‘অভিশপ্ত সম্পদ’ মডেল তেল ও খনিজ সম্পদের কারণে প্রতিকূল ফলভোগী দেশগুলোকেই ‘অভিশপ্ত সম্পদের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় (Tsalik and Schiffrin, 2005)।
যেখানে জনবিরোধী রাজনীতি ও ক্ষমতার আধিপত্য তৈরি হয়েছে, সেখানেই অর্থনৈতিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। অন্যদিকে যেসব দেশ উত্পাদনবান্ধব, জনস্বার্থমুখী নীতি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, সেখানে পরিস্থিতি ভিন্ন (Mehlum et al, 2005)।
প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ অনেক দেশের শাসকই তাদের সম্পদ লুণ্ঠন ও অপচয় করার ক্ষেত্র তৈরি করে, শুধু হাতেগোনা কিছু মানুষের ভোগ বিলাসের জন্য সম্পদ উত্তোলন করা হয়। তাই সেখানে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও অব্যবস্থাপনা অধিক সংখ্যক মানুষকে রাখে দরিদ্র করে। ২০০৩-এ প্রকাশিত জাতিসংঘের দ্বিতীয় ‘আরব মানব উন্নয়ন রিপোর্ট’ অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর অধিক নির্ভরতা অল্প কিছু মানুষের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করেছে, সেসঙ্গে অর্থনৈতিক গতিকে খর্ব করেছে এবং জ্ঞানের চাহিদাকে করেছে দুর্বল (Tsalik and Schiffrin, 2005)।
এসব দেশে দমনপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো প্রচুর উদাহরণ আছে, যা খনিজ সম্পদ শোষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভারতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চল কার্যত সামরিক শাসনের মাধ্যমে পরিচালিত। এবং এ সমস্যাযুক্ত এলাকার অধিকাংশই প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। নাইজেরিয়ায় শেল কোম্পানি স্থানীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে নাইজার ব-দ্বীপে নিপীড়ন চালানোর বাহিনীতে পরিণত করেছে, শেভরন কোম্পানি নাইজেরিয়ান মিলিটারি ও পুলিশকে পরিচালনা করেছে, যাতে তারা শেভরনের হেলিকপ্টার থেকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করতে পারে (১৯৯৮ ও ১৯৯৯)। কবি ও অ্যাক্টিভিস্ট ‘কেন সারওয়া’কে তার প্রতিবাদের কারণে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়।
ইউনোকাল কোম্পানি মিয়ানমারে সে দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইয়াদানা পাইপলাইন রক্ষা করার একটি চুক্তি করেছিল। সেজন্য গ্রামবাসীকে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করা হয়েছিল, তাদের অবকাঠামো নির্মাণে বাধ্য করা হয়েছিল (১৯৯৪- বর্তমান)। কলম্বিয়ায় দাঙ্গা পুলিশ আনা হয়েছিল ইউয়া আদিবাসী সদস্যদের উচ্ছেদ করতে, যারা অক্সিডেন্টাল পেট্রোলিয়াম কোম্পানির তেল প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছিল (১৯৯০-এর শেষ ভাগ)। এটি মাদকবিরোধী অপারেশনের নামে জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অবিরাম যুদ্ধ। ইকুয়েডরের আমাজন জঙ্গলে কুইটোর কাছে কথিত ‘শেল এর শহর’ দিয়ে নিরাপদ রাখা হয়েছে মিলিটারি ক্যাম্প। সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশ পুরোপুরি একনায়কতন্ত্রের মধ্যে বাস করছে বহু বছর যাবত্। কয়েক দশক ধরে বহু দেশেই এ-জাতীয় নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে উঠেছে (মুহাম্মদ ২০১১, পারকিন ২০০৬, পারকিন ২০০৭)।
সৌদি আরব সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমরাস্ত্র ক্রয়ের জন্য সর্বোচ্চ একক ৩০ বিলিয়ন ইউএস ডলারের একটি সামরিক চুক্তি সম্পাদন করেছে। এটি ঘটেছে সে দেশে বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের ক্রমবৃদ্ধির সময়ে।
রফতানি করো ও বিপদগ্রস্ত হও
রফতানি যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে দ্রব্য ও বাজারভেদে এর নানা রকম প্রভাব রয়েছে। এখানে আমরা কথা বলছি প্রকৃতি থেকে উত্তোলিত অনবায়নযোগ্য সম্পদ নিয়ে। কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই আমরা বুঝতে পারি যে, অনবায়নযোগ্য সম্পদের রফতানির ফলাফল আর নবায়নযোগ্য কিংবা প্রস্তুতকৃত দ্রব্যের রফতানির ফলাফল এক নয়। প্রান্তস্থ অর্থনীতির ক্ষেত্রে খনিজ সম্পদ রফতানির পক্ষে সহজেই যুক্তি দাঁড় করানো হয়। করপোরেট অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় যে, খনিজ সম্পদ রফতানি দেশের অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি করবে। কিন্তু আমরা এর বিপরীত অনেক দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। এ বিষয়ে প্রতিকূল অভিজ্ঞতার দেশগুলোর ওপর করা একটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, ‘যেসব দেশ উচ্চহারে খনিজ সম্পদের রফতানি করেছে, সেসব দেশে পরবর্তী ২০ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি মন্থর হয়ে পড়েছে’ (Sachs and Warner, 1997)।
সৌদি আরবের অপরিশোধিত তেলের মজুদ এখনো বিশ্বে বৃহত্তম। সেখানে মাথাপিছু আয় ১৯৮১ সালে ২৮ হাজার ৬০০ ডলার থেকে সংকুচিত হয়ে ২০০১-এ এসে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৮০০ ডলারে; তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে ২০০৮ থেকে তা আবার বেড়েছে।
নাইজেরিয়ার গ্যাস, কয়লা, তেল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে, যা বিদ্যুত্ উত্পাদন ও শিল্পায়নের কাজে ব্যবহার হতে পারত। হিসাব অনুযায়ী, নাইজেরিয়ায় ১৮৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) নিশ্চিত প্রাকৃতিক গ্যাসের ভাণ্ডার রয়েছে, যা বিশ্বের নবম এবং আফ্রিকার সর্ববৃহত্ গ্যাসের মজুদ (বিপি, ২০১০)। নাইজেরিয়া ওই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় তেলেরও মজুদ। বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো নাইজেরিয়ায় কয়েক দশক ধরে অনুসন্ধান ও উত্তোলন করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তা রফতানির কাজও করছে। অথচ দেশটির জনগণ ব্যাপক হারে লোডশেডিং, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অনুন্নত অবকাঠামোগত সমস্যায় ভুগছে। অর্থাত্ তেল থেকে আয়কৃত অর্থ জনগণের জীবনযাত্রার মান আদৌ বাড়াচ্ছে না। বরং ১৯৭০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ থেকে বেড়ে ৭০ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে (Tsalik and Schiffrin, 2005)।
২. আরেকটি গবেষণা থেকে দেখা যায়, নাইজেরিয়ার অর্থনীতি ২০০৩ থেকে ২০১০ এ গড়ে শতকরা ৭ দশমিক ৬ ভাগ বৃদ্ধি পেলেও দিনে ১ ডলারের নিচে আয় করা মানুষের সংখ্যা ২০০৪ সালে শতকরা ৫১ দশমিক ৬ থেকে বেড়ে ২০১০ সালে শতকরা ৬১ দশমিক ২ ভাগে এসে দাঁড়িয়েছে।
যেখানে ৫০ বছর আগে অপরিশোধিত তেল আবিষ্কারের পর থেকে এ জৌলুসভরা শিল্প প্রবৃদ্ধির অন্যতম উত্স ছিল, সেখানে এখন এই ক্ষেত্রের আধিপত্য ‘জনগণের কাছে অভিশাপ’ হয়ে চেপে বসেছে।
কয়েক বছর আগে ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা (৪ এপ্রিল, ২০০২) মিয়ানমারের ওপর একটি রিপোর্ট করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘জ্বালানি সম্পদসমৃদ্ধ দেশ মিয়ানমার এখন জ্বালানি তেলের চরম সংকটে ভুগছে। সে দেশের জনগণ বিদ্যুত্ সংকটে পতিত অথচ শাসকগোষ্ঠী দেশের একটি স্থিতিশীল গ্যাসের প্রবাহ পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। অথচ রফতানির এ টাকা জনগণের জীবন পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখেনি। সাম্প্রতিক হিসাবকৃত বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ২৪০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বেশি নয়, যা শুধু পরবর্তী ছয় সপ্তাহের আমদানি ব্যয় বহন করতে সমর্থ। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি কালো বাজারে গ্যাসোলিনের দাম ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে এক বছরের কম সময়ের মধ্যে।’
লাতিন আমেরিকার আরেকটি সম্পদসমৃদ্ধ দেশ ইকুয়েডর। এর অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। ১৯৭০ সালে তেলের অধিক মূল্যবৃদ্ধির সময় থেকে সরকারি হিসাবে এ দেশের দারিদ্র্যের মাত্রা ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ এবং রাষ্ট্রীয় ঋণ ১৬ মিলিয়ন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪০ মিলিয়ন ডলারে। লোকসংখ্যার দরিদ্র অংশের জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কমে ২০ থেকে ৬ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে (Perkins, ২০০৬)।
