গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ধর্মের উপস্থিতি

বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলের মতো দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও রাজনীতিতে ধর্ম এখন আগের যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি উপস্থিত। ধর্ম সামনে রেখে সহিংসতা, অসহিষুষ্ণতা, সন্ত্রাস বাড়ছে ক্রমেই। পাকিস্তান প্রথম থেকেই ইসলামী রাষ্ট্র। তবুও সেখানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীদের মধ্যে সহিংস সংঘাত কখনও কমেনি, বরং বেড়েছে। এই অঞ্চলের সবচাইতে বড় রাষ্ট্র ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হলেও সেখানে গত দুই দশকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটেছে অনেক। সর্বশেষ নির্বাচনে একচেটিয়া বিজয় নিয়ে সেখানে হিন্দুত্ববাদী দল ক্ষমতাসীন। জোর করে ইতিহাস পরিবর্তন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ ও বিদ্বেষ নানাভাবে বাড়ছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। নেপালে নতুন প্রণীত সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান রেখে পাস হলেও নেপালকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার জন্য সেখানে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। নেপালের রাজনীতিতে ভারতের বর্তমান সরকার সরাসরি হস্তক্ষেপ করছে। সামনে সেখানেও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রসারের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ফেরত এসেছে; তবে সঙ্গে আছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দল বা জোট ক্ষমতায় থাকলেও রাজনীতি ও সমাজে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহীনতা প্রশ্নের মুখে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলকেও পরিচালনা করছে। বিশ্বজুড়ে ধর্মকে ধরে সন্ত্রাস, সংঘাত ও অনিশ্চয়তা বাড়ছে। তার থেকে বেশি বাড়ছে আতঙ্ক এবং এই বিষয় নিয়ে ধোঁয়াশা।

বর্তমানে যথাযথ পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনার গুরুত্ব বহুবিধ। কারণ প্রথমত, বিশ্বজুড়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ‘ধর্মীয়’ এজেন্ডার চাপ আগের চাইতে অনেক বেশি। একই সময়ে সাম্প্রদায়িক, জাতিবিদ্বেষী, বর্ণবাদী, যৌনবাদী, অসহিষুষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়গুলোও আগের তুলনায় বেশি উপস্থিত। দ্বিতীয়ত, ধর্মকে ভিত্তি করে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য নানা গোষ্ঠীর তৎপরতা বাড়ছে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ নামে দেশে দেশে সামরিকীকরণ বাড়ছে। তৃতীয়ত, শোষণ ও অবিচারের সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং এর থেকে মুক্তির দিশাহীনতার মধ্যে বিভিন্ন ধর্মের নানাবিধ সংগঠন ও তৎপরতা অনেক বেশি পরিসর তৈরি করেছে। চতুর্থত, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হিসেবে পরিচিত অনেক রাজনৈতিক দলও নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে; ক্ষমতা ও ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে ধর্ম ও ধর্মীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। পঞ্চমত, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা তার প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখতে নানাভাবে ‘ধর্মীয় সন্ত্রাস’-এর চাষ করছে।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নিজের কাছে কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি হই। এগুলো হলো- এক. ‘মৌলবাদী’ শব্দটি ধর্মপন্থি রাজনীতি বোঝাতে উপযুক্ত শব্দ কিনা। দুই. এই রাজনৈতিক শক্তিগুলো সব সময় ‘উদারনৈতিক’ ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর বিপরীত হিসেবে দেখা ঠিক কিনা। তিন. তথাকথিত ‘মৌলবাদী’ রাজনৈতিক শক্তি কি পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের বিরুদ্ধ কোনো শক্তি, ‘মৌলবাদ’ আর পুঁজিবাদী উন্নয়নের মধ্যে কি অন্তর্গত কোনো বিরোধ আছে? চার. প্রান্তস্থ দেশগুলোতে ‘মৌলবাদ’ কি বৈশ্বিক পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ তৈরি করেছে? পাঁচ. ‘মৌলবাদ’ কি কেবল মুসলিম দেশ ও গ্রামীণ অঞ্চলের বিষয়? ছয়. ধর্মপন্থি রাজনীতি কি সমাজের গরিব, নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বা করতে পারে?

সাধারণভাবে ধার্মিক মানুষের কাছে ধর্মের রূপ, আর ধর্মের একটি নির্দিষ্ট বয়ানের ওপর ভিত্তি করে কোনো গোষ্ঠীর রাজনৈতিক তৎপরতা এক কথা নয়। দ্বিতীয়ত, নিজ নিজ ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধর্মের মৌল আদর্শের প্রতি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তার/তাদের বিশ্বাস ও চর্চার অধিকার অবশ্যই রাখে। তা অন্য কারও সঙ্গে না মিললে তাতে কেউ আপত্তি করতে পারে না, যদি তা তাদের অসুবিধা না ঘটায়। কিন্তু তৃতীয়ত, কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠী/সংগঠন যখন ধর্মের মৌল আদর্শ নিজেদের মতো সংজ্ঞায়িত করে এবং অন্যদের মত কিংবা বিশ্ব্বাস বা চর্চা অস্বীকার করে তা বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে তখন তা তৈরি করে সহিংস পরিস্থিতি। জোর করে চাপানোর এই মতাদর্শিক অবস্থানই ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জন্ম দেয়। চতুর্থত, ধর্মীয় চর্চায় যুক্ত আছেন, সেটাই তাদের জীবিকা এ রকম অনেককে কায়েমি স্বার্থবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা কতিপয় ক্ষমতাবান ধর্মীয় নেতার ভূমিকা থেকে ভিন্নভাবে দেখতে হবে। কারণ এই পেশাজীবীরা পেশাগত কারণে এবং জীবিকার প্রয়োজনে সাধারণত বিত্তবান ও ক্ষমতাবানদের ওপর নির্ভরশীল থাকেন। পঞ্চমত, মৌলবাদী আর সাম্প্রদায়িক এক কথা নয়। কারও মধ্যে এই দুটো প্রবণতা একসঙ্গে নাও থাকতে পারে। মৌলবাদ ধর্মকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জীবনচর্চা কাঠামো। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ধর্মের পরিচয়কে ভিত্তি করেই তৈরি হয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি মানে অন্য সম্প্রদায়ের ব্যাপারে বিদ্বিষ্ট, আক্রমণমুখী। একজন ধর্মবিশ্বাসী সাম্প্রদায়িক নাও হতে পারেন। আবার একজন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ধর্মবিশ্বাসী বা চর্চাকারী নাও হতে পারে। অর্থাৎ ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়কে নিয়ে বিদ্বেষী রাজনীতি এক কথা নয়। অভিজ্ঞতা বলে, সাম্প্রদায়িকতা অনেক সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুর জমিজমা, সম্পদ দখলের আবরণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। ষষ্ঠত, ধর্মবিশ্বাসী মানেই মৌলবাদী নয়। ধর্মবিশ্বাসী মানেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অনুসারী নয়। সপ্তমত, খ্রিষ্টান মানে খ্রিষ্টান সুপ্রিমেসিস্ট নয়; ইহুদি মানেই ইহুদিবাদী নয়; হিন্দু মানেই বর্ণবাদী নয়; ইসলামপন্থি রাজনীতি মানেই সন্ত্রাসী নয়। অষ্টমত, মৌলবাদ প্রাচ্যনির্দিষ্ট বা প্রাচীন মতবাদ যেমন শুধু নয়; বস্তুত এর শুরু পাশ্চাত্যেই এবং এটি বর্তমানে ‘আধুনিক’ ব্যবস্থারই ফলাফল। ইহজাগতিকতা বা সেক্যুলারিজম এবং গণতন্ত্রও পশ্চিম নির্দিষ্ট এবং ‘আধুনিক’কালের বিষয় শুধু নয়। এর বহু ধারা বিভিন্নকালে মুসলিম বিশ্বসহ প্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া যায়।

ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ বা ইহুদি; যে ধর্মেরই হোক না কেন, এর অনুসারী রাজনৈতিক শক্তি নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ বা ‘ঐশী বিধান’-এর নিজ নিজ ব্যাখ্যার ওপর ভর করেই তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে। বৌদ্ধধর্ম নিরীশ্বর হলেও তার মধ্যেও বিধিবিধান নিয়ে ব্যাখ্যা ও ভূমিকার তারতম্য হয়। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি তারা ইহজগতের রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ, আইনকানুন, প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থের নিজ নিজ ব্যাখ্যাকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে বিবেচনা করে। হিন্দুধর্মের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি বিষয় হলো বর্ণপ্রথা, যা এর মৌল ভিত্তি। মৌলবাদী বা ফান্ডামেন্টালিস্ট শব্দটি এসেছে মার্কিন প্রটেস্টান্ট খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে। তারা তুলনামূলক উদারনৈতিক খ্রিষ্টানদের থেকে নিজেদের পার্থক্য বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহার করত। এখন এই শব্দটি ইসলামপন্থি রাজনীতির বিষয়েই ব্যবহূত হয় বেশি। মৌলবাদী বলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয়, ধর্মগ্রন্থ যে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিধিবিধান জারি করেছে তার মধ্যেই সব সমস্যার সমাধান খোঁজা এবং এর বাইরে কোনো কিছু গ্রহণ করতে অসম্মতি। এর অর্থ হলো সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরিবর্তন তাদের বিবেচনাগ্রাহ্য নয়। সেই হিসেবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্গেও তাদের মিলার কথা নয়। এ জন্য এদের অনেক সময় ‘প্রাক পুঁজিবাদী’ শক্তিও বলা হয়। কিন্তু বিশ্বজুড়ে বহু ধর্মপন্থি দলের কার্যক্রম থেকে তার প্রমাণ মেলে না। ধর্মের বাণিজ্যিকীকরণ, নেতাদের জীবনযাপন, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে দক্ষ বিনিয়োগ তৎপরতা, অর্থনৈতিক নীতি কোনো কিছুই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে না। তারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সুফলভোগীও বটে। বর্তমান ধর্মপন্থি রাজনীতি আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর।

পার্থক্য এখানেই, তাদের অনেকে এই ব্যবস্থার ওপর ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে চায়। যেমন বিজেপি আরএসএস পুঁজিবাদের কট্টর বা নয়া উদারনৈতিক ধারা অনুসরণ করছে হিন্দুত্ববাদের আবরণ দিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি অনুযায়ী ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক তৎপরতা তাদের সমাজ-অর্থনীতি মডেলের দুটো গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। বলা হয়, অর্থনীতির একচেটিয়াকরণ ও বৈষম্য ঠেকাতে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা থাকবে। এই ব্যবস্থা পরিচালিত হবে ‘ঐশী নির্দেশ’ অনুযায়ী, যা নির্ধারণ করবেন ক্ষমতাবানরা। এর বিরুদ্ধে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ নেই। একদিকে শোষণমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা; অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এ দুটোর সমন্বয় প্রকৃতপক্ষে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাই নির্দেশ করে।

[৮ মে ২০২২ দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত]