অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে ছয় বছর পূর্ণ হলেও তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার বিচার এখনো হয়নি। এই ছয় বছরে দেশে খুন, গুম, নিপীড়ন ও অকালমৃত্যুর মিছিল দেখলে ত্বকী হত্যার বিচার না হওয়া আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হবে না। এখন পর্যন্ত এ রকম ঘটনা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যেখানে খুনি সরকারি দলের ক্ষমতার আশীর্বাদপুষ্ট আর তার বিচার হয়েছে। বিশ্বজিৎ বা জোবায়ের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক তোলপাড় হওয়ার কারণে বিচার হয়েছিল, রায়ও হয়েছে, কিন্তু দণ্ডপ্রাপ্ত মূল আসামিরা পলাতক থেকে যেতে পেরেছে। এ ছাড়া সাগর-রুনি হত্যার তদন্তকাজই শেষ হয়নি। তনু হত্যার ক্ষেত্রেও তা-ই। তবে ত্বকীর ক্ষেত্রেও প্রবল আন্দোলনের চাপে তদন্ত অনেক দূর ভালোভাবেই অগ্রসর হয়েছিল। তখন মামলার তদন্তকারী সংস্থা ছিল র্যাব, হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তি হওয়ার আগেই তারা ত্বকী হত্যা কেন, কখন, কোথায়, কীভাবে সংঘটিত হয়েছে, কারা করেছে, তার প্রাপ্ত তথ্যাবলি সংবাদ সম্মেলন করে জানায়। র্যাব কর্মকর্তারা তখন একটি খসড়া অভিযোগপত্র উপস্থাপন করে সংবাদকর্মীদের জানান যে অচিরেই অভিযোগপত্রটি আদালতে পেশ করা হবে। কিন্তু তারপর থেকেই পুরো প্রক্রিয়া থমকে যায়। অভিযোগপত্র আজও আদালতে পেশ করা হয়নি।
ত্বকীর জীবন মাত্র শুরু হওয়ার পথে ছিল, তখনই তাকে খুন করেছে দুর্বৃত্তরা। বাংলাদেশে এমনিতে অকালমৃত্যুর শেষ নেই। এই অকালমৃত্যুর বহু ধরন, শিশু-তরুণ-নারী-পুরুষ, জবাবদিহি করার কেউ নেই। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের কথিত মালিক জনগণের এতিম অবস্থা। জনগণের ওপর খবরদারি করা আর তাদের জীবন অতিষ্ঠ করায় ক্ষমতাবানদের বহু শাখা-প্রশাখা আছে। তাদের কাছ থেকে কর আদায়ে, করসহ গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে সরকারের প্রবল আগ্রহ, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সব রকম প্রতিবাদ-সমালোচনার পথ বন্ধ করতে সরকার সদা সক্রিয়। কিন্তু জনগণের বাঁচা-মরা নিয়ে সরকার কোনো দায় বোধ করে না।
আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দেখেছি, পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র দেখেছি। উপনিবেশকালের এসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান রাষ্ট্রযন্ত্রের তফাত কী? ঔপনিবেশিক প্রভুদের মতোই দেশি শাসকেরা, তাঁদের অর্থবিত্ত-ক্ষমতার উৎস এই পোড়া দেশ, কিন্তু তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঠিকানা অন্যত্র। সড়ক দুর্ঘটনাতেই বাংলাদেশে প্রতিবছর পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার মানুষ নিহত হচ্ছে, জখম বা পঙ্গু হচ্ছে কত, তার হিসাব নেই। এর প্রতিকারে রাষ্ট্রের কোনো উদ্যোগ নেই। আদালত শুধু তা-ই দেখেন, যা দেখতে সরকার আপত্তি করে না। কারাগারে বিনা বিচারে, এমনকি বিনা অপরাধে আটকে থাকে হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর। অচল গাড়ি ফিটনেস কাগজ দিয়ে, বেআইনি ভবন অনুমতি দিয়ে, নদী-বন দখলদার, পানি-বায়ু বিষাক্তকারীদের রক্ষা করে, সরকারি বিভিন্ন বিভাগ দেশের মানুষের অস্বাভাবিক-অকালমৃত্যু আর দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার পথ তৈরি করে।
দেশের মানুষের জীবনের বিনিময়ে কিছু লোকের হাতে জমা হতে থাকে অর্থবিত্ত। মুনাফা ও মূলধন সংবর্ধনের উলঙ্গ প্রক্রিয়াকে পূর্ণ পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় কীভাবে মানুষের জীবন ও সম্পদ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, সর্বশেষ চকবাজারের চুড়িহাট্টার নির্মম ঘটনা তারই প্রকাশ। নয় বছর আগে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর জননিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে রাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার কিছুই তারা পূরণ করেনি। অনেকে বলেন, এই রাষ্ট্র অদক্ষ। না, এই নিষ্ক্রিয়তা দক্ষতার সমস্যা নয়। কেননা, এই একই সময়ে এই রাষ্ট্র জননিপীড়নে, সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারে, নির্বাচনসহ সব প্রতিষ্ঠান দখলে উল্লেখযোগ্য দক্ষতা ও সক্রিয়তা দেখিয়েছে। খুনের দক্ষতাও কম দেখায়নি। নির্লজ্জ দক্ষতায় খুনিদের রক্ষা করেছে, ফাঁসির আসামিকে মুক্তি দিয়েছে। অভিজিৎ রায়সহ লেখকদের খুন নিয়ে সরকার নিজের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী অনেক প্রচার চালিয়েছে। কিন্তু খুনিদের চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে অনেক কিছুই এখনো রহস্যময় হয়ে আছে।লেখক সংগঠক বাকি বিল্লাহ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘মাত্র কদিন আগেই দেখলাম, আনসারুল্লাহর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ জিয়াউল হককে প্রধান আসামি করে অভিজিৎ হত্যার চার্জ গঠন করা হয়েছে। তবে ওই সাবেক সেনা কর্মকর্তা এখন কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর। পত্রিকার পাতায় আসামিদের নামগুলো ভালো করে পরখ করে দেখছিলাম। এর কারণ হচ্ছে কয়েক বছর আগের র্যাবের একটি প্রেস কনফারেন্স। সেই প্রেস কনফারেন্সে তিনজন ব্যক্তিকে হাজির করে বলা হয়েছিল, তারাই অভিজিতের খুনি। কীভাবে তারা খুনের পরিকল্পনা করেছে, কেমন করে বাস্তবায়ন করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছিল। খুনের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাঁকে উপস্থাপন করা হয়েছিল, তাঁর নাম ছিল সম্ভবত তৌহিদুল, যিনি একজন ব্রিটিশ নাগরিক। বাকি দুজনকে বলা হয়েছিল তাঁর সহযোগী। তবে র্যাব যেদিন তাদের গ্রেপ্তার করেছে বলে দাবি করেছিল, তার সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষ্য পাওয়া গিয়েছিল তৌহিদুলের বোনের বয়ানে। তিনি দাবি করেছিলেন, তৌহিদুল মানসিক ভারসাম্যহীন এবং র্যাবের দাবিকৃত সময়ের আরও তিন মাস আগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। …অভিজিৎ খুনের সর্বশেষ গঠিত চার্জে তৌহিদুলের নাম নেই। তখনই তৌহিদুলকে অভিজিতের খুনি মানতে আমি ঘোরতর সংশয়ী ছিলাম, ফেসবুক পোস্টে সেই সংশয় প্রকাশও করেছিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে তৌহিদুল এখন কোথায় আছে? কেন তথ্য–প্রমাণ সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে কয়েকজনকে অভিজিতের খুনি প্রমাণ করার দরকার পড়েছিল, কেনই–বা তা এত ফলাও করে জনসমক্ষে প্রচার করা হয়েছিল? …অভিজিৎ খুন হওয়ার দিনটিতেও এ রকম অসংখ্য প্রশ্ন ছিল। বইমেলার তিন স্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে সময় নিয়ে এ রকম অবলীলায় খুনের ঘটনা কীভাবে সম্ভব হলো। কেন মাত্র ৪০ গজ দূরের পুলিশের দলটি ঘটনার আধঘণ্টার মধ্যেও কোনো রেসপন্স করল না?…’
একটা বিষয় এত দিনে সবার কাছে পরিষ্কার হওয়ার কথা, কোনো অপরাধের বিচারে যদি শ্লথগতি বা টালবাহানা দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে খুনি বা অপরাধীকে যেকোনোভাবে রক্ষা করাই সরকারি সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্তই আসল, বাকি সবই সাজানো খেলা। তবু আইন, আদালত, নানা
বাহিনীর রঙিন আয়োজন, সরকারি উদাত্ত প্রতিশ্রুতিতে মানুষ বারবার বিশ্বাস করতে চায়, বারবার তার বিশ্বাসভঙ্গ হয়।
ত্বকী কিশোর বয়সেই সমাজের এই দস্যুদের শনাক্ত করেছিল তার কবিতায়, আবার স্বপ্নও দেখেছিল বাংলাদেশ আবার জেগে উঠবে, মানুষ এই দস্যুদের পরাজিত করবে। ত্বকী খুন হয়েছে তার ভেতরের এই শক্তির জন্যই। সন্ত্রাসী, দখলদারদের হাতে বিপর্যস্ত একটি জনপদে মানুষের পক্ষে লড়ছিলেন তার বাবা ও স্বজনেরা। ত্বকীকে খুন করে তারা শুধু একটি সৃজনশীল প্রাণকে স্তব্ধ করতে চায়নি, স্তব্ধ করতে চেয়েছিল জনগণের সেই শক্তিকে, যার ভয়ে তারা বরাবর সন্ত্রস্ত থাকে। সারকথা এই, ত্বকীকে নির্মমভাবে খুন করার পরেও পরাজিত হয়নি জনগণের সেই শক্তি; বরং আরও অপ্রতিরোধ্য হয়েছে। ত্বকীর কথা বলতে গেলে ভিআইপি দস্যুদের কথা আসে, আসে তাদের লোভে-আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত অসংখ্য মানুষের কথা, আসে সুন্দরবনের কথা, হারিয়ে যাওয়া বা মরতে বসা নদীর কথা, আসে বাংলাদেশের মলিন মুখের কথা। সে জন্যই ত্বকী একা নয়, তার হত্যার বিচারের লড়াই শুধু এক কিশোরের জীবননাশের বিষয় নয়, ত্বকী এখন সমগ্র বাংলাদেশকে মানুষের হাতে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নের সঙ্গে জড়ানো। সে জন্যই ত্বকী হত্যার বিচার হবেই, জনগণের শক্তিই তার খুনি আর খুনিদের পৃষ্ঠপোষকদের বিচার করবে।