আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকার কেন সব দৃঢ়তা আর প্রশাসনিক শক্তি নিয়ে একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? এর কারণ হতে পারে একটাই, আওয়ামী লীগ ধারণা করছে, যদি তারা সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য কোনো আপসে যায়, তাহলে অন্তত প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনাকে সরে যেতে হবে। এটা মেনে নিতে আওয়ামী লীগের অসুবিধা কী? অসুবিধা একটাই, সে রকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতে আসার ব্যাপারে ভরসা পাচ্ছে না। যদি জনসমর্থন অটুট থাকে, আওয়ামী লীগ বিভিন্ন বিলবোর্ডের এবং টিভি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে উন্নয়ন প্রচার করছে, তাতে জনগণের যদি আস্থা থাকে, তাহলে নির্বাচনে বিজয় তো নিশ্চিত হওয়ার কথা। তা ছাড়া যুদ্ধাপরাধীর বিচার শুরু তো আওয়ামী লীগের বড় সাফল্যের বিষয়। তাহলে? না, আওয়ামী লীগ কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।
অন্যদিকে বিএনপিও নিশ্চিত, শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী থাকেন, তাহলে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যদি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা থাকেন, যদি মিডিয়া সতর্ক থাকে, তাহলে আওয়ামী লীগের পক্ষে কি ইচ্ছা করলেই কারচুপি করা সম্ভব হবে? না, কোনোভাবেই এই ঝুঁকি বিএনপি নিতে রাজি নয়। কেউ পরাজয় তো নয়ই, তার ঝুঁকিও নিতে রাজি নয়।
নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় কখনো জয় কখনো পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সরকার গঠনই তো নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশে দুই পক্ষ কেউ যদি পরাজয়ে রাজি না থাকে, তাহলে নির্বাচন-প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করবে? দুই পক্ষই নির্বাচনে অংশ নিতে চায়, তবে নিশ্চয়তা দিতে হবে, জিতবে শুধু তারাই। এর ফলাফল দেশ অচল। প্রতিদিন গুলি-সংঘর্ষে মানুষ মরছে, ছোড়া ককটেলে পুড়ছে, মরছে! চারদিকে রক্ত, আগুনপোড়া মানুষ, ধ্বংসপ্রাপ্ত গাড়ি, রেলের বগি, টেম্পো। যাঁরা মারা যাচ্ছেন, জীবনের তরে পঙ্গু হচ্ছেন তার বেশির ভাগ মানুষ শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই বের হয়েছিলেন রাস্তায়। কতজন পঙ্গু হচ্ছেন তার হিসাবও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে ক্ষমতার যাঁরা থাকেন বা যাঁরা যেতে চান, তাঁদের কাছে যে মানুষের জীবন তুচ্ছ, দেশের ভবিষ্যৎ অর্থহীন, এগুলো তারই একেকটি চিহ্ন!
সরকার মাঝেমধ্যেই বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার ও দমন-পীড়ন করে উসকানি দিয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের হয়তো ধারণা যে এভাবে বিএনপি-জামায়াত যত অবরোধ হরতাল দিতে থাকবে, যত জ্বালাও-পোড়াও করবে, বোমা-গুলি-সংঘর্ষে যত মানুষ মারা যাবে, যত মানুষ কাতরাবে যন্ত্রণায়, যত মানুষ জীবনের অনিশ্চয়তায় ধুঁকবে, ততই বিএনপি জনধিক্কৃত হবে এবং আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়বে। ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারেরও নিজের সম্পর্কে এই একই ধারণা ছিল, যখন আওয়ামী লীগ-জামায়াত দিনের পর দিন হরতাল অবরোধ দিয়েছিল। ইতিহাসের কী নিষ্ঠুর পুনরাবৃত্তি!
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আন্দোলন করছে। বিএনপিসহ চারদলীয় জোট যখন সরকারে ছিল তখন তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছিল, কিন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই এই সরকার যাতে তার আজ্ঞাবহ হয়, সে জন্য তোড়জোড় শুরু করল এবং ২০০৬ সালে দেশকে ঠেলে দিল গভীর সংকটে। এর মাধ্যমে বিএনপি নিজেই প্রমাণ করেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকাই সমস্যার সমাধান নয়। ক্ষমতায় থাকাকালে হাওয়া ভবন নামের কেন্দ্র খুলে দুর্নীতি আর দখল-লুণ্ঠনের বিস্তার অন্যদিকে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তোলার ব্যবস্থা করে বিএনপি জোট জনধিক্কৃত হয়েছে এবং জনগণের ভোটে বিতাড়িত হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কেউ কাজ করে জনপ্রিয় হয়ে ক্ষমতায় আসেনি। অকাজ করার কারণে যারা জনধিক্কৃত হয়েছে, তাদের ক্ষমতা থেকে বিতাড়ন করেছে মানুষ। অন্য পক্ষ তখন ক্ষমতায় এসেছে।
শেখ হাসিনা খুবই সঠিক, যখন তিনি বলেন যে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের হাতে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে পারেন না। ঠিক যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে নির্বাচন কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। তাহলে স্থায়ী সমাধানের দিকে কি শেখ হাসিনা সরকার গেছেন? স্বাধীন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন? স্বাধীন বিচারব্যবস্থা? স্বাধীন প্রশাসন? না।
আসলে দুটো কারণ প্রধান, যার জন্য এই দুই পক্ষের কাছে জীবনমরণ প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রক্ষমতা। এর একটি হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতা খুব দ্রুত সম্পদ আহরণ ও কেন্দ্রীভবনের প্রধান মাধ্যম। ওয়ার্ল্ড আলট্রাওয়েলথ রিপোর্ট ২০১৩ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ন্যূনতম প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিকদের সংখ্যা এখন ৯০। ২০০৯ সালে তাঁদের সংখ্যা ছিল ৫০ জন। বর্তমানে এই ৯০ জনের হাতে সম্পদ আছে এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার, বা প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। (বণিক বার্তা, ৩ ডিসেম্বর ২০১৩)। জমিসহ দেশের সম্পদ দখল, লুণ্ঠনের পাশাপাশি কমিশন ও দুর্নীতির মাধ্যমে কিছু লোকের মহাধনী হওয়ার এই উন্নয়ন ধরনই ক্ষমতা নিয়ে এই উন্মাদনার প্রধান কারণ। এদের কাছে তাই জনগণের জীবন, হাহাকার আর দেশের সর্বনাশ কোনো আবেদনই সৃষ্টি করে না।
আর দ্বিতীয়ত, যারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে, তাদের অপর পক্ষের হিংস্র প্রতিহিংসার মুখোমুখি হতে হয়। দমন-পীড়ন হয়রানি পাঁচ বছরের নিত্যসঙ্গী থাকে। অনেক ক্ষেত্রে ঐক্য থাকলেও ক্ষমতা থেকে দূরত্ব তাদের বিশাল সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে, বরং অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করে।
