ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘বন্ধুত্বের বার্তা’ নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসছেন। কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে বসবাস করলে খাঁচায় বসবাসের অনুভূতি হয়, আমাদেরও তা-ই হওয়ার কথা। প্রধানমন্ত্রী মোদির রাজনীতি, দর্শন, তার গুজরাট রেকর্ড নিয়ে আপাতত প্রশ্ন না তুললেও এ প্রশ্ন থাকেই যে, খাঁচায় থেকে কী করে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো সম্ভব?
কয়েক হাজার একর জমি নিয়ে বিরোধ জিইয়ে ছিল ৬৮ বছর। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ব্যবস্থা নিলেও ভারত এতদিন এটা আটকে রেখেছিল। এর জন্য ছিটমহলে আটকে থাকা দু’দেশের মানুষদের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে যেতে হয়েছে এত বছর। ভারতের লোকসভা ও রাজ্যসভায় প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সংক্রান্ত বিল পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে এটা পরিষ্কার হল যে, ইচ্ছা করলে সহজ কাজ কত সহজে করা যায়! এত বছর পর হলেও অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে সেজন্য আমরা খুশি। আমরা চাই এখন সীমান্ত হত্যা বন্ধ হবে, কাঁটাতারের বেড়া থেকেও বাংলাদেশ মুক্ত হবে। আমরা চাই অভিন্ন নদী নিয়ে আমাদের বিপর্যয়ের অবসান হবে। আমরা চাই ট্রানজিট নিয়ে লুকোচুরি অস্বচ্ছতা বন্ধ হবে। আমরা চাই, সুন্দরবনধ্বংসী সব প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ ঘোষণা দিয়ে সরে যাবে এবং সুন্দরবন বিকাশে মন দেবে। দু’দেশের মধ্যে সম্মানজনক বন্ধুত্বের পথ তৈরি হবে।
কাঁটাতার দেয়া সীমান্তে হত্যাকাণ্ড এখনও বন্ধ হয়নি। এখন আগ্নেয়াস্ত্রের বদলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে বেয়নেট ও লাঠি। নিহত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভারত রাষ্ট্রের অভিযোগ, তারা সন্ত্রাসী কিংবা চোরাচালানি। দেশের মধ্যে র্যাবের হাতে যারাই খুন হয় তারা যেমন সন্ত্রাসী হয়ে যায়, সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতেও তেমনি। ১২ বছরের বালিকারও নিষ্কৃতি নেই এ অপবাদ থেকে। আর চোরাচালান কি এ গরিব মানুষেরাই করে? তাতে শুধু কি বাংলাদেশের লোকজনই জড়িত থাকে? সীমান্তে কখনও ভারতীয় নিহত হয় না; কিন্তু নিয়মিতভাবে নিহত ও জখম হয় বাংলাদেশের কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সের গরিব মানুষ।
সর্বশেষ হিসাবে বর্তমানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈধ বাণিজ্য ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। এর শতকরা মাত্র ৮ ভাগ বাংলাদেশ রফতানি করতে পারে, বাকিটা আমদানি। অশুল্ক বাধাই বাংলাদেশের পণ্য আটকে দেয়। ধারণা করা হয়, অবৈধ বাণিজ্য প্রায় এর সমপরিমাণ কিংবা আরও বেশি। এ বাণিজ্য ভারতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করছে, বাংলাদেশে তৈরি করছে তাদেরই বাজার। প্রাথমিকভাবে লাভ ভারতীয় ব্যবসায়ীদেরই।
ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশ অনেক উন্মুক্ত, অনেক উদার। বাংলাদেশে ভারতের পণ্য, বিনিয়োগ, শ্রম, পরিষেবা, প্রতিষ্ঠান আসায় কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশে ভারতের বহুসংখ্যক টিভি চ্যানেল দেখতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ভারতে বাংলাদেশের পণ্য থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেল পর্যন্ত সবকিছুতেই নানাবিধ বাধা আছে। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা অবিরাম ভারতে উৎপাদিত পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের বাজার সম্প্রসারিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের চ্যানেল ভারতে কার্যত নিষিদ্ধ থাকায় এখানকার পণ্যের খবর ভারতে যায় না। নৌপথে ভারত ট্রানজিট সুবিধা অনেক আগে থেকেই পাচ্ছে, এখন পেতে যাচ্ছে সড়ক ও রেলপথে; কিন্তু এখন পর্যন্ত নেপাল বা ভুটানে যাওয়ার জন্য ভারতের ৩০-৪০ কিমি. ব্যবহার শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশ। বহু আগে সম্মতিপত্র দিলেও ভারতের কারণেই কাজের সূচনা হতে পারেনি।
