বিশ্বের বহু দেশ থেকে সৌদি আরবে হজ করতে গিয়েছেন মানুষ। সেখানে পদদলিত হয়ে কতজন নিহত হয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায়নি। আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ। কেননা, এ বিষয়ে খুব কম জনই মুখ খুলছেন। বিশ্বের প্রধান প্রধান সংবাদমাধ্যমও এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধানী রিপোর্ট করছে না। সৌদি রাজতন্ত্র সব সময়ই এই সুবিধা পেয়ে থাকে। তবে ইরান ব্যতিক্রম। ইরান দাবি করছে, মৃত্যুসংখ্যা আরও অনেক বেশি। তাদের দাবি, সৌদি রাজপুত্রের গাড়ির বহর যাওয়ার কারণে রাস্তা আটকে থাকায় এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তারা এর আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে।
সৌদি আরব ও ইরানের সংঘাত দিনে দিনে আরও দানা বাঁধছে। এবারে হয়তো তা আরও তীব্র হবে। সিরিয়া ও ইয়েমেনে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পেছনে সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব অন্যতম উপাদান। সৌদি রাজতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রসহ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। মধ্যপ্রাচ্যে রাজতন্ত্র থাকলেই তাদের জন্য সুবিধা। ইসরায়েলের স্বার্থও তাই। সৌদি-ইরান সংঘাত সামনে আরও নতুন নতুন সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করবে বলে আশঙ্কা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে নিত্যনতুন বাহানা নিয়ে তৈরি হচ্ছে যুদ্ধ আর সংঘাত। আর্নেস্ট ম্যান্ডেল বলেছিলেন, পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা ‘স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতি’র পর্বে প্রবেশ করেছে। সমরাস্ত্র উৎপাদন ও যুদ্ধ, অতএব হত্যা ও ধ্বংস তার জীবনীশক্তি। ছোটবেলা থেকেই প্যালেস্টাইন ও কাশ্মীর সমস্যার কথা শুনছি, তথাকথিত শান্তি আলোচনারও কমতি নেই। কিন্তু সমস্যা নিরসনে কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। কিছুদিন আগেও গণহত্যা চলল, সিরিয়ায় বছরের পর বছর যুদ্ধ, সংঘাত, খুন চলছে। আইএস নামে এক গোষ্ঠীর নতুন উন্মাদনা শুরু হয়েছে। নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম, ইরাক ও লিবিয়ায় নিয়মিত হামলা, সংঘাত, বোমা এবং পাকিস্তান ও ভারতেও প্রায়ই সংঘাত-সহিংসতা। লাতিন আমেরিকায় নতুন সাজ সাজ রব যুক্তরাষ্ট্রের। চীনের অস্ত্র প্রতিযোগিতায় জোর বৃদ্ধি নতুন উত্তেজনা তৈরি করছে, জাপানেরও যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে। ইউক্রেনকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছেই এবং রাশিয়া সিরিয়ায় বাশারের সমর্থন নিয়ে আইএসের ঘাঁটিগুলোতে বিমান আক্রমণ শুরু করেছে। রাশিয়া ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিরোধ বাড়ছে, সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।
সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব কয়েকটি রাষ্ট্র ইয়েমেনে সামরিক আক্রমণ শুরু করার পর থেকে নিজেদের বৈরিতা বিস্তৃত হচ্ছে নানা দিকে। ইয়েমেন, বাহরাইন, ইরাক, সিরিয়াসহ বহু স্থানে শিয়া-সুন্নি সংঘাত ক্রমেই বাড়ছে। ইরাক ও ইয়েমেনে এই সংঘাতের অস্তিত্বই ছিল না। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ায় আল-কায়েদার ধারার কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না আগে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ এই অঞ্চলকে চেনা-অচেনা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছে। সর্বশেষ এই অঞ্চলে বিরাট শক্তি ও সম্পদ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে আইএস, যা ইসলামি রাষ্ট্র বা খিলাফত প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তারা ইরাক ও সিরিয়ায় একের পর এক অঞ্চল দখল করছে। তারা একের পর এক ভিন্নধর্ম ও মতাবলম্বী, সংখ্যালঘু জাতির মানুষদের ধরছে, গলা কাটা ও নির্যাতনের দৃশ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করছে। হঠাৎ করে এ রকম একটি বিশাল বাহিনীর জন্ম এবং ক্রমান্বয়ে বিজয় আফগানিস্তানে তালেবানদের আচমকা আবির্ভাব এবং দ্রুত আফগানিস্তান দখলের কথা মনে করিয়ে দেয়।
প্রথমে মুজাহিদিনদের মাধ্যমে আফগানিস্তানে সোভিয়েত-সমর্থিত সরকার উচ্ছেদ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময় আফগান মুজাহিদিনদের সব রকম পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রশিক্ষণ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে। অর্থ দিয়েছে সৌদি আরব। সিআইএর এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে মাঠের ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সামরিক শাসনের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াউল হকের মতো একজনকে অধিষ্ঠিত করা তাই খুব দরকার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ইউএসএআইডি সরবরাহ করেছে ইসলামি উন্মাদনা সৃষ্টির মতো বই, শিশুদের পাঠ্যপুস্তক। যার মধ্যে নৃশংসতায় উসকানি দেওয়া, শত্রুসেনার চোখ উপড়ে ফেললে বেহেশতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদিও ছিল। USA prints textbooks to support Jihad in Afghanistan and Pakistan
তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের সূচনা করে ১৯৯৭ সালের ২৪ মে। ঠিক তার আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ ব্যবসাজগতের মুখপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়: ‘আফগানিস্তান হচ্ছে মধ্য এশিয়ার তেল, গ্যাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির প্রধান পথ।…তাদের পছন্দ করো বা না করো, ইতিহাসের এই পর্যায়ে তালেবানরা আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।’ পরের দিন নিউইয়র্ক টাইমস লেখে: ‘ক্লিনটন প্রশাসন মনে করে যে তালেবানদের বিজয় ইরানের পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে…এমন একটি বাণিজ্য পথ উন্মুক্ত করবে, যা এই অঞ্চলে রাশিয়া ও ইরানের প্রভাবকে দুর্বল করবে।’ মার্কিন তেল কোম্পানি ইউনোকল ক্লিনটন প্রশাসন ও ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর অবস্থানকে ‘খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি’ বলে অভিহিত করে। এই কোম্পানি বিশ্ববাজারে বিক্রির জন্য তুর্কমেনিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল নেওয়ার প্রকল্প নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
সোভিয়েত প্রভাবের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থী জঙ্গি সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঐক্য তৈরি হয়, তার ধারাবাহিকতা ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবই এখন ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। আইএস, তালেবান, আল-কায়েদা ইত্যাদি নামে পরিচিত যেসব গোষ্ঠীকে দমন করার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে দখলদারির নতুন জাল ফেঁদেছে, তারা সবাই মার্কিনদের সৃষ্ট বা লালিত-পালিত দানব। এগুলোর সূত্রে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে। ইসলামের নাম নিয়ে বহু গোষ্ঠীর বর্বর দিগ্ভ্রান্ত সন্ত্রাসী তৎপরতাকে কেউ কেউ ‘জিহাদ’, কেউ কেউ ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াই’ বলে মহিমান্বিত করতে চান। ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, আসলে ঘটনা পুরোই উল্টো।
অনেকে আবার এ রকমভাবে বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনা করছে ‘ইসলামি জঙ্গি’দের বিরুদ্ধে সেক্যুলার শক্তির পক্ষে। এটিও আরেকটি বড় ভ্রান্তি। নির্বাচিত সেক্যুলার সরকার উচ্ছেদে মার্কিন রেকর্ড অনেক। সত্তর ও আশির দশকে আফগানিস্তানে সেক্যুলার সরকারই ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু তারা ছিল মার্কিনবিরোধী, সোভিয়েতপন্থী। এই সরকারগুলো আফগানিস্তানে ভূমি সংস্কার, নারী অধিকার, শিক্ষা ও চিকিৎসা সংস্কারে অনেক দূর অগ্রসর হয়েছিল। ইরাক ও লিবিয়ায়ও সেক্যুলার সরকার ছিল। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিশুদ্ধ পানিসহ জন-অধিকারের ক্ষেত্রেও তাদের অনেক সাফল্য ছিল। যুক্তরাষ্ট্র সাদ্দাম ও গাদ্দাফিকে উচ্ছেদের পর সেসব ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। আর সেখানে বিভিন্ন ‘ইসলামপন্থী’ ভাড়াটে বা উগ্র গোষ্ঠীর প্রভাব বেড়েছে।
২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক সমীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের আক্রমণে ইরাক, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ১৩ লাখের বেশি লোক নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ লাখ ইরাকে, ২ লাখের বেশি আফগানিস্তানে। এই সময়ে মার্কিন ড্রোন ও অন্যান্য আক্রমণে ৮০ হাজারের বেশি লোক নিহত হয়েছে শুধু পাকিস্তানেই। এর মধ্যে বেসামরিক নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার।
ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ছিন্নভিন্ন হওয়ার ফলে এই দেশগুলোর মানুষকে নারকীয় অবস্থায় পড়তে হয়েছে। ইউরোপে অভিবাসীদের বিশাল স্রোত এরই ফল। তবে এর প্রত্যক্ষ সুবিধাভোগী তিন পক্ষ—সৌদি আরব, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাদের কাছে ইরাকের সাদ্দামের অপরাধ স্বৈরশাসন ছিল না, ছিল তেলক্ষেত্র জাতীয়করণ এবং সামরিক শক্তি হিসেবে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের কর্তৃত্ব অস্বীকার করার ক্ষমতা। লিবিয়ার গাদ্দাফিরও একই অপরাধ ছিল। সৌদি রাজতন্ত্রের বরাবরই তার ওপর গোসসা ছিল। জীবনের শেষ পর্যায়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার লক্ষ্যে নয়া উদারতাবাদী কিছু সংস্কারের পথে গেলেও গাদ্দাফির বড় অপরাধ ছিল সৌদি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট আক্রমণাত্মক কথাবার্তা। ২০১১ সালে গাদ্দাফি সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য ন্যাটো বাহিনীর ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচি এবং আল-কায়েদাসহ বিভিন্ন ভাড়াটে সন্ত্রাসবাদীদের জড়ো করার কাজটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা কয়েকটি দেশ ও সৌদি আরবের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।
সিরিয়ার বাশার সরকারেরও অপরাধ স্বৈরশাসন নয়, অপরাধ সৌদি আরব ও ইসরায়েল সরকারের কাছে তার অগ্রহণযোগ্যতা। বাশার সরকারকে উচ্ছেদ করার জন্য অতএব বিভিন্ন জঙ্গিবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়। ইরানকে কাবু করাও একটি উদ্দেশ্য ছিল। বাশারবিরোধী এসব গোষ্ঠীর অধিকাংশ ছিল আল-কায়েদা ঘরানার বিভিন্ন গ্রুপ। সৌদি আরব, কাতার, তুরস্ক, জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে বিপুল অর্থ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র জোগানের ওপর ভর করেই এসব গোষ্ঠী শক্তি অর্জন করে। এর সঙ্গে কাজ করে মার্কিন, ব্রিটিশ, ফরাসি ও ইসরায়েলি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বিত ভূমিকা। এদেরই অনেকে এখন গঠন করেছে আইএস। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কিছুদিন আগে এক বক্তৃতায় মুখ ফসকে আইএসের পেছনে এই দেশগুলোর শত হাজার কোটি ডলারসহ নানা পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে ফেললেও পরে মিত্রদের ক্ষোভের মুখে মাফ চেয়েছেন। বাইডেন অবশ্য নিজেদের ভূমিকার কথা বলেননি। কিন্তু সত্য ঢাকা পড়েনি।
তাই এটা বিস্ময়কর নয় যে ‘সন্ত্রাসবিরোধী তৎপরতা’র নামে যখন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে, অস্ত্র জোগানও বাড়ছে, তখন নতুন নতুন দৃশ্যমান-অদৃশ্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, গোয়েন্দা সংস্থার দাপট বাড়ছে, সন্ত্রাস বাড়ছে, তা দমনে নতুন নতুন দমন-পীড়নের আইন, বিধিনিষেধ তৈরি হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এই মডেলে প্রবেশের অর্থ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীর বর্ধিত পুনরুৎপাদন এবং সন্ত্রাসের চিরস্থায়ীকরণ করা। যেন এক অদ্ভুত হৃদয়হীন ও বোধহীন বিশ্বব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাস করছি। এখানে যারা সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী, তারাই বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’র নামে। তাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, ‘গণতান্ত্রিক’ ‘সভ্য’ রাষ্ট্র, এনজিও, ‘সুবোধ’ বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই।