প্রতিবারই বছর যখন শেষ হয় তখন সাংবাদিকরা ‘নতুন বছরের প্রত্যাশা’ নিয়ে জানতে চান। এটা গৎবাঁধা প্রশ্ন। গৎবাঁধা উত্তর পেলেই তারা খুশি থাকেন কিন্তু সে রকম উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না। ‘আমি খুব আশাবাদী’ বলে বানানো আশাবাদ প্রকাশ করা তো প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। বছর শুরু হলেই তো সবকিছু বদলে যায় না। আগের বছর বা তারও আগের ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে, সংকটগুলো যদি জিইয়ে থাকে, তবে তার ফল তো পেতেই হবে। রেললাইন যেভাবে পাতা থাকে রেল তো সেভাবেই চলবে। সে জন্য ২০১৪ সালের শেষে এসে ২০১৫ সাল নিয়ে নতুন কিছু আশা করা ‘ইচ্ছাপূরণের গল্প’ বলে মনে হয়েছে। দেশের ভেতর-বাইরে অনেক রকম ঘটনাপ্রবাহ আছে, সমীকরণে পরিবর্তনও হচ্ছে অনেক রকম। বিশ্বজুড়ে যে ক্ষমতার দাপটের মধ্যে আমরা বাস করছি তা অব্যাহত থাকলে তার প্রভাব তো থাকবেই। সে জন্য এসব বিষয় উপেক্ষা করে নতুন বছরের জন্য কোনো প্রত্যাশা দাঁড় করানো কঠিন। বিদ্যমান ব্যবস্থা অটুট রেখে এক বছরে বড় কোনো পরিবর্তন আশা করাই সম্ভব নয়।
কিন্তু এটা তো বলা সম্ভব নতুন বছরে আমরা কী কী ঘটনা বা সিদ্ধান্ত দেখতে চাই। রাষ্ট্র জনবৈরী না হলে কী কী ক্ষেত্রে পরিবর্তন সম্ভব এবং জরুরি তার সংক্ষিপ্ত তালিকা তো করা দরকার। এসব বিষয়ে জনমত তৈরি করা, এর পক্ষে মানুষের শক্তি তৈরি করার জন্য এসব বিষয় স্পষ্ট করা এবং বারবার তা উচ্চারণ করাও তো জরুরি। উন্নয়ন, গণতন্ত্র, মানুষের অধিকার এসব কথামালাকে বাস্তব রূপ দিতে গেলে আসলে কী কী লাগবে তা পরিষ্কার হলে শাসকশ্রেণির ভূমিকা স্পষ্ট হয়, স্পষ্ট হয় জনগণের করণীয়ও। পরিবর্তন একদিনে হয় না, কিন্তু হয়।
সেভাবেই কী কী ঘটনা, সিদ্ধান্ত ও পরিবর্তন আনলে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ একটি নতুন যাত্রা শুরু করতে পারে তার একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করলাম ২০১৪ সালের শেষ সপ্তাহে। এটি ছিল নিম্নরূপ :
১। যুদ্ধাপরাধী বিচার শেষ হবে। সাম্প্রদায়িক, জাতিবিদ্বেষী সহিংসতা বন্ধ হবে। বিনা বিচারে হত্যাকা- আর তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় অবিরাম মিথ্যাচার বন্ধ হবে। চাঁদাবাজি, গুম, অপহরণে পুলিশ-র্যাব যুক্ত থাকবে না। সাগর-রুনী, ত্বকী হত্যাকারীদের ধরা হবে এবং বিচারপর্ব শুরু হবে।
২। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণের জন্য পুনর্গঠিত হবে। যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী, দখলদার, চোরাই টাকার মালিকরা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হবে। শান্তিপূর্ণভাবে সবার অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
৩। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুণ্ঠনকারীরা সমাজের সর্বস্তরে ধিকৃত হবে। সরকার তাদের রক্ষক থাকবে না। টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীদের প্রতি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হবে।
৪। সুন্দরবনধ্বংসী রামপাল ও ওরিয়ন বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ সব বাণিজ্যিক প্রকল্প বন্ধ হবে। সুন্দরবনের দায়িত্ব বনজীবী ও পশুপাখির ওপর ছেড়ে দেওয়া হবে। নৌপথ বিপজ্জনক যান চলাচলের জন্য নিষিদ্ধ থাকবে। তেল দূষণে সৃষ্ট ক্ষতি দূরীকরণে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
৫। বঙ্গোপসাগরের মৎস্য ও খনিজসম্পদ শতভাগ দেশের কাজে লাগানোর প্রস্তুতি শুরু করতে আত্মঘাতী পিএসসি প্রক্রিয়া বাতিল হবে। বঙ্গোপসাগরসহ দেশের বিশাল সম্পদের ওপর জাতীয় কর্তৃত্ব নিশ্চিত হওয়ায় বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। বিদেশি কোম্পানির আজ্ঞাবহ ভূমিকা থেকে মুক্ত হয়ে পেট্রোবাংলা স্বাধীন ও সাবালক হয়ে উঠবে। ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিষয়ে ব্যাপক উদ্যোগ শুরু হবে।
৬। জ্বালানি খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের ‘দায়মুক্তি আইন’ এবং মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ‘আইসিটি আইন’সহ বিভিন্ন জনস্বার্থবিরোধী আইন বাতিল হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ওপর ভর করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
৭। সর্বজনের শিক্ষা ও চিকিৎসা শক্তিশালী হতে থাকবে। নম্বরের ঢল, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং, গাইড, বিরাট সিলেবাস ইত্যাদি জাল থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্ত হবে।
৮। ছলছুতা, বলপ্রয়োগ, হুমকি দিয়ে কৃষি ও বসতিজমি অধিগ্রহণ বন্ধ হবে। পাহাড়, নদী, জলাশয় লিজ দেওয়া বন্ধ হবে। পাহাড়ে সহিংসতা বন্ধ হবে। বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ সব নদী বাঁচার পথ পাবে।
৯। সব জাতি, ধর্ম ও ভাষার মানুষ বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ ভাবতে পারবে। নারীর জীবন নিরাপদ হবে।
১০। সমাজে মানুষের গুরুত্ব বাড়বে। ভিআইপিদের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা কমবে, প্রাইভেট কার নিয়ন্ত্রিত হবে।
১১। বৃহৎ ব্যয়ের প্রকল্প উন্মাদনা বন্ধ হবে। অসমাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে আগে। রেল দেশের প্রধান যান হিসেবে ঘোষিত হবে। আনফিট বাস, নৌযানের বদলে নতুন বহর আসবে। ফায়ার ব্রিগেডসহ দুর্যোগ মোকাবেলা এবং জাতীয় সক্ষমতার সব ক্ষেত্র শক্তিশালী করার কাজ শুরু হবে।
১২। রানা প্লাজা ও তাজরীন হত্যাকা-ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হবে। বাঁচার মতো ন্যূনতম জাতীয় মজুরি চালু হবে।
কিন্তু ২০১৫ সালের প্রথম থেকেই এটা স্পষ্ট হলো যে, অতীতের ভার, ক্ষমতা ও লুটেরা রাজনীতির বিষচক্র থেকে আমাদের সহজে মুক্তি নেই। ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া’ এবং ‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার’ এই দুটো অনিষ্পন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র রাজনীতির বিষচক্রের থাবার মধ্যে দেশ হাবুডুবু খেতে থাকল বছরের শুরু থেকেই।
২০১৪ সাল শুরুই হয়েছিল সাধারণ নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা আর সহিংসতা দিয়ে। সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বর্তমান সরকার গঠিত হয়েছে। যেভাবে নির্বাচন হয়েছে তাতে বর্তমান সরকারকে স্বনির্বাচিত বলাই শ্রেয়। নির্বাচনের এক বছর পূর্তির দিনে বিএনপি জোট বড় আকারে সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়ার পর সরকার সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করাসহ নানারকম দমনপীড়নের পথ গ্রহণ করে। প্রত্যুত্তরে বিএনপি জোট অনির্দিষ্টকাল অবরোধ ঘোষণা করে। জনসম্পৃক্ততা এর মধ্যে দেখা যায়নি। তাই প্রথম থেকেই তা সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ‘জনগণ ছাড়া নির্বাচন’ আর ‘জনগণ ছাড়া আন্দোলন’ই যদি হয় দুই প্রধান দলের রাজনীতির পরিচয়, তাহলে তার ভয়াবহতায় জনগণের জীবন দুর্বিষহ হবে তাতে তো অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।
সে জন্যই ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে অবিরাম সহিংসতা। ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই ৩৪ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন মোট ৮৫ জন। এর মধ্যে পেট্রলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৫১ জন। এদের মধ্যে শিশু, নারী, তরুণ, বৃদ্ধ, ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী সব ধরনের মানুষই আছেন। সংঘর্ষ ও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন ৩৪ জন। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে বা বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশ বা র্যাবের গুলিতে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ জন। ক্রসফায়ারে নিহতদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী ছাড়াও দলহীন খুদে ব্যবসায়ী-শ্রমজীবী মানুষ আছেন। গ্রেফতারের সঠিক সংখ্যা সরকার প্রকাশ করেনি। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী এর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিএনপি জোটের হরতাল-অবরোধ শেষ কবে হবে তার কোনো লক্ষণ বা সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, পেট্রলবোমায় ক্ষতবিক্ষত মানুষের সংখ্যাও তাই থামছে না। অদৃশ্য ঘাতকের পেট্রলবোমার সঙ্গে সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে পুলিশ-র্যাবের আক্রমণ। গ্রেফতার, দমনপীড়নের শিকার কে হবে তার ঠিক নেই। গ্রেফতার বাণিজ্যের শিকার হলে অল্পের ওপর দিয়ে গেলেও বহু হাজার টাকার মামলা। আর জীবন তো এখন কার যে হাতের মুঠোয় সেটাই সর্বক্ষণের দুশ্চিন্তা মানুষের। সরকারের গৃহীত সব পথ, পদ্ধতি : হুমকি, আলটিমেটাম, গ্রেফতার, ক্রসফায়ার ইত্যাদি দিয়ে যে সন্ত্রাস থামছে না, জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে না তা এতদিনে সবার কাছে পরিষ্কার হওয়ার কথা।
তবে সমাধান না হলেও প্রতিদিনই মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের বাগাড়ম্বর আস্ফালন আমরা শুনছি। বলাই বাহুল্য, তাতে আমাদের স্বস্তি আসছে না। ১৯ জানুযারি সরকারের অন্যতম মুখপাত্র মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছিলেন, ‘কথা দিলাম, আগামী সাত দিনের মধ্যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’ ২৮ জানুয়ারি বিজিবির মহাপরিচালক বলেছিলেন, ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক। আর কেউ বার্ন ইউনিটে আসবে না।’ পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তাদের মুখেও বেশ কয়েকবার কঠিন হুমকি ও আশ্বাস শোনা গেছে। বলেছেন, সব সন্ত্রাসীর তালিকা করা হয়েছে। শিগগিরই সব দমন করা হবে। দেখামাত্র গুলির কথাও তারা বলেছেন। নেতা-মন্ত্রীরাও বলেছেন, বলেছেন সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেলও। পুলিশের ডিআইজি সবাইকে স্তম্ভিত করে গত ৭ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, অপরাধীদের শুধু নয়, তাদের বংশধরদেরও নিশ্চিহ্ন করা হবে। ‘দেখামাত্র গুলি’তে মানুষ মরছে, নির্বিচার গ্রেফতার হচ্ছে, দমনপীড়ন অব্যাহত আছে কিন্তু চোরাগোপ্তা হামলা কমছে না। পথেঘাটে পেট্রলবোমা হামলার শিকার যেমন সাধারণ মানুষ, সঙ্গে সঙ্গে নির্বিচার গ্রেফতার ও দমনপীড়নের শিকারও সাধারণ মানুষই।
দলীয় সন্ত্রাস ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, পেট্রলবোমা আর দমনপীড়নের বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের শক্তির ওপর নির্ভর করে আমরা বিষচক্র থেকে বের হব, না আবার একই জায়গায় থাকবে সেটি। নতুন বছরে সর্বজনের স্বার্থচিন্তা ও রাজনীতি বিকাশের বিষয়গুলোই উত্থাপন করেছিলাম। ক্ষমতার রাজনীতির বিষবাষ্পে মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেসব বিষয় ধামাচাপা পড়ে গেছে। মানুষ এখন অস্তিত্বের সংকটে। কিন্তু এই অস্তিত্বের সংকট থেকে মুক্ত হতে হলে মানুষকে নিজের এজেন্ডা নিয়েই সোচ্চার হতে হবেÑ যেগুলো তার স্বার্থ, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। সেখান থেকেই প্রতিরোধের কার্যকর শক্তি তৈরি হবে। এছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ক্ষমতার বিষচক্রের বিরুদ্ধে জনগণের এজেন্ডা
(১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে আমাদের সময়ে প্রকাশিত)