ভারতের জন্য বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যে ধরনের ‘ট্রানজিট’ প্রস্তুতি চলছে, তার কোনো তুল্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই। একমাত্র কাছাকাছি হল দক্ষিণ আফ্রিকা দিয়ে চারদিকে ঘেরাও হয়ে থাকা লেসোথো। কিন্তু এটিও তুলনীয় নয়; কারণ, সোনার খনি নিয়েও লেসোথো রাষ্ট্র হিসেবে প্রায় ভেঙে পড়েছে, আয়ুসীমা ৩৪ বছর, মারিজুয়ানা চাষের ওপর নির্ভর অনেক কর্মসংস্থান, আর লেসোথোর মানুষ নিজেরাই দক্ষিণ আফ্রিকার দশম প্রদেশ হওয়ার আবেদন করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও এর সঙ্গে তুলনা করা যাবে না দুটি কারণে। প্রথমত, দেশগুলোর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে এতটা অসমতা নেই, যেটি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আছে। দ্বিতীয়ত, সেখানে কোনো দেশই অন্য দেশের ভূমি বা নৌপথ ব্যবহার করে নিজ দেশেরই অন্য প্রান্তে যায় না, যায় তৃতীয় কোনো দেশে।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে অবাধ যোগাযোগ ভারতের জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সবদিক থেকেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ যদি ভারতকে এ সুবিধা দেয় তাহলে ভারতের পরিবহন ব্যয় কমে যাবে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি, অর্থাৎ আগে যে পণ্য পরিবহনে খরচ হতো ১০০ টাকা তার খরচ দাঁড়াবে ৩০ টাকারও কম। এছাড়া সময় লাগবে আগের তুলনায় ২৫ শতাংশ, বা চার ভাগের এক ভাগ। এ সময় ও অর্থ সাশ্রয় বহুগুণে তাদের অর্থনেতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা বৃদ্ধিতে কাজে লাগবে। ভারতের এত লাভ যেখানে, বাংলাদেশের সেখানে প্রাপ্তি কী? আমাদের সার্ভিস ও অবকাঠামোর সুযোগ ব্যয় কত? কী কী লাভ, আর কী কী ক্ষতি বা সমস্যা? কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি?
‘ট্রানজিটের’ লাভক্ষতি নিয়ে সরকার থেকে কোনো হিসাব-নিকাশ আমাদের জানানো হয়নি। অথচ মন্ত্রী কিংবা বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে বহুবার বলা হয়েছে ট্রানজিট বাংলাদেশের জন্য খুব লাভজনক, দেয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার লাভের অংক। কীভাবে ট্রানজিট বিষয়ে দুই দেশের সরকারের বিস্তারিত সিদ্ধান্তের আগে এ বিষয়ে অংক দেয়া যায়, তা আমার বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে ভারতের সঙ্গে সব চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। তারা এরই মধ্যে অনেক কথা বলেছেন, তা থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, যে কাজে তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ তাদের কাছে কোনো বিষয় নয়। আরও পরিষ্কার হয়েছে, তারা যে কোনো মূল্যে চুক্তি করতে অতি আগ্রহী এবং নিশ্চিত যে, ভারতই বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। উপদেষ্টা মসিউর রহমান এও বলেছিলেন, সভ্যদেশ হিসেবে বাংলাদেশ ট্রানজিট ফি চাইতেই পারে না। অবশ্য পরে ফি নির্ধারণের জন্য কমিটি করা হয়েছে। কিন্তু তারও সুপারিশ অকার্যকর রেখে ‘মানবিক কারণে’ ভারতের চাল যেতে দেয়া হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, ট্রানজিট নিয়ে নতুন কোনো চুক্তিরই দরকার নেই, ১৯৭২ সালেই সব চুক্তি করা আছে! যাদের দরকষাকষি করার কথা, তারাই যদি আগে থেকে বলতে থাকেন, এতে বাংলাদেশেরই লাভ হবে, তাহলে দরকষাকষির আর কী সুযোগ থাকে?
