টিকফা চুক্তি: বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী বিপদ ও শৃঙ্খল

জনগণের সম্মতি না নিয়ে, নির্বাচিত সংস্থায় কোন আলোচনা না করে, উত্থাপিত কোন প্রশ্নের মীমাংসা না করে, নির্বাচনকালীন সরকারের স্বঘোষিত কর্তব্যপরিধি লংঘন করে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করলো। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে গিয়ে সরকার বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদী বিপদ ও শৃঙ্খলে ঠেলে দিলো। কেন সে বিষয়টিই এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করছি।

টিকফা বা ‘ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট’ নামের চুক্তি এতোদিন টিফা বা ‘ট্রেড এন্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ নামে পরিচিত ছিলো। বাংলাদেশেও টিফা নামে ২০০২ সালে কথাবার্তা শুরু হয়ে টিকফা নামে তা চূড়ান্ত হয়েছে। তবে বিষয়বস্তু অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ, চাপ ও খসড়া দিয়েই চুক্তিটি হচ্ছে। বাংলাদেশ ও মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন যে, এতে বাংলাদেশের লাভ হবে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্প্রসারিত হবে। বলা হচ্ছে এই চুক্তি স্বাক্ষর করলে বিশেষ সুবিধা পেতে বাংলাদেশ অনুরোধ করতে পারবে। কিন্তু এগুলোর জন্য এই চুক্তিই কেন সই করতে হবে তা বাণিজ্যমন্ত্রী বা কারও কথায় পরিষ্কার হয়নি।

বিষয়টি বস্তুনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনার জন্য আমাদের তাই চারটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। এগুলো হল, (১) যুক্তরাষ্ট্র কেনো এই চুক্তি স্বাক্ষরে এতো আগ্রহী? (২) যে দেশ গুলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্যে প্রথম সারিতে তারা কি টিফা বা টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে? এবং (৩) আর যারা এই চুক্তি করেছে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কী? (৪) বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোন কোন বিষয় ফয়সালা করা দরকার?

বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিয়ে যেখানে বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ (ডব্লিউটিও) আছে সেটাকে পাশ কাটিয়ে, এই বিশ্ব ব্যবস্থারই কেন্দ্র্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, আলাদা করে বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে বরাবরই আগ্রহী। কারণ দুর্বল দেশের বিশেষত যেসব দেশের শাসকেরা গলা বাড়িয়ে ফাঁস পড়তে উন্মুখ তাদের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি হলে আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের বাইরে নিজেদের বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা তাদের জন্য সহজ হয়। শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক সামরিক আধিপত্যেও এটা খুব কার্যকর। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ বহুদেশ এর দৃষ্টান্ত। এই দুই অঞ্চলেই টিফা চুক্তিতে আবদ্ধ দেশের সংখ্যা বেশি।

যে দশটি দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বেশি বাণিজ্য সেগুলো হল যথাক্রমে কানাডা, চীন, মেক্সিকো, জাপান, জার্মানী, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, সৌদী আরব ও ফ্রান্স। তালিকায় ভারত ত্রয়োদশ। এরপরই ভেনেজুয়েলা, ইটালী। এই সবগুলো দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের টিফা চুক্তি আছে শুধু সৌদী আরবের সাথে। দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। এটা নিয়ে কয়েকবছর দেন-দরবার হবার পর চূড়ান্ত স্বাক্ষরের সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন, ‘এতে মার্কিন ব্যবসার উল্লেখযোগ্য লাভ হবে। সেসব বাণিজ্য চুক্তিই আমি স্বাক্ষর করতে সম্মত যেগুলো আমেরিকান স্বার্থ নিশ্চিত করে।’ (http://www.ustr.gov/uskoreaFTA)

টিকফা ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরে, বোধগম্য কারণেই, যুক্তরাষ্ট্র সবচাইতে বেশি সংখ্যক দেশ পেয়েছে তার অনুগত অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায়। আফ্রিকায় টিফা চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর অগ্রগণ্য নাইজেরিয়া। ২০০০ সালে তারা টিফা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া আছে ঘানা, এঙ্গোলা, রুয়ান্ডা। এইদেশগুলোর অনুন্নয়ন চক্র আর রাজনৈতিক সংঘাতের খবর আমরা জানি। মধ্যপ্রাচ্যে চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আছে বাহরাইন, মিশর, কুয়েত, ওমান, সৌদী আরব। এর বাইরে দক্ষিণ এশিয়ায় চুক্তি আছে আফগানিস্তান, নেপাল, পাকিস্তান, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচাইতে বেশি বাণিজ্য ভারতের সাথে, তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোন টিফা বা টিকফা চুক্তি নেই। পাকিস্তানের সাথে টিফা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে ২০০৩ সালে। সেখানকার উন্নয়ন ও রাজনীতির জাল আমাদের জানা আছে। এখন সেখানে নিয়মিত মার্কিন ড্রোন বোমা পড়ছে। এশিয়ায় সবচাইতে বেশি বাণিজ্য চীন ও জাপানের সাথে, তাদের সাথে এই ধরনের চুক্তি নেই। তাহলে বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য এই চুক্তি কীভাবে জরুরী?

আর যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বেশি ও তার সাথে বাণিজ্য বেশি থাকা মানেই কি তা জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করে? কোনো বিদেশি বিনিয়োগ জাতীয় স্বার্থ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করবে কিনা তা নির্ভর করে কী শর্তে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ হচ্ছে তার ওপর। টিফা চুক্তি আছে এরকম দুটো দেশ নাইজেরিয়া ও সৌদী আরব, এই দুই দেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি। এই দুটো দেশ থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সবচাইতে বেশি তেল আমদানি করে। আমরা এও জানি মধ্যপ্রাচ্যে সব অশান্তি সৃষ্টিতে ইসরাইলের পাশাপাশি সৌদী আরব যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাত হিসেবে কাজ করে। সম্প্রতি সৌদী আরব বৃহত্তম অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। যুক্তরাষ্ট্র তার অনুগত অঞ্চলে অস্ত্র বিক্রয় করবার ক্ষেত্র তৈরিতে সবসময়ই সক্রিয় থাকে। অন্যদিকে নাইজেরিয়া তেল ও গ্যাস সম্পদে আফ্রিকার অন্যতম শীর্ষস্থানীয়। সেখানে মার্কিন বিনিয়োগ এখন প্রায় ৫০০ কোটি ডলার, পুরোটাই খনিজ সম্পদে। আবার এই মার্কিন কোম্পানিগুলোর মাধ্যমেই যুক্তরাষ্ট্রে নাইজেরিয়ার তেল রফতানি হয়, যার পরিমাণ বার্ষিক ৩৫০০ কোটি ডলার। এদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ও তার মধ্য থেকে এদেশ থেকে তেল রফতানি চলছে বহুবছর ধরে। অথচ নাইজেরিয়ার পরিণতি হল, সেখানে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে ব্যয়ের জন্য রাষ্ট্রের অর্থ নেই, লোডশেডিং এখনও বড় সমস্যা, শিল্পায়নে পশ্চাদপদ। নাইজেরিয়ার সম্পদ ও সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশের চাইতে বহুগুণ বেশি কিন্তু উন্নয়ন ধরন এমন চক্রে পড়েছে যে সেখানে দারিদ্রের হার এখনও বাংলাদেশের দ্বিগুণ।

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে হলে তার জন্য করণীয় আসলে কী? যুুক্তরাষ্ট্রের সাথে মোট বাণিজ্যের পরিমাণ বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৫৯তম। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ রফতানির তুলনায় প্রায় ১০ ভাগের ১ ভাগ, মাত্র ৫০ কোটি ডলার। রফতানি প্রায় ৫০০ কোটি ডলার। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয় সুতা, কাপড়, যন্ত্রপাতি, স্টীল, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, এবং কিছু গমসহ খাদ্যশস্য। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যায় প্রধানত তৈরি পোশাক। এর বাইরে সিরামিকসহ কিছু সামগ্রী। আমদানি পণ্যগুলোর বেশিরভাগ আসলে গার্মেন্টস রফতানির সাথে সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের অস্ত্র ছাড়া আমদানি বাড়ানোর সুযোগ খুবই কম। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি বাড়ানোর সুযোগ অনেক। তৈরি পোশাক রফতানিই আরও অনেক বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া খাদ্যশস্য সহ আরও অনেক পণ্য রফতানি সম্ভব। কিন্তু তার পথে বাধা কী? বাধা যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বৈষম্যমূলক সংরক্ষণশীল শুল্ক কাঠামো।

আইএমএফ এর হিসাবে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত একবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রফতানির শতকরা প্রায় ২৩ ভাগ গেছে, সেই হিসেবে গতবছরও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পণ্যের উপর আরোপিত আমদানি শুল্কবাবদই আয় করেছে কমপক্ষে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের জন্য জিএসপি বা শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিয়ে একটা কৃত্রিম হাহাকার ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য গার্মেন্টস কোনো জিএসপি সুবিধা কখনোই পায়নি। বরং বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বহুরকম বৈষম্যের শিকার, সেদেশই ‘মুক্তবাজার নীতিমালা’ ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস এর ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে!! সেজন্য বিশেষ কোন সুবিধা বা অনুগ্রহের দরকার নেই, যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের পণ্যের ওপর তাদের গড় শুল্কহার আরোপ করে, অর্থাৎ অন্যান্য দেশের পণ্য যে শুল্ক হার দিয়ে প্রবেশ করে সেই শুল্কই দেয়, তাহলেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের রফতানি আরও অনেক বাড়ানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের দাম তাহলে অনেক কমে আসবে। বাণিজ্য সম্প্রসারণই যদি লক্ষ্য হয় তাহলে এটাই যুক্তিযুক্ত পথ। এই শুল্কহার বিষয়টি টিকফা চুক্তির মধ্যে নেই, সেখানে বলা আছে অশুল্ক বাধার কথা।

টিকফা চুক্তি অনুযায়ী আরেকটি আক্রমণ আসবে মেধাসত্ত্ব দিয়ে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী, বাংলাদেশে মেধা স্বত্বাধিকার প্রয়োগের চাপ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছাড় পেয়েছে। ঔষধ শিল্প তারই সুবিধাভোগী, কম্পিউটর ও আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক এই যৌক্তিক বিধিমালার কারণেই ঘটতে পেরেছে। এখন টিকফা স্বাক্ষর হলে আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত ছাড় গুড়িয়ে দিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসতে পারবে। এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওষুধ শিল্প এবং আইটি বা তথ্য প্রযুক্তি শিল্প। জনগণের জন্য ফলাফল: এইসব ক্ষেত্রের সবকিছুর দাম অনেক বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও বহুবিধ বিপদের আশংকা। বাংলাদেশ জানেনা কত কত বীজ ফসল গাছ ফল ফুল মেধাস্বত্ব জালে কোন কোন কোম্পানির মালিকানায় চলে গেছে। সেই জাল টানতেই টিকফা চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানির ব্যবসার জন্য জরুরি।

