গার্মেন্টস শ্রমিকের স্যান্ডেল আর খালিব্যাগের কথা

এই লেখা কয়েক বছর আগের। নাকি এখনকার? এ যেনো একই ঘটনার পুন পুন দৃশ্যায়ন। এর মধ্যে ডলারের বিশাল মজুদ তৈরি হয়। মালিকসহ দেশি বিদেশি ভাগীদাররা মোটাতাজা হয়। মৃতের তালিকায় যোগ হয় আধা খাওয়া, শীর্ণ, সকাল রাত রাস্তায় ছুটে চলা মানুষদের নতুন নতুন নাম।)

২৩ ফেব্র“য়ারি রাতে আবারো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে আগুনে পুড়ে ছাই হলেন শ্রমিকেরা, প্রধানত নারী। এবারে কত সংখ্যা? কেউ আসলে ঠিক বলতে পারে না। সন্ধ্যায় রাতের শিফটের জন্য বিশেষভাবে খাবারের কথা বলা হয়েছিল প্রায় হাজার শ্রমিকের। কতজন বের হতে পেরেছিলেন? যারা পারেননি কেন পারেননি?

সংবাদপত্রে সবকথা আসে না, যা আসে তার সবটার ওপর নানা কারণেই ভরসা করা কঠিন। সুযোগ করে আমি নিজেই যাই সেখানে। ফ্যাক্টরীর গেটে আমি যখন পোঁছাই ততদিনে তিনদিন পার হয়ে গেছে। কয়েকদিন পার হয়েছে বলেই গেটে কোন জোরদার পাহারা নেই। তবু ভেতরে ঢোকা নিষেধ। ওখানেই শুনলাম সেদিন সকালেই পাহারা শিথিল করা হয়েছে। আশেপাশে অনেক লোকজন, নারীপুরুষ বৃদ্ধ। কাছে ঘেঁষতে বাধা দিচ্ছে গার্ড, পুলিশ। এই কয়েকদিন এতদূরও আসতে দেয়নি। কারখানাটি গলির ভেতর। একটা ট্রাক ঢুকে সহজে বের হতে পারে না। ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি কী করে দরকারমতো আসবে এখানে? আসতে পারেনি সময়মতো।

আশেপাশে আরও কারখানা। এই কারখানায় যে আগুন লেগেছিল তা বাইরে থেকেই বোঝা যায়। কারখানার সামনে জমা পানি কালো হয়ে আছে। বাতাসে পোড়া গন্ধ এখনও। বলে কয়ে আমরা কয়েকজন ঢুকলাম পোড়া কারখানার ভেতরে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে যেরকম অপ্রশস্ত সিঁড়ি থাকে কিংবা সরু গেট থাকে এটা ঠিক সেরকম নয়। গেট একাধিক আছে, সিঁড়িও প্রশস্ত। কিন্তু সেই সিঁড়ির মধ্যে বিভিন্ন বস্তা রাখা, চারতলা পর্যন্ত সিঁড়ি যেন গুদাম হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। একাধিক গেট আছে কিন্তু গেটগুলো থাকে কড়া পাহারায় এবং বন্ধ।

কারখানার দোতলা তিনতলায় সব পোড়ার স্বাক্ষর। বাতাস ভারী। কয়েকদিন পার হয়ে গেছে, কিন্তু নি:শ্বাস নিতে তখনও কষ্ট হচ্ছিলো। আগুন লেগেছিল ২৩ ফেব্র“য়ারি সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। এরকম সময়ে আগুন লাগলে তো সাহায্য পাওয়া সহজ, বের হওয়াও তাই সম্ভব। সম্ভব হয়নি, কারণ সব গেট তখন বন্ধ ছিল। সাহায্য করবার লোকজনও কাছে ঘেঁষতে পারেনি। আগুনের ভয়াবহতা দেখে গেট খুলে দেবার পরিবর্তে চাবি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন পাহারাদার । কোথায়, কেন কেউ জানে না। সাধারণভাবে তার দায়িত্ব সবার ওপর গার্মেন্টসের জিনিষপত্র রক্ষা করবার। শ্রমিকেরা কাপড় চুরি করে নিয়ে যেতে পারে এই অনুমিতির ওপরই সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি।

চার তলা পর্যন্ত গেলাম। প্রতি তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শ্রমিকদের ব্যাগ আর স্যান্ডেল। চারতলায় কিছু মেশিন তখনও অক্ষত। সেজন্য মেশিনের সামনেই সব ব্যাগ, মেয়েদের ছোট ছোট ব্যাগ। কোথাও কোথাও টিফিন বক্স। আর নীচে ছড়ানো ছিটানো স্যান্ডেল। নানা রঙের কমদামি স্যান্ডেল। মানুষ নেই। ব্যালকনি মতো জায়গা থেকে নীচে তাকালে একতলা টিনশেড। শুনলাম এখান থেকে অনেকে লাফ দিয়ে সেখানেই পড়েছেন। কতজন? আর কতজন আটকে পড়েছিলেন এখানে কিংবা সিঁড়িতে? কেউ বলতে পারে না।

কয়েক তলা জুড়ে সারি সারি ব্যাগ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্যন্ডেলগুলোর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা কঠিন। বারবার এসবের পেছনের উপস্থিত-অনুপস্থিত মানুষদের কথাই মনে হয়। তারপরও ব্যাগগুলো দেখতে চাইলাম। একটা দুটো এবং একে একে অনেকগুলো। সবগুলো ব্যাগের ভেতরেই একই চেহারা। কিছু নেই, একেবারেই শূন্য! একদম!!

গার্মেন্টস এর কাজে নিয়োজিত এই তরুণী কিশোরী শ্রমিকদের ব্যাগে কী কী থাকার কথা? অনেক টাকা তো নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কিছু জিনিষ তো নিশ্চয়ই ছিল। কয়েকটা টাকা, রুমাল, হয়তো একটা সস্তা লিপস্টিক, হয়তো প্রিয়জনের চিঠি বা ছবি। আর একটা জিনিষ বটেই। কোন ব্যতিক্রম থাকবার কথাই নয়। সবার কাছে থাকতেই হবে। পরিচিতি পত্র, ছোট্ট এক টুকরো কার্ড। শ্রমিকের নাম আর কারখানার নাম লেখা। গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকদের কোন নিয়োগপত্র দেয়া হয় না। তার ফলে শ্রমিকদের হাতে নিজেদের ‘অধিকার’ সংরক্ষণের কোন কাগজও থাকে না। তাই তার কোন সংগঠনেরও আইনগত ভিত্তি নেই। শ্রমিকদের একমাত্র অবলম্বন এই পরিচয়পত্র। এটা দিয়েই তার বেতন, ওভারটাইমের জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়। আর এটাই তার একমাত্র অস্তিত্ব। যদি এই পরিচয়পত্র না থাকে তাহলে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর কাছে তার আর দাঁড়াবার জায়গাই থাকে না। আবার অনেকগুলো ব্যাগ নেড়ে দেখলাম সবগুলো ব্যাগই শূণ্য। কোন ব্যাগেই কিছুই নেই, পরিচয়পত্রও নয়। মরণের মুখে দাঁড়িয়ে, ছোটাছুটি করতে করতে কি শ্রমিকেরা নিজেরাই ব্যাগের জিনিষপত্র নিয়ে নিলো? পরিচয়পত্র বের করলো? তাহলে তাদের ব্যাগ নিয়ে স্যান্ডেল পড়ে গুছিয়েই তো ছোটাছুটি করবার কথা!

কারা তবে ব্যাগ থেকে এসব জিনিষ সরিয়েছে? কেউ যদি টাকাপয়সার লোভে এসব করে থাকে তাহলে সব ব্যাগ একেবারেই শূণ্য কেন? একটা টুকরো কাগজও নেই। হুড়োহুড়ি করে ব্যাগ থেকে কিছু নেবার ব্যাপার থাকলে তার স্বাক্ষরও থাকতো। সবকিছু গোছানো। চারতলায় সবগুলো ব্যাগই টেবিলের ওপর, ঠিকঠাকমতো। মালিক ও পুলিশের ভাষ্য কী তা সবাই অনুমান করতে পারেন, বলবেন, আগুন লাগার পর মানুষজন কারা বাইরে থেকে এসেছে তার তো শুমার ছিল না। তারাই হয়তো করে থাকবে। অনেক মানুষই এটাই বিশ্বাস করবে। ‘জনতার’ তো এসব উচ্ছৃঙ্খল কান্ডই করবার কথা। ব্যাগের ভেতরের জিনিষের প্রতি লোভ যে জনতার, ব্যাগের প্রতি তার লোভ নেই কেন? তার কেন স্যান্ডেলের প্রতি লোভ দেখা গেল না? শত শত স্যান্ডেল আর ব্যাগ পড়েই থাকলো, আর হুড়োহুড়ির মধ্যে গুছিয়ে শুধু ব্যাগের ভেতরের জিনিষ এবং অবশ্যই পরিচয়পত্রই নিয়ে গেলো ‘জনতা’ ? উচ্ছৃঙ্খল জনতা এতটা সুশৃঙ্খল?

না এই গল্প কোনভাবেই মেলানো যায় না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় আগুন লাগবার পর চারতলা ভবন জুড়ে মরণপণ চিৎকার হচ্ছিল, শ্রমিক মেয়েদের নিজেদের জীবনরক্ষার হুড়োহুড়ি চেষ্টা এক ভয়ংকর এবং অসম্ভব অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। আশেপাশের সব কারখানা ভেঙে শ্রমিকেরা এবং আশেপাশের অনেক মানুষ তখন ছুটে এসেছেন সাহায্য করতে। কেউ পানি নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ লাফ দিয়ে পড়া শ্রমিকদের রক্ষা করতে এগিয়ে যাচ্ছেন, কেউ আহতদের টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। যে কারণে মরতে থাকা শ্রমিকেরা গেট দিয়ে বের হতে পারেননি সেই কারণে বাইরের কারও পক্ষে কারখানার ভেতরে ঢোকাও সম্ভব ছিল না। কারণটি হল, সবগুলো গেটই বন্ধ ছিল। শ্রমিক মেয়েরা ছাদ, চারতলার তিনতলা দোতলার জানালা ব্যালকনি দিয়ে লাফ দিয়েছে। সিঁড়িতে গাদাগাদি করে লাভ হয়নি। গেট খোলেই নি পরদিন সকাল পর্যন্ত।

উপস্থিত ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতা’ গেট ভেঙে ফেলতেন নিশ্চয়ই, অন্তত একটা পথ বের করবার চেষ্টা করতেন। সেটাই উচিৎ ছিল। কিন্তু খুব দ্রুত সেখানে পুলিশ চলে আসে, পরে র‌্যাবও আসে। ঘেরাও করে ফেলে পুরো কারখানা। ধারে কাছে আর কারও যাবার উপায় ছিল না। পুলিশ র‌্যাব ছাড়া ভেতরে যাবার সুযোগ ছিল শুধু মালিকপক্ষের লোকজনেরই। এই পাহারা কয়দিন ধরেই ছিল। কতজন লাফ দিয়ে বাঁচলো বা মরলো, ভেতরে কতজন পুড়ে কয়লা হল তার কোন হিসাব তাই আশেপাশের উৎকন্ঠিত মানুষের জানা নেই। কতজনের লাশ সামনে এলো কতজনের লাশ গুম হল তার হিসাব তাই একমাত্র পুলিশ, র‌্যাব আর মালিক পক্ষই জানে।

কতজন মারা গেছে তার হিসাব কীভাবে করা যাবে? খুব সহজ। কতজন সেদিন কাজ করছিলেন আর তারমধ্যে কতজন বেঁচে আছেন, এই হিসাব করলেই সব পরিষ্কার হয়। কিন্তু এই পরিষ্কার চিত্রকে ঢেকে দিতে সব ব্যবস্থা পাকা । আমি সেদিনও অনেক স্বজনকে কারখানার সামনে দেখেছি অসহায় অস্থির খুঁজছেন কন্যা, বোন বা বান্ধবীকে। তাদের হাতে কোন প্রমাণ নেই। একমাত্র প্রমাণ তো সেই পরিচয়পত্র। সেগুলো তো কেবল শ্রমিকদের কাছেই থাকে। কিন্তু ব্যাগ তো শূণ্য! তাহলে প্রমাণ কোথায় যে তারা কাজ করতো এই কারখানায়?

এখানে কারা কাজ করতেন, এবং কতজন পুড়ে বা পিষ্ট হয়ে মারা গেলেন তার প্রমাণ এখন তাহলে কে দেবে? তাহলে মৃতের সংখ্যা মালিকপক্ষ যা বলবেন সেটাই মেনে নিতে হবে। অন্যদের স্বজনরা তাদের জীবিত বা মৃত কোন অবস্থাতেই না পেয়ে যতই বুক ফাটা কান্না করুক, যত অনুনয় বিনয় করুক, যত হাত পা ধরুক কোন পথ নেই। যেহেতু নিয়োগপত্র নেই, যেহেতু পরিচয়পত্র উধাও সুতরাং আর তো কোন প্রমাণ নেই। মজুরি তাদের কত পাওনা ছিল? কত বকেয়া জমেছিল তাদের? সেগুলোর পরিশোধেরও কোন সম্ভাবনা নেই। অগ্নিকান্ডের জন্য মালিক পাবে বীমার অর্থ আর তার বেঁচে যাবে বহু শ্রমিকের পাওনা টাকা। কারণ পাওনা টাকা চাইবার জন্য তাদের অনেকে বেঁচে নেই। আর কোন প্রমাণও নেই। প্রমাণ না থাকলে ক্ষতিপূরণও দেবার দায় নেই।

আগেই বলেছি, সন্ধ্যায় প্রায় একহাজার জনের রাতের খাবারের অর্ডার দেয়া হয়েছিল। তার মধ্যে কতজন গেট বন্ধ থাকা অবস্থায় আগুন পার হয়ে জীবিত অবস্থায় বের হতে পেরেছিলেন? মালিক পক্ষ বলছে ৬২ জন। এই সংখ্যার ভিত্তি কী? প্রমাণের কোন দরকার নেই। কারণ মালিকের পক্ষে সাক্ষ্য দেবার জন্য পুলিশ র‌্যাব কয়েকদিন কারখানা ঘিরে রেখেছিল। কারখানার গেটে একজন বৃদ্ধের সঙ্গে কথা হল। আরও অনেকের মতো তিনিও স্বজনের খোঁজে দিনের পর দিন এই কারখানার আশেপাশে ঘুরছেন। সেদিনই কেবল কারখানার গেটের কাছে আসতে পেরেছেন। তার মেয়ে ২২ তারিখ নাইট ডিউটি করেছে, ২৩ তারিখেও সারাদিন কাজ করেছে, তারপর চলে যাবার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। তার এক বান্ধবীর কথা অনুযায়ী, মালিকপক্ষ একপ্রকার জোর করেই তাকে কাজে ধরে রেখেছে। বলা হয়েছে সকালে কাজ শেষে সকলের জমে থাকা সব বকেয়া শোধ করা হবে। তারপর থেকে সেই মেয়ের এখনও কোন সন্ধান নেই।

বাংলাদেশে গার্মেন্টস এখন অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দিচ্ছে। বহু মালিক এই গার্মেন্টস করে এখন কোটিপতি। কিন্ত এখানে যারা কাজ করেন তারা এখনও শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃত নন, কার্যত তাদের জীবন দাসের জীবন। তাদের কাজের সময় ঠিক নেই। নিয়োগপত্র নেই। কাজের নিরাপত্তা নেই। মজুরি যার কম হতে পারে না সেরকম। সেই সামান্য মজুরিও বকেয়া থাকে। আবার এগুলো নিয়ে কথা বলবার জন্য সংগঠন করবারও অধিকার নেই। গার্মেন্টস শিল্পে মজুরি আর ওভারটাইম বকেয়া এখন কয়েক হাজার কোটি টাকা। তারপর কারখানার ভেতরে বাইরে যৌন নিপীড়ন। আর সর্বোপরি আগুনে পুড়ে মরণের ব্যবস্থা। মরণের পর যার অস্তিত্ব মুছে ফেলার ব্যবস্থা পাকা।

মে দিবসে এই মালিক আর তাদের সরকার অনেক কথা বলবে। শ্রমের মর্যাদার কথা তুলে আরও বেশি বেশি কাজ করতে বলবে শ্রমিক নামের দাস বাহিনীকে। আর স্থিরচিত্রের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা স্যান্ডেল আর খালি হাতব্যাগ নিষ্ঠুর এই মুনাফা জগতের সাক্ষ্য হয়ে থাকবে।

এই ঢাকা মহানগরীতেও সকালে বিকালে রাতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটে যেতে দেখি প্রতিদিন। এখন না চাইলেও আমার দৃষ্টি যায় ছুটে চলা মেয়েদের হাতের ব্যাগ আর স্যান্ডেলের দিকে। সামনে আবার কোথায় কবে সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট আরেক মালিকের কারখানা ধ্বসে পড়বে বা আগুন লাগবে? কাজের জন্য ছুটে চলা এই মেয়েদের মধ্যে কার কার স্যান্ডেল পরে থাকবে আর মালিকের নৃশংস হাত ওদের পোড়া বা পিষ্ট মৃতদেহের ওপর দিয়ে নিয়ে যাবে তাদের অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ পরিচয়পত্র? আর গার্মেন্টসের সাফল্যের ঢাক আরও জোরে বাজতে থাকবে চারদিকে?