স্বাধীনতার সময়ে বাংলাদেশ ছিল সব অর্থেই গ্রাম ও কৃষিভিত্তিক। জাতীয় আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসত কৃষি থেকে। কর্মসংস্থানের প্রায় ৯০ শতাংশ কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতেই হতো। সে সময়ের তুলনায় গত চার দশকে কৃষির উৎপাদন অনেক বেড়েছে কিন্তু আনুপাতিক হারে এর চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে অকৃষি খাতের বিভিন্নমুখী তত্পরতা। সে কারণে জাতীয় আয়ে কৃষির অনুপাত অনেক কমে গেছে। সর্বশেষ হিসাবে খাদ্যশস্য ও শাকসবজির হার জিডিপিতে ৯ শতাংশ আর কৃষি, বনজ ও মত্স্য মিলিয়ে এ হার হলো ১২ শতাংশ। তবে কর্মসংস্থানের বৃহৎ অংশ এখনো কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতেই। এর বিপরীতে বৃহৎ খাত গঠন করেছে শিল্পের পরিবর্তে সার্ভিস সেক্টর বা পরিসেবা খাত। এর মধ্যে আছে ব্যবসা, পরিবহন, হোটেল রেস্তোরাঁ, শিক্ষা ও চিকিত্সাবাণিজ্য, দোকানপাট ইত্যাদি। শুধু পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্যই এখন জিডিপিতে কৃষির চাইতে বড় অংশ দখল করে আছে, ১৪ শতাংশের বেশি। শিল্প খাতের বিকাশকে পাশ কাটিয়ে কৃষিপ্রধান অর্থনীতি থেকে সার্ভিসপ্রধান অর্থনীতিতে বাংলাদেশের এই রূপান্তর খুব তাত্পর্যপূর্ণ।
৬০ দশকে যে ‘সবুজ বিপ্লব’ শুরু হয়েছিল, তা ছিল একসঙ্গে চারটি তত্পরতার প্যাকেজ। এগুলো হলো: প্রথমত, ইরি নামের উচ্চ ফলনশীল বীজ (উফশী) প্রবর্তন; দ্বিতীয়ত, এ বীজ যেহেতু অধিক পানি সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে যান্ত্রিক সেচের প্রবর্তন; তৃতীয়ত, এ বীজ যেহেতু অনেক পোকামাকড় আমদানি করে, সুতরাং কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার শুরু এবং চতুর্থত, এ বীজ যেহেতু জৈবিক সারে কাজ করে না; সুতরাং রাসায়নিক সার ব্যবহার শুরু। বীজ, নলকূপ, কীটনাশক ওষুধ, সার সবই আমদানি করে উচ্চমাত্রায় ভর্তুকি দিয়ে যাত্রা হয়েছিল। কোনো কোনো সার এবং বীজ বাদে বাকি সবই এখনো আমদানি করা হয়। এ ধারাতেই জাতীয় কৃষিনীতি ১৯৯৯তে ‘জৈবপ্রযুক্তির প্রবর্তন, ব্যবহার ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ’ অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে। এবং তার কাঠামোতেই তারপর থেকে যথাযথ বিচার-বিবেচনা ছাড়াই হাইব্রিড ও জিএমও বীজ চালু এবং কোম্পানিকেন্দ্রিক বীজনির্ভরতা স্থায়ীকরণের ক্ষেত্রে সরকার, বহুজাতিক বীজ ও রাসায়নিক কোম্পানি এবং বৃহৎ এনজিওর সম্মিলিত উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে।
গত কয়েক দশকে গভীর ও অগভীর নলকূপের সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। শ্যালোমেশিন পানি উত্তোলন ছাড়াও লাগসই নানা কাজে ব্যবহার হচ্ছে। নৌকাসহ পরিবহন এর মধ্যে অন্যতম। এ মেশিন ব্যক্তিমালিকানাধীন, বহু মালিক এখন ভাড়ায় এ মেশিন ব্যবহার করেন। চুক্তি অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে পানি দেয়া হয়। মালিক ছাড়াও পানির মেশিন ঘিরে মেকানিক, চালক ইত্যাদি গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। গ্রামে হালবলদের চেয়ে যন্ত্রনির্ভর চাষাবাদ এখন অনেক বেশি। বিভিন্ন ধরনের সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পও নেয়া হয় এগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিতভাবেই। নদী নালা খাল বিল ক্রমান্বয়ে শাসনের আওতায় আসে।
এসবের মধ্য দিয়ে গত চার দশকে ধানচালের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭২-৭৩ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১ কোটি টন, সর্বশেষ হিসাবে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ কোটি টন, বৃদ্ধি পেয়েছে চারগুণ। এ সময়ে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ গুণের কিছু বেশি। সেই অনাহার বা অর্ধাহারের জন্য এখন আর জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে দায়ী করা চলে না। তবে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও তা কার বিনিময়ে হয়েছে, সে হিসাব এখনো করা হয়নি। টেকসই পথগুলোর অনুসন্ধান বা পৃষ্ঠপোষকতাও করা হয়নি। অনেক বাঁধ এবং কাঠামোগত নির্মাণে বহু এলাকা উফশী চাষের উপযোগী হয়েছে, আবার বহু এলাকা শিকার হয়েছে স্থায়ী জলাবদ্ধতার। নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করায় বহু এলাকায় উফশী ফলন ভালো হলেও অন্যান্য শস্য ও জীবজগতে স্থায়ী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়েছে, বহু অঞ্চলের পরিবেশ-অযান্ত্রিক পানির যোগান— জৈবসার উপযোগী দেশী বীজ হারিয়ে গেছে। ভূগর্ভস্থ পানি নির্বিচারে উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ভারসাম্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর সঙ্গে যোগ আছে পানিতে আর্সেনিক দূষণের। বাংলাদেশে অধিকাংশ গ্রামের মানুষ এখন আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে আছেন।
মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কীটনাশক ওষুধ আর রাসায়নিক সারের ব্যবহার বৃদ্ধি এখন উন্মাদনার পর্যায়ে। বাজারের বৈরী অবস্থা মোকাবেলা করে মুনাফা নিশ্চিতের জন্য এসব উপাদানের ওপর তার নির্ভরতা প্রয়োজনকেও অতিক্রম করে। স্বাধীনতার পর এসবের ব্যবহার যে হারে বেড়েছে, উৎপাদনশীলতা বেড়েছে সে তুলনায় অনেক কম। অন্যদিকে সার-কীটনাশক আমদানি, সংগ্রহ, বিতরণ নিজেই একটি অর্থনৈতিক তত্পরতায় পরিণত হয়েছে। এগুলোর আমদানি, বিপণন ডিলারশিপে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য এবং এটি কৃষির উৎপাদনের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে বেশি লাভজনক। এগুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের চেষ্টা থাকে এগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধির। ১৯৭২-৭৩ সালে বিভিন্ন রকম সারের ব্যবহার ছিল মোট প্রায় ৪ লাখ টন। ২০১৫ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টন। ৪ গুণ খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সার ব্যবহার বেড়েছে ১০ গুণেরও বেশি।
বাজার যেহেতু লক্ষ্য, সেহেতু বেশি উৎপাদন বা আকর্ষণীয় চেহারা প্রদানের কাজেও নিয়োগ ও বিনিয়োগ ঘটেছে। অধিক উৎপাদনের জন্য, তাড়াতাড়ি পাকানোর জন্য, অধিক ওজনের জন্য সার ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, টকটকে দেখানোর জন্য রং দেয়া ইত্যাদি তত্পরতা এখন অনেক বেড়েছে। রঙের কারখানা, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসা ইত্যাদিও বেড়েছে। সার কীটনাশক ইত্যাদির ব্যাপক বৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদে জমির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে, পানির ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব আরো বেশি। দেশে পানির প্রবাহ এমনিতে বিভিন্ন প্রকল্পের আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার ওপর যে নদীনালা খালবিল অবশিষ্ট আছে— সেখানকার প্রাণজগৎ সার-কীটনাশকের প্রত্যক্ষ শিকার। এর অন্যতম প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত দেশী মাছ।
ভারতের ফারাক্কা, গজলডোবা বাঁধসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আগ্রাসনে আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশের নানা প্রকল্পে দেশে নদীর পানিপ্রবাহ বিপর্যস্ত। স্বাদু পানির দেশী মাছ এক ধরনের সাধারণ সম্পত্তিই ছিল, যা এখন আর নেই। বিভিন্ন ইজারা প্রক্রিয়ায় ভালো মাছের আনাগোনা আছে এমন নদী বা খালবিল এখন প্রায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি। বাকি খালবিল-ডোবা অঞ্চলে এ মাছের যোগান কমেছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছের চাষ বেড়েছে অনেক। প্রায় প্রতি গ্রামেই এখন মত্স্য খামার আছে। এ মাছ বেশির ভাগ আমদানি করা জাতের, যেগুলোর উৎপাদন দ্রুত হয়, ওজন বেশি থাকে। কেননা এখানে লক্ষ্য বাজার ও মুনাফা। এসব পুকুর-ডোবায় মাছ চাষ হয় পরিকল্পিতভাবে। এখানে বিনিয়োগ, নিয়মিত তদারকি এবং ওষুধপত্র লাগে। আর মালিকানা বা ইজারা নেয়ার ক্ষমতা তো লাগেই। গ্রামের সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত বা ব্যাংক ইত্যাদিতে ভালো যোগাযোগ আছে এ রকম পরিবারগুলোর মধ্য থেকে গ্রামাঞ্চলে মত্স্য খামারকেন্দ্রিক একটি উদ্যোক্তা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে।
জিডিপিতে মত্স্য খাতের অনুপাত বৃদ্ধি সরাসরি মাছের এ বাণিজ্যিক চাষ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। এ বৃদ্ধির কারণে গত কয়েক বছর থেকে এটিকে পূর্ণাঙ্গ একটি খাত হিসেবে দেখানো শুরু হয়েছে। চিংড়িসহ মাছের একটি ভালো অংশ এখন বিশ্ববাজারকে লক্ষ্য করে উৎপাদিত হয়। এ কাজে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থান এবং পৃষ্ঠপোষকতাও আছে। উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি ঘের একদিকে দখল, জবরদস্তি, সহিংসতা বৃদ্ধি এবং অন্যদিকে চাষের জমি ও ফলের গাছ বিরান করবারও একটি ক্ষেত্র।
আশির দশক থেকে গ্রামে মুরগির খামারও অনেক বেড়েছে, দ্রুত মুরগি উৎপাদনের জন্য নানা ওষুধসামগ্রী বিপণন তত্পরতাও গ্রামাঞ্চলে উল্লেখযোগ্য হারে এখন দৃশ্যমান। এছাড়া আছে ছোট ছোট ডেইরি; আড়ং, মিল্কভিটা, প্রাণ ইত্যাদি দুধ বাজারজাতকরণের কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত প্রক্রিয়া হিসেবেই এগুলো বিকশিত হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে সবজি ও ফলচাষের উদ্যোগও ক্রমবর্ধমান। বিক্রেতা পর্যায়ে দাম না পেয়ে সংকট ও ঋণগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাও একইভাবে দেখা যাচ্ছে প্রচুর। এসব সংকট এ ক্ষেত্রগুলোয় ক্রমে ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের বিতাড়ন করে একচেটিয়া গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটাচ্ছে। শহরগুলোয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের চেইন ধীরে ধীরে একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছে।
গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর ৮০ দশক থেকে অনেক বেড়েছে। গ্রাম থেকে ঢাকা, ঢাকা হয়ে অন্য কোনো দেশ। শহরে-গ্রামে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেরও বিকাশ ঘটেছে এ সময়। স্বনিয়োগভিত্তিক কাজের অনুপাতও বেড়েছে। এছাড়া রিকশা, অটোরিকশা, বাস-ট্রাক, টেম্পোসহ বিভিন্ন পরিবহন, হোটেল রেস্তোরাঁ, ছোট বড় দোকান ইত্যাদি বেশির ভাগ মানুষের অস্থায়ী নিয়োজনের জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘টুকটাক অর্থনীতি’ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমজীবী মানুষের প্রধান কর্মক্ষেত্র। এসব খাতে বেশির ভাগ কাজ অস্থায়ী, অনিয়মিত ও মজুরি নিম্নমাত্রার। তার পরও এ পথেই গ্রামের মানুষের শহরমুখী প্রবাহ। ৮০ দশক থেকে সড়ক যোগাযোগ যেভাবে প্রসার লাভ করে, তা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অর্থনৈতিক তত্পরতাকে দেশের কেন্দ্রীয় এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করার প্রক্রিয়াকে জোরদার করে।
৯০ দশক থেকে টেলিযোগাযোগও অনেক সম্প্র্রসারিত হয়েছে। থানা পর্যায় পর্যন্ত টিঅ্যান্ডটির টেলিফোন সরাসরি সংযোগ এ দশকেই সম্পন্ন হয়। ৯০ দশকেই ইন্টারনেট এবং মোবাইল প্রযুক্তি চালু হয়। গ্রামপর্যায় পর্যন্ত মোবাইল টেলিফোনের ব্যাপক প্রসার ব্যক্তি ও পরিবারের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক তত্পরতায় খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলও এখন অনেক গ্রামে সুলভ। মোবাইল, টিভি সম্প্রসারণ গ্রামে নতুন নতুন অনেক অর্থনৈতিক তত্পরতার জন্ম দিয়েছে, পেশার জন্ম দিয়েছে; আবার নতুন অনেক পণ্যের চাহিদারও সমপ্রসারণ ঘটিয়েছে। অনেক অপরাধমূলক তত্পরতাও এখন এ প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে জোরদার হয়েছে।
রেমিট্যান্স গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির বিশেষ চালিকাশক্তি এখন। প্রায় এক কোটি মানুষ এখন প্রবাসে, যার বিপুল অধিকাংশ গ্রাম থেকে গেছেন। তাদের প্রেরিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বাজার বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণ গ্রামাঞ্চলে অকৃষি খাতে ব্যক্তিক বাজারমুখী তত্পরতা বৃদ্ধি করেছে। এ ঋণের বৃদ্ধির সঙ্গে গ্রামে ছোট দোকান, রিকশা, ভ্যান, বিক্রির জন্য হস্তশিল্প, বিক্রির জন্য হাঁস-মুরগি, চিড়ামুড়ি ইত্যাদির বৃদ্ধির ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। এছাড়া এ ঋণ অনেক খুদে মহাজনও তৈরি করেছে। ৮০ দশক থেকে পল্লীবিদ্যুতের মাধ্যমে এখন শতকরা প্রায় ৬০টি গ্রামে বিদ্যুৎ আছে। গ্রামে টিভি-ভিসিডি ক্যাসেট প্লেয়ারের চাহিদা বেড়েছে, এর দোকান মেকানিক কিংবা শো-নির্ভর পেশা ও তত্পরতাও বেড়েছে। বিজ্ঞাপন আবার আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা তৈরি করে। গ্রামপর্যায়ে এখন কম দোকানই পাওয়া যাবে, যেখানে বিষাক্ত সফট ড্রিংকস বা চিপসজাতীয় খাবার পাওয়া যায় না।
গ্রাম ও শহরের বাণিজ্যিক যোগাযোগ এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। গ্রাম থেকেও বহুকিছু বাইরে যায়, জেলা শহর, রাজধানী, এমনকি বিদেশেও। আবার বিদেশ বা ঢাকা শহর থেকে নিয়মিত বিভিন্ন পণ্য গ্রাম পর্যন্ত যাচ্ছে। এর ফলে পরিবহনসহ এ ব্যবসাতেও এখন অনেক বিনিয়োগ হচ্ছে। গ্রামে বাজারের টানে উৎপাদন বা কর্মতত্পরতা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। খাদ্যশস্য, সবজি, ফল, দুধ, ডিম, হস্তশিল্প, চিড়ামুড়ি, মাছ ইত্যাদি এখন প্রধানত বাজারকে লক্ষ্য করেই উৎপাদন হয়। আত্মপোষণমূলক খামারের সংখ্যা এখন দ্রুত হ্রাসমান। বাজারের চাহিদা বিবেচনা করেই এখন জমি, পুকুর, খালি জায়গা নতুন নতুন পরিকল্পনার মধ্যে আসছে। খাসজমি দখল, নদীনালা-খালবিল বন্দোবস্ত নেয়া ইত্যাদির প্রত্যক্ষ লক্ষ্য এখন মুনাফাকেন্দ্রিক কোনো তত্পরতা শুরু করা। উল্টো বর্গা বেড়েছে। জমির দাম বেড়েছে দ্রুত হারে। সরকারের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ নানা প্রকল্পে আবাদী জমির ওপর চাপ বাড়ছে।
মজুরি বা বেতনের বিনিময়ে কিংবা উপার্জনমুখী কাজের সঙ্গে নারীর সম্পৃক্ততা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেড়েছে ৮০ দশক থেকে। তবে এসব কাজের সঙ্গে না থাকা মানে কাজ না করা নয়। প্রথাগতভাবে নারীরা এ দেশে যেসব কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, সেগুলো অর্থনৈতিক কাজ হিসেবেই স্বীকৃত ছিল না। এর বেশির ভাগ যেমন কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্তশিল্প, হাঁসমুরগি-গরুছাগল প্রতিপালন, শাকসবজি উৎপাদন, ফলগাছ দেখাশোনা, পরিবার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজ দুভাবে অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে। এর একটি হচ্ছে ব্যয় হ্রাস এবং অন্যটি আয় বৃদ্ধি। এ বিবেচনায় নারী সব সময়ই অর্থনৈতিক কাজ করে আসছে। কাজের সংজ্ঞা পরিবর্তনের ফলে এখন এর কিছু কিছু স্বীকৃত, তবে পুরোটা নয়। ক্ষুদ্রঋণ আর এনজিও কার্যক্রম ডিম-দুধ-কাঁথা-হস্তশিল্প উৎপাদন ইত্যাদি কাজকে পারিবারিক ও সামাজিক গণ্ডি থেকে বের করে বাজারের আওতায় এনেছে। আগের তুলনায় নারীর দৃশ্যমান সচলতা এখন বেশি। পাশাপাশি যৌন নিপীড়ন ও তার বিরুদ্ধে ছোট বড় প্রতিরোধ এখন নিয়মিত খবর।
গ্রামে জমি, কাজ ও আশ্রয় থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি শিশু ও নারীর তুলনায় আক্রান্ত করে বেশি। অর্থনৈতিক সংকটে রোজগারী পুরুষের পরিবার ত্যাগ, অসুস্থতা, মৃত্যু অনেক নিম্নআয়ের পরিবারে নারীর আয় রোজগারে যুক্ত হওয়ার একটা বাধ্যবাধকতা হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেছে। এভাবে যোগান সম্প্রসারিত হয়। অন্যদিকে রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলোয়, গার্মেন্টস কিংবা চিংড়ি, নারী শ্রমিক নিয়োগের আগ্রহ ‘নারী শ্রমিকের’ চাহিদাও তৈরি করে। এনজিও কাজের বিকাশ তার কর্মী হিসেবে এবং ক্ষুদ্রঋণ বিস্তারের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন অর্থনৈতিক তত্পরতার বিস্তার বিভিন্ন কাজে নারীকে যুক্ত করে।
৭০ দশকে উদ্ভবকালে বাংলাদেশে এনজিওগুলোর সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। আর বাজেট, লোকবল, কর্মপরিধির দিক থেকে এগুলোর মধ্যে তফাৎও খুব বেশি ছিল না। আর সে সময়ে বেশির ভাগ এনজিও সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে উত্সাহী ছিল বেশি। ৯০ দশকে এসে এ দৃশ্যপটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এনজিওর সংখ্যা বেড়ে যায় প্রায় জ্যামিতিক হারে। ক্ষুদ্রঋণসহ বাণিজ্যিক তত্পরতায় তাদের মনোযোগ ঘনীভূত হয়। মেরুকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণ প্রক্রিয়ায় কয়েকটি বৃহৎ এনজিওই এখন এ খাত নিয়ন্ত্রণ করছে।
স্বাধীনতার পরপর গ্রামে কৃষকরাই, ছোট বড় মাঝারি সব মিলে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভূমিহীন জনগোষ্ঠীর হার তখন ছিল শতকরা ৩৩, সর্বশেষ হিসাবে এখন এই হার প্রায় ৬০। প্রান্তিক কৃষক যারা একটু সংকটেই ভূমিহীনদের কাতারে আসবেন কিংবা সেই কৃষকরা যারা জমি বন্ধকী দিয়ে তা ফেরত পাওয়ার ভুল আশায় নিজেদের এখনো জমির মালিক ভাবছেন, তাদেরসহ হিসাব করলে ভূমিহীন হার আরো বেশি হবে। আন্তর্জাতিক খাদ্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ গবেষণা (২০১৩) অনুযায়ী গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শতকরা ৮২ ভাগ সম্পদদরিদ্র। এরা সকলেই ক্ষেত ও দিনমজুর, যা গ্রামীণ মজুরের যোগান বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এই যোগান বছরের অধিকাংশ সময়ে কৃষিখাতে মজুরের যে চাহিদা, তার তুলনায় অনেক বেশি। আশ্বিন-কার্তিকসহ কয়েক মাসে এ চাহিদা আরো অনেক কমে যায়।
চাহিদা যোগানের এই ভারসাম্যহীনতায় ‘উদ্বৃত্ত’ গ্রামীণ মজুরদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখন ভাসমান, একটি অংশ স্থায়ীভাবে শহরে চলে এসেছেন, আরেক অংশ বছরের কিছু সময় গ্রামে কাজ করেন কিছু সময় শহরে করেন। সব মিলিয়ে গ্রামাঞ্চলে এখন গ্রামীণ মজুরশ্রেণী সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই শ্রেণীর বড় অংশ নির্দিষ্ট স্থান ও কাজে আটকে নেই। এ সচলতা শহর, রাজধানী থেকে দূর দেশে নিয়ে যায় তাদের। কাজের খোঁজে মানুষের বিদেশ গমনের অস্থিরতার সুযোগে বিপজ্জনক পথে মানবপাচার তত্পরতা বেড়েছে। এ খাতেও বিনিয়োগ কম নয়।
১৯৭৪ সালে আখলাকুর রহমান তাঁর বাংলাদেশের কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ এ ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদকে পেয়েছিলেন আচ্ছাদিত অবস্থায়, এখন সেই আচ্ছাদন অনেক সরে গেছে। তবে বাংলাদেশের কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির এ পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় ভূমি সংস্কারের কোনো কার্যকর ভূমিকা নেই। অর্থাৎ বাজার সম্পর্কের বিকাশ হয়েছে ভূমি মালিকানা ব্যবস্থা এবং ভূমি প্রশাসন অপরিবর্তিত রেখেই। পরিবর্তন হয়েছে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ এবং বাজার বিস্তারের লক্ষ্যে রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবিধ হস্তক্ষেপ এবং সেই সঙ্গে নতুন নতুন (আমদানিকৃত) প্রযুক্তির প্রবেশ থেকে। সেজন্য সমৃদ্ধি ও বঞ্চনা, গতি ও নাজুকতা এ প্রবল বৈপরীত্য একসঙ্গে নিয়েই গ্রামের পরিবর্তন ঘটছে।
(এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনার জন্য আনু মুহাম্মদ: গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতি (২০০০), কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ (২০০৮) এবং Bangladesh-A model of Neo-liberalism: The case of Microfinance and NGOs, Monthly Review, March 2015 দ্রষ্টব্য।)
[১৬ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে বণিকবার্তায় প্রকাশিত]