর জনগণের শতভাগ মালিকানা বা অধিকারের প্রশ্ন তুলি, তখন তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। তাদের আঁতে ঘা লাগে। তাদের অস্তিত্বে ঘা লাগে। তাদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। কমিশন পাওয়ার সম্ভাবনা বন্ধ হয়। সে কারণে তারা জনগণেরই অর্থে প্রতিপালিত পুলিশকে আমাদের বিরুদ্ধে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করে।
পরিবর্তন : জাতীয় কমিটি প্রতিষ্ঠার পর গত চৌদ্দ বছরে আপনারা কতোটা জনগণের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছেন? কিংবা আন্দোলনের সাথে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা কতোটুকু বাড়াতে পেরেছেন?
আনু মুহাম্মদ : জনগণের কাছাকাছি যাওয়া মানে আমরা যে ইস্যুগুলো নিয়ে আন্দোলন করছি সেগুলো জনগণের স্বার্থেই এবং তাদের স্বার্থ বা অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতেই। আমাদের সমস্ত প্রতিক্রিয়ায় জনগণেরই কর্তৃত্ব। সুতরাং জনগণের স্বার্থকে কেন্দ্রে রেখে যে আন্দোলন হচ্ছে, সে আন্দোলন নির্ভরই করে জনগণের সম্পৃক্ততার উপর। এতদিন পর্যন্ত আমাদের যতোটুকু সাফল্য, তা জনগণের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থনের কারণেই এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত যে আরো বড় ধরণের পরিবর্তন আনতে পারিনি, সেটার একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে আরো বেশি জনগণকে সম্পৃক্ত করার যে প্রয়োজন, সেই জায়গায় আমরা এখন পর্যন্ত যেতে পারিনি।
পরিবর্তন : বলা হয়ে থাকে, গ্রামীনব্যাংক এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আপনি একজন প্রবল সমালোচক।
আনু মুহাম্মদ : ‘প্রবল সমালোচক’ বলাটা আসলে ঠিক হবেনা। মুহাম্মদ ইউনূসের কৃতিত্ব যেটা, তা আমি স্বীকার করি। তার ব্যর্থতা যেটা, সেটাও আমি সনাক্ত করি। তবে মূল বিষয় হচ্ছে, কৃতিত্বটা হচ্ছে ড. ইউনূস যে তার ক্ষমতা কিংবা শক্তির দিকগুলো, সেগুলো সব সময় উল্লেখ করি। যেমন, তিনি খুবই দক্ষ সংগঠক, তিনি খুবই সফল উদ্ভাবক। তিনি নতুন নতুন চিন্তা করতে পারেন এবং সে চিন্তার মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীতে ব্যাংকিং প্রথার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন। গরীব মানুষকে যে ব্যাঙ্কিং প্রথার মধ্যে আনা সম্ভব, সেটা তিনি দেখিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠান সমাদৃত হয়েছে। এগুলো আমি স্বীকার করি। তিনি যে দাবি করে সারা পৃথিবীতে একটা মডেল হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করছেন, সেখানে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি যে দাবি করেছেন, যে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে মানুষের দারিদ্র বিমোচন হবে কিংবা ক্ষুদ্র ঋণই হচ্ছে মানবাধিকার, সেটা অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
তিনি যে দাবি করেন, ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন সম্ভব, এটাকে আমি বলি প্রতারণামূলক। আসলে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন হয় না। দারিদ্র বিমোচনের জন্য যে ধরনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন দরকার, সেই পরিবর্তনের সংজ্ঞায়নের মধ্যে একটা আচ্ছন্নতা তৈরি করে।
পরিবর্তন : দেশে এখন এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এখানে সব মহল থেকে বলা হচ্ছে, সরকার এবং বিরোধী দলের সমঝোতার ব্যাপারটি। কিন্তু এ সমঝোতাকে অনেকে মনে করেন প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা। একবার এক দল ক্ষমতায় তো পরেরবার অন্য দল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ আছে কিনা?
