১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বর্বরতা তো মাত্র ৪২ বছরের আগের ব্যাপার, ২৫০ বছর আগের মীরজাফর তো এখনো জীবন্ত। মীরজাফরের বিচার হয়নি, হয়তো সে জন্যই তার প্রতি ঘৃণা প্রতিমুহূর্তে পুনরুৎপাদিত হচ্ছে, কেউ জাতীয় স্বার্থবিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে মানুষ খুব সহজেই তাকে বুঝছে মীরজাফর হিসেবে। এখন রাজাকার শব্দটিও তেমন। যারাই দেশ ও দেশের মানুষের বিপক্ষে দাঁড়াবে, তার নামের সঙ্গেই এখন যুক্ত হবে রাজাকার, কিংবা নব্য রাজাকার। এভাবেই মানুষ তার শত্রু-মিত্র শনাক্ত করে, পরম্পরায় সামষ্টিক চেতনা প্রবাহিত হয়। হাজার বছর আগেরও অনেক বেদনা বা লড়াইয়ের স্মৃতি মিথ আকারে মানুষকে কাঁদায়, আবার প্রেরণাও জোগায়।
ইতিহাসের দায় থেকে মানুষের মুক্তি নেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী আর তার দেশি সহযোগীদের গণহত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনায় প্রায় সব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ক্ষত আছে। নীরবতা, প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতায় এগুলো ঢেকে রাখা যায় না, তা অপেক্ষা করে ঠিক মুহূর্তের। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সামষ্টিক স্মৃতি বেয়ে চলে। সময়ের ব্যর্থতায় প্রবল প্রতাপে খুনি-ধর্ষকেরা ঘুরে বেড়াতে পারে, কিন্তু তাতে ইতিহাস মুছে যায় না।
তরুণ বিদ্রোহ যে বিচার দাবিতে সারা দেশকে জাগিয়ে তুলেছে, তা ৪২ বছর পর হঠাৎ হয়নি। এরও একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আছে, আছে একদিকে জনগণের লড়াই, বিশ্বাসভঙ্গ আর হতাশার, অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্বাসঘাতকতা আর আঁতাতের ইতিহাস। কিন্তু সব সময়ই ক্ষুদ্র-বৃহৎ চেষ্টা অব্যাহত ছিল (এ বিষয়ে আমার লেখা ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার…’, প্রথম আলো, ৭ জানুয়ারি, ২০১৩)। এসব প্রচেষ্টার কারণেই পরম্পরায় তৈরি হয়েছে যোগসূত্র।
বস্তুত তরুণদের নেতৃত্বে এই গণজাগরণ সরকার, প্রধান রাজনৈতিক দল এবং তাদের ভোটের রাজনীতির প্রতি অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ। দুই আশঙ্কা মানুষের মধ্যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার অনুভূতি দিয়েছে। প্রথমত, ভোটের হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে অতীতের মতো সরকার জামায়াতের সঙ্গে আবারও যেকোনো ধরনের আপসরফায় বা আঁতাতে চলে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, যদি শুধু কারাদণ্ড হয়, তাহলে সরকার পরিবর্তনে বা কোনো চাপে এরা আবার ছাড়া পেয়ে যেতে পারে।
যুদ্ধাপরাধী হিসেবে কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড নিয়ে তাই এত প্রতিক্রিয়া। এর কিছুদিন আগে থেকেই রহস্যজনক কিছু ঘটনা ঘটছিল। পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘাত ও ফুলনিবেদন, অদ্ভুতভাবে পুলিশের মার খাওয়া, অস্ত্র ছিনতাই ইত্যাদি নিশ্চয়ই কারও কাছেই স্বাভাবিক মনে হয়নি। এর পাশাপাশি বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি হলো, কিন্তু বিচারের আগেই তার পালিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। এই সময়ই হঠাৎ পুলিশের ভূমিকা পাল্টে গেল, মিছিল-সভা-সমাবেশ বাড়তে থাকল, পরপর দুই দিনের হরতাল ডাকল জামায়াত। তাদের ভাঙচুর, বক্তৃতা ইত্যাদিতে অভূতপূর্ব ঔদ্ধত্য। ভোটের হিসাব-নিকাশে সরকার জামায়াতের সঙ্গে আবারও নতুন আঁতাতের পথে যাচ্ছে, এই সন্দেহ তখন চারদিকে। এরপরই জামায়াতের হরতালের মধ্যে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ অনেকগুলো অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো না। তখনই ঘটল বিস্ফোরণ। সমাজের ভেতরে নানা সংশয় ও প্রশ্ন নিয়ে প্রতিবাদের যাত্রা শুরু করল সজাগ তরুণেরা। তৈরি হতে থাকল নতুন ইতিহাস।
কারা নির্মাণ করল এই ইতিহাস? ফেসবুকসহ নতুন মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে তৈরি হলো বিস্ময়।
এক তরুণ সাংবাদিক বন্ধুর উদ্যোগে ফেসবুকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক প্রথম দিকেই। গত কয়েক বছরে ফেসবুকের সূত্রে বিভিন্ন জাতীয় বিষয়ে অসংখ্য তরুণের মনের ভাব জানার সুযোগ হয়েছে। তারা রাজনীতি করবে না, কারণ রাজনৈতিক দলের ওপর তাদের আস্থা নেই। কিন্তু তারা দেশের জন্য কাজ করতে চায়, জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে থাকতে চায়, দেশকে লুটেরামুক্ত করতে ভূমিকা রাখতে চায়। তারা দল করতে চায় না, কিন্তু তারা রাষ্ট্রের চেহারা বদলে দিতে চায়। তরুণদের আকাঙ্ক্ষার এই ধরন মূলধারার গণমাধ্যম থেকে বোঝা যেত না। কিন্তু তরুণদের উল্লেখযোগ্য অংশ যে এসব আগ্রাসনের মধ্যেও নিজেকে সামষ্টিক ডাকের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে সক্ষম, তা গত এক দশকেই প্রমাণিত হয়েছে বারবার, অনেক বড় আকারে এবার হলো শাহবাগে।
ফেসবুকের মধ্য দিয়ে গত কয়েক বছরে অনেক প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে, অনেক মতও তৈরি হয়েছে, অনেক বিতর্ক পরিণত আকার নিয়েছে। এই খোলা মাধ্যম অনেকভাবে অপব্যবহার হচ্ছে ঠিক, কিন্তু এই মাধ্যম যে ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি পরিণত রাজনৈতিক মত গঠন, তথ্য সরবরাহ, সীমান্ত অস্বীকার করে দেশে দেশে মানুষের লড়াইকে সূত্রবদ্ধ করতে পারে, তার প্রমাণ তৈরি হয়েছে অন্য অনেক দেশের মতো এই বাংলাদেশেও।
যারা এই তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে জানে না, তাদের কাছে তাই শাহবাগ এক বিস্ময় কিংবা হঠাৎ ঘটা কোনো ঘটনা। যাদের দেখে তরুণদের সম্পর্কে তারা হতাশা ও নেতিবাচক ধারণা পোষণ করত, তারা এখনো কিন্তু সে রকমই আছে। যখন শাহবাগের তারুণ্যের নতুন ভাষা ও জননন্দিত জোয়ারে সারা দেশ নতুনভাবে আশাবাদী হয়ে উঠেছে, যখন রাষ্ট্র ও রাজনীতির নতুন বিশ্লেষণের তাগিদ অনুভব করছেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা, তখনো সরকারি ছাত্রসংগঠনের রামদা বাহিনী বা চাঁদাবাজদের তৎপরতা বন্ধ হয়নি। শাহবাগ চত্বরের উজ্জ্বল খবরের পাশাপাশি সমাজের ক্ষমতাবান, দখলদার ও সন্ত্রাসীদের ব্যবহূত এই তরুণদের অপতৎপরতার খবরও ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।
এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শাহবাগ আন্দোলনে যে তরুণেরা প্রথম থেকেই দিন-রাত লেগে থেকে একে ঐতিহাসিক গণজোয়ারে পরিণত করেছে, তাদের বড় অংশের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এটাই প্রথম নয়। কেউ কেউ নিজেদের অঙ্গীকার বোধ থেকে ব্লগকেই লড়াইয়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রথম থেকেই। কেউ যুদ্ধাপরাধীর বিচার, কেউ জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, কেউ রাজনীতি, কেউ সাহিত্য, কেউ জাতিগত নিপীড়ন, কেউ নারীর নতুন পরিচয় কিংবা সব নিয়েই লেখালেখি করত। এদের মধ্যে কারও কারও ফেসবুক ব্লগ আর মাঠের লড়াইয়ে একই সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা আছে। গত ১০ বছরে এদের অনেককেই মিছিলে দেখেছি, সরকারি বাহিনী মোকাবিলা করতে দেখেছি; গুলি, টিয়ার গ্যাস, গ্রেপ্তার-নির্যাতন পাত্তা না দিয়ে দৃঢ়তা নিয়ে জনগণের স্বার্থে কাজে লেগে থাকতে দেখেছি। বাংলাদেশ থেকে গ্যাসসম্পদ ভারতে রপ্তানির জন্য মার্কিন-ভারত-বিশ্বব্যাংক-এডিবি-ইউনোকল-কমিশনভোগীদের সব আয়োজন প্রতিহত করতে ঢাকা-বিবিয়ানা লংমার্চে অংশ নিয়েছিল যারা, যারা চট্টগ্রাম বন্দর মার্কিনিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে লংমার্চ করেছিল, যারা ফুলবাড়ী গণ-অভ্যুত্থানে গুলির মুখে দাঁড়িয়েছিল, যারা সুনেত্র, রামপাল, আড়িয়াল, রূপগঞ্জ ও রূপপুর নিয়ে নানা চক্রান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, যারা বঙ্গোপসাগরেও সম্পদ ও দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী চুক্তি মোকাবিলা করতে মাঠ নেমেছে, তাদের প্রায় সবাইকে তো দেখেছি শাহবাগে কিংবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গণজাগরণ মঞ্চে।
আজ যারা যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে টালবাহানা বুঝতে পেরে প্রতিরোধের এক ইতিহাস তৈরি করেছে, তাদের অনেককেই আমরা বিভিন্ন মাত্রায় নারী নির্যাতন, গার্মেন্টসের শ্রমিক হত্যা ও নির্যাতন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকীকরণ, ক্রসফায়ার, গুম-খুন, বিশ্বজিৎ হত্যা, সরকারি ছাত্রসংগঠনের রামদা উৎসব, সীমান্ত হত্যা, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদির বিরুদ্ধেও ব্লগে-ফেসবুকে লিখতে দেখেছি, বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে সামনের সারিতে পেয়েছি। কেউ মাঠে স্লোগানে, কেউ লেখায়, কেউ ছবি আঁকায়, কেউ গানে, কেউ নাটকের মধ্য দিয়ে গত ১০ বছরে নতুন এক শক্তির জাগরণ ঘটিয়েছে। গত কিছুদিনে কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ ও দেশের সার্বভৌমত্ব তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে, ফুলবাড়ীতে দেশের ‘জল-জমি-জনের’ সর্বনাশ করে কয়লা সম্পদ বিদেশে রপ্তানির নতুন নতুন চক্রান্ত, হামলা-মামলা, লুটেরা গোষ্ঠীর স্বার্থে আইএমএফের নির্দেশে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বাড়িয়ে জীবন-অর্থনীতি ভয়ংকর দিকে ঠেলে দেওয়ার বিরুদ্ধে সরকারি বাহিনীর গ্রেপ্তার, লাঠিপেটা, মরিচের গুঁড়া, কাঁদানে গ্যাস এবং সরকারি দলের সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করে যারা কাজ করেছে, তাদের মধ্যেও এই তরুণেরাই ছিল প্রধান। জাতীয় কমিটির আন্দোলনের প্রধান শক্তিই ছিল-আছে এই তরুণেরা। এদের মধ্যে বিভিন্ন বাম ছাত্রসংগঠনের সদস্য, বিভিন্ন পাঠচক্র, চলচ্চিত্র সংসদ, আবৃত্তি সংগঠন, পাঠাগারের সদস্য আবার একদমই ব্যক্তি-তরুণেরা, প্রধানত শিক্ষার্থী, কোনো সংগঠন করে না, কিন্তু দেশের জন্য কাজ করতে আগ্রহী এ রকম।
শাহবাগে তরুণদের নতুন জাগরণের অন্যতম কৃতিত্ব সমাজের সামনে এটা প্রতিষ্ঠা করা যে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ-ছিনতাইকারীরা তরুণদের মূলধারা নয়। তরুণদের মূলধারা এখন ৪২ বছরের দায় ও কলঙ্কমুক্ত হওয়ার জন্য সেই শহীদ তারুণ্যের পরম্পরায় যুক্ত হয়েছে, যে তরুণেরা নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ যে জীবন, তা দেশের জন্য সমর্পণ করেছিল। এই নতুন জাগরণ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিসহ যেসব দাবি উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলো বহু বছরের জমে থাকা রক্তের দায় পূরণ।
বর্তমান রাজনীতির দুষ্টচক্রে হতাশ-বীতশ্রদ্ধ-বিপর্যস্ত মানুষের সামনে এ রকম সজাগ তরুণেরাই শাহবাগের গণজাগরণের মধ্য দিয়ে একটি বড় ভরসা হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সংঘাত, বিদ্বেষ, লোভ ও দখলের জঞ্জালের মধ্যে টানা ১৭ দিন-রাত লাখ লাখ নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধের জমায়েত ঐক্য, শান্তি, আনন্দ, সৃজন, শক্তি আর উদ্দীপনার নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের সপক্ষ রাজনীতি ধর্মের বর্ম দিয়ে যতই বিভ্রান্তি বা সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা করুক, তা এই শক্তিকে পরাজিত করতে পারবে না। আর বিদ্যমান লুটেরা, দখলদার ও কমিশনভোগীদের ক্ষমতালোভী রাজনীতিও এই তরুণ শক্তিকে গিলতে পারবে না।
(ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৩ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)