জ্বালানি খাতে মুনাফামুখী ব্যক্তিমালিকানা ও বিদেশী বিনিয়োগ

স্বাধীনতা অর্জনের পর পরই প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার- ২৭ এর মাধ্যমে ২৬ মার্চ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ তেল-গ্যাস ও খনিজ সম্পদ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ২২ আগস্ট, ১৯৭৪ সালে অর্ডিন্যান্স-১৫ এর মাধ্যমে পুনর্গঠিত এ সংস্থার সংক্ষিপ্ত নাম দেয়া হয় ‘পেট্রোবাংলা’। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম অনুসন্ধান ও উৎপাদন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) পেট্রোবাংলার অনুসন্ধানকাজ পরিচালনার জন্য পেট্রোবাংলার অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৮৯ সালের জুনে আত্মপ্রকাশ করে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, মালয়েশিয়ার জাতীয় পেট্রোলিয়াম এজেন্সি পেট্রোনাস এবং আমাদের পেট্রোবাংলা একই সময় যাত্রা করে। অথচ প্রথমোক্তটি এখন বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করছে এবং ‘নিউ সেভেন সিস্টার’-এর একটিতে পরিণত হয়েছে। এদিকে পেট্রোবাংলা ক্রমেই স্থানীয় ও বৈশ্বিক করপোরেট স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রান্তিকৃত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রথম বিস্তৃত গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ হয় ১৯৮২ সালে। ১৯৮১ সালের অক্টোবরে ‘এনার্জি এসেসমেন্ট মিশন’-এর অভিজ্ঞতা ও প্রাপ্তির ওপর ভিত্তি করে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়। একই সময় ইন্দোনেশিয়া, মৌরিতাস, কেনিয়া, শ্রীলংকা, জিম্বাবুয়ে, হাইতি, পাপুয়া নিউগিনি, বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা ও মালয়ের জন্যও একই ধরনের রিপোর্ট ইস্যু করা হয়।

কোনো বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা ছাড়াই এ রিপোর্টে বাংলাদেশে মজুদ গ্যাসের পরিমাণ ১০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট (টিসিএফ) উল্লেখ করা হয়। বিশ্বব্যাংক এ মজুদকে ‘উল্লেখযোগ্য’, ‘অর্থনৈতিকভাবে ব্যবহারযোগ্য (রিকভারেবল) প্রাকৃতিক মজুদ গ্যাস’ হিসেবে আখ্যা দেয়। তারা আবার এ বিষয়টির ওপরও জোর দেয় যে, ‘বর্তমান ভোগ বা ব্যবহারের মাত্রায় এ পরিমাণ গ্যাস কয়েক দশক চলবে।’ এ রিপোর্ট এর পর দেশের ‘প্রধান সম্পদের দ্রুত ও কার্যকর ব্যবহার’-এর প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেয়। কারণ এর মাধ্যমেই অর্থনীতিতে ‘সাম্প্রতিক বৈদেশিক লেনদেনের সমস্যা দূর হবে এবং জ্বালানি খাত নিয়ে যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি দাঁড় করাতে সক্ষম হবে’ (WB-UNDP, ১৯৮২, পৃ. ২)।

এর পর কীভাবে এ সম্পদ থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারে, এ রিপোর্ট সেই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দিয়েছে।

সংশ্লিষ্ট খাতের সামগ্রিক পুনর্গঠনের পরামর্শ দিয়ে বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘যেহেতু বাংলাদেশের সীমিত সক্ষমতা দিয়ে নিজ উদ্যোগে অনুসন্ধান কাজ চালানো সম্ভব নয়, সেহেতু এ খাতে বিদেশী তেল কোম্পানির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেয়া উচিত’ (পূর্বোক্ত, পৃ. ৪)।

সর্বোপরি এতে বলা হয়েছে, যেহেতু ‘বাংলাদেশের এ গ্যাসসম্পদ বহুদিন পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হবে’, সেহেতু এ রিপোর্ট ‘সম্পদের সর্বোত্তম সদ্ব্যবহারের জন্য’ বিভিন্ন ধরনের রফতানির সুযোগ প্রস্তাব করেছে। তার মানে ১৯৮২ সালেই বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবের মধ্যে ছিল—

‘(ক) ভারত পর্যন্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রফতানি;

(খ) গ্যাস তরলায়িত করে রফতানি;

(গ) রফতানিমুখী জ্বালানিনির্ভর শিল্পকে আকর্ষণ করা; যেমন— মিথানল উৎপাদন অথবা প্রাকৃতিক গ্যাসকে ফিডস্টক হিসেবে ব্যবহার করা।’

পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বিশ্বব্যাংক কথিত ‘সুযোগের তালিকা’ কমিয়ে একটিতে নামিয়ে আনা হয়, তাদের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের করণীয় দাঁড়ায় একটি, তা হলো— ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বার্থে ভারত পর্যন্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস রফতানি করা।’

কাছাকাছি সময়ে একই ধরনের রিপোর্ট ও প্রস্তাব পাওয়া যায় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও। একই বছর তারা বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থা বৃহৎ জ্বালানি গবেষণা ও ‘বিদ্যুৎ খাতের চূড়ান্ত পরিকল্পনা’র বিষয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করে। এ রিপোর্ট ‘গ্যাস সম্পদের সবচেয়ে কার্যকর ব্যবহার’-এর প্রস্তাবে আরো সুনির্দিষ্ট ছিল। এ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা হলো যে, বাংলাদেশ গ্যাস রফতানির সিদ্ধান্ত নিলে ভারতই হবে তার সবচেয়ে যৌক্তিক (সবচেয়ে লাভজনক) গন্তব্য এবং বৃহৎ বাজারে বাংলাদেশ গ্যাস নিয়ে প্রবেশ করতে চাইলে কলকাতা পর্যন্ত পাইপলাইনই সবচেয়ে কার্যকর পথ।

একজন ব্রিটিশ কনসালট্যান্ট, যিনি গ্যাস বিক্রির সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন, তিনিও একে সহজসাধ্য বলেই মনে করেছেন’ (ADB, ১৯৮২, পৃ. ৬৫)।

বিদ্যুৎ খাতের জন্যও একই পথরেখা নির্দেশ করা হয়েছিল। কীভাবে সরকার, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (পিবিএস) এমন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলো, যেখানে বিশ্বব্যাংক এবং তার সংস্থা আইডিএ কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো, তা উপলব্ধি করা বিদ্যুৎ খাতের পরবর্তী ‘উন্নয়ন পদক্ষেপ’ বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরইবি ও পিবিএস এসব প্রতিষ্ঠানই পূর্ববর্তী বিভিন্ন সমীক্ষা ও পরামর্শের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছিল (Muhammad, ২০০৩)।

১৯৯৬ সালের অক্টোবরে একই ধরনের অন্যান্য প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ‘এজেন্ডা ফর অ্যাকশন’ অনুযায়ী ‘বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি’ (পিপিজিপি) অনুমোদন করে।

এ নীতির মূলকথা হলো, নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তৈরি হবে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের (আইপিপি) মাধ্যমে। বলা বাহুল্য, এ প্রক্রিয়া বিদ্যুৎ খাতে ব্যক্তিমালিকানা, বিশেষত বহুজাতিক করপোরেশনের কর্তৃত্বে এ খাত নিয়ে আসার রাস্তা প্রশস্ত করে।

বলা হয় যে, নতুন বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মাণ হবে নির্মাণ-মালিকানা-পরিচালনার [Build- Own- Operate (BOO)] ভিত্তিতে। সরকারি খাতের চারটি বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পগুলোকেও (কয়লানির্ভর বড়পুকুরিয়া, গ্যাসভিত্তিক শাহজিবাজার, বাঘাবাড়ী, সিলেট গ্যাস টার্বাইন) স্থগিত করে আইপিপির মাধ্যমে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।

নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে তাই নাটকীয়ভাবে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়তে থাকে। গ্যাস, টেলিযোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে নতুন নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৯৬ সাল থেকে পাঁচ বছর গ্যাস খাতে পুঁজি প্রবাহের সর্বোচ্চ বার্ষিক গড় পাওয়া গিয়েছিল, তার পরই ছিল বিদ্যুৎ খাত। ইপিজেডে বিদেশী বিনিয়োগ ছিল তুলনামূলক কম (WB, ১৯৯৯)। যদিও প্রথম দিকে টেলিযোগাযোগ খাতে বিদেশী বিনিয়োগ কম ছিল, পরবর্তী বছরগুলোয় তা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেতে দেখা গেছে।

১৯৯৩-৯৪তে প্রথম রাউন্ডে ছয়টি উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি) স্বাক্ষরিত হয়। কেয়ার্ন এনার্জি-হল্যান্ড সি সার্চকে ব্লক ১৫ ও ১৬ দ্বারা পুরস্কৃত করা হয়। পরবর্তীতে হেলিবার্টন/সান্তোস ব্লক ১৬ নিয়ে নেয় এবং কেয়ার্ন/শেল পায় ব্লক ১৫। প্রাথমিকভাবে অক্সিডেন্টাল পেয়েছিল ব্লক ১২, ১৩ ও ১৪। পরে তা ইউনোকলে হাতবদল হয় এবং তারও পরে এ ব্লকগুলো চলে যায় শেভরনের কাছে। ১৭ ও ১৮ নম্বর ব্লক প্রথমে অকল্যান্ড-রেক্সউড পায়, পরে তা পায় অকল্যান্ড/তাল্লো। ইউনাইটেড মেরিডিয়ান করপোরেশন পায় ২২ নম্বর ব্লক। ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় লাইসেন্স প্রদান রাউন্ডে চারটি পিএসসি স্বাক্ষরিত হয়। ৫ ও ১০ নম্বর ব্লক পায় শেল-কেয়ার্ন এনার্জি, তাল্লো-শেভরন-টেক্সাকো পায় ৯ নম্বর এবং ইউনোকল (পরবর্তীতে শেভরন) পায় ৭ নম্বর ব্লক। দ্বিতীয়বারের চুক্তিগুলোয় বাপেক্সকে এসব কোম্পানির সঙ্গে খুব ক্ষুদ্র শেয়ার দিয়ে যুক্ত করা হয়। এ চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম নিজের গ্যাস নিজেই কিনতে শুরু করে, তাও আবার রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো যে দামে গ্যাস সরবরাহ করত, তার প্রায় ৩০ গুণ বেশি দামে এবং কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অনুসন্ধান এজেন্সি— বাপেক্স যেখানে একই কাজ করতে সক্ষম, সেখানে দক্ষতা ও পুঁজির অভাবের যুক্তি দেখিয়ে এমনভাবে নীতি নির্ধারণ করা হলো, যাতে এ কাজে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি (আইওসি) অথবা বহুজাতিক কোম্পানিকে (এমএনসি) নিয়ে আসা যুক্তিযুক্ত দেখায়। গ্যাস সমৃদ্ধ পূর্ব দিকের অংশ দিয়ে দেয়া হয় এসব বিদেশী কোম্পানিকে। সাধারণের সম্পত্তি পরিণত হয় ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে। বেশি দামে তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে থাকায় রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় কমার বদলে (বিশ্বব্যাংক যা দাবি করে) তা আরো বেড়ে যায়। একপর্যায়ে বিশ্বব্যাংকও স্বীকার করে যে, ‘জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দামেই পেট্রোবাংলা আইওসির কাছ থেকে গ্যাস কেনে। এভাবে পেট্রোবাংলার ঘাটতি ক্রমে বাড়ছে ও পুঁজির প্রবাহ হচ্ছে ঋণাত্মক।’ (WB, ১৯৯৯; পৃ. ১৩)

তার মানে বিদেশী বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করার পর অবশেষে ১৯৯৯ সালে বিশ্বব্যাংক নিজেই বিবৃতি দেয়— এ বিনিয়োগ ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতি সামান্যই বাড়ায়।’ কারণ ‘বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী বিনিয়োগের অর্থ এর নানা আমদানিতেই খরচ হয়ে যায়। … সেভাবেই হিসাব করা হয় গ্যাস ক্ষেত্রে আইওসির মূলধনি পুঁজির খরচ। টেলিকম খাতের বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ ব্যবহূত হয় টেলিযোগাযোগ খাতের সরঞ্জামাদি আমদানির উদ্দেশ্যে।’ (WB, ১৯৯৯; পৃ. ৭)

এ কথার সূত্রে বিশ্বব্যাংক স্পষ্টভাবে জানায় যে, ‘বিদেশী বিনিয়োগের আমদানি বাহুল্য এবং পরবর্তীতে মুনাফার বহির্গমন ও সুদ পরিশোধের ফলাফল হলো, লেনদেনে অধিকতর ঘাটতি (পূর্বোক্ত, পৃ. ৭)। ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, বিদেশী বিনিয়োগে পুঁজির অন্তঃপ্রবাহ এর বহিঃপ্রবাহের চেয়ে অনেক কম, যা আসে তা আবার প্রকল্প আমদানিতেই খরচ হয়ে যায়। এটি ভবিষ্যতে আরো বাড়বে এমন প্রাক্কলনও করা হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের সুপারিশকৃত বিদেশী বিনিয়োগের প্রতিকূল প্রভাব নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এ স্বীকৃতি অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। কিন্তু এ সংকট সমাধানে তাদের পরামর্শটি ভালোভাবে খেয়াল করলে বিষয়টি খোলাসা হতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট, তার সমাধান ‘গ্যাস রফতানি’। কারণ ‘গ্যাস রফতানি ব্যতীত বৈদেশিক মুদ্রার সংবর্ধন সম্ভব নয়।’ (পূর্বোক্ত)

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) এ নতুন সমস্যার স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে, ‘যদিও এডিবির অর্থায়নে একক কোম্পানির গ্যাস খাতের প্রকল্প লাভজনক, তা সত্ত্বেও বিদেশী কোম্পানির অধিক ব্যয়বহুল অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির কারণে পেট্রোবাংলা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।’

ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাংক ও এডিবির বাতলানো সমাধান ছিল খুবই সুনির্দিষ্ট—

ক. আর্থিক ক্ষতি পোষানোর জন্য গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে।

খ. বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে গ্যাস রফতানি করতে হবে।

অর্থাৎ গ্যাস রফতানির যে ব্যবস্থাপত্র দেয়া হয় ১৯৮২তে, সেটাই ১৯৯৯ সালে এক রকম বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে এবং ক্রমে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সরকার সেদিকেই এগোতে থাকে। ১৯৯৯ থেকে মার্কিন কোম্পানি ইউনোকলের পক্ষ থেকে গ্যাস রফতানির পক্ষে (সিলেটের বিবিয়ানা থেকে ভারত পর্যন্ত) প্রবল প্রচারণা চলতে থাকে। এ প্রচারণার অংশ হিসেবে অনেক মার্কিন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেন, এমনকি প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও ঢাকায় আসেন ২০০০ সালের মার্চে।

কিন্তু স্বাধীন বিশেষজ্ঞ ও জনসাধারণের বিপক্ষে অবস্থান নেন। পিএসসি ও গ্যাস রফতানির বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে সরকার ২০০২ সালে দুটি কমিটি গঠন করে। একটি কমিটির দায়িত্ব ছিল— মজুদ অবস্থা পর্যালোচনা করা, আরেকটির কাজ— সর্বোত্তম ব্যবহারের পথ নির্ধারণ করা। দ্বিতীয় কমিটি সব প্রাসঙ্গিক বিষয় পর্যালোচনা করে গ্যাস রফতানির বিপক্ষে সিদ্ধান্ত টানে। তারা রিপোর্টে বলেন, ‘বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সম্পৃক্ততা দেশের গ্যাস অর্থনীতিকে কেবল ক্ষতিগ্রস্তই করেছে।’ (Report, ২০০২; পৃ.৬১)

বাড়তি বোঝার উন্নয়ন

প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি থেকে পরিষ্কার যে, সমৃদ্ধ গ্যাস ব্লকসহ বেশির ভাগ সম্পদ বহুজাতিক কোম্পানির কাছে ইজারা দেয়া মানে প্রকৃতপক্ষে এদের কাছে বাংলাদেশের জিম্মি হয়ে পড়া। গ্যাস ও বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রাজস্ব ঘাটতির বোঝা ক্রমে বেড়ে চলেছে। রাষ্ট্রীয় টাকা বাঁচানোর বদলে অপচয় ও দুর্নীতি বরং বহুগুণে বেড়েছে। কয়েক বছরে বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের কাছে গ্যাস বিক্রি করে ১৬ হাজার কোটি টাকা কামিয়েছে, যা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির কাছ থেকে কিনলে প্রয়োজন হতো স্থানীয় মুদ্রায় মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা।’ (মোস্তফা প্রমুখ, ২০১০) অর্থাৎ গ্যাস খাতে বিদেশী বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্রের সরাসরি ফলাফল হলো, ১৪ হাজার কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। এ পরিমাণ অর্থ তিন বছরে জ্বালানি খাতের গড় বাজেট বরাদ্দের চেয়ে বেশি।

জ্বালানি খাতে বহুজাতিক কোম্পানিকে যুক্ত করার প্রয়োজনে দুটো যুক্তিকে মিথে পরিণত করা হয়। এগুলো হলো— ক. বাংলাদেশের মতো দেশের প্রয়োজনীয় পুঁজি নেই। বিদেশী বিনিয়োগই পারে সেই ঘাটতি পূরণ করতে। খ. বাংলাদেশের উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাব। বহুজাতিক কোম্পানি পারে দক্ষ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করতে।

কিন্তু আরো অনেক প্রান্তিক দেশের মতোই এখানে বাস্তবতা ও তথ্য ভিন্ন চিত্র দেখায়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে— ১. বেসরকারীকরণ ও জ্বালানি খাতে বহুজাতিক কোম্পানি আনার ফলে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর দাবি মতো, ‘রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়’ কমেনি, বরং উল্টো হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ব্যয় আরো বেড়েছে। বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কেনার সময় ভর্তুকি হিসেবে যে অর্থ ব্যয় হয়, তা দিয়ে কমপক্ষে একটি ৫০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্লান্ট প্রতি বছর তৈরি করা যেত। এসব কোম্পানির অংশীদারিত্ব বাড়ার সঙ্গে টাকার এ অঙ্ক ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২. যেখানে বাপেক্স-পেট্রোবাংলা একটি কূপ খননের জন্য ১০০ কোটি টাকা খরচ করে, সেখানে বহুজাতিক কোম্পানি এ কাজের জন্য দুই থেকে ছয় গুণ বেশি খরচ দেখায়। কাজেই ‘বহুজাতিক কোম্পানি সবচেয়ে দক্ষ এবং এর উৎপাদন খরচ কম’— এটি একটি বহুল প্রচারিত মিথ। ৩. বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের (এমএমসিএফ) মূল্য দেয় ৩-৪ ডলার, অন্যদিকে বাপেক্সসহ জাতীয় কোম্পানিগুলো অনেক লাভ রেখেও ২৫ শতাংশ কম দামে গ্যাস দিতে সক্ষম। ৪. কোম্পানির বর্ধিত অংশীদারিত্বের জন্য ভর্তুকি দিতে সরকার ধাপে ধাপে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। উৎপাদন তথা জীবনযাপনের খরচ বৃদ্ধি এর প্রত্যক্ষ ফলাফল। ৫. মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় বিস্ফোরণের (১৯৯৭ ও ২০০৫) কারণে আমরা ৫০০ বিসিএফ গ্যাস হারিয়েছি। এ পরিমাণ বর্তমানে পুরো বাংলাদেশে ২০ মাসের বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত গ্যাসের সমান। ৬. মার্কিন কোম্পানি শেভরন ও কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোর কাছে আমাদের পাওনা ক্ষতিপূরণ এখনো বকেয়া রয়েছে। নষ্ট হয়ে যাওয়া গ্যাসের দাম ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা জ্বালানি খাতে প্রতি বছরের বাজেট বরাদ্দের প্রায় আট গুণ। ১৯৯৭ সাল থেকে শুরু করে কোনো সরকারই এ ক্ষতিপূরণ আদায়ে উদ্যোগী হয়নি। বরং উল্টো সরকারগুলো এদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেছে।

উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক, এডিবি অথবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা অনেক বিষয় নিয়ে ভীষণ রকম সোচ্চার, তারা এ ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়টি নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চুপ থেকেছে।

এসব কারণে সব তথ্যপ্রমাণ এ বিষয় স্পষ্ট করে যে, জ্বালানি খাত ও এতে বহুজাতিক কোম্পানি যুক্ত করার যৌক্তিকতা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দাবি ও অবস্থান পুরোপুরি ভ্রান্ত, মিথ্যাচারপূর্ণ এবং প্রতারণামূলক।

(২৪ মে ২০১৪ তারিখে বণিকবার্তায় প্রকাশিত)