যখন ‘উন্নয়ন’-এর বিলবোর্ড আর প্রচারণায় ভেসে যাচ্ছে দেশ তখন আন্তর্জাতিক জরিপ জানিয়েছে, ঢাকা মহানগরীর বায়ুদূষণ বিশ্বের দ্বিতীয় নিকৃষ্টতম। শুধু বায়ুদূষণ নয়, পানিদূষণ, দুর্ঘটনা, আশ্রয়হীন মানুষ, যানজট, নিরাপত্তাহীনতা— সব দিক থেকেই ঢাকা মহানগরী বিশ্বের নিকৃষ্ট শহরগুলোর সঙ্গে এখন পাল্লা দিচ্ছে। বোধশক্তিসম্পন্ন সবাই স্বীকার করবেন যে, ঢাকা শহর বিশ্বের অন্যতম অনিরাপদ শহর, বিশেষত নারী ও স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য শত্রুভাবাপন্ন। নগরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের ওপর, তারাই মানুষের সবচেয়ে বেশি ভয়ের কারণ।
ঢাকা শহরে অকালে মানুষ মরছে অহরহ— ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দুর্ঘটনা, ক্রসফায়ার, গুম, ডাকাতি, নির্মাণকাজ করতে গিয়ে, ম্যানহোলে পড়ে, বস্তি বা কারখানায় আগুনে। ঢাকা শহরের সর্বত্র দখলের বিষ। শহরে অনেক খেলার মাঠ ছিল, সেগুলোর প্রায় সবই বিভিন্ন সরকারের আমলে দখল করে প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হয়ে গেছে। পুরো শহরেই এখন শিশু-কিশোর-তরুণ ছেলেমেয়েদের জন্য খেলার মাঠ নেই, তাদের জন্য আছে ঘর, ছাদ আর ফুটপাত। গরিব হলে রাস্তা, রেললাইন।
বড় ঝিলও অনেকখানি দখল হয়ে গেছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে বহুতল ভবনের নিচে। বাকি অংশ আছে দখলের প্রক্রিয়ায়। পুরো শহরেই জমি দখলের সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে— দ্রুত বস্তি বানিয়ে তাতে গরিব মানুষদের বসানো। তাতে দখলও থাকে, নিয়মিত পয়সা কামাইও হয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জন্য ভাড়ায় কিংবা ভয় দেখিয়ে লোক জোগাড়ের জন্য একসঙ্গে লোক পাওয়াও সুবিধা হয়। তারপর যখন প্রয়োজন হয়, যখন কাগজপত্র তৈরি হয়ে যায়, তখন বস্তি ভেঙে ফেলার আয়োজন হয়। বাধা পেলে বা ক্যাচাল হলে লাগে আগুন। তারপর সেখানে ওঠে বহুতল ভবন। বস্তিবাসী মানুষ সহায়-সম্বল হারিয়ে কিংবা পুড়ে মরে সন্তানকে হারিয়ে আবার নতুন কোনো মরণঘরে চলে যায়।
ঢাকা শহরে কেউ যদি জমি অবৈধ দখল করে তাহলে তাদের প্রতি পুলিশ বা প্রশাসনের আচরণ বন্ধুসুলভই দেখা যায়। কিন্তু যারা এখানে ভাড়া নিয়ে থাকে, তাদের জীবন অনিশ্চিত ও অতিষ্ঠ করতে তাদের কোনো কমতি থাকে না। এ মানুষদের জীবিকা কোথায়? কোনো কারখানা বা নির্মাণ শ্রমিক, গৃহশ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুরি অথবা রেললাইনের ধারে কিংবা ফুটপাতে কিছু নিয়ে বসা। এসব রাস্তা বা ফুটপাত আবার বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে, যারা ফুটপাতে বসার বিনিময়ে নিয়মিত চাঁদা আদায় করে। এই চাঁদা আদায়কারীরাই এখানকার মালিক, তাদের সঙ্গে প্রশাসন বা পুলিশের বোধগম্য কারণেই ভালো খাতির। কিন্তু বিভিন্ন কারণে মাঝে মধ্যেই এ মানুষগুলোকে উচ্ছেদ করার কর্মসূচি নেয়া হয়। তখন সব পুঁজি শুধু হারাতে হয় না, অনেক সময় ক্ষমতার খেলা বুঝতে না পারা মানুষদের হাজতবাসও ঘটে। ছাড়াতে গিয়ে ঋণ করতে হয় স্বজনদের। যারা পারেন না, তাদের কতজন উধাও হয়ে যায় তার কোনো হিসাব নেই।