শুধু গাড়িভাড়া, বন্দরভাড়া হিসাব করলেই তো হবে না। আগপাছ বিচার না করে শুধু টাকার জন্য নিজের যে কোনো কিছু ভাড়া দেয়া একজন আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য তো তা আরও অচিন্তনীয়। তাই শুধু টাকার প্রশ্ন নয়, বাংলাদেশের জন্য আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন আছে। প্রথমত, বাংলাদেশের জমি সীমিত, আবাদি জমি নষ্ট করা তাই খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতের ক্রমবর্ধমান পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে যে সড়ক সম্প্রসারণ ও সংযোজন করতে হবে, তা কত কৃষিজমি-জলাভূমি বিনাশ করবে? এর ফলে খাদ্যসহ অন্যান্য কৃষি উৎপাদন, জীববৈচিত্র্য কত বিনষ্ট হবে? কত পরিবেশ দূষণ হবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নিজের পণ্য পরিবহন ভবিষ্যতে অনেক বাড়বে। এখনই বিভিন্ন রাস্তায় জটের কারণে পণ্য পরিবহন বাধাগ্রস্ত হয়, পচনশীল দ্রব্য বিনষ্ট হয়, দ্রব্যমূল্য বাড়ে। ভারতকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আমাদের পণ্যপ্রবাহে কী রকম সমস্যা তৈরি হতে পারে? তৃতীয়ত, যে রাজ্যগুলোয় ভারত পণ্য নিয়ে যাবে, সেসব রাজ্য এতদিন ছিল বাংলাদেশের বহু শিল্পপণ্যের বাজার। সেই বাজার সংকুচিত হয়ে যাবে, সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। তার ক্ষতি কত? চতুর্থত, যেখানে ভারত বাংলাদেশকে ‘সন্ত্রাসী’ বিবেচনা করে তিনদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরাও করে রাখে, সেখানে বাংলাদেশ ভেদ করে তার পণ্য পরিবহনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কে করবে? কী পণ্য ভারত নিয়ে যাচ্ছে তার তদারকির ব্যবস্থা কী থাকবে? পঞ্চমত, নদী, সমুদ্র, কাঁটাতার, অসম প্রবেশাধিকার, সীমান্ত হত্যা নিয়ে আগে সমাধান কেন নয়? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই ভারতের কাছ থেকে কঠোর শর্তযুক্ত ঋণ নেয়ার চুক্তি হয়েছে তাদেরই কাক্সিক্ষত পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা দাঁড় করার জন্য। এ রকম শর্তযুক্ত ঋণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের কমই আছে, যেখানে সবকিছু ভারত থেকে কিনতে হবে, সব সিদ্ধান্ত তাদের। বাংলাদেশের দায়িত্ব শুধু তাদের নির্দেশমতো কাজ করা এবং সময়মতো সুদসমেত ঋণের টাকা ফেরত দেয়া। এ ঋণকেই বিশাল অর্জন বলেন অর্থমন্ত্রী।
ট্রানজিট নিয়ে লাভের নানা কাল্পনিক হিসাব দিতে ব্যস্ত না থেকে নীতিনির্ধারকরা নানা সমাধান খুঁজতে পারতেন। ভারতের প্রয়োজন এবং বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় না পড়ার মতো একটা সমাধান হতে পারত- সীমান্তজুড়ে বাংলাদেশের প্রান্তে বিশাল শিল্প বেল্ট তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ। কাঁচামাল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এবং বাজারে বাংলাদেশের প্রবেশাধিকারে ভারত যদি অনুকূল অবস্থান নেয়, তাহলে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি কিংবা যৌথ উদ্যোগে এ রাজ্যগুলোর চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের বিস্তার খুবই সম্ভব। বর্তমানে এসব রাজ্যে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য সরবরাহ সাফল্যে এ সক্ষমতার ইঙ্গিত আছে। ভারতকে তাহলে এতদূর পণ্য টেনে আনার কষ্ট করতে হতো না, বাংলাদেশের শিল্পভিত্তি শক্তিশালী হতো, আবার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর অর্থনীতিও চাঙ্গা হতো। কিন্তু ভারতের আগ্রহ নেই বলে এ রকম কোনো কিছুই আলোচনার টেবিলে নেই।
শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, আমরা উন্মুক্ত বিশ্বের পক্ষে। কিন্তু উন্মুক্ত হওয়া আর আত্মসমর্পণ কিংবা অধীনস্থ হওয়া এক কথা নয়। আমরা চাই, সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত থাকুক, সারা বিশ্বও বাংলাদেশের কাছে উন্মুক্ত হোক। আমরা ভারত, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের শক্তিশালী ও ক্ষমতাবানদের জন্য দরজা-জানালা খুলে দিলাম, আর এসব দেশে বাংলাদেশের পণ্য ও মানুষের প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিতই থাকল- এটা উন্মুক্ত হওয়া নয়। আর চুক্তি বলি, সমঝোতা বলি তা ঠিক করছে কে, কার স্বার্থে হচ্ছে এগুলো? এগুলোতে জনগণের সম্মতি আছে কিনা, জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কিনা সেগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু ভারত রাষ্ট্র আর তাদের কর্পোরেট প্রভুরা যা চায়, তাতেই যদি কৃতার্থ হয়ে থাকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকর, তাহলে দরকষাকষি কীভাবে হবে, কীভাবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে?
(০৬ জুন ২০১৫ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত)