বাংলাদেশকে সর্বজনের জন্য উপযুক্ত বাসভূমি হিসেবে গড়ে তুলতে, সামনে অগ্রসর হতে, আমাদের যখন দরকার আরও অনেক গুরুতর বিষয়ে সমাজে বিতর্ক, রাজনৈতিক লড়াই তখন ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার’ এই দুটো অনিষ্পন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র রাজনীতি এক বিষচক্রের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। এক মাসেরও বেশি অতিক্রান্ত হল অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন, প্রায় অচল অবস্থায় দেশ ‘চলছে’। পেট্রল বোমা, সহিংসতা, খুন, আগুন, আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণে মানুষ দিশেহারা। পরিস্থিতি ভয়াবহ আরও এই কারণে যে এর শেষ কোথায় তার কোনো কূলকিনারা নেই তাদের সামনে। হিংসা, প্রতিহিংসা জমে জমে ক্রমেই আরও ভয়ঙ্কর চেহারা নিচ্ছে। দুঃস্বপ্নের যেন শেষ নেই।
৫ জানুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি এই এক মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৬৬ জন। এর মধ্যে পেট্রল বোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৩৯ জন। এদের মধ্যে শিশু, নারী, তরুণ, বৃদ্ধ, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী সব ধরনের মানুষই আছেন। সংঘর্ষ ও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ২৭ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশ বা র্যাবের গুলিতে নিহতের সংখ্যা ১১ জন। নিহতদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও দলছাড়া ক্ষুদে ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষ আছেন। গ্রেফতারের সঠিক সংখ্যা সরকার প্রকাশ করেনি। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
কারা পথে ঘাটে বাসে ট্রেনে নিষ্ঠুর প্রাণঘাতী হামলা চালাচ্ছে? এর উত্তরে সাধারণভাবে ধারণা করা হচ্ছে, সরকারও দাবি করছে, এগুলো করছে বিএনপি ও জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। হুকুমের আসামি হিসেবে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হয়েছেন, খালেদা জিয়া প্রায় অন্তরীণ অবস্থায় আছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবি, এসব সন্ত্রাসী ঘটনা সরকারই ঘটাচ্ছে আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য। হাজার হাজার গ্রেফতার করা হলেও এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করা ও তাদের বিচারের আওতায় আনার ব্যাপারে পুলিশ-র্যাবের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ঘটনা যারাই ঘটাক, যেহেতু হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির মধ্যে এসব ঘটনা ঘটছে সেজন্য এর প্রধান দায়িত্ব বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের। তবে যারা ক্ষমতায় থাকে ভালো-মন্দ সবকিছুর দায় তাদেরই নিতে হয়, নাগরিকদের নিরাপত্তা বিধানের মূল দায়িত্ব সরকারের। সন্ত্রাসে সরকারের কোনো বাহিনীর কোনো ভূমিকা আছে কি না সেটা জানা সম্ভব নয়, কিন্তু এতটুকু পরিষ্কার যে, তার গৃহীত পথ ও পদ্ধতিগুলো পরিস্থিতির ভয়াবহতা দূর করতে কোনো কাজে আসছে না।
অনেক বাগাড়ম্বর আস্ফাালন আমরা শুনছি। তাতে আমাদের স্বস্তি আসছে না। ১৯ জানুয়ারি সরকারের অন্যতম মুখপাত্র মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছিলেন, ‘কথা দিলাম, আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ ২৮ জানুয়ারি বিজিবির মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কেউ বার্ন ইউনিটে আসবে না।’ পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তাদের মুখেও বেশ কয়েকবার কঠিন হুমকি ও আশ্বাস শোনা গেছে। বলেছেন, সব সন্ত্রাসীর তালিকা করা হয়েছে। শিগগিরই সব দমন করা হবে। দেখামাত্র গুলির কথা তাঁরাও বলেছেন। নেতা মন্ত্রীরাও বলেছেন, বলেছেন সরকারের এটর্নি জেনারেলও। ‘দেখামাত্র গুলি’তে মানুষ মরছে, নির্বিচারে গ্রেফতার হচ্ছে, দমনপীড়ন অব্যাহত আছে, কিন্তু চোরাগোপ্তা হামলা কমছে না। পথে ঘাটে পেট্রল বোমা হামলার শিকার যেমন সাধারণ মানুষ, নির্বিচারে গ্রেফতার ও দমনপীড়নের শিকারও সাধারণ মানুষই।
বিএনপির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর তার সঙ্গী জামায়াতের মূল এজেন্ডা যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা, ইতোমধ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্ত করা। ৪৪ বছর হতে চলেছে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড়ায়নি। যে কারণে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রতিবারই অশান্তি ও সহিংসতা তৈরি হয়। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবির আন্দোলন কেন্দ্র করেই সৃষ্ট সহিংসতায় নিহত হয়েছিলেন ৮২ জন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০১ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ৯৬ জন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবিতে সৃষ্ট সহিংসতায় ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে ৩২ জন এবং ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ৮ ডিসেম্বর ৫৯ জন নিহত হন (তথ্যসূত্র : প্রথম আলো, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। এছাড়া জখম ও সম্পদ ধ্বংসের সব হিসাব পাওয়াও প্রায় অসম্ভব।