অর্থনীতির ধরনের কারণেই সারা দেশেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের আয়তন ক্রমাগত বাড়ছেই। ঢাকা তার কেন্দ্র। ঢাকার রিকশা, ছোট দোকান, হকার, নির্মাণকাজ সবগুলোই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিত্তহীন শ্রমজীবী নারীপুরুষের কাজের ক্ষেত্র। ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশের গড়হারের দ্বিগুণেরও বেশি। মোট জনসংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই বস্তিবাসী। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পর্কে শহরের বিত্তবান বা মধ্যবিত্তের খুবই অস্বস্তি। অস্বস্তি দূর করতে তাদের উচ্ছেদ অভিযান প্রায়ই চলে। কিন্তু তা স্থায়ী হয় না, কেননা এদের ছাড়া কারো চলে না, শহর অচল হয়ে যায়। কিন্তু এই সদা পরিশ্রমী মানুষদের জীবন ঘিরে থাকে অবৈধ বসতি, অবৈধ গ্যাস বিদ্যুত্, অবৈধ পানির অনিশ্চয়তা। তাদের অর্থ দিতে হয় সবটাতেই, হারও বেশি। কিন্তু তা বৈধতা পায় না এবং সে কারণে নিরাপত্তাও পায় না কখনো।
নাগরিক সুবিধা বা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক দূরে থাকলেও জমির দামের দিক দিয়ে ঢাকা মহানগরী পাল্লা দিচ্ছে লন্ডন নিউইয়র্ক টরন্টোর সঙ্গে। ঢাকার কোনো কোনো অঞ্চলের জমির দাম গত তিন দশকে বিশেষত গত এক দশকে যে হারে বেড়েছে, তা ওইসব শহরেও ঘটেনি। এর পেছনে আছে দেশে বিশেষ করে ঢাকায় চোরাই টাকার দ্রুত বৃদ্ধি ও কেন্দ্রীভবন। এছাড়া প্রবাসী আয়েরও একটি ভূমিকা আছে। জমির দামের এই বৃদ্ধি জমি দখলের উন্মাদনা বৃদ্ধি করেছে বহুগুণ। আইনকানুন প্রতিষ্ঠান সবকিছু ভেঙে পড়ে এখানে। রাজনীতিও জিম্মি হয়ে পড়ে।
ক্ষমতা যেমন কেন্দ্রীভূত, নানা প্রশাসনিক দপ্তর এবং শিক্ষা, চিকিত্সাসহ নানা প্রয়োজনীয় সার্ভিসও এ শহরেই কেন্দ্রীভূত। সেই কারণে মহানগরীর দিকে সারা দেশের মানুষের প্রবাহ অবিরাম। কিন্তু এ জনপ্রবাহের একাংশকে ধারণ করার জন্যও ঢাকা প্রস্তুত নয়। ঢাকা শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ খুবই দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু পয়োনিষ্কাশন, পানি সরবরাহ, যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গতিপূর্ণ বিকাশ নেই। শহরে সর্বজনের জায়গা ও অধিকারগুলোই বেশি আক্রান্ত বা অবহেলিত। নারীর জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আরো উপেক্ষিত। অথচ ঢাকা মহানগরীর শিক্ষা, কারখানা শ্রমিক, দিনমজুর, অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন পেশায় নারীর অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। পাবলিক টয়লেট, পাবলিক বা সর্বজন পরিবহনের সংকট তাদের প্রতিদিনের জীবন বিষময় করে, দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক-মানসিক ক্ষতির কারণ হয়।
দেশে শিক্ষা ও চিকিত্সা বাণিজ্যিকীকরণের ঢলে এবং দোকানদারী অর্থনীতির বিস্তারে ঢাকার বহিরঙ্গে জাঁকজমক অনেক বেড়েছে। গত দুই দশকে অভূতপূর্ব হারে বেড়েছে বাণিজ্যিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও শপিংমল। কিন্তু বাড়েনি সর্বজনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল। তাই শিক্ষা ও চিকিত্সার জন্য মানুষের ব্যয় বেড়েছে অভূতপূর্ব হারে।