আনু মুহাম্মদ : বর্তমানে বিদ্যমান যে রাজনৈতিক শক্তি ও ভারসাম্য, তাতে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাদের ভেতরে ভেতরে সমঝোতা আছে। দেশের যতো ধরণের দখল হয়, লুন্ঠন হয়, ব্যাংক-বীমা সব কিছুর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি একসাথে কাজ করে। ভবিষ্যতে এটা অব্যাহত থাকবে। নির্বাচন নিয়ে তাদের যে বিরোধ আমরা দেখি, তার চেয়ে তাদের ঐক্যই বেশি। বরং এই বিরোধটা হয়তো কেটে যাবে। না কাটলেও যে ধরনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখবো তাতে মানুষের ভোগান্তি হবে। নির্বাচন হয়তো একটা পর্যায়ে হবে। কিন্তু এই নির্বাচন হওয়া না হওয়া নিয়ে আমাদের তেমন কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। আসলে যেটা দরকার, তাদের যে ঐক্যের জায়গাটা, তা মানুষের সামনে পরিস্কার করা এবং মানুষ যদি তাদের ঐক্যটা বুঝতে পারে, তবে জনগণের শক্তি তৈরি করার জন্য মানুষের নতুন ধরনের চিন্তার রাজনীতি এবং সংগঠন সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তির একমাত্র উপায়। এই সঙ্কট উত্তরণে আর কোনো পথ নেই।
পরিবর্তন : তাজরিন এবং রানা প্লাজায় আমরা শতাধিক পোশাক শ্রমিককে নির্মমভাবে মরতে দেখেছি। এটাকে অনেকেই গণহত্যা বলছেন। কেন না আজকাল যে কারখানাগুলো গড়ে উঠে, সেগুলো দেখা যায় কোনো রকমের ডোবায় মাটি চাপা দিয়েই, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ভবন তৈরি করা হয়। কারখানায় ফাটল দেখা দিলে সেটাকে উপেক্ষা করে পোশাক শ্রমিকদের আটকে রাখা হয় কাজের মধ্যে। পোশাক শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হয় তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অপ্রতুল ও অতি নগন্য।
আনু মুহাম্মদ : গার্মেন্টস সেক্টরটি পুরোপুরি পুনর্গঠন করতে হবে। এই শিল্প ভয়ঙ্কর রকম নিপীড়নমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এতো বড় হয়ে গেছে। তার ফলাফল আমরা দেখতে পাচ্ছি রানা প্লাজায়। গার্মেন্টস শিল্প বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু তার তদারকি সরকার করে না। এই সেক্টরকে নিয়ে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই, ব্যবস্থাপনা নেই, কোনো বরাদ্দ নেই। সরকার শিল্প পুলিশ তৈরি করেছে, যাদের কাজ হলো শ্রমিকদের পেটানো। মালিকদের অনিয়ম, দুর্ব্যবহার, বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা, কম মজুরি দেওয়া এগুলোর ব্যাপারে আইনগত সরকারের পরিকল্পনা নেই। তারা এমন কারখানা করে, যে কারখানা যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে, আগুনে পুড়তে পারে। কয়েকটি বাদে দেশের বেশির ভাগ কারখানার এই অবস্থা। এটার মধ্য দিয়ে যে ধরণের মজুরি পান কিংবা যে ধরনের কর্মপরিবেশ তাদের জীবনে আছে, তাতে এটাই হচ্ছে পরিণতি। সুতরাং এখন সরকার করণীয় হচ্ছে, দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে পুনর্গঠন করা।
দ্বিতীয়ত মজুরিটা নূন্যতম বাঁচার মতো হয়, তা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত তাদের কর্মঘণ্টা, মজুরি, বকেয়া, ওভারটাইম এগুলো যাতে তারা ঠিক মতো পায়, তা নিশ্চিত করা। তার জন্য ফ্যাক্টরি ইন্সপেকশন গঠন করা। নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া। ইউরোপিয় ইউনিয়ন বা মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললে সেটা শুনলে এর চেয়ে অপমানজনক আর কিছু হতে পারে না। সেটা বলার আগে বাংলাদেশ সরকারের গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত ছিলো। গার্মেন্টস মালিকদের আত্মসম্মানবোধ থাকলে অনেক আগেই এসব পরিকল্পনা গৃহিত হতো। কিন্তু শ্রমিক নিহত হওয়ার পর নিহতদের আত্মীয় স্বজনের আর্তচিৎকার, আর্তনাদ কিংবা বিক্ষোভের লাঠি মিছিল দেখে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় কোনো স্থায়ী সমাধান হয় না। আমি মনে করি যখন সমাধান কিংবা পরিকল্পণাটা মালিকদের ভিতর থেকে আসবে, বা সরকার দুর্ঘটনা ঘটার আগেই পরিকল্পনা হাতে নিবে, তখনই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
পরিবর্তন : রামুর সাম্প্রাদায়িক হামলা বিষয়ে আপনি উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করছিলেন। ওই সময় আমরা দেখেছিলাম যারা রামুর নেতৃত্ব দিয়েছে তারা শুধু নির্দিষ্ট কোন দলের নয়। স্থানীয় চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, বিএনপি নেতা সবাই একত্রিত হয়ে এমন জঘণ্য সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। এজন্য তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও কোন ধরণের তৎপরতা দেখা যায়নি। এক বছর পর আপনার মূল্যায়ন কি?
আনু মুহম্মদ : এমন ঘটনায় আমি মোটেও বিস্মিত হইনি। আমাদের দেশে যে সাম্প্রদায়িক হামলাগুলো হয় সেগুলো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমেই হয়। আর তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাক বা না পাক এলাকার সবাই জানে যে এমন হামলায় ক্ষমতাসীন সরকারি দলের লোকজনরা আছে তাদের সহযোগি বিরোধীদলের লোকজন জড়িত আছে, জামায়াতের লোকজন আছে পুলিশ প্রশাসনের একটা বড় ভুমিকা আছে, গোয়েন্দা সংস্থার একটা ভুমিকা আছে। যারাই এটা ঘটাক না কেন কোন একটা ক্ষমতার উৎস থেকেই হামলার সূত্রপাত হয়। এছাড়া ভুমিদস্যুর ব্যাপার থাকতে পারে, বৌদ্ধমুর্তির লুণ্ঠন থাকতে পারে। একটা সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু করে পুরো অঞ্চলে মিয়ানমার, রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন ধরণের যে জটিলতাগুলো আছে, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কূটকৌশলের ব্যাপার থাকতে পারে। তবে এরসাথে যে বাংলাদেশের ক্ষমতাবানরা জড়িত সেটা তদন্ত কমিটির কাজ না করা দেখে বোঝা যাচ্ছে। এ ধরণের সাম্প্রদায়িক হামলায় যারা সংগঠিত করে তাদের চিহ্নিত করতে হলে সরকারি তদন্ত কমিটির আশায় থাকলে হবে না। আমাদের জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। জনগণের শক্তির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে জাতিগত বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে বা আঞ্চলিক বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে জীবন এবং সম্পদ লুণ্ঠন করতে চায় বা দেশকে যারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে চায় তাদের কে চিহ্নিত করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চেতনার বিস্তার যেমন দরকার তেমনি যারা দেশি-বিদেশি চক্রান্ত করে তাদেরকে প্রতিরোধ করতে হবে জনগণকে সাথে নিয়ে। সেই সাথে জনমত তৈরি করতে হবে।
পরিবর্তন : ফুলবাড়ী বড়পুকুরিয়াতে, সুনেত্রে আপনারা আন্দোলন করেছেন, সাগরে গ্যাসবলক ইজারা দেয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর রক্ষায় ও আন্দোলন করেছেন। সেগুলো কতটা সফল?
আনু মুহাম্মদ : ফুলবাড়ি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এখনো চলছে। ভেতরে ভেতরে কমিশনভোগিরা এখনো চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে জনগণের প্রতিরোধ এখনো তীব্র আছে। এই বছর সরকার এবং বহুজাতিক কোম্পানি থেকে চেষ্টা করা হয়েছে ফুলবাড়িতে সেই প্রকল্প স্থাপনের কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধেই উত্তরবঙ্গ ধ্বংসজজ্ঞ সংঘটিত হয়নি। জনগণের মত না থাকলে এতাদিনে উত্তরবঙ্গ ধ্বংস হয়ে যেত।
সাগরে গ্যাসবলয় ইজারা দেয়া সম্পর্কে আমি বলবো আমরা জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছি। আমরা মানুষের কাছে বার্তা পৌছাতে সমর্থ হয়েছি যে সাগরে যে চুক্তিগুলো হচ্ছে সেগুলো এদেশের জনগণ তথা বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বার্থবিরোধী। আমাদের আন্দোলনের একটি অর্জন হচ্ছে, পরবর্তী চুক্তিতে তারা আর রপ্তানী রাখেনি। কিন্তু তারা চুক্তির মধ্যে নানা ধরনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। যার ফলে বঙ্গোপসাগর এখন বাংলাদেশের হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম। জনগণকে জাগাতে আমাদের লংমার্চেও এটা একটা বিষয় থাকবে।