কঙ্গোর রয়েছে রক্তাক্ত ও নিষ্ঠুর ইতিহাস, যার জন্য মূলত দায়ী সে দেশের বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ। ৭৫ শতাংশ কঙ্গোর প্রাকৃতিক সম্পদ এখন বিদেশী কোম্পানিগুলোর দখলে। খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মাথাপিছু জিডিপি ও মানব উন্নয়ন সূচকের (HDI) তালিকায় কঙ্গো যথাক্রমে ১৫৮ ও ১৪২ নম্বর অবস্থানে।
বিদেশী বিনিয়োগ: অন্য কাহিনী
যে কোনো গতিশীল রাষ্ট্রের জন্য স্থানীয় এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কী ধরনের বিনিয়োগ হচ্ছে, কী তার শর্তাবলি অর্থাত্ বিনিয়োগের গুণগত মান কী, সেটা বিবেচনায় রাখা জরুরি। গতানুগতিক উন্নয়ন অর্থশাস্ত্রে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বহুজাতিক কোম্পানিকে পুঁজির স্বল্পতার সমাধান হিসেবে দেখা হয় এবং সেসঙ্গে তাকে প্রান্তস্থ অর্থনীতিতে দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের জন্য ‘অতি নিশ্চিত সমাধান’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও মাঝে মধ্যে এসব বিশ্লেষণেও স্থানীয় বাস্তবতার আংশিক স্বীকৃতি খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন— ‘প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ কিছু সুবিধা আনতেও পারে, কিন্তু এটি একই সঙ্গে অত্যন্ত উঁচু মাত্রায় পুঁজিঘন হতে পারে, যেখানে উদ্বৃত্ত শ্রমিক বিদ্যমান। অথবা বিনিয়োগকৃত দেশের কাছে অনেক বেশি করে তার ব্যয় দেখাতে পারে, রাতারাতি এ হিসাব পাহাড় প্রমাণ করে ফেলতে পারে, ব্যয়-সুবিধা অনুপাত ওই দেশের প্রতিকূলে নিয়ে যায় (Meier and Stiglitz, ২০০১)।’
আমরা এরই মধ্যে দেখেছি, অনেক দেশেই শুধু জ্বালানি ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগের ওপর নির্ভরতার ফলে উন্নয়ন একটি বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। জাতিসংঘের এক সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নব্বইয়ের দশকের শতকরা ৬৬ ভাগ বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। ২০০০-২০০৫ এ এটি ৮৭ শতাংশে উন্নীত হয়। শুধু অ্যাঙ্গোলা, চাদ, গিনি ও সুদান এ চারটি তেল উত্পাদনকারী দেশ বিদেশী বিনিয়োগের শতকরা ৫৬ ভাগ গ্রহণ করেছে (UNCTAD, ২০০৬)। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের বিদেশী বিনিয়োগ মূলত ‘সম্পদ অনুসন্ধানী’। সে কারণে এ ধরনের বিনিয়োগ স্থানীয় পর্যায়ে কাজের সুযোগ, সক্ষমতা তৈরি কিংবা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কোনোটাই করে না। এ ক্ষেত্রগুলো যেন একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ, যেখানে দিন শেষে মুনাফা তুলে পকেটস্থ করে কেবল বহুজাতিক কোম্পানি।
খনি বিশেষজ্ঞ ও লেখক রজার মুডি তার গবেষণালব্ধ বইয়ে দেখিয়েছেন, যেসব দেশ তেল ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্য বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল, তাদের অর্থনৈতিক গতি মন্থর হয়ে পড়ে। যেসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দারিদ্র্য ও সংঘাত নিত্য বিদ্যমান, সেসব দেশের সঙ্গে উপরোক্ত দেশগুলোর পার্থক্য থাকে না। পৃথিবীজুড়ে নানা উদাহরণ উল্লেখ করে মুডি দেখিয়েছেন, কোম্পানিগুলো বন-জঙ্গল, পানি ও পরিবেশ ভারসাম্যের কী রকম অপূরণীয় ক্ষতি সাধন করেছে। পরিবেশ রক্ষা ও মানবাধিকার সংরক্ষণে এদের রেকর্ড অত্যন্ত ভয়াবহ (Moodz, ২০০৭)।
উন্নয়ন ও সক্ষমতা তৈরির মধ্যকার সম্পর্ক ও খনিজ সম্পদের প্রাপ্যতার ওপর একটি গবেষণা এ সিদ্ধান্ত টেনেছে যে, অনেক খনিজ সম্পদসমৃদ্ধ দেশ যেমন— জাম্বিয়া, সিয়েরালিওন, কঙ্গো ও অ্যাঙ্গোলার অর্থনীতি পৃথিবীর অন্যান্য সম্পদ অপ্রতুল দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে (Journal, ২০০৬)। এ গবেষণায় আরো দেখানো হয়েছে, কোনো কোনো দেশে সম্পদ অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সম্পদের প্রাচুর্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ক্ষমতাশীল গোষ্ঠী সুবিধামতো সম্পদ লুট করার জন্য গণতন্ত্র এবং এর প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে।
‘Fanning the Flames’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে যেসব বৃহত্ খনি কোম্পানির কারণে বিভিন্ন দেশে মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে, তা আলোচনা করা হয়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে আছে যুক্তরাজ্যের ‘বিএইচপি’ এবং অস্ট্রেলিয়ার ‘রিও টিন্টো’।
বাণিজ্য প্রভুদের কর্মসূচি
এটি মাথায় রাখা সঙ্গত যে, কমন প্রপার্টি বা সাধারণ সম্পত্তির ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার সংজ্ঞায়ন করা দুরূহ’ এবং ‘কেউ তা শোষণ করলে অপরের জন্য (বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের জন্য) তা ক্ষতির কারণ হয়’ (Dashgupta, ১৯৮২)।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ (১৯৯৯ সালে তিনি এ পদ ত্যাগ করেন) অর্থশাস্ত্রে নোবেলজয়ী জোসেফ স্টিগলিজ বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে বলেছিলেন, ‘কোনো দেশ যদি তার প্রাকৃতিক সম্পদ বিক্রি করে, তেল কোম্পানিগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে দেয় এবং ভবিষ্যত্ আয় থেকে ঋণ করতে থাকে; তাহলে সেখানে ভোগের উচ্চহার দেখা দিতে পারে, যা জিডিপি বৃদ্ধি করে। কিন্তু হিসাববিজ্ঞানের যথাযথ কার্যপ্রণালি দ্বারা দেখা যাবে দেশটি প্রকৃত অর্থে দরিদ্রতর হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘অনেক উন্নয়নশীল দেশেই প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় দেয়া আর বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা একই কথা, যেহেতু সেখানে কোনো দেশী প্রতিষ্ঠান নেই, যার উত্তোলনের কাজ সম্পাদন করার প্রয়োজনীয় পুঁজি ও দক্ষতা আছে’ (Tsalik and Schiffrin, ২০০৫. পৃ: ১৫-১৬)।
বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদ নিয়ে বিতর্কের প্রশ্নেও তিনি মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো একটি দেশের (যার গ্যাসের মজুদ সীমিত) উচিত গ্যাস বিক্রির সময় সতর্ক থাকা। কেননা ভবিষ্যতে তেলের মূল্যবৃদ্ধি থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখার আর কোনো কার্যকর পথ নেই’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৫)। একই সঙ্গে কোনো দেশকে তাদের খনিজ শিল্প কিংবা সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় দেয়ার জন্য অযাচিত চাপ না দিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে পরামর্শ দিয়েছিলেন স্টিগলিজ।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং এর সহযোগীদের জ্বালানি ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা রয়েছে। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানপত্রে তার আঁচ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক এর তেল, গ্যাস ও খনি নীতিমালা বিভাগ সেবা, ঋণ, প্রযুক্তিগত সহযোগিতা, নিশ্চয়তা ও জ্ঞান এসবের সমন্বিত রূপ দ্বারা আইনগত, বার্ষিক ও চুক্তিভিত্তিক ইস্যু, নিয়ম ও ক্ষেত্র পুনর্নিমাণ ও বেসরকারীকরণ-সংক্রান্ত পরামর্শ প্রদান করে। স্বভাবতই এ ধরনের চেষ্টা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে যেতে সহায়তা করে এবং এর মাধ্যমে সরকারি খাতের অপচয় দূর করে উত্পাদন ব্যয় কমায় ও প্রতিযোগিতার সমান ময়দান তৈরি করে, যাতে বিনিয়োগকারীরা প্রতিযোগিতার বাজারে প্রবেশ করে (World Bank, 2011)।’
অতএব স্পষ্টতই বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য ব্যক্তিমালিকানা ও মুনাফামুখী তত্পরতার দিকে জ্বালানি খাতকে ঠেলে দেয়া। তারা দাবি করে, এর মাধ্যমে সরকারি খাতের অপচয় দূর হবে, উত্পাদন ব্যয় কমবে এবং প্রতিযোগিতার বাজার তৈরি হবে। আমরা বাংলাদেশে এর বাস্তবতা পরীক্ষা করব, যা পুরোপুরি উল্টো একটি চিত্র দেবে। (চলবে)
(১৭ মে ২০১৪ বণিকবার্তায় প্রকাশিত)