বহু আগেই যুদ্ধাপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল। তা এখনও শেষ তো হয়ইনি, বরং দেশের রাজনীতিতে একটি বড় বিষফোঁড়া হয়ে আছে। সামরিক শাসনের প্রশ্রয়ে যুদ্ধাপরাধীরা সংগঠিত হয়েছে। ১৯৯১ থেকে দুই নেত্রীর নেতৃত্বাধীন দলগুলো বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে আঁতাত করায় তাদের বিপদ ভঞ্জন হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতার অংশীদার করে তাদের আরও শক্তিদান করেছে। যে সময়ে যে রাজনীতির প্রক্রিয়ায় এগুলো ঘটেছে সেই একই রাজনীতির আধিপত্যের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে লুটেরা কোটিপতি, বেড়েছে দুর্নীতি ও সম্পদ পাচার। দখল লুণ্ঠনে বনজঙ্গল, নদী খাল খোলা জমি সর্বজনের হাতছাড়া হয়েছে। কমিশনভোগীদের দাপটে স্বাক্ষরিত হয়েছে নানা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি। কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি, স্বচ্ছতা দাঁড়ায়নি, জবাবদিহিতার জায়গাও তৈরি হয়নি। সংবিধানের ধারাবলে এযাবত্কালের সব সরকারই এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দেশি ও বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠী, জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। ক্ষমতায় যেতে পারলে লুণ্ঠন দখল আর যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা। এ কারণেই এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ধরে রাখা বা তা দখলে নেওয়ায় তৈরি হয়েছে উন্মাদ জনধ্বংসী রাজনীতি।
এই রাজনীতির ধারাবাহিকতার মধ্যেই বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তির দিন থেকে এই শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি। যে ধরনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে তাতে এই সরকারকে ‘স্বনির্বাচিত সরকার’ই বলতে হবে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দুর্বলতার কারণে আইনগত বৈধতা থাকলেও এর সামাজিক ও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। যেকোনো রাজনৈতিক দল যার জনভিত্তি থাকে তার জন্য এ রকম নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসীন হওয়া এবং থাকা সম্মানজনক নয়। নিজের দুর্বলতার কারণেই সরকার দিনে দিনে আরও বেশি বেশি স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠছে, নিজের দুর্বলতা ঢাকতে গিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরের অনেক শক্তির কাছে আপস করছে। ছাড় দিতে হচ্ছে অনেক কিছু। দেশি-বিদেশি অনেকের দাবি-আবদার মানতে হচ্ছে। অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির ওপর ভর করে চলতে হচ্ছে। জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষা করতে হচ্ছে।
সরকারের ভূমিকার কারণেই বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোট নিজেদের অতীত কলঙ্ক আড়াল করে পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের বছরপূর্তির দিনে তারা বিশাল সভা-সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার আতঙ্কিত হয়ে তা বন্ধ করতে গিয়ে শুরু সন্ত্রাসের বিস্তার। পুলিশ, র্যাবের এমনিতে অনিয়ন্ত্রিত ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, সেই ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে। নামানো হয়েছে বিজিবি ছাড়াও দলীয় বিভিন্ন বাহিনী। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুন-গ্রেফতার বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
জনস্বার্থে কাজ করলে জনগণের ওপরই ভরসা করতে পারত সরকার, সভা-সমাবেশ নির্বাচন কোনো কিছু নিয়েই সরকারের ভয় থাকত না। কিন্তু নিজ ভূমিকার কারণেই তার সেই ভরসা নেই, সেজন্য তাকে ভর করতে হচ্ছে বল প্রয়োগের ওপর। সন্ত্রাসী রাজনীতি ও লুটেরা অর্থনীতির সঙ্গে নাড়ির যোগ বিএনপি-জামায়াত জোটেরও। জনসমর্থনের ওপর ভর করলে তার ডাকে জনস্রোত নামত, সব বিধিনিষেধ নিষেধাজ্ঞা অচল হয়ে যেত। কিন্তু জনগণ আসেনি, নামেনি। কারণ তার কাছ থেকে ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা করার মতো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। তাই আমরা দেখি, একদিকে জনগণ ছাড়া নির্বাচন, অন্যদিকে জনগণ ছাড়া আন্দোলন। বর্তমানকে দখল করতে গিয়ে ক্ষমতার রাজনীতির দুই পক্ষ বাংলাদেশের ভবিষ্যেক আরও ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ঘরে-বাইরে পথে-ঘাটে আতঙ্ক-সন্ত্রাসে মানুষের প্রশ্ন এখন একটাই-বর্তমান অচলাবস্থার কী হবে? কবে এই আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে? কাণ্ডজ্ঞান থেকে বুঝি যে, বর্তমান অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া খুবই সম্ভব। সমস্যা হল, যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে সমাধান তাদেরই হাতে। সমাধানের প্রথম আশু পথ : বিএনপি জোট অবরোধ হরতাল প্রত্যাহার করবে, সন্ত্রাসী তত্পরতা বন্ধ করবে। পেট্রল বোমা আগুন চোরাগোপ্তা হামলা বন্ধ করে সভা-সমাবেশে আসবে। দ্বিতীয়ত, সরকার দমনপীড়ন বন্ধ করবে, ঘোষিত-অঘোষিত সব অগণতান্ত্রিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করবে। ক্রসফায়ার, গ্রেফতার বাণিজ্য বন্ধ করবে। আর তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে এই বছরের মধ্যে স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এই নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী ও লুটেরা বাদে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। এর মধ্য দিয়ে সাময়িক সমাধান নিশ্চয়ই হবে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে সর্বজনের চিন্তা ও রাজনীতি না দাঁড়ালে বারবার এই বিষচক্রের রাজনীতির পাকেই হাবুডুবু খেতে হবে।
(৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সকালের খবরে প্রকাশিত)