তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ, আইএমএফ ও জনগণের দুর্ভোগ

আইএমএফের রেকর্ড হচ্ছে, মজুরি ছাড়া সবকিছুর দাম বৃদ্ধির পক্ষে কাজ করা। সুতরাং বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে যে অবস্থায় আছি, এই ধারা যদি চলতে থাকে সরকার গ্যাস- বিদ্যুৎ-তেল-পানির দাম ক্রমাগত বাড়াতেই থাকবে।


করোনার সময় দুনিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাদেশেও সবাই অনিশ্চয়তায় পড়েছিল। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের প্রধান অংশ, প্রায় পাঁচ কোটির বেশি ইনফরমাল সেক্টরে স্বনিয়োজিত মানুষ, যাদের স্থায়ী কাজ ছিল না, সঞ্চয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। লকডাউনের কারণে চলাফেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাবেচা, বিভিন্ন ধরনের তৎপরতায় যখন নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়, তখন বিশাল অংশের মানুষ—যেমন বিভিন্ন খাতের মজুর, ফুটপাতসহ বিভিন্ন ধরনের হকার, বিভিন্ন ধরনের ছোট ব্যবসা, অস্থায়ী কাজ, টিউশনি ইত্যাদি জায়গায় যুক্ত লোকজন ভয়াবহ সংকটে পতিত হয়।


সে সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখি পুঁজিবাদী কেন্দ্রীয় দেশগুলো থেকে আমাদের আশপাশের দেশগুলোর সরকারও জনগণের জন্য বহু রকম নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়েছিল, করোনায় বিপদগ্রস্ত মানুষদের সহযোগিতার জন্য বিভিন্ন ধরনের খাদ্য, অর্থ ও রেশনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ ছিল হাতে গোনা কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে রাষ্ট্র দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের প্রতি একেবারেই নির্লিপ্ত ছিল। এই যে বিশালসংখ্যক মানুষ যাদের আয়, কাজ, সঞ্চয়, স্বাস্থ্যসেবার ঠিক ছিল না, তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো ধরনের সহযোগিতার ব্যবস্থা ছিল না।

তবে কিছু প্রণোদনা কর্মসূচি ছিল, যেগুলো শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের জন্য বরাদ্দ ছিল; বিশেষ করে তৈরি পোশাক মালিকদের জন্য। কিছু ঋণের ব্যবস্থা ছিল শিল্প ও কৃষি খাতে। সম্পূর্ণভাবে আশ্রয়হীন, যাদের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই, তাদের জন্য কোনো কিছুর ব্যবস্থা ছিল না।
সেই অবস্থায় করোনা পরিস্থিতি যখন মোটামুটি পার হলো, তত দিনে বহুজনে ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছে, অনেকের শিক্ষা বন্ধ হয়ে গেছে, চিকিৎসা অনেকের ঠিকমতো হয়নি—এ রকম একটা অবস্থায় জিনিসপত্রের দাম বাড়া শুরু করল।


রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের অজুহাত ধরে সরকার প্রথমে তেলের দাম বাড়াল। এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তি ছিল, এ কারণে আবার সবকিছুর দাম হু হু করে বাড়তে থাকল। এরপর সরকার আবার বিদ্যুতের দাম বাড়াল এবং সম্প্রতি গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এবারের গ্যাসের দাম বৃদ্ধির হার শিল্প খাতের জন্য বড় আক্রমণ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হুমকি দিচ্ছেন, আবারও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হবে। এসবের প্রতিটিই হলো শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর একেকটা আঘাত। কারণ, প্রতিটি পর্বেই জীবনযাত্রা, পরিবহন এবং বাসাভাড়ার ব্যয় বেড়েছে। এসবের ঊর্ধ্বগতি সরকার যে মুদ্রাস্ফীতির হার দেখাচ্ছে, তা দিয়ে বোঝা যাবে না; বিশেষ করে গরিব মানুষের যেসব দরকার, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অনেক বেশি বেড়েছে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা গত দুই বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। অন্যদিকে কিছু লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। এটা হলো বর্তমান উন্নয়নের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিছু লোক ও গোষ্ঠী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে, টাকা পাচার করে, নদী-বন-খাল-জমি, সরকারি জায়গা দখল করার মাধ্যমে সম্পদ পুঞ্জীভূত করছে। ইতিমধ্যে মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে—দুবাই, টরন্টো, লন্ডনসহ বিভিন্ন দেশের অভিজাত এলাকায় বাংলাদেশি এসব ধনিক গোষ্ঠীর বড় আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এরাই এই সময়ের উন্নয়ন ধারার বড় সুবিধাভোগী। এরাই দেশ চালায়। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্ফীতিতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না; বরং তারা সেসব থেকে সুবিধা পেয়ে থাকে।


আমরা দেখি মুদ্রাস্ফীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুদ্রার দাম আপেক্ষিকভাবে কমেছে। আগে যেখানে প্রতি ডলারের দাম ছিল গড়ে ৮৫ টাকা, সেটা এখন গড়ে ১০৫ টাকা।


প্রতি ডলারে পতন হয়েছে ২০ টাকা। যারা দেশে থেকে ডলারে আয় করে, তাদের জন্য এতে বাড়তি আয় সৃষ্টি হয়েছে। যেমন রপ্তানিকারক গার্মেন্টস মালিকেরা যদি এক হাজার কোটি ডলার আয় করেন, তাহলে টাকায় তাঁদের বাড়তি আয় হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা, তিন হাজার কোটি ডলার মূল্যের রপ্তানিতে তাঁরা বছরে তাই ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করছেন। অন্যদিকে টাকায় শ্রমিকের মজুরি তো আগেরটাই আছে, শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি; বরং দেখা যাচ্ছে, যে শ্রমিক মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করতেন, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে তাঁর প্রকৃত আয় কমে গিয়ে ৭-৮ হাজার টাকা হয়েছে; অর্থাৎ একই সময়ে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আয় কমে গেছে আর মালিকদের আয় বেড়ে গেছে। বর্তমান সময়ে এই এক খাতেই ৩০ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিকের আয় কমে গেল আর ২ হাজার গার্মেন্টস মালিকের আয় বেড়ে গেল। এই হলো পুরো সমাজের একটা খণ্ডচিত্র।


এই পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার একের পর এক তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। এর পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে সরকার বলছে, আমরা তো আর এত ভর্তুকি দিতে পারব না। আর আইএমএফ বলছে, এসবে ভর্তুকি আছে, তা তুলে দিতে হবে। সুতরাং এসবের দাম বাড়াতে হবে। আইএমএফ ও সরকার দুই পক্ষের কেউই এই ভর্তুকির কারণ দূর করতে আগ্রহী না। যেমন বিদ্যুৎ খাতে কুইক রেন্টাল ও প্রাইভেট পাওয়ার প্ল্যান্টের যারা মালিক, তাদের মধ্যে মাত্র ১২টি গ্রুপ গত ১১ বছর ঘরে বসে ৬০ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে। পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল বানানোর পেছনে যে টাকা খরচ হয়েছে, এই টাকা প্রায় তার সমান। তারা কিন্তু এই টাকার বিনিময়ে কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ করেনি।


কেন তারা এত টাকা পেল? কারণ চুক্তিটা সেভাবেই করা হয়েছিল। তখন সরকার বলেছিল, আমাদের বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত আছে, আমাদের বিদ্যুৎ দরকার নেই। সুতরাং তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে বসে বসে এ টাকা দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে আছে—সামিট, ওরিয়ন, ইউনাইটেড আর এখন ভারতের আদানি গ্রুপ যুক্ত হচ্ছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান নীতিমালায় এলএনজি, এলপিজি, কয়লা ইত্যাদিতে সুবিধাভোগী গ্রুপগুলোর মধ্যে আরও আছে বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, এস আলম ইত্যাদি এবং বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি।


যদি দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান করা হতো, তাহলে প্রতি ইউনিট গ্যাসের জন্য খরচ পড়ত দেড় টাকারও কম আর বর্তমানে আমদানি করা এলএনজি গ্যাসের দাম পড়ছে প্রতি ইউনিট ৩০ থেকে ৫০ টাকা। যেটির দাম কম, সরকারের তো সেটাই করা উচিত। কিন্তু সরকার উল্টো করেছে, গত চার বছরে সরকার এলএনজি আমদানি করতে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। একই সময়ে দেশের গ্যাস অনুসন্ধানের জাতীয় সংস্থা বাপেক্স পেয়েছে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা। গ্যাস আমদানির জন্য সরকার ৮৫ হাজার কোটি খরচ করল, কিন্তু বাপেক্স শক্তিশালী করার জন্য, গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য তাদের কোনো টাকা নেই। তাদের আরও কিছু বাড়তি টাকা দিলে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধানের ফলে তা আমরা খুব কম টাকায় পেতাম। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন এলএনজির দাম যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে, তাতে বাড়তি ব্যয়ের চাপ আরও বাড়বে। কারণ, সরকার এখন গ্যাস খাতে যে ভর্তুকি দিচ্ছে, তা এলএনজি আমদানির জন্যই দিচ্ছে। লাভ এলএনজি ব্যবসায়ীদের, ক্ষতি দেশের।


কিন্তু এলএনজি আমদানির তো বিকল্প ছিল। আমরা বহু বছর থেকে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বলে আসছি। কারণ জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করলে আমরা খুব কম টাকায় গ্যাস উত্তোলন করতে পারতাম। যদি বাপেক্সকে শক্তিশালী করা যেত, তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য রামপালের মতো ভয়াবহ প্রকল্প নিতে হতো না। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যেত যদি ভালোভাবে গ্যাস অনুসন্ধান করা হতো। আর যদি নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রটাকে শক্তিশালী করা হতো, তাহলে কোনো ধরনের নির্ভরশীলতাই থাকত না।


সরকার এখন একটা শব্দ ব্যবহার করে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে শেখা—সমন্বয় করা। সমন্বয়ের নামে তারা সব সময় দাম বাড়ায়। গত বছর সরকার যখন তেলের দাম বাড়ায়, তখন তার আগের কয়েক বছরের তেলের কারণে আমাদের মুনাফা ছিল প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ার পরেও সরকার সেই আগের মুনাফা থেকে সামাল দিতে পারত। তাহলে আমাদের পুরো অর্থনীতির মধ্যে তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে যে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেল, উৎপাদনশীল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলো, সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না।


আইএমএফ কোনো দেশে প্রবেশ করা মানে সরকারকে আরও ঋণ পাওয়ার জন্য স্বীকৃতি দেওয়া। কিন্তু আইএমএফ মানে হলো সেই দেশের জনগণের জন্য নতুন বিপদ।


কারণ, আইএমএফ কখনো ভর্তুকি দেওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে দূর করার চেষ্টা করবে না, তারা এর সুবিধাভোগীদের পক্ষে থেকে এর দায় জনগণের ওপর চাপানোর ব্যবস্থা করে। তারা কখনো বলবে না তোমরা এলএনজি আমদানি বন্ধ করো, নিজ দেশের গ্যাস অনুসন্ধান করো, অর্থ পাচার বন্ধ করো, রামপাল-রূপপুর বন্ধ করো। তারা শুধু ভর্তুকি বন্ধ করার কথা বলে দাম বাড়ানোর কথা বলবে। আইএমএফের রেকর্ড হচ্ছে, মজুরি ছাড়া সবকিছুর মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে কাজ করা। সুতরাং বর্তমানে আমরা বাংলাদেশে যে অবস্থায় আছি, এই ধারা যদি চলতে থাকে সরকার গ্যাস-বিদ্যুৎ-তেল-পানির দাম ক্রমাগত বাড়াতেই থাকবে। যারা ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা এরই সুবিধাভোগী এবং আইএমএফ তাদেরই সহযোগী।

[২৫ জানুয়ারি ২০২২ দৈনিক আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত]

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *