বাংলাদেশে আমরা দুই ধরনের জাতীয়তাবাদের কথা শুনি— একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অন্যটি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। ‘জাতীয়তাবাদ’ শব্দটির বহুমাত্রিক অর্থ আছে। স্থান, কাল ও প্রেক্ষিত অনুযায়ী এর তাত্পর্যের পরিবর্তন হয়। একই ধারণা একসময় নিপীড়িতের আশ্রয় হতে পারে, আধিপত্যবিরোধী রাজনীতির বাহন হতে পারে। আবার এই একই আওয়াজ অন্য সময় অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়নের বাহন হতে পারে। এ দুই অভিজ্ঞতাই গত কয়েক শতকে অনেক পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে বাংলাদেশেও।
গত ৪৭ বছরে, ‘বাঙালি’ ও ‘বাংলাদেশী’ শাসনকালে, বাংলাদেশে উন্নয়ন কর্মসূচি কম হয়নি, উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যাও অগণিত। উন্নয়নের নাম করে করে স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষত গত তিন দশকে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, চিকিৎসা, গ্যাস, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ, বন্দর, রেলওয়ে, পাট, নদী, পানি ইত্যাদি অর্থাৎ বাংলাদেশের সমাজ অর্থনীতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রায় সর্বক্ষেত্রে বহু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারভেদে, জাতীয়তাবাদভেদে, তেমন কোনো পার্থক্য হয়নি। কারণ এসব নীতি প্রণয়নে যারা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তারা ছিল অভিন্ন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংস্থা হলো বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি। সুবিধাভোগীদের মধ্যে বহুজাতিক পুঁজি, দেশী বৃহৎ ব্যবসায়ী, আমলা, কনসালট্যান্ট এবং লুটেরা দখলদার গোষ্ঠী।
এসবের মধ্য দিয়ে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে আমরা পেয়েছি অনেক ভবন, যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে অভূতপূর্ব হারে, জিডিপি বেড়েছে অনেক। সেসঙ্গে আরো পেয়েছি, (১) বিপুল চোরাই টাকার মালিক একটি ক্ষুদ্র অতিধনিক গোষ্ঠী; (২) একটি ক্ষুদ্র সচ্ছল মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী; (৩) অনিশ্চিত জীবন ও জীবিকায় ক্লান্ত নিম্নমধ্যবিত্ত গোষ্ঠী; (৪) কর্মসন্ধানীদের বিপুল সমাবেশ; (৫) মানব দারিদ্র্যসীমার নিচে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ; (৬) ভোগবাদিতা আর অমানবিকতার অশ্লীল সমাবেশ; (৭) শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন গণদ্রব্যের বাজারীকরণ; (৮) রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও সাধারণ সম্পত্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর; (৯) নদী-নালা খাল-বিল বন-পাহাড়ে দখলদারিত্বের বিস্তার; (১০) তেল, গ্যাসসহ জনগণের সম্পদ কতিপয় দেশী-বিদেশী কোম্পানির হাতে জিম্মি; (১১) বাণিজ্য বা মুনাফালোভী তত্পরতার দাপটে বিপর্যস্ত আবাদি জমি, জলাশয়, উন্মুক্ত স্থান এবং (১২) প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশধ্বংসী তত্পরতার বিস্তার।
সুতরাং এ মডেলের বাইরে গিয়েই আমাদের বাংলাদেশের জন্য জাতীয় মুক্তি বা মানুষের জন্য এ দেশকে বাসযোগ্য বিকশিত করার কর্মসূচি চিন্তা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, শাসকদের জাতীয়তাবাদী প্রহসন থেকে জাতীয় মুক্তির লড়াই গুণগতভাবেই ভিন্ন। ‘জাতীয় বুর্জোয়া’, ধনিক শ্রেণীর ‘দেশপ্রেমিক দল’ কিংবা বাঙালি জাতির একক আধিপত্যের শৃঙ্খলে আত্মসমর্পণ করে এ লড়াই চালাতে গেলে তা শাসক শ্রেণীর পুরনো কাঠামো থেকে কখনই বের হতে পারবে না।
রাজনৈতিক নীতি দর্শনে ‘জাতীয়তাবাদ’ ধারণা ও চর্চার জন্ম ইউরোপে। জাতি ও জাতি রাষ্ট্রের পাশাপাশি ইউরোপে ‘জাতীয় চেতনা’ও পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের সময়ই স্পষ্ট হতে থাকে। পুঁজিবাদের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে সমাজ অর্থনীতি গঠন, নতুন শ্রেণীর উদ্ভব এবং সমাজ চেতনার মধ্যে যে পরিবর্তনগুলো আসে, তার মধ্য দিয়ে জাতি, জাতি চেতনা এবং জাতীয় রাষ্ট্রের চেহারা স্বচ্ছ হতে থাকে। জাতীয় সীমানা, রাষ্ট্র, বাজার, সরকার ইত্যাদির উদ্ভব যে সব দেশে একইভাবে হয়েছে তা নয়। কোথাও ভাষা, কোথাও ধর্ম, কোথাও রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে।
ইউরোপে অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকেই পুরনো সাম্রাজ্যগুলোর ভাঙন স্পষ্ট হতে থাকে। দূর বাণিজ্য, উপনিবেশ বিস্তার, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে যে বণিক শ্রেণীর উদ্ভব ও বিস্তার ঘটে, তারাই পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া শ্রেণী হিসেবে ক্রমে সামন্তবাদের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে সংগঠিত হয়। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর সামন্ত রাজত্বের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক লড়াই বিস্তৃত হয়।
পুঁজিবাদের বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ বুর্জোয়া শ্রেণীকে নিজ ভূখণ্ডের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে তাড়া করে নিয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে অসম বিকাশ ছাড়াও দুর্বল রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর ওপর বৃহৎ সংগঠিত বুর্জোয়া শ্রেণীর দমন, দখল ও আধিপত্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে; পুঁজিবাদ প্রবেশ করে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের পর্বে। যেখানে নিপীড়ক জাতীয়তাবাদ, আর এর বিরুদ্ধে নিপীড়িতের জাতীয়তাবাদের মুখোমুখি অবস্থান দেখা যায়।
সাধারণভাবে একটি জাতি-রাষ্ট্র গঠনে একটি স্থিতিশীল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন হয়, যারা অভিন্ন ভাষা, ভূখণ্ড, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতিতে ঐক্যবদ্ধ থাকে। তবে এর ভিন্নতাও রয়েছে। একাধিক ভাষাভাষীর মানুষ নিয়ে রাষ্ট্র আমরা অনেকই দেখি, যেমন ভারত। ঔপনিবেশিক শাসনও যে কখনো কখনো একটি জাতীয় পরিচয় নির্মাণ করে, তার উদাহরণ অনেক আছে।
যেমন বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত বরাবরই ‘ভারতীয় জাতি’ পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ‘ভারতীয় জাতীয়তাবাদ’ পরিচয় দিয়ে অন্যসব পরিচয় আড়াল করতে চায়। কিন্তু তাতে এর ভেতরের বহু জাতির কণ্ঠ চাপা পড়ে না। হিন্দি চলচ্চিত্র, গান আর হিন্দুত্ববাদ দিয়ে যখন ভারতীয় পরিচয় দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়, তখন অহিন্দি দক্ষিণ তা প্রত্যাখ্যান করে, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মের বিক্ষোভ নানাভাবে প্রকাশিত হয়, উচ্চ বর্ণের আধিপত্যের বিরুদ্ধে নিম্ন বর্ণের কণ্ঠস্বর প্রতিবাদ করে ওঠে। বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে ‘জাতীয়’ ঐক্য অপরিহার্য, কিন্তু পুঁজিবাদ যে বৈষম্য ও নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে বিকশিত হয়, তার কারণে স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য সম্ভব হয় না। তখনই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের জন্য বলপ্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ভারতের ক্রমবর্ধমান সামরিকীকরণ এবং অভ্যন্তরীণ যুদ্ধের বিস্তার এরই ফল। ভারতের মতো বহু দেশে পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্রই হয়ে দাঁড়াচ্ছে নিজ নাগরিকদের বিরুদ্ধে বড় সন্ত্রাসী। এসব ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ হলো নিপীড়ন, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদের আরেক নাম।
বিশ্ব পুঁজিবাদী কাঠামোতে, জাতিসংঘসহ বহু ধরনের তত্পরতা সত্ত্বেও, বিভিন্ন প্রান্তে যে জাতি সমস্যা টিকে থাকছে, তা এর অন্তর্গত বৈষম্য ও নিপীড়ন ভিত্তির কারণে। প্যালেস্টাইন আর কাশ্মীর সমস্যা, সংঘাত, গণহত্যার কথা আমরা শুনছি ছোটবেলা থেকেই। তার সমাধানের নানা লেফট রাইটের পর যথারীতি সমস্যা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। শুধু প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, রোহিঙ্গাসহ বিশ্বের আরো বহু রক্তাক্ত অধ্যায় নয়; ইউরোপ, উত্তর আমেরিকায় বর্ণবাদ, শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থী তত্পরতাও তৈরি করছে নতুন নতুন রক্তাক্ত অধ্যায়। দেশে দেশে খ্রিস্ট, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বাড়ছে ধর্মোন্মাদনা, চরমপন্থী অন্য ধর্মবিদ্বেষী সন্ত্রাসী তত্পরতা।
২০০১ সাল থেকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ মডেলে বিশ্বজুড়ে হামলা জোরদার করার অজুহাত আরো বেড়েছে। একে একে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম সন্ত্রাসী শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যখন সন্ত্রাস দমনের অভিযানের কথা বলা হয়, তখন নিশ্চিত হয় যে, শান্তি মানে যুদ্ধ, সন্ত্রাস দমন মানে সন্ত্রাস বিস্তার। ইউরোপে শরণার্থী প্রবাহ এসবেরই পরিণতি।
বর্তমান বিশ্ব তাই জাতিগত, ধর্মীয় ও আঞ্চলিক সংঘাত, ঘৃণা ও বিদ্বেষে জর্জরিত। জগৎ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ না দেখলেও এসব ঘিরে যুদ্ধ, সন্ত্রাস আর চরমপন্থার বিস্তার দেখছে। অসহিষ্ণুতা, সহিংসতায় প্রতিদিন মরছে মানুষ। হঠাৎ করেই যেন মানুষ অনেক ক্ষুদ্র হয়ে গেছে। হয়ে গেছে নিরাশ্রয়। তাই বৃহৎ কোনো স্বপ্ন দেখার বদলে সে এখন নিজেকেই খোঁজে, মানুষে মানুষে সংহতির সম্ভাবনার দেখা ভুলে গিয়ে জাতি-ধর্ম বা অঞ্চলের পরিচয়ে নিজেকে সাজায় আর বাকি সবার বিরুদ্ধে। এখন যেন সবাই সবার শত্রু।
জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে নিজেরাই সংখ্যালঘু জাতির ওপর নব্য নিপীড়ক হিসেবে হাজির হওয়ার ঘটনাও আছে। এর সাক্ষাৎ দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকে বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আওয়াজে যে ক্ষমতার পালাবদল আমরা দেখেছি, তাতে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রান্তিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিগুলোর অবস্থান আরো প্রান্তিক হয়েছে। জাতিগত, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, হামলাও বিভিন্নভাবে বেড়েছে।
তাই শাসক শ্রেণীর ‘জাতীয়তাবাদী’ আওয়াজের বিপরীতে বর্তমান সময় জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হলো— প্রথমত, এ রাষ্ট্রের কাঠামোতে বসবাসরত সব জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষদের স্বীকৃতি, বৃহৎ ঐক্য এবং সবার মুক্তির এজেন্ডা হাজির করা; শ্রেণী ও লিঙ্গীয় বৈষম্য-নিপীড়নবিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের বৈশ্বিক আঞ্চলিক আধিপত্যের নানা আয়োজন থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা। তৃতীয়ত, ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ এ অঞ্চলের নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে সংহতির ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য অগ্রসর হওয়া; চতুর্থত, সব প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সর্বজনের মালিকানা প্রতিষ্ঠা; পঞ্চমত, মানুষ ও পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে, সামাজিক মালিকানা গুরুত্ব দিয়ে, শিক্ষা-চিকিৎসায় সর্বজনের অধিকার নিশ্চিত করে উন্নয়নের নতুন পথনকশা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়নের লড়াই এবং ষষ্ঠত, সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য ধারাবাহিক লড়াই।
বলাই বাহুল্য, জনপন্থী রাজনীতির বিকাশে নাগরিকদের সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া এসব কাজে গতি আসার অন্য কোনো পথ নেই।
(০৩ জানুয়ারী ২০১৯ তারিখে দৈনিক বণিকবার্তায় প্রকাশিত)