মার্কিন বিনিয়োগ বাড়লেই কি তা বাংলাদেশের স্বার্থ নিশ্চিত করবে? বাংলাদেশে গ্যাসখাতে মার্কিন কোম্পানির বিনিয়োগ আছে। শেভ্রনের কাছ থেকে কয়েকবছরে যে পরিমাণ গ্যাস ১৬ হাজার কোটি টাকায় কিনতে হয়েছে তা দেশিয় সংস্থার মাধ্যমে করালে ২০০০ কোটি টাকায় পাওয়া সম্ভব ছিলো। সমুদ্রে ১ হাজার কোটি টাকা ৫ বছরে বিনিয়োগ করছে আরেক মার্কিন কোম্পানি কনকো ফিলিপস, এর বদলে দুই ব্লকের গ্যাস সম্পদের শতকরা ৮০ ভাগের কর্তৃত্ব তাদের হাতে, রফতানির অধিকারও তাদের। বঙ্গোপসাগরের আরও গ্যাস ব্লক এই কনকো ফিলিপসকে দেবার আয়োজন এখন সম্পন্ন। এজন্য কদিন আগেই পিএসসি ২০১২ সংশোধন করে তাদের জন্য সুবিধা আগের চাইতেও অনেকবেশি বাড়ানো হয়েছে। এখান থেকে প্রাপ্ত গ্যাস তাদের কাছ থেকে কেনার দাম বাড়ানো হয়েছে, তাদের ইচ্ছামতো দামে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির সুবিধা দেয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের নিজের গ্যাস কিনতে যা খরচ পড়বে তার তুলনায় অন্য দেশের কাছ থেকে গ্যাস আমদানি করাই বেশি লাভজনক হবে! বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদ বাংলাদেশের হাতছাড়া হবে।

সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের উন্নতির জন্য দরকার ছিলো, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর নয়, বরং কতগুলো বিষয় সমাধান করা। প্রথমত, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতি যাতে যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তন করে তার জন্য দাবি উত্থাপন। দ্বিতীয়ত, যেসব অসম বিনিয়োগ চুক্তি বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার সংশোধন বা বাতিল। তৃতীয়ত, মার্কিন কোম্পানি শেভ্রনের কাছে মাগুড়ছড়ার গ্যাসসম্পদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা আদায়। চতুর্থত, গোপন সব সামরিক বেসামরিক চুক্তি কি জনগণের কাছে প্রকাশ করা। পঞ্চমত, জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি।

বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই বাণিজ্যবৃদ্ধিতে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে নিজের স্বার্থ নিশ্চিত করতে অনেক সতর্ক থাকা দরকার। কেননা বিশ্ব বাণিজ্য এখনও নিয়ন্ত্রণ করে কতিপয় শক্তিধর রাষ্ট্র ও বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা। এসব রাষ্ট্র বা সংস্থার নিয়ন্ত্রণে থেকে কোন দেশ টেকসই উন্নয়ন করতে পারে না; কোন দেশের বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটলেও তা অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালনের বদলে দীর্ঘস্থায়ী অনুন্নয়নের চক্র তৈরি করতে পারে। ভারসম্যহীন উন্নয়নের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

দেশে নির্বাচন নিয়ে নানা খেলা চলছে। নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে তুষ্ট করবার জন্য প্রধান দুপক্ষই প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগরসহ সমগ্র দেশ এই প্রতিযোগিতার বলি। জনগণের স্বার্থের কথা বলে সরকার যখন চুক্তি করবার কথা বলছে তখন জনগণের কাছে এসব বিষয় খোলাসা করতে সরকার সাংবিধানিকভাবেই বাধ্য। সেজন্য জনগণের সম্মতি ছাড়া তাদের নামে কোন সরকারেরই টিকফা নামের এই দাসত্বের চুক্তি স্বাক্ষরের নৈতিক অধিকার নেই। বর্তমান নির্বাচনকালীন সরকার আইনগত ভাবেই তা করতে পারে না। অতএব এই চুক্তি জাতীয় স্বার্থবিরোধী আরেকটি দলিল, অনৈতিক ও অবৈধ। এই চুক্তির অর্থ গলা বাড়িয়ে ফাঁস নেয়া, হাত মুচড়ানোর শিকার হওয়া, আর্থিক ক্ষতি ছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্রে দেশের সার্বভৌম অস্তিত্ব বিপন্ন করা। সরকারের এই আত্মসমর্পণমূলক চুক্তি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে দীর্ঘমেয়াদী আরও কঠিন শৃঙ্খল, আর্থিক ক্ষতি ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে নিয়ে যাবে।।

(নভেম্বর ২৭,২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)