বাজেটের কাঠামো নির্ধারিত। নির্ধারিত এই কাঠামো হচ্ছে কর আরোপের মাধ্যমে আয় ও সেই আয় প্রশাসনিক কাজে ব্যয়। সেই কাঠামো অনুযায়ী যুক্তিসংগত কারণে বাজেটের আকার বেড়েছে। রাজস্ব আয়, ব্যয় ও উন্নয়ন কর্মসূচি বেড়েছে। এই বৃদ্ধির হার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কিন্তু বৃদ্ধিটাই যুক্তিসংগত। দেশে কর্মশক্তি বাড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে, কাজেই রাজস্ব বাড়ছে। আমরা বর্ধিত বাজেট পাচ্ছি। কিন্তু আমরা যদি আগের বছরের সংশোধিত বাজেট মূল্যায়ন করি, তাহলে কোনো আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারব না। গত বছরের সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব আয় কমেছে, উন্নয়ন কর্মসূচি কমেছে, পাশাপাশি ঘাটতি বেড়েছে। এই বৃদ্ধির খাত ও হ্রাসপ্রাপ্তির খাত পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, আগের বছরের বাজেট বাস্তবসম্মত ছিল না। কিন্তু সে বিষয়ে কোনো পর্যালোচনা ছাড়াই আগের বছরের তুলনায় এ বছর লক্ষ্যমাত্রা বেশি।
রাজস্ব ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সহজ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে দক্ষতা বছরের পর বছর আমরা দেখতে পাচ্ছি। সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ এ বছরও নেই। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির সমস্যা কয়েকটি। প্রথমত, প্রকল্প বাছাই; দ্বিতীয়ত, প্রকল্প বাস্তবায়নপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি; তৃতীয়ত, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বছরের শেষ দিকে এসে সৃষ্ট তাড়াহুড়ায় অপচয়। এ বছরও দেখেছি এপ্রিল মাস পর্যন্ত অর্ধেক কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে। এর অর্থ হলো, বাকি দুই মাসে বাকি অর্ধেক কাজ বাস্তবায়িত হবে। এ ধরনের বিন্যাস থেকে অপচয়, দুর্নীতি ও অব্যবস্থা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। এখান থেকেই তৈরি হয় স্ববিরোধিতা। এক দিকে আমরা দেখি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজে টাকার অভাব- যেমন, স্কুলঘর নির্মাণ, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, কম দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নবায়ন, জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের উদ্যোগ ইত্যাদি। অন্যদিকে দেখা যায় শেষের দুই মাসে বিপুল অঙ্কের টাকা তাড়াহুড়া করে খরচ করা হয়।
এবারে বর্ধিত বাজেটের ব্যয় সামলাতে গিয়ে বিভিন্নভাবে কর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় উৎসকে করের আওতায় আনার ব্যাপারে সরকারের উৎসাহ দেখা যায়নি। এটি হচ্ছে চোরাই অর্থনীতি। করের বিন্যাস ও প্রকল্প বাস্তবায়নপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে চোরাই অর্থনীতির আকার সামনের বছর আরো বাড়বে। করবিন্যাস যেভাবে করা হয়েছে, কার্যত দেখা যাচ্ছে, যাদের আয় কম- যেমন গরিব ও মধ্যবিত্ত, তারা আনুপাতিক হারে বেশি কর দেবে। আর বেশি আয়ের জনগোষ্ঠী- যেমন চোরাই টাকার মালিক, তাঁরা কম কর দেবেন। যাঁরা বৈধ পথে আয় করেন তাঁরা বেশি কর দেবেন। যাঁরা অবৈধ পথে আয় করেন তাঁরা কম কর দেবেন।
এবারের বাজেটে অর্থমন্ত্রী বেশ উৎসাহের সঙ্গে মেগা প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সরকারে অগ্রাধিকারভুক্ত কয়েকটি প্রকল্পের কথা উল্লেখ করেছেন। কয়েক বছর ধরেই বৃহৎ ও ব্যয়বহুল প্রকল্পে সরকারের উৎসাহ বেশি। কম ব্যয়ের প্রয়োজনীয় প্রকল্পে টাকা পাওয়া না গেলেও বৃহৎ প্রকল্পে টাকার জোগাড় হচ্ছে প্রধানত ঋণ ও কর বৃদ্ধির মাধ্যমে। বৃহৎ প্রকল্পের বৃহৎ ব্যয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও সামগ্রিক বাজেটের আকার বড় করে দেখায়। কিন্তু এই বৃহৎ ব্যয়বহুল প্রকল্প মানেই কাঙ্ক্ষিত প্রকল্প নাও হতে পারে। সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পগুলোর কিছু অভিন্ন সমস্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রথমত, এই প্রকল্পগুলোর ব্যয় স্বচ্ছতা কিংবা প্রয়োজনীয় কারণ দর্শানো ছাড়াই দ্রুত ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, এই প্রকল্পগুলোকে টেকসই প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করার জন্য যে ধরনের Cost Benefit Analysis বা ‘ব্যয়-লাভ বিশ্লেষণ’ করা দরকার ছিল, যেভাবে সামাজিক ও পরিবেশগত অভিঘাত সমীক্ষা করার দরকার ছিল, সেগুলো উপেক্ষা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, এসব প্রকল্প এলাকায়ই জনগণের সম্মতি নেওয়ার পরিবর্তে নিপীড়নমূলক আবহাওয়া তৈরি করা হয়েছে। অর্থনীতি, জননিরাপত্তা ও পরিবেশ হুমকির মধ্যে ফেলে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশি-বিদেশি কতিপয় গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে; কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এটা টেকসই উন্নয়নের কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি ও সমৃদ্ধি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার পেছনে তিনটি জনগোষ্ঠীর ভূমিকা প্রধান। প্রথমত, কৃষক, যারা বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় ভূমিকা রেখেছে; কিন্তু সরকারের ভুল নীতির কারণে ফসলের দাম না পেয়ে তারা বিপন্ন, অসহায়। দ্বিতীয়ত, গার্মেন্ট শ্রমিক, যারা এখনো মজুরি ও নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তৃতীয়ত, প্রবাসী শ্রমিক- দেশে ও বিদেশে যাদের নিরাপত্তা ভয়ংকর প্রশ্নের সম্মুখীন। বর্তমান বাজেটে এই তিন জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো সুখবর নেই।
(০৬ জুন ২০১৫ তারিখে দৈনিক কালের কন্ঠে প্রকাশিত)