একুশে ফেব্রুয়ারির লড়াইয়ের মর্মকথা যদি আমরা স্বীকার করি, তাহলে প্রাথমিক কয়েকটি কথা আমাদের মাথায় গেঁথে নিতে হবে। এগুলো হলো, বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালি অধ্যুষিত দেশ হলেও কেবল বাঙালির বাসভূমি নয়; বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও কেবল মুসলমানের বাসভূমি নয়। এই বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক বৈচিত্র্য আমাদের সমস্যা নয়, সম্পদ। আমাদের ঐশ্বর্য। অথচ মুক্তিযুদ্ধের এ দেশে অন্যান্য জাতি, ধর্ম ও ভাষার অস্তিত্ব অস্বীকারের চেষ্টা নানাভাবে এখনো চলছে। সর্বশেষ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতেও একই কাজ করা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এ রকম অস্বীকৃতি গণতন্ত্রের ভিত্তি তৈরি হতে দেয় না। অবিশ্বাস, বিদ্বেষ আর সহিংসতাই কেবল বাড়ায়। এতে দিন শেষে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি ও ধর্মের মানুষেরও বিপন্নতা বাড়ে। তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে, উন্নয়ন ধারায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বাংলা ভাষাও এখন প্রান্তিক ভাষায় পরিণত হয়েছে।
যাই হোক, সারা দেশ থেকে বিভিন্ন সময় আমরা জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জীবন ও সম্পদ বিপন্ন হওয়ার খবর পাই। তার সঙ্গে পাওয়া যায় জমি দখলের খবর। উন্নয়নের নামেই অনেক দখল ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটছে। মুনাফার লোভ অনেক ক্ষেত্রেই জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতা এবং বিদ্বেষের চালিকাশক্তি। মধুপুরের বন কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রাম বা অন্য যেকোনো স্থান হোক না কেন, ঘটনার শেকড় খুঁজতে গেলে একই রকম ধরন পাওয়া যাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে এসব বিষয় ঘনীভূত হয়েছে অনেক দিন ধরে। এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, অগ্নিকাণ্ডসহ যেসব হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে দেখি, তার ক্ষেত্র বহুদিনে সৃষ্ট, সে কারণে এগুলো নতুন বা আকস্মিক নয়।
কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে রক্তপাত, সহিংসতা, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তার উত্স সন্ধান করলে মোটা দাগে দুটো কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত. উন্নয়ন প্রকল্প; যা মানুষ ও প্রকৃতির ওপর দীর্ঘমেয়াদে বিষফল বিবেচনায় না এনে প্রণয়ন করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত. জাতিগত অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি; আপেক্ষিকভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতি উপনিবেশ ধরনের সংস্কৃতি ও রাজনীতি।
৬০ দশকে এর শুরু, যখন বিদেশী ঋণ ও উপদেষ্টা-সহযোগে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লোভনীয় লক্ষ্য সামনে রেখে কাপ্তাই জলবিদ্যুত্ প্রকল্প করা হয়েছিল। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের কথিত উন্নয়ন দশকের এটি ছিল বড় অবলম্বন। সেই প্রকল্প অনুযায়ী বাঁধ নির্মিত হলো, সেই বাঁধের কারণে সৃষ্টি হলো কাপ্তাই লেক, ভেসে গেল রাঙ্গামাটির রাজবাড়ীসহ বৃহত্ জনবসতি। সেই অঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হলো, যারা সবাই সংখ্যালঘু জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষ। তথাকথিত ‘উন্নয়ন’-এর শিকার লাখো মানুষের ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন নিয়ে অনেক রঙিন গল্প ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা এখনো অমীমাংসিত। একটি অংশ এখনো উদ্বাস্তু। একাংশ এখনো ভারতে পরিচয় স্বীকৃতিহীন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। যে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ভাসিয়ে দেয়া হলো লাখো মানুষ, সেই বিদ্যুত্ উত্পাদনও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়নি। পরে বরং তার আরো অবনতি হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, আগের পরিকল্পনায় বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে গেলে আরেকটি বাঁধ দিতে হবে। উন্নয়ন দর্শন অভিন্ন হলে বিপর্যয় বা আক্রমণ এক জায়গায় থেমে থাকে না। এ রকম উন্নয়ন গল্প তাই সমতলেও অনেক শোনা যাচ্ছে : ফুলবাড়ী, সুন্দরবন, রূপপুর, মহেশখালী…।
জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের ফল হিসেবেই বাংলাদেশের উদ্ভব। তার পর এ অঞ্চলে জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যের অবসানই প্রত্যাশিত ছিল, সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জন্য বিদ্যমান সমস্যা স্বীকার করে তা সমাধানের দিকে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তা হয়নি, বরং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতিগত অস্বীকৃতি। সংবিধান প্রথমেই অস্বীকার করল যে, বাংলাদেশে শুধু বাঙালি নয়, অন্যান্য জাতিও আছে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের এ অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আগের জমে থাকা ক্ষোভ আরো বৃদ্ধি পেল। সংঘাত, অবিশ্বাস ও নিপীড়নের নতুন পর্ব শুরু হলো। এম.এন. লারমা প্রতিবাদ করলেন, প্রত্যুত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের আয়োজন শুরু হলো। শুরু হলো সশস্ত্র প্রতিবাদ, প্রত্যুত্তরে নিপীড়নের আয়োজন আরো সম্প্রসারিত হলো।
সে কারণে বাংলাদেশের সব মানুষ সামরিক শাসনের অধীনে আসার আগেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে সামরিক শাসন। বাংলাদেশের সব মানুষ যখন সামরিক শাসনের অধীনে, তখন এ অঞ্চল বাড়তি সামরিক শাসনের আওতায়। আর এ শাসনকালে আড়ালে সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতাবানদের হাতে জমি গেছে, সম্পদ গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা গেছে, বসত গেড়েছে। কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু ৭০ দশকের শেষে জাতিগত শাসন পদ্ধতির অংশ হিসেবে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরিব বাঙালিদের অর্থ, জমি ও কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হলো, তখনই জটিলতার শুরু। গরিব বাঙালিদের ঢাল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শুরু হলো নিপীড়ন, সহিংসতা ও জাতিগত বিদ্বেষের আরেক পর্ব। প্রকৃতপক্ষে গরিব বাঙালিদের জীবনও নিরাপদ হয়নি।
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এভাবে বাঙালি ‘সেটেলার’দের সংখ্যা বেড়েছে, ক্রমে কোথাও কোথাও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাবলি ক্রমে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব, অবিশ্বাস, সংঘাত ও সহিংসতা বাড়িয়েছে। অন্যদিকে নিরাপত্তা রক্ষার নামে পাহাড় উজাড় হয়েছে। রেশন, উন্নয়ন বাজেট, নির্মাণ, স্থাপনা ইত্যাদি ধরে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে; উন্নয়ন ও নিরাপত্তার অজুহাতে পাহাড় ইজারা হচ্ছে ব্যক্তির নামে। এগুলো ঘিরে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত। এদের মধ্যে অধিকাংশ বাঙালি হলেও নতুন সুবিধাভোগী কিছু পাহাড়িও আছে। এদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি অর্থাত্ সামরিকীকরণ অর্থাত্ অব্যাহত সহিংসতা উত্তেজনা অবিশ্বাস দরকার। এর শিকার প্রথমত. সংখ্যালঘু জাতির মানুষ, একই সঙ্গে এর শিকার অবশ্যই টেনে নিয়ে যাওয়া দরিদ্র বাঙালিরাও। ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলো অনিষ্পন্নই রাখা হয়েছে। জাতিগত স্বীকৃতি, বসতি-পুনর্বাসন ও উন্নয়ন দর্শনের সমস্যা বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তার ফলে শান্তিও আসেনি।
জাতিগত নিপীড়ন, বিদ্বেষ দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই। জাতিগত অসন্তোষ সামরিক উপায়ে সমাধান হয় না। এর চেষ্টা বিশ্বের কোথাও সফল হয়নি। শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কথাই যদি বিবেচনা করি, তাহলে দেখা যাবে এ কারণেই পাকিস্তান ভেঙেছে, এ কারণেই ভারতের এক-তৃতীয়াংশ এখন সামরিক শাসনের অধীনে, নিপীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা বাড়ছে, শ্রীলংকা বহু অশান্তির মধ্যে আছে এখনো। বাংলাদেশেও এ কারণেই স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ক্রমান্বয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মানুষের, রক্তক্ষরণ হচ্ছে সমাজ ও অর্থনীতির।
গত চার দশকে বাংলাদেশে তথাকথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দখলদার দুর্বৃত্তদের দাপট তৈরি হয়েছে; উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির গল্পের আড়ালে নদীনালা খালবিল বনজঙ্গল সবকিছু দখলে নেয়ার জন্য তারা মরিয়া, তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের কিংবা বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিশাল ভূমি ও সম্পদ তাদের আওতার বাইরে কী করে থাকে? জাতিগত সংঘাত আর নিরাপত্তাকে খুব জুতসই একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাবান দখল তত্পরতা চালাচ্ছে। আক্রান্ত হচ্ছে সব পর্যায়ের সাধারণ মানুষ। সেজন্য এতগুলো হত্যাকাণ্ড আর অগ্নিসংযোগের ঘটনা, কোনোটিরই যথাযথ তদন্ত বা বিচার হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।
আর তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে বারবার পাহাড়ি-বাঙালি, পাহাড়ি-পাহাড়ি সংঘাত, সহিংসতা, নিপীড়নের ঘটনা ঘটছেই। এর ভেতরের মূল কারণ দূর করার চেষ্টা নেই। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে শুধু এটাই স্পষ্ট হচ্ছে যে, জাতিগত নিপীড়নের দায় থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো মুক্ত হতে ইচ্ছুক নয়। একটি শক্তিশালী সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এ নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এ সূত্র ধরে দেশী-বিদেশী নানা ফাঁদ সৃষ্টি হওয়াও খুবই সম্ভব। সমতলের অন্যান্য অঞ্চলেও ঘটনার ধরন একই রকম।
এর ফলে কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অবশ্যই লাভবান। কিন্তু এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশ, ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়-সমতলের নানা জাতির মানুষের সঙ্গে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও। এ অবস্থার অবসানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি জনগোষ্ঠী আর তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। মূল কারণ সন্ধান ও তা দূর করতে সাধ্যমতো সব পর্যায়ের চেষ্টাই জোরদার করা দরকার। সব জাতি ভাষা ও ধর্মের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, সবার মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার, তাদের জমি ও সাংস্কৃতিক অধিকারের নিশ্চয়তা, সর্বোপরি মানুষ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে উন্নয়ন দর্শন পুনর্বিন্যাস নিয়ে পাহাড়ে-সমতলে ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার থাকার মধ্য দিয়েই পরিবর্তনের পথ তৈরি হবে। একুশের এটাই বার্তা।
(২২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তারিখে দৈনিক বনিক বার্তায় প্রকাশিত)