গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটে শিল্পকারখানা ও জনজীবনসহ সব পর্যায়ে ভোগান্তির মাত্রা কী দাঁড়িয়েছে, সে সম্পর্কে বর্ণনা অনাবশ্যক। প্রধানমন্ত্রী ও জ্বালানিমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘রাতারাতি এর সমাধান হবে না।’ রাতারাতি কেউ সমাধান চায়ওনি; রাতারাতি কেন, এই সরকারের এক বছর ক্ষমতাকালে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানও কেউ প্রত্যাশা করেনি। কিন্তু মানুষ এটা নিশ্চয়ই বিচার করছে যে এ খাতে গত দু-তিন সরকারের আমলে গৃহীত নীতি (পলিসি) ও দুর্নীতির কারণে যে সংকটের সৃষ্টি, এর সমাধানে এই সরকারের ভূমিকা কী? আগের নীতি ও দুর্নীতির কি কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে? বাগাড়ম্বর ও অস্বচ্ছতা, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা এবং ক্ষতিকর বা প্রশ্নসাপেক্ষ ফাইলপত্রের দ্রুত নড়াচড়া, বিভিন্ন লবিস্টের আকর্ষণীয় প্যাকেজ নিয়ে ঘোরাফেরা—সব ক্ষেত্রেই ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন আছে।
বিদ্যুৎ উত্পাদন বহুভাবে হতে পারে। গ্যাস, কয়লা, তেল দিয়েই সরাসরি বেশির ভাগ বিদ্যুৎ উত্পাদিত হয়। তবে বিশ্বব্যাপী পানি, বায়ু ও সৌরশক্তিচালিত বিদ্যুৎ উত্পাদন ক্রমেই বাড়ছে। এ ছাড়া পারমাণবিক শক্তিও আছে। জাপান, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কয়েকটি দেশ গ্যাস, তেল, কয়লা না থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধান করেছে। আবার নাইজেরিয়াসহ বহু দেশ বিপুল তেল, গ্যাস বা কয়লা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। আফ্রিকার মধ্যে সর্ববৃহত্ তেল রপ্তানিকারক দেশ নাইজেরিয়ায় এখন বিদ্যুৎ-সংকট ভয়াবহ। স্বাস্থ্য খাতে তাদের যে বাজেট, এর পাঁচ গুণ বেশি তারা ভর্তুকি দিচ্ছে জ্বালানি খাতে। ভেনেজুয়েলা তৃতীয় বৃহত্তম তেল মজুদের দেশ এবং অন্যতম তেল রপ্তানিকারক দেশ হয়েও এখন বিদ্যুৎ-সংকটে জর্জরিত। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ধরনে পরিবর্তনের কারণে ভেনেজুয়েলা এসব থেকে উত্তরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে আর নাইজেরিয়া আগের নীতি ও দুর্নীতিতে ডুবে থাকায় আরও গভীর খাদে পড়ছে। বাংলাদেশ এখনো এই দ্বিতীয় ধারার অন্তর্ভুক্ত।
নাইজেরিয়ার তুলনায় বাংলাদেশে অনবায়নযোগ্য সম্পদ অপ্রতুল। ৫০ বছরের সম্ভাব্য চাহিদা বিবেচনায় (১৬০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস ও কয়লার যতটুকু সন্ধান পাওয়া গেছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় শতকরা মাত্র ২৫ ভাগ। স্থল ও সমুদ্রে আরও অনুসন্ধানে সম্পদের প্রাপ্তি ঘটলে তা এই ঘাটতি কিছুটা কমাবে, কিন্তু এর পরও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কমই থাকবে। সে জন্য রপ্তানির বিধানযুক্ত তেল, গ্যাস ও কয়লা উত্তোলনের যেকোনো চুক্তি বাংলাদেশের জন্য খুবই বিপজ্জনক। বর্তমান পরিস্থিতিই এর প্রমাণ।
বছর দশেক আগে ‘বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে’ বলে এক শোরগোল তৈরি করা হয়েছিল। এই শোরগোলে মূল ভূমিকা ছিল বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর, সহযোগী ছিল মার্কিন দূতাবাস, বিশ্বব্যাংক, এডিবি, কতিপয় আমলা ও কনসালট্যান্টের। পাঠক, খেয়াল করুন, বর্তমানে চাহিদার তুলনায় ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকাতেই শিল্পকারখানাসহ সর্বত্র এত নৈরাজ্য। আর মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল চেয়েছিল বিবিয়ানা থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস রপ্তানি করতে। গণপ্রতিরোধের মাধ্যমে তা ঠেকানোর কারণে সে গ্যাস এখন বিদ্যুৎ ও গ্যাস উত্পাদনে কাজে লাগছে; সেই গ্যাসভিত্তিক সিএনজির বিস্তার ঢাকা মহানগরের কোটি মানুষকে পরিবেশদূষণের বিপর্যয় থেকে অনেকখানি রক্ষা করেছে। পরিবহনব্যয় কমেছে, কিন্তু বিপদ কাটেনি। কাটেনি বলেই বর্তমান সংকট।
বর্তমানে যে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট চলছে, এর সমাধানে গ্যাসের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। এর জন্য স্বল্প মেয়াদে যে পথগুলো আছে:
তিতাস ও হবিগঞ্জের মতো সমৃদ্ধ গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উত্তোলন বৃদ্ধি;
পেট্রোবাংলার কর্তৃত্বাধীন যে ১২টি গ্যাসকূপ এখন বন্ধ, সেগুলো চালু করা;
বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে যেসব গ্যাসক্ষেত্র আছে, এর বেশির ভাগেই এখনো অনুসন্ধান ও উত্তোলন করা হয়নি। নির্দিষ্ট মেয়াদে তা করতে তাদের বাধ্য করা, নয়তো চুক্তি বাতিল করা।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ পরিবহন লাইন মেরামত ও নবায়ন করা।
রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্ট মেরামত ও নবায়নে গুরুত্ব প্রদান এবং কম দামে বিদ্যুৎ উত্পাদন পাওয়ার জন্য এসব প্লান্টে গ্যাস সরবরাহে অগ্রাধিকার প্রদান। জরুরি ভিত্তিতে ক্ষুদ্র বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণের জন্য বেসরকারি দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুযোগদান।
নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং গ্যাসে রূপান্তর করে কয়লাসম্পদের নিরাপদ ব্যবহারের জন্য জাতীয় সংস্থাগুলোকে ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় সুযোগদান; আর সে জন্য—
জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ।
বর্তমান সংকট নিরসনে সরকার কী করছে এবং কী করছে না? এ সম্পর্কে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, ‘বর্তমান সরকার জরুরি ভিত্তিতে অন্তত ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের উত্পাদন বাড়াতে “ফাস্ট ট্রাক কর্মসূচি” নিয়েছিল। এর অধীনে প্রথমে আটটি কূপ খনন, একটি পুরোনো কূপে সংস্কার (ওয়ার্কওভার) এবং কয়েকটি স্থানে অনুসন্ধানের পরিকল্পনা ছিল।’ ঠিক ছিল পরিকল্পনা। ‘কিন্তু এখন পর্যন্ত এই কাজের জন্য দরপত্র-প্রক্রিয়াই শুরু করা হয়নি।’ কেন? এ ছাড়া ‘পেট্রোবাংলার অধীন তিনটি কোম্পানির মোট ১২টি কূপ থেকে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস উত্তোলন সাময়িকভাবে বন্ধ আছে। পেট্রোবাংলা সূত্রের দাবি, এই কূপগুলো থেকে কম সময়ে ও স্বল্প ব্যয়ে উত্পাদন শুরু করে দৈনিক সর্বনিম্ন ১৫ থেকে ২৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস তোলা সম্ভব’ (প্রথম আলো, ২৭ মার্চ ২০১০)।
লক্ষণীয়, ওপরের যেকোনো একটি কাজ করলেও বর্তমানে গ্যাসের ঘাটতি থাকার কথা নয়। এগুলো করার জন্য সরকারের বাড়তি অর্থ বরাদ্দেরও দরকার ছিল না। সিলেট গ্যাসক্ষেত্র ও বাংলাদেশ গ্যাসক্ষেত্র নিজস্ব বাজেট থেকেই এ কাজ করতে সক্ষম। জাতীয় সংস্থা বাপেক্সের কর্মক্ষমতায়ও শেকল পরিয়ে রাখা হয়েছে। উত্পাদন-খরচের চেয়ে কম দামে গ্যাস কেনা অব্যাহত না থাকলেই বাপেক্স ঝরঝরে অবস্থায় যেতে পারে। বন্ধ তিনটি কূপসহ অনেক নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে নিয়োজিত হতে পারে। কেন তা করতে দেওয়া হচ্ছে না?
যখন এসব কাজে জ্বালানি মন্ত্রণালয় নিষ্ক্রিয়, তখন এই সংকট মেটানোর কথা বলে আবার অন্যত্র তা খুবই সক্রিয়। এর মধ্যে আছে স্থলভাগে নতুন পিএসসি চুক্তি স্বাক্ষর এবং সমুদ্রবক্ষে পিএসসি ২০০৮ অনুযায়ী কনকো ফিলিপস ও টাল্লোকে গ্যাসক্ষেত্র ইজারা দান (প্রথম আলো, ২ এপ্রিল ২০১০)। কিন্তু এখন যে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র বিদেশি কোম্পানিগুলোর হাতে আছে, সেগুলোর বেশির ভাগ তারা অলস ফেলে রেখে পুরো দেশকে জিম্মি করে রেখেছে, সেগুলোতে অনুসন্ধানের জন্য চাপ দেওয়া হয়নি, এমনকি কোনো কোনোটি মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও নবায়ন করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পুরোনো চুক্তি বাতিল না করে কেন এই নবায়ন এবং কেন আবার একই ধরনের কোম্পানিগুলোর হাতে আরও নতুন নতুন ক্ষেত্র তুলে দেওয়ার আয়োজন? কেন এখনো শেভরন ও নাইকোর কাছ থেকে মাগুরছড়া বা টেংরাটিলার ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয়নি, যার পরিমাণ বর্তমানে জ্বালানি খাতে বার্ষিক বরাদ্দের পাঁচ গুণ? সব সময় আমরা সম্পদের অভাবের কথা শুনি। কিন্তু এই তহবিল দিয়েই তো জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তিসহ দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব।
কয়লা উত্তোলনের ক্ষেত্রে মালিকানা ছাড়াও পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনিতে ভূমিধস, বাড়িতে ফাটল ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার সমস্যা জনমনে খনি নিয়ে দুর্ভাবনা আরও বাড়িয়েছে। আবার এসব সমস্যাকে অজুহাত হিসেবে নিয়ে উন্মুক্ত খনির পক্ষেও প্রচারণা বাড়ছে। অথচ হিসাবে দেখা যায়, উন্মুক্ত খনির ক্ষতি এর হাজার গুণ বেশি। বলা হয়, এতে কয়লা উত্তোলনের হার অনেক বেশি। কিন্তু এই প্রচারণায় যা আড়াল করা হয়, তা হলো, এই বেশি উত্তোলিত কয়লা বিদেশি কোম্পানির মালিকানায় রপ্তানি হলে বাংলাদেশের কী লাভ। আর এর ফলে জনবসতি ছাড়াও দেশের তিনফসলি উর্বর আবাদি জমি, অমূল্য পানিসম্পদ নষ্ট হয়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা বিনষ্ট হলে এর দায় কে নেবে? সবকিছু বিনষ্ট করে উত্তোলিত কয়লা বিদেশে পাচার হলে বিদ্যুৎ উত্পাদন হবে কীভাবে?
এখনো বাংলাদেশের উর্বর মাটি, পানির স্তর ও জনবসতি বিবেচনা করে কী ধরনের পদ্ধতি কয়লাসম্পদকে দেশের কাজে লাগানোর জন্য সহায়ক, তা নিয়ে অনুসন্ধান, গবেষণা, আলোচনার উদ্যোগ নেই। অথচ এসব রক্ষা করেও কয়লাসম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব, যার মধ্যে ‘কোল গ্যাসিফিকেশন’ অন্যতম। ২০০৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বার্থ বিবেচনায় উন্মুক্ত খনন-পদ্ধতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে দৃঢ় ঘোষণা দিলেও এখন সরকারের তত্পরতা উল্টো। অর্থমন্ত্রীসহ সরকারের কেউ কেউ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্পাদনের পক্ষে জোর বক্তব্য দিচ্ছেন।
দীর্ঘ মেয়াদ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট সমাধানে দেশের নবায়নযোগ্য ও অনবায়নযোগ্য দুই সম্পদেরই সমন্বিত ব্যবহার প্রয়োজন হবে। নবায়নযোগ্য সম্পদের মধ্যে সৌরশক্তি বাংলাদেশে অসীম সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। অনবায়নযোগ্য সম্পদের মধ্যে নিশ্চিত ও সম্ভাব্য যে কয়লা ও গ্যাসের মজুদ আমাদের আছে, এর সর্বোত্তম ব্যবহারের নীতি দীর্ঘ মেয়াদে জ্বালানি-নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য। সর্বোত্তম ব্যবহারের অর্থ অবশ্য সবার জন্য এক নয়। বহুজাতিক কোম্পানির দৃষ্টিতে, দ্রুত যত বেশি সম্ভব উত্তোলন করে রপ্তানির মাধ্যমে উচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করাই হচ্ছে এসব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পথ।
আর জনগণের বর্তমান ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের স্বার্থের বিবেচনায় এসব সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের অর্থ হচ্ছে, প্রয়োজন অনুযায়ী এর উত্তোলন, যাতে দীর্ঘ মেয়াদে এর প্রতিটি বিন্দু ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ এবং জাতীয় অর্থনীতি বিকাশে শিল্প ও কৃষির প্রবৃদ্ধিতে কাজে লাগানো সম্ভব হয়। সে জন্য শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করে সমন্বিত জ্বালানি-নীতি অপরিহার্য। কিন্তু এদিকে সরকারের মন নেই।
বর্তমান সরকারি নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত, যার ফলে কয়লা ও গ্যাস নিয়ে, সংকটের সুযোগে, উচ্চ ব্যয়বহুল ও রপ্তানিমুখী চুক্তির তত্পরতাতেই জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সব উত্সাহ ও সক্রিয়তা। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা জন উইলিয়ামসন দেশে দেশে তাঁদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘these worst of times give rise to the best of opportunities.’ অর্থনীতি বিপর্যস্ত করে, জনগণের জীবন অতিষ্ঠ করে তাদের কাছ থেকে সর্বনাশা কাজে, অর্থাত্ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত জাতীয় স্বার্থবিরোধী বহুজাতিক কোম্পানির শৃঙ্খলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বলপূর্বক সম্মতি আদায়ের এই মডেল আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় অনেক দেখা গেছে। এখন তা-ই আমরা বাংলাদেশে দেখছি।
(এপ্রিল ৮, ২০১০ তারিখে দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)