সংবিধান কী বলে? প্রকৃতপক্ষে আমাদের সংবিধান শুধু যে সাম্প্রদায়িক ও জাতিবিদ্বেষী তা-ই নয়, এখানে গণতন্ত্রেরও কার্যকর হওয়ার বা নড়াচড়ার সুযোগ নেই। বিধান অনুযায়ী সাংসদেরা নিজের কোনো মত ব্যক্ত করতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতার স্থান সংসদ কার্যত একটি ব্যয়বহুল আনুষ্ঠানিকতা। হাত তোলা এমপি দিয়ে গণতান্ত্রিক সংসদ হয় না, হাত তোলা কর্মী দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হয় না। সুতরাং জমিদারি ব্যবস্থাই অবধারিত পরিণতি। দেশ তাই এখন দেশ নয়, জমিদারি।
তাহলে মানুষ এখন কোথায় যাবে? কী সমাধান? তৃতীয় শক্তি হিসেবে সামরিক বাহিনীর কথা মাঝেমধ্যে শোনা যায়। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। প্রতিবারেই নতুনভাবে আবার একই দুষ্টচক্রের যাত্রা শুরু হয়েছে। অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তি, যারা জমিদারি ব্যবস্থার বাইরে দেশকে নিতে চায়, সে রকম কেউ? না, সে রকম সম্ভাবনা এখন নেই। সে কারণে দুই দলের সমঝোতা ছাড়া এ মুহূর্তের আগ্নেয়গিরির হাত থেকে উদ্ধার নেই। না হলে পতন কোথায় নিয়ে যাবে, আমরা কেউ জানি না।
আওয়ামী লীগ যদি একতরফা নির্বাচন নিয়েই এগিয়ে যেতে থাকে, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন, সম্পদ ও কাজের নিরাপত্তাও তাদের নিশ্চিত করতে হবে। পারবে? ঘটনাবলি প্রমাণ, পারবে না। না পারলে তাদের সমঝোতার পথেই আসতে হবে। সেখানে একটা স্বচ্ছ চুক্তিতে আসতে হবে দুই পক্ষকেই, যেখানে ভবিষ্যৎ অচলাবস্থা ঠেকানোর জন্য দুটো বিষয় সুনির্দিষ্টভাবে থাকতে হবে: ১. সবাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে, তার রায় কার্যকর করতে নিজ নিজ ভূমিকা পালনে বাধ্য থাকবে। ২. যেই জয়লাভ করুক না কেন, কোনো পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক কোনো ব্যবস্থা নেবে না।
স্বাধীনতার ৪২ বছরের মাথায় আমরা রক্তাক্ত, দিশাহীন, উদ্ভ্রান্ত। এই দেশ নিয়ে নিজেদের জীবন নিয়ে মানুষ নতুন কোনো উচ্চতার স্বপ্ন দেখবে কি, এখন শুধু বেঁচে থাকার জন্যই সবার আর্তনাদ। এত বছরে রাজনীতি আর অর্থনীতির কী ঘটল যে আমাদের শুনতে হচ্ছে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়োগের সম্ভাবনার কথা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নড়াচড়ার কথা, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের চিন্তার কথা। আমাদের উন্নয়নের ধরন আর রাজনীতির মধ্যে বড় ধরনের অসংগতি ছাড়া এ রকম একটি পরিস্থিতি কীভাবে সৃষ্টি হতে পারে? আমরা জানি, দেশের স্বাধীনতার জন্য এত ত্যাগ আর এত জীবন উৎসর্গ খুব কম দেশের মানুষই করেছে। অথচ সেই স্বাধীনতা লাভের পর তৈরি হয়েছে জনগণের পরাজয়ের দীর্ঘ ইতিহাস। আজকের ঘটনাবলি সেই পরাজয়ের অংশ। আক্রান্ত দেশ, আক্রান্ত জনগণ।
বড় অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস করে যে জনগোষ্ঠী, তার কাছে বড় পরিবর্তনের তুলনায় আপাত-স্বস্তি পাওয়ার জন্য খড়কুটোর সন্ধানে অস্থির হওয়াই স্বাভাবিক। সেই খড়কুটোও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে এখন দেশ একটু স্বস্তি পাবে। তবে তাতে জনগণের পরাজিত অবস্থার যে পরিবর্তন হবে তা নয়। দুই জমিদারি গোষ্ঠীর বিষচক্র থেকে মুক্তির চিন্তা ও শক্তির বিকাশ ছাড়া বারবার এই খাদে পতন থেকে যে উদ্ধার নেই, সেটাও তাই আমাদের মনে রাখতে হবে।
( ডিসেম্বর ০৮, ২০১৩ তারিখে প্রথম আলোতে প্রকাশিত)