আলোকিত বাংলাদেশ : বর্তমানে চলমান সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য সরকারি দল এবং সংসদের বাইরে থাকা বিরোধী বৃহৎ রাজনৈতিক দল দুটি একে অপরকে দায়ী করছে। আপনার মতে এ পরিস্থিতির কারণ কী এবং কারা এজন্য দায়ী?
আনু মুহাম্মদ : যে কোনো সময় কোনো পরিস্থিতির জন্য অর্থাৎ ভালো কিছু হলে তার কৃতিত্ব আবার খারাপ কিছু হলে তার দায়িত্ব ক্ষমতাসীনদের ওপরই বর্তায়। সুতরাং সে হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতির প্রধান দায়িত্ব সরকারের। এ পরিস্থিতির ক্ষেত্র তৈরিতে বিরোধী দল বিএনপি বা তাদের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের ভূমিকাও কম নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যে একটি পরিবারতন্ত্র, লুটেরা অর্থনীতি, অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু রয়েছে, সেগুলোর কারণেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে নির্বাচন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। অর্থাৎ একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া দাঁড়াতে পারেনি। এর কারণ যারা ক্ষমতায় যায় তারা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চায়। ক্ষমতার মাধ্যমে সম্পদ দখল-লুণ্ঠনের যে সুযোগ তৈরি হয়, তার কারণে তারা কোনো প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হতে দেয় না। এ প্রক্রিয়া আমরা বিএনপির চারদলীয় শাসনামলে দেখেছি, তারা নির্বাচন প্রক্রিয়া দাঁড় করাতে দেয়নি এবং বর্তমান সরকার সেই ধারাবাহিকতাই অব্যাহত রেখেছে। সে হিসেবে দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে বা তাদের ভূমিকার ক্ষেত্রে একটা অভিন্নতা দেখতে পাই।
সর্বশেষ অচলাবস্থায় সরকারের ভূমিকাই প্রধান। কারণ গত বছরের ৫ জানুয়ারি যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তাতে বর্তমান সরকারকে আমরা স্বনির্বাচিত বলতে পারি। সেই নির্বাচনটি যেভাবে হয়েছে তা কখনোই স্থিতিশীলতা দেবে না। এভাবে নির্বাচিত সরকার কখনও স্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে না। তার নিজের ক্ষমতার ভিত্তিও খুব নড়বড়ে থাকে। ফলে এ অস্থিতিশীলতা অনিবার্য ছিল।
আলোকিত বাংলাদেশ : দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের কোনো উপায় আছে কি?
আনু মুহাম্মদ : উপায়টা কঠিন। কারণ যারা এ পরিস্থিতি তৈরি করছেন ক্ষমতা তো তাদের হাতে। যারা এ পরিস্থিতির শিকার অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষের রাজনৈতিক ক্ষমতায় অংশীদারিত্ব এবং প্রভাব তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এ পরিস্থিতিতে সুবিধাভোগীদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক বেশি এবং সে কারণে এমন পরিস্থিতি থেকে বেরোতে তাদের ভূমিকাটাই বেশি দরকার হয়। যেমন- এখন যদি আমি সহজভাবে কা-জ্ঞান থেকে বলি যে, এ সমস্যার সমাধান হচ্ছে সরকার সব সভা-সমাবেশ, গণতান্ত্রিক চর্চার ওপর বিধিনিষেধ দূর করবে। আমরা এখন দেখছি বিরোধী পক্ষ কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারে না। তাদের ওপর বহু নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সরকার গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, ঘোষিত-অঘোষিত বিধিনিষেধ জারি করেছে। সেগুলো প্রত্যাহার করলে স্বাভাবিক একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে তাহলে তার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হবে জনসমর্থন কার পক্ষে আছে এবং যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে স্বাধীন গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়ায় একটা নির্বাচন যদি হয় তার মাধ্যমেই তো প্রমাণিত হওয়া সম্ভব যে জনগণ কার পক্ষে আছে। এটা তো গায়ের জোরে বলার কিছু নেই। এটা হচ্ছে স্বাভাবিক সমাধান প্রক্রিয়া। এখন এই সমাধান প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হবে এটা প্রত্যাশা করা খুব কঠিন।
আলোকিত বাংলাদেশ : বর্তমানে দেশের রাজনীতিতে যে মুখোমুখি অবস্থা চলছে সেটা দীর্ঘায়িত হলে দেশের পরিস্থিতি কেমন হতে পারে?
আনু মুহাম্মদ : যেভাবে আমরা অগ্রসর হচ্ছি তাতে দেশের ভেতরের এবং বাইরের বহু ধরনের শক্তি এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। এখন সরকার যদি জনগণের ওপর ভরসা করত তাহলে তো তাদের এত আতঙ্কিত হওয়ার কিছু ছিল না। মানে সরকারের আচরণ দেখলে মনে হয় সরকার খুবই আতঙ্কিত এবং ভীতিগ্রস্ত। ভীতিগ্রস্ত না হলে তো সরকারের এত দমন-পীড়নের দরকার নেই, এত নিষেধাজ্ঞা আরোপের দরকার নেই, সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার দরকার নেই। এখন সরকার যেভাবে নির্বাচিত হয়েছে তাতে তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে এবং জনগণের ওপর ভরসা করতে পারছে না। এর ফলেই তার এ দমন-পীড়ন। অন্যদিকে বিএনপিসহ যারা আন্দোলন করছে তারাও জনগণের ওপর ভরসা করতে পারছে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারছে না। ফলে তারা চোরাগোপ্তা হামলা কিংবা এক ধরনের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া বা বিদেশের সমর্থন লাভের চেষ্টা- এসব প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করছে। অর্থাৎ ষড়যন্ত্র, দমনপীড়ন, অবিশ্বাস, পুলিশি ব্যবস্থা এগুলোর ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। একদিকে পুলিশি ব্যবস্থা, অন্যদিকে চোরাগোপ্তা হামলা। দুটোর কোনোটার মধ্যেই জনগণের অবস্থান নেই। ফলে দীর্ঘমেয়াদে একটা অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই সমর্থিত হচ্ছে। দুই দিকেই অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এটা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, জনগণের নিরাপত্তা, দেশের সম্পদ, দেশের ভবিষ্যতের জন্য সব দিক থেকেই একটা হুমকি তৈরি করছে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং জনগণের ক্ষমতা এবং সম্ভাবনা সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আলোকিত বাংলাদেশ : সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন দেশের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে, একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আপনি সরকারের এ দাবিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আনু মুহাম্মদ : অর্থনৈতিক অগ্রগতি পরিমাপের বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি আছে। সরকার যেভাবে পরিমাপ করে সেটা একটা অংশ যেমন জিডিপি, রফতানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। এগুলো হচ্ছে একটা অংশ। এগুলো দেখলে আমরা একটা উন্নতি-অগ্রগতির চিত্র পাই। কিন্তু এর অন্য অংশটি না দেখলে সামগ্রিক চিত্রটি পাওয়া যায় না। যেমন- গার্মেন্ট, রেমিট্যান্স এবং কৃষি- এ তিনটি খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তৈরি করছে। আমরা পরিসংখ্যানে যে অগ্রগতি পাই তার পেছনে মূল ভূমিকা রয়েছে প্রবাসী শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক এবং কৃষকের। কিন্তু এদের অবস্থা যদি আমরা দেখতে যাই তাহলে দেখব এ অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরির জন্য তাদের একটা উচ্চমূল্য দিতে হচ্ছে। গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঘোষিত নূ্যনতম মজুরি এখনও অনেক কারখানায় কার্যকর হয়নি। তাদের কর্মসময়ের ঠিক নেই। তাদের কর্মঝুঁকি রয়েছে, বহু নিষ্ঠুর ও নির্মম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা কাজ করছে। প্রবাসী শ্রমিকদের অবস্থাও তা-ই। প্রবাসী শ্রমিকদের অনেক কাহিনী আমাদের অজানা। কৃষক উৎপাদন করছে; কিন্তু তারা তাদের উৎপন্ন ফসলের দাম পাচ্ছে না। তাদের ঋণগ্রস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। এটা হচ্ছে আরেকটা দিক। এর আরও একটা দিক হচ্ছে যেভাবে জিডিপি বাড়ছে, যেমন- নির্মাণ খাতের যেভাবে বিস্তার হচ্ছে তার মধ্য দিয়ে নদী, জলাশয়, কৃষিজমি যেভাবে দখল হচ্ছে, পাহাড়-বন যেভাবে উজাড় হচ্ছে এবং কিছু গোষ্ঠীর দখলে আসছে সেটার মূল্য কিন্তু অনেক বেশি। মানে পরিবেশ দূষণ এবং অন্যান্য ক্ষতি বিবেচনা করলে এ সমৃদ্ধির অনেক কিছু মস্নান হয়ে যাবে। আরেকটা দিক হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুদ তৈরি হচ্ছে তার একটা অংশ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের চোরাই অর্থনীতি দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে এ অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কারণে। সম্পদ দখল এবং পাচারের ঘটনা ঘটছে। ফলে প্রতি বছর গার্মেন্ট শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং নির্মমতার মধ্য দিয়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন তার একটা বড় অংশ পাচার হয়ে যায় চোরাই অর্থনীতির কারণে। এ সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি যেমন একটা অংশ তেমনি বঞ্চনাও একটা বড় অংশ। এ চিত্রটি আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। এখানে আমরা উন্নয়ন যেমন দেখতে পাই, পাশাপাশি একটা বিপর্যয়ের চিত্রও দেখতে পাই। দেখতে পাই প্রকৃতি, সম্পদ এবং ভবিষ্যতের বিপর্যয়। সুতরাং একতরফা জৌলুসটা দেখলে হবে না, সেটা কী মূল্য তৈরি করছে এবং কী বিপর্যয় তৈরি করছে সেটা দেখলে আমরা দেখব একটা ভারসাম্যহীন এবং নাজুক উন্নয়ন। এটাকে টেকসই করতে হলে উন্নয়নের ধারণাকে পাল্টাতে হবে। তা না হলে এ সমৃদ্ধি সামগ্রিক হতে পারবে না। বরং এ খ-িত উন্নয়ন অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
আলোকিত বাংলাদেশ : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ : আপনাদেরও ধন্যবাদ।