তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস, বিশেষত এখানকার শ্রমিকদের জীবন ও কাজের নিরাপত্তা নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা অনেক বৃদ্ধি পায়। এ ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায়ই বিশ্বের ইতিহাসে গার্মেন্টস কারখানার সবচেয়ে ভয়ংকর বিপর্যয় যে বাংলাদেশেই ঘটবে, এটা কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। কেননা, সবারই ধারণা ছিল, তাজরীনের পর সরকার, বিজিএমইএ, মালিক, বায়ার ও ব্র্যান্ড—সবারই সতর্কতা তৈরি হবে। সবার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে সারা বিশ্ব্বকে কাঁপিয়ে, সারা দেশকে কাঁদিয়ে রানা প্লাজার ধস থেকে পাওয়া গেল এক হাজার ১২৭ শ্রমিকের লাশ, যাঁদের অধিকাংশ নারী। এখনো শত শত নিখোঁজ। আহত হাজারের বেশি। তার মধ্যে বহু আছেন অঙ্গ হারিয়ে প্রায় অচল। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও জখম যাঁরা বেঁচে থাকলেন, তাঁদের জীবন নিষ্ঠুরতার এক নতুন পর্বে প্রবেশ করল। এ রকম মৃত্যুই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জীবনের মূল আঘাত নয়। জীবনটা নিষ্ঠুর বলেই মৃত্যু এ রকম ভয়ংকর হয়।
এখন দায়দায়িত্ব, শাস্তি, ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছে, সভা-সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যেই আরও জোরদার হয়েছে বাংলাদেশকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধা প্রত্যাহারের হুমকি, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টিকফা (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি স্বাক্ষরের চাপ। বর্তমান সময়ে এ বিষয়ে সারা দেশে প্রচলিত ও প্রচারিত উদ্বেগের সারকথা হলো, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি-সুবিধা প্রত্যাহার করলে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তার গার্মেন্টসের বিশাল বাজার হারাবে। এই বাজার রক্ষা করতে হবে। অতএব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অতি তাড়াতাড়ি টিকফা চুক্তি সম্পাদন করা উচিত।’ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অর্থ দেয়, খাদ্য দেয়, নানা রকম সুবিধা দেয়; নইলে বাংলাদেশ ডুবে মরত। তাই তার কথা অমান্য করা যাবে না। কিন্তু এসবের মধ্যে সত্যতা কতটুকু?
মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যবিষয়ক অফিসের ওয়েবসাইটে তাদের জিএসপি-সুবিধা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে: ‘১২৭টি সুবিধাভোগী দেশের থেকে আমদানি করা প্রায় পাঁচ হাজারটি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার জন্য এই জিএসপি। এর অন্য উদ্দেশ্য হচ্ছে আমদানি করা পণ্যে মার্কিন সামগ্রী ব্যবহার নিশ্চিত করে মার্কিন নাগরিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।…জিএসপির অধীনে যেসব পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে, তার মধ্যে আছে: বহু রকম রসায়ন দ্রব্য, খনিজ দ্রব্য, বিল্ডিং স্টোন, জুয়েলারি, বহু রকমের কার্পেট, এবং কিছু কৃষি ও মৎস্যজাত দ্রব্য। যেসব পণ্য জিএসপি শুল্কমুক্ত সুবিধাবহির্ভূত সেগুলোর মধ্যে আছে: বেশির ভাগ বস্ত্র ও পোশাকসামগ্রী, বেশির ভাগ জুতা, হাতব্যাগ ও ব্যাগ।’ <http://www.ustr.gov/trade-topics/trade-development/ preference-programs/ generalized-system-preference-gsp>
বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য সেই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি-সুবিধার বাইরে। বরং সে দেশে গড় আমদানি শুল্ক হার যেখানে শতকরা ১ ভাগের মতো, সেখানে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর শুল্কহার শতকরা গড়ে ১৫ ভাগ, কোনো কোনো পণ্যে আরও বেশি। গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানির প্রায় শতকরা ২৩ ভাগ গেছে, সেই হিসাবে এ বছরও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক বাবদ প্রদান করেছে কমপক্ষে প্রায় পাঁচ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে যে ঋণ অনুদান নানাভাবে বাংলাদেশে আসে, তার ছয় গুণেরও বেশি। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নয়, বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রকে অর্থের জোগান দিচ্ছে প্রতিবছর! এবং যুক্তরাষ্ট্রই মুক্তবাজার নীতিমালা ভঙ্গ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর বৈষম্যমূলক শুল্ক আরোপ করে রেখেছে!
অর্থাৎ প্রচারণা বা বিশ্বাস যা-ই থাকুক, তথ্য অনুযায়ী প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাংলাদেশের গার্মেন্টস যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে কোনো বিশেষ সুবিধা পায় না, বরং অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে সেখানকার বাজারে প্রবেশ করতে হয়। নেপালের অভিজ্ঞতাও অভিন্ন। কেননা, নেপালও জিএসপি-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
<http://www.sawtee.org/sawtee-in-media/tifa-where-is-our-homework.html>
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ প্রভাবাধীন সংস্থা আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলও (আইএমএফ) বলছে, শিল্পায়িত দেশগুলোর বেশির ভাগ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কম থাকলেও কৃষি, শ্রমঘন পণ্য যেগুলো গরিব দেশ থেকে আসে, তার অনেকগুলোর ওপরই মার্কিন শুল্কহার অস্বাভাবিক রকম বেশি, গড় শুল্কহারের চেয়ে কখনো কখনো ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কাপড় ও জুতার ওপর আমদানি শুল্ক শতকরা ১১ থেকে ৪৮ ভাগ। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের তুলনা করে আইএমএফই স্বীকার করছে যে, যে বছরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার পণ্য আমদানি বাবদ ৩৩ কোটি ডলার আমদানি শুল্ক আয় করল, সেই বছরেই সমপরিমাণ শুল্ক তারা ফ্রান্সের কাছ থেকে আয় করল ১২ গুণ বেশি। অর্থাৎ তিন হাজার কোটি ডলার পণ্য আমদানির জন্য। <http://www.imf.org/external/pubs/ft/fandd/2002/09/smith.htm>
অর্থাৎ ধনী দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে। এটাই বিশেষ সুবিধা!
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন শ্রমিকের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছে, টিকফা চুক্তির মধ্যেও এই বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর আরোপিত উচ্চহারে শুল্ক কমিয়ে তাদের গড় শুল্কহারেরও সমান করে, তাতে যে পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে, তাতে ৪০ লাখ শ্রমিকের মজুরি তিন মাস অতিরিক্ত শোধ করেও নিরাপত্তাজনিত সব ব্যয় বহন সম্ভব হবে।
বলা হচ্ছে, টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্কের উন্নতি হবে। বাংলাদেশের দিক থেকে এই উন্নতির অর্থ কী? বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চরম বৈষম্যমূলক ও সংরক্ষণবাদী শুল্কনীতি কি যুক্তরাষ্ট্র পরিবর্তন করবে? মার্কিন কোম্পানি শেভরনের কাছে মাগুরছড়ার গ্যাসসম্পদের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা ২০ হাজার কোটি টাকা কি শোধ করার ব্যবস্থা করবে? সব সামরিক-বেসামরিক চুক্তি কি জনগণের কাছে প্রকাশ করবে? না, এগুলোর বিষয়ে কোনো কথা নেই। কোনো সরকারের মুখে এই কথাটা কেন আসে না যে আমাদের বিশেষ সুবিধা দিতে হবে না। আন্তর্জাতিক রীতিনীতিবিরোধী বৈষম্যমূলক সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য ব্যবস্থা বাতিল করো।
আরও প্রশ্ন হলো, বর্তমান বৈশ্বিক ব্যবস্থায় যেখানে বহুপক্ষীয় সংস্থা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আছে, সেখানে বিশ্বব্যবস্থার সর্দার যুক্তরাষ্ট্র কেন আলাদা করে চুক্তি করতে চায়? কারণ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠকগুলোতে প্রায়ই বিভিন্ন দেশ জোটবদ্ধভাবে কাজ করে, এটা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ নয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের কোনো সরকারই ন্যায্য প্রশ্নে এমন কোনো শক্ত অবস্থান নেয়নি, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট স্বার্থরক্ষায় সমর্থন দিতে বাংলাদেশের কোনো সরকার কখনো কার্পণ্য করেনি। তবে টিকফা কেন? কারণ, শক্ত হাতে সবদিক থেকে কোনো দেশকে ধরতে এই চুক্তি ভালো একটি অস্ত্র।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধি অনুযায়ী বাংলাদেশে মেধা স্বত্বাধিকার প্রয়োগের চাপ থেকে কিছুদিন ছাড় পেয়েছে। ওষুধশিল্প তারই সুবিধাভোগী, কম্পিউটার ও আইটির বিস্তারও আন্তর্জাতিক এই যৌক্তিক বিধিমালার কারণেই ঘটতে পেরেছে। এখন টিকফা স্বাক্ষর হলে, এই চুক্তি যেহেতু অন্য সব আইনবিধির ঊর্ধ্বে, সুতরাং আন্তর্জাতিকভাবে প্রাপ্ত ছাড় গুঁড়িয়ে দিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চেপে বসতে পারবে। এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওষুধশিল্প এবং আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তিশিল্প। এ ছাড়া কৃষিক্ষেত্রেও বহুবিধ বিপদের আশঙ্কা। বাংলাদেশ জানে না কত কত বীজ, ফসল, গাছ, ফল, ফুল মেধাস্বত্ব জালে কোন কোন কোম্পানির মালিকানায় চলে গেছে। টিকফা সেই জাল বিস্তারেই আসছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কথা না শুনলে গার্মেন্টস বাজার হারানোর ভয় বহু দিন ধরেই ছড়ানো। আসলে বাংলাদেশের গার্মেন্টসে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ও সরকারের বিপুল পরিমাণ লাভ খেয়াল করলে এটা পরিষ্কার হবে যে তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেই কখনো বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে সরে যাবে না। কারণ, তাতে মার্কিন বহু ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর বিশাল মুনাফার একটা বড় উৎস, সরকারের শুল্কের একটি ভালো উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। মার্কিন সরকার বা কোনো লবি তাই ইচ্ছা করলেও বাংলাদেশের গার্মেন্টস আমদানি বন্ধ করতে সক্ষম হবে না।
মার্কিন টিভি চ্যানেল সিএনএন ‘ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল লেবার অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’-এর গবেষণা থেকে হিসাব করে দেখিয়েছে, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পোশাক যে দামে বিক্রি হয়, তার শতকরা ৬০ ভাগই পায় সে দেশের বায়ার ও বিখ্যাত ব্র্যান্ড বিক্রেতারা, উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বাকি ৪০ ভাগের মধ্যে উৎপাদন প্যাকেজ ও পরিবহন খরচ এবং মালিকের মুনাফা অন্তর্ভুক্ত। শ্রমিকের মজুরি একেবারে তলায়, শতকরা ১ ভাগেরও কম। <http://edition.cnn.com/2013/05/02/world/asia/bangladesh-us-tshirt/index.html>
এই বৈশ্বিক লোভনীয় বাণিজ্যে মুনাফার হার খুবই উঁচু। তারপরও ক্ষুধার শেষ নেই। আরও মুনাফার জন্য দেশের মালিক, বিদেশের ক্রেতা-বিক্রেতা সংস্থা সবাই নিরন্তর চেষ্টায় থাকে। তাদের অর্থ ও ক্ষমতা দুই-ই আছে। দেশের মধ্যে এই মুনাফায় ভাগীদার হয় বড় দল, মন্ত্রী, এমপি, পুলিশসহ অনেকেই। দেশি-বিদেশি সবার খাইয়ের পুরো চাপ পড়ে শ্রমিকদের ওপর। শুধু যে মজুরি নিম্নতম সীমায় চলে যায়, তা-ই নয়, প্রয়োজনীয় খরচ কমানোর কারণে জীবনের দামও তুচ্ছ হয়ে যায়। রানা প্লাজার মতো বাংলাদেশের আপাত জৌলুশ এ রকম চাপা দিয়ে রাখে লাখ লাখ শ্রমিকের বিবর্ণ ও পিষ্ট জীবন। বিশ্বজোড়া ছড়ানো মুনাফার জালেই তাঁরা আটকা। জিএসপি-ভীতি আর টিকফা নিয়ে নানা তৎপরতা সেই জালকে আরও কঠিন বানাতে উদ্যত।
( মে ২৩, ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)