ঢাকার মানুষের স্বার্থ বিবেচনা করলে এত শপিংমল তার দরকার নেই, তার দরকার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো বৃহত্ অন্তত ১০টি সর্বজনের হাসপাতাল, হয়নি। ঢাকা ভরে গেছে, রাস্তা অচল হয়ে আছে প্রাইভেট কারে, দরকার সর্বজনের পরিবহন ব্যবস্থার বিকাশ, হয়নি। দরকার সর্বজনের উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ। নেই। ঢাকায় নির্বোধ পরিকল্পনায় আর অর্থ আত্মসাতের নানা প্রকল্পে সৌন্দর্যবৃদ্ধির কর্মসূচিতে লাগানো হয় প্লাস্টিক গাছ। দরকার সর্বত্র অসংখ্য ফলের গাছ, বটগাছসহ বৃহত্ গাছ। দরকার শিশুদের আনন্দ ও নিরাপত্তা। নেই।
বুড়িগঙ্গায় যদি নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহিত হতে পারে, যদি এ শহরে পানের জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত হয় (বোতলের পানি নয়), তাহলে ঢাকা শহরের মানুষের অসুখ-বিসুখ বিনা খরচেই অর্ধেক কমে যাবে। বুড়িগঙ্গায় এ-যাবত্ ‘বহুপ্রকল্প’ বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু নদী দখল ও বর্জ্যমুক্ত হয়নি। হিসাবে দেখা যায়, এসব প্রকল্পে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। টাকা পানিতে পড়েনি, কিছু লোকের পকেটে গেছে।
ঢাকাকে মানুষের নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তাই আশু করণীয় হচ্ছে—
প্রথমত. ঢাকা মহানগরীর ভূমি সংস্কার। ঢাকায় বসবাসের জন্য কারো একাধিক জমি বা ফ্ল্যাট থাকার দরকার নেই। কম জমি বেশি মানুষের এ শহর আরো দাবি করে পরিবার প্রতি বসবাসের জমি বা ফ্ল্যাটের আয়তনের সিলিং বা ঊর্ধ্বসীমা। মাথাপিছু ৫০০ বর্গফুট এবং পরিবারপ্রতি সর্বোচ্চ তিন হাজার বর্গফুট প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। যদি এটাকে সিলিং ধরা যায় তাহলে অনেক বাড়তি জমি ও ফ্ল্যাট পাওয়া যাবে প্রয়োজনীয় আবাসন পরিকল্পনার জন্য।
দ্বিতীয়ত. বিজিএমইএ ভবনসহ অবৈধভাবে নির্মিত সব স্থাপনা সরিয়ে জমি জলাশয় খাল দখলমুক্ত ও পুনরুদ্ধার করে তাতে সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করা আবশ্যক। যেকোনো জমি ব্যবহারে সর্বজনের হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তৃতীয়ত. বাঁচতে হলে বুড়িগঙ্গাসহ সব নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। ফল ও ঔষধি গাছে ঢাকা ভরে দিতে হবে।
চতুর্থত. এ শহরে যানজট দূর করার সবচেয়ে যৌক্তিক ও কার্যকর পথ হচ্ছে প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বজন বা পাবলিক পরিবহন সম্প্রসারণ। সপ্তাহে একদিন গাড়ি চলাচল পুরোপুরি বন্ধ রাখা দরকার। কোনো পরিবারে একটির বেশি গাড়ি থাকা চলবে না। বাণিজ্যিক এলাকাসহ বেশকিছু জায়গায় প্রাইভেট গাড়ি চলাচল সবসময়ই নিয়ন্ত্রিত থাকতে হবে।
পঞ্চমত. কর্মজীবী ও শিক্ষার্থী নারীর চলাচল ও বাসস্থান ব্যবস্থা সম্প্রসারণে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারীর একা পথ চলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে হবে, সংবেদনশীল নারী পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সাইকেল চালানো উত্সাহিত ও নিরাপদ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
যারা বর্তমান অমানবিক ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তারা এসব করণীয় কাজে কখনই অগ্রসর হবে না। কিন্তু যাদের স্বার্থে এই ঢাকার পরিবর্তন দরকার, সেই নাগরিকদের এসব আওয়াজ তুলতে হবে। সংবাদ মাধ্যমে, গবেষণায় বিষয়গুলো গুরুত্ব দিতে হবে। যারা জনপন্থী রাজনীতি করেন, তাদের এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এসব দাবি।
[১৫ মার্চ ২০১৭ বণিকবার্তায় প্রকাশিত]