পরিবর্তন : ২০০৬ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়ি কয়লা খনিতে যে হত্যাকাণ্ড সঙ্ঘটিত হয়, তার পুরো দায়ভার তেল-গ্যাস-বন্দর রক্ষা কমিটি পরোক্ষভাবে আপনার উপরই চাপিয়ে দিয়েছেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান (‘ফুলবাড়ির রাজনীতি’ দ্রষ্টব্য)- এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
আনু মুহাম্মদ : যে নিহত হয় সেই দায়ী! মাহমুদুর রহমান জ্বালানী উপদেষ্টা, তিনি এশিয়া এনার্জি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছিলেন। টাটার প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সামনে তার ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। জ্বালানী উপদেষ্টা বাংলাদেশে বহুজাতিক ভারতীয় কোম্পানি তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। এটা জনগণের প্রতিরোধের মুখে বাস্তবায়ন হয়নি বলে তার ক্ষোভ এখন পর্যন্ত আছে। সেটারই বহিপ্রকাশ বইয়ের মধ্যে এসেছে। এটার অর্থটা হচ্ছে, আমরা দায়ী মানেই হলো যে, মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের শহীদ হওয়ার দায়িত্ব হলো মুক্তিযোদ্ধারা। জ্বালানী উপদেষ্টা হিসেবে ফুলবাড়ির যে হত্যাকাণ্ড এশিয়া এনার্জিকে টাকার কাজ দেওয়ার জন্য যে দায়-দায়িত্ব সেটা মাহমুদুর রহমানকে বহন করতে হবে। উনি ভারত বিরোধিতার বাগাড়ম্বর করলে তো সে ক্ষেত্রে কেলেঙ্কারি থেকে মুক্তি পাবেন না। যতোদিন পর্যন্ত তিনি নিজের দোষ স্বীকার করে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থণা না করেন।
পরিবর্তন : সুন্দরবন রক্ষার লং মার্চ সম্পর্কে কিছু বলুন।
আনু মুহাম্মদস : লং মার্চ হচ্ছে ভারতীয় একটি কোম্পানির স্বার্থে বাংলাদেশের কিছু কমিশনভোগী দখলদার তাদের স্বার্থে সুন্দরবন ধ্বংস করে সেখানে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প করা হচ্ছে। এটা যদি হয়, তাহলে লাখ লাখ মানুষের জীবন অরক্ষিত হয়ে পড়বে। পুরো বাংলাদেশ অরক্ষিত হবে। বাংলাদেশের সর্বশেষ বন শেষ হয়ে যাবে। আমরা বারবার বলছি যে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক উপায় আছে। কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং সেই সুন্দরবন ধ্বংস হবে এরকম কোনো প্রকল্প যতোই উন্নয়নের নাম থাক, কোনো প্রকল্পতেই সুন্দরবন ধ্বংসকে যৌক্তিক করা যায় না। সুন্দরবন ধ্বংস করার এই প্রকল্পে বাংলাদেশ থেকে আমরা লং মার্চ করছি। যেহেতু ভারতের কোম্পানি যুক্ত আছে, তাই ভারতের জনগণকেও আহ্বান জানাচ্ছি। তারাও আমাদের আন্দোলনের সাথে একটা পর্যায়ে এসে যুক্ত হবেন এবং আমাদের সুন্দরবন রক্ষা হবে। এই লংমার্চের মধ্য দিয়ে হাজার হাজার মানুষ দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হবেন। ইতোমধ্যে লক্ষ মানুষ নানাভাবে এ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হয়েছেন। আমরা নিশ্চিত যে, লং মার্চের মধ্য দিয়ে একটি জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশে সুন্দরবন ধ্বংস করার এ প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে।
পরিবর্তন : আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে বিকল্প কী আছে?
আনু মুহাম্মদ : বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে সহজ পথ আছে। প্রথমত, বহুজাতিক বিদেশি কোম্পানি নির্ভর কিংবা ব্যবসানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন, এটা সম্পূর্ণ বাদ দিতে হবে। বাংলাদেশ গ্যাস আছে, গ্যাস এবং ফসিল ফুয়েলের উপরই প্রধানত নির্ভর করতে হবে। আর এর বাইরে আছে নবায়নযোগ্য জ্বালানী, সৌরশক্তি, বায়োশক্তি, বর্জ্য— এগুলোর ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। বাংলাদেশে আমরা এটা করে দেখেছি, গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ভালোভাবে আরো গ্যাস সম্পদ পাওয়া যাবে। সেই সাথে বঙ্গোপসাগর আমাদের বিশাল উৎস হবে। সুতরাং বঙ্গোপসাগরের যে সমস্ত চুক্তি এখন করা হয়েছে, সেটা বাংলাদেশে খুব সস্তায় নিরবচ্ছিন্নভাবে, ভালোভাবে বিদ্যুৎ পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা হবে। সেজন্যই আমরা বঙ্গোপসাগরের চুক্তির বিরোধিতা করি। যারা বঙ্গোপসাগরের চুক্তি করে, বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ বিদেশীদের দিয়ে দিচ্ছে, তারাই কিন্তু আর কোনো উপায় নেই বলে সুন্দরবন ধ্বংস করছে কিংবা উত্তরবঙ্গ ধ্বংস করার জন্য উন্মুক্ত খনি করতে চায়। আমাদের কথা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরের গ্যাস সম্পদের শতভাগ মালিকানা বাংলাদেশের হাতে থাক। গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে আমাদের বহু বছর চলে যাবে। দ্বিতীয় হচ্ছে, আমাদের নবায়নযোগ্য জ্বালানীর যে সুবিধা, সৌরশক্তি, বায়োশক্তি সেটার মধ্য দিয়েই আমরা যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি, তাতে বিদ্যুৎ আমাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়। তার জন্য জাতীয় সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। পূর্ণ মনোযোগ নবায়নযোগ্য জ্বালানীর দিকে দিতে হবে। সেটা সরকার দিতে চায় না, কারণ বহুজাতিক তেল কোম্পানি, বিদ্যুৎ নিয়ে যারা ব্যবসা করতে চায়, তারা সহজ পথে সমাধানের দিকে বাংলাদেশকে যেতে দিতে চায় না।
পরিবর্তন : শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি আমাদের দেশের লাখ লাখ যুবকের আশা আকাঙ্ক্ষাকে শেষ করে দিয়েছে। তারা নিঃস্ব হয়েছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী এই কেলেঙ্কারির পেছনের রুই-কাতলাদের ধরতে তদন্ত কমিটি করেছিলেন। আজ পর্যন্ত শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির ধুম্রজাল সাধারণ মানুষের কাছে পরিস্কার করা হয়নি। এক সময় শেয়ারবাজারে হাজার হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো, এখন সেটা নেমে এসে শত কোটিতে! এ প্রসঙ্গে কিছু বলুন।
আনু মুহাম্মদ : শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর একটা তদন্ত কমিটি হয়েছিলো। ইব্রাহিম খালেদ সে কমিটির প্রধান ছিলেন। তদন্ত কমিটিতে অপরাধীদের সনাক্তও করা হয়েছিলো। কিন্তু সরকার যেটা করলো, সেই তদন্তটা পুরো ধামাচাপা দিয়ে রাখলো। ছিয়ানব্বই সালেও একই ঘটনা ঘটেছিলো। ওই সময় যারা দায়ী ছিলো, সেই তারাই এই সময় শেয়ারবাজার ধ্বংসের পেছনে আছে। নিশ্চিতভাবে এরা সরকারের খুব প্রভাবশালী লোকজন। এই লুটেরা কোটিপতিদের, আর আমি যেটা বলি, শাসক শ্রেনী হচ্ছে লুটেরা দখলদারদের অপরনাম। দেশের উপর আধিপত্য এবং সরকারি সহায়তা পাওয়ার কারণেই তারা শেয়ারবাজারের এই সর্বনাশ করে। শেয়ারবাজারের লাখ লাখ মানুষ যে সর্বহারা হয়ে গেলো, যেখানে প্রধান কারণ হচ্ছে এটা লুট করার জন্য লাখ লাখ বিনিয়োগকারীদের আয়-সঞ্চয় লুট করার জন্য এটি করা হয়েছিলো। পুরো ঘটনাই ঘটেছে সাজিয়ে ও পরিকল্পিতভাবে। সেটার পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পৃক্ত ছিলো। সেখানে আমরা দেখি যে, যে কয়েকজনের নাম এসেছিলো, তাতে আওয়ামী লীগের সাথে বিএনপির লোকও আছে। এ ক্ষেত্রে তাদের যে ঐক্য দেখা গেলো, সেটার ব্যাপারে সরকার কিন্তু খুবই নমনীয়, এবং সরকার তাদেরকে ধরতে ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না; বা ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটা প্রকাশ করা, এই সম্পৃক্তদের উন্মোচিত করা, তাদের পরিচয় প্রকাশ করাটা আমার মনে হয় যে, সকল গণমাধ্যম সেই কাজটি এখনো করেনি।
পরিবর্তন : বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সংকট ও বর্তমান সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুতের যে সংকট ছিল সেই মুহূর্তে কি কুইক রেন্টালের বিকল্প কিছু ছিল? কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্প কি সুফল বয়ে আনেনি, বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে সরকারের কুইক রেন্টাল প্রকল্প ও পরবর্তী সময়ে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আনু মহাম্মদ : কুইক রেন্টালটা হচ্ছে যেখানে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যানগুলো নবায়ন (মেরামত) করলে প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব ছিলো এবং সেই বিদ্যুৎ খরচ হতো দুই টাকা করে। কিন্তু সেটা সরকার না করে দুই টাকা করে বিদ্যুৎ পাওয়ার পথ অনুসরণ না করে, আঠারো বা বিশ টাকা দরে বিদ্যুৎ পাওয়ার জন্য কুইক রেন্টাল গঠন করলো। তার জন্য আমাদের তেল আমদানি করতে হয়েছে। অনেক ঋণগ্রস্ত হতে হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা বড় ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি পড়বে। সুতরাং এটা সরকার সব সময় বলে যে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি, কিন্তু অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে, সেটা সরকারের মতে অনিবার্য ছিলো। কিন্তু আমি বলবো, এটা অনিবার্য ছিলো না। এর চাইতে অনেক সহজ পথ ছিলো। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো নবায়ন, মেরামত করলেই কোনো রকম ঋণ করা ছাড়া অর্থনীতির উপর দায় চাপানো ছাড়াই, বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যায় বৃদ্ধি করা ছাড়াই বাংলাদেশে স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুতের সংকট কাটানো সম্ভব ছিলো।
পরিবর্তন : আগামী নির্বাচনে জাতীয় কমিটি এই দুই রাজনৈতিক শক্তির কোনটিকে সমর্থন করবে?
আনু মুহাম্মদ : জাতীয় কমিটি কাউকে সমর্থন করবে না। আমাদের নির্বাচন নিয়ে কোন পরিকল্পনা নেই। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আমাদের আন্দোলন চলবেই।
পরিবর্তন : ফেলানী হত্যার বিচার হলো, প্রথমে দোষী বিএসএফকে খালাস দেয়া হলো, আন্দোলনের মুখে আবার পূনর্বিচারের সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। অনেকেই বলছেন শেষ পর্যন্ত দোষী বিএসএফকে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন দেয়া হবে এবং বর্তমান সরকার এটাকে তাদের পক্ষে নিয়ে সাফল্যের প্রচারণা চালাবে। প্রতিদিন সীমান্ত এলাকাগুলো থেকে এ দেশের নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অনেকে বলেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী দিপু মনি বিদেশে ভ্রমণের সেঞ্চুরি করে সফল। তবে তিনি প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারত থেকে কিছুই আনতে পারেননি, এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
আনু মুহাম্মদ : সারা পৃথিবীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র যেমন প্রভাবশালী, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত তেমন। ভারত তার আশে পাশের দেশগুলোর ওপর আধিপত্ম, কর্তৃত্ব, নিপীড়নমূলক, বৈষম্যমূলক আচরণ জারি রাখার জন্য তারা সবসময় সবধরণের তৎপরতা বজায় রাখে। শুধু এক ফেলানি নয় শত শত ফেলানি সীমান্তে নিহত হয়েছে। এটা নিয়ে সরকারের ভুমিকা খুবই আপত্তিকর। সরকারকে জনগণের নিরাপত্তা বা তার নাগরিকদের হত্যা করার ব্যাপারে যেভাবে কথা বলা উচিত সেটা কখনোই তারা বলেনি। সরকারের কোন কোন ক্ষেত্রে কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয় তারা ভারতের কোন ধরনের অত্যাচার নিপীড়ন নিয়ে কথা বলবেন না এটাই তাদের সীদ্ধান্ত। তবে সরকার চুপ থাকলেও জনগণের বিক্ষোভ থেমে থাকেনি। শুধুমাত্র জনগণের বিক্ষোভের কারণেই ভারত তাদের সাজানো নাটকটি পুনরায় বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরে সুষ্ঠু বিচার করবে এ কথাটির অর্থই হচ্ছে আগে সুষ্ঠু বিচার হয়নি। তবে আমার দাবি হচ্ছে শুধু ফেলানি নয় সীমান্তে যতোগুলো হত্যা হয়েছে সবগুলোর বিচার করতে হবে। আর ভারত যদি বিচার না করে এর দায়দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। কারণ সরকারের দায়িত্বই হলো জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেয়া। বিদেশি একটা বাহিনী একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের সরকার কিছুই বলছে না এটা হতে পারে না।
পরিবর্তন : অনেকে বলে থাকেন, আপনারা কয়লা তোলার ব্যাপারে বা গ্যাস অনুসন্ধানের ব্যাপারে বাধা দিচ্ছেন। তাহলে আমাদের জ্বালানী ও বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান কীভাবে হবে?
আনু মুহাম্মদ : আমরা যে চুক্তি বা উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারগুলোতে বাধা দিয়ে থাকি সেগুলো যদি সফল হতো তাহলে বাংলাদেশের তেল, গ্যাস, কয়লা, বিদ্যুৎ কোন কিছু বাংলাদেশে থাকতো না। ১৯৯৭-৯৮ সাল থেকে আমাদের যে আন্দোলন চলছে এটা যদি না থাকতো বর্তমানে যে পরিমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তার ৩০ ভাগও হতো না দেশের সম্পদ বিদেশে চলে যেত। দেশের কয়লা সম্পদ বিদেশেতো পাচার হতোই পুরো উত্তরবঙ্গ ধ্বংসজজ্ঞ হতো। আমাদের দাবি হচ্ছে এই সম্পদ দেশের শতভাগ মালিকানায় গ্যাস, কয়লা উৎপাদন করে দেশের মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। দেশের চাহিদা শতভাগ না মিটিয়ে কোনক্রমেই সম্পদ রপ্তানি করা যাবে না, উন্মূক্ত খনি বা সুন্দরবন ধ্বংসের মতো কোন প্রকল্প হাতে নেয়া যাবে না এবং সমস্ত কাজ নিজেদের কর্তৃত্বে করার মতো জাতিয় সক্ষমতা তৈরি করতে হবে।
পরিবর্তন : প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ সম্পর্কে বলুন-
আনু মুহাম্মদ : নারীর বিকাশের জন্য, নারীর কর্তৃত্বের জন্য, নারী নিপিড়ন, বন্ধের জন্য যা যা দরকার তার থেকে অনেক দূরে। কাগজের ক্ষেত্রেও অনেক দূরে এবং সেই কাগজের ক্ষেত্রেও যেটা আছে সেটা বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা এখন পর্যন্ত আমরা দেখিনি।
পরিবর্তন : অনেকেই বলেন যে, আপনাদের আন্দোলনগুলোর বাজেট আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে…
আনু মুহাম্মদ : আমাদের আন্দোলনের এক বছরের যে বাজেট তার থেকে কয়েকগুন বেশি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির একটা জনসভায় খরচ হয়। ওই টাকাটা কে দেয় এই নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না? আমাদের খরচ হয় না আসলে কারণ আমাদের শরীক রাজনৈতিক দল আছে প্রায় ২০টি তারা খরচ করে, আমাদের নাগরিক খরচ করে আমি নিজে চাঁদা দেই, আমাদের আহ্বায়ক চাঁদা দেয়, আমাদের কর্মীরা চাঁদা দেয়, নিজেরা গায়ে গতরে খেটে কাজ করে, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাজ করে। মানুষ যে অর্থ ছাড়া কাজ করতে পারে এটা যারা কমিশনভোগী, দালাল লুটেরা গোষ্ঠী তারা বুঝতে পারবে না যে কী কারণে মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে, কী জন্য কী কারণে দেশের সম্পদ রক্ষার জন্য জীবন দেয় কী কারণে মানুষ পয়সা ছাড়া ২৪ ঘন্টা কাজ করতে পারে এটা তারা বুঝতে পারবে না।
পরিবর্তন : ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও পরিবর্তনকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আনু মুহাম্মদ : আপনাকেও ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
(২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে poriborton.com এ প্রকাশিত)