৪ জানুয়ারি থেকে দেশের মানুষ যখন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে, তখন থেকেই মন্ত্রীরা বেশ কৌতুকপ্রবণ হয়ে উঠেছেন।
‘খালেদার বাসার সামনে বালুর ট্রাক সিমেন্টের ট্রাক কী কারণে?’
‘তিনি বাড়ি মেরামত করতে এনেছেন।’ কিংবা ট্রাকগুলো ‘ওখানে এসে নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘খালেদার বাসায় তালা পুলিশ কেন?’
‘তাঁর নিরাপত্তার জন্য, কারণ জঙ্গিরা তাঁর ওপর হামলা করতে পারে, সে রকম গোয়েন্দা তথ্য আছে।’
‘গতবার ছিল বালুর ট্রাক, এবারে যোগ হলো সিমেন্টের ট্রাক, আগামীবার ইট-রডের ট্রাক যোগ হলেই বাড়ি বানানো শুরু করব।’
এসব কথা কৌতুক হিসেবে উপভোগ করা যেত যদি চারপাশের পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক থাকত। বর্তমান সরকারের এক বছর পূর্তির আগের দিন থেকে এক শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চিত-নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে দেশে। সরকার বিএনপি ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে গিয়েই এই পরিস্থিতির উদ্ভব। আর সরকারের আয়োজন মোকাবিলা করতে গিয়ে বিএনপি জোট নিয়েছে চোরাগোপ্তা হামলার পথ।
দেশে বর্তমান যে স্বনির্বাচিত শাসনব্যবস্থা চলছে, তাকে রক্ষা করার জন্য প্রশাসন, পুলিশ-র্যাবসহ নানা বাহিনী, সরকারি দলের বিভিন্ন অংশ—সবাইকে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ৪ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতা না থাকলেও লুট দখল নিয়ে সহিংসতা, খুনোখুনি, গুম, ক্রসফায়ারের নামে রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড চলছিল। গ্রেপ্তার-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে ভয়ংকরভাবে। একচেটিয়া ক্ষমতার কারণে লুণ্ঠন-দখল নিয়ে সরকারি দলের মধ্যেই সংঘাত-সহিংসতা বেড়েছে। ৪ জানুয়ারি থেকে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অনিশ্চয়তা এবং দমনপীড়ন ও বিধিনিষেধ। সর্বশেষ পুলিশ-বিজিবি পাহারার মধ্যেও আগুনে পুড়ে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। শ্রমিক, শিশু, নারী, পুরুষ—সবাই আক্রান্ত। কর্মহীনতায় বিপন্ন অসংখ্য মানুষ।
প্রকৃতপক্ষে জনস্বার্থে কাজ করলে জনগণের ওপরই ভরসা করতে পারত সরকার, সভা-সমাবেশ, নির্বাচন—কোনো কিছু নিয়েই সরকারের ভয় থাকত না। কিন্তু সর্বজনের সম্পদ লুণ্ঠন ও দখলকেন্দ্রিক তৎপরতায় লিপ্ত থাকায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের ওপর তার ভরসা নেই, তাই ভর করতে হচ্ছে বল প্রয়োগের ওপর। নিজের ক্ষমতাকে স্থায়িত্ব দেওয়ার বাসনায় সরকার হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। তার এ বেপরোয়া ভূমিকার কারণেই অগণতান্ত্রিকতা ডালপালা মেলছে, সমাজে খুঁটি গাড়ছে। দেশি-বিদেশি নানা স্বার্থগোষ্ঠী সুযোগ খুঁজছে আরও দখলদারিত্বের। বিজিবি, পুলিশ ও র্যাবপ্রধানদের হুমকি পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে। বস্তুত বর্তমানকে দখল করতে গিয়ে সরকার বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে আরও ভয়ংকর পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অন্যদিকে জনসমর্থন থাকলে কিংবা যুদ্ধাপরাধ, দুর্নীতি, লুণ্ঠন, সম্পদ পাচার, সন্ত্রাসের কলঙ্ক না থাকলে বিএনপি জোট যদি জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারত, তাহলে সরকারের কোনো বিধিনিষেধ, দমন-পীড়ন কিছুই কাজ করত না। তা করতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি জোট ধরেছে চোরাগোপ্তা হামলার পথ। জনগণের জীবন ও সম্পদ চেনা-অচেনা সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি, প্রতিটি মুহূর্ত প্রত্যেক নাগরিকের জন্য অনিশ্চিত, নিরাপত্তাহীন। অর্থনীতির গতি হুমকির মুখে।
যথারীতি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পর বিষোদ্গার, চিৎকার ও অসহিষ্ণুতা অব্যাহত আছে। এর মধ্যে আরেকটি বিষক্রিয়া তৈরি হচ্ছে প্রতিপক্ষের নেত্রী সমালোচনায় নারীবিদ্বেষী টান এনে। রাজনৈতিক নেতাদের পরস্পর আক্রমণে রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর চেয়ে নারী নেত্রীর ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি কটাক্ষ থাকে বেশি। বলাবাহুল্য, নেতাদের এ ধরনের বক্তব্যে কর্মীরাও তাঁদের ‘মনের ভাব’ সেভাবে প্রকাশেই উৎসাহিত হন। এবং ক্রমে দুই দলের কর্মীদের মধ্যে অন্য দলের নেত্রীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা ও আক্রমণই প্রকাশিত হতে থাকে। সব মিলিয়ে সমাজে প্রচলিত নারীবিদ্বেষী যৌন হয়রানিমূলক চিন্তা ও কথাই এতে উৎসাহিত হয়। ফেসবুকে এর বীভৎস প্রকাশ দেখে আমাদের আতঙ্কিত হতে হয়। রাজনৈতিক পার্থক্য, বিতর্ক পরিণত হয় নারীবিষয়ক কুৎসিত আলোচনায়। অনেক মন্ত্রীর ‘কৌতুকময়’ কথাও সেই সুরের ওপর ভর করেই চলছে।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৮১ ও ১৯৮৩ সাল থেকেই দুই নারী বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা সবাই জানি যে এ দুজনই নিজ নিজ দলের সংকটকালে দলের ঐক্য রক্ষার জন্য নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৯১ থেকে তাঁরা পালাক্রমে দেশের সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময় অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিশ্বনীতিতে যা যা ঘটেছে, বাংলাদেশের যা কিছু ভালোমন্দ ঘটেছে, এগুলোর দায়দায়িত্ব ও কৃতিত্ব নিজ নিজ সময়কাল অনুযায়ী তাঁদেরই। কিন্তু এর কোনোটিই নারী হিসেবে নয়, নির্দিষ্ট রাজনীতির নেতা হিসেবেই তাঁদের ওপর বর্তায়। যে উন্নয়ননীতি ও দর্শনের দ্বারা আমরা পরিচালিত হচ্ছি, তার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক সরকারপ্রধান হিসেবে, নারী হিসেবে নয়। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনামলে নেতা-কর্মী ও সহযোগী সুবিধাভোগীদের দখল, লুণ্ঠন, দুর্নীতি, কমিশনের ঘটনাবলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ কিংবা প্রায় সবাই পুরুষ। সরকারি ক্ষমতার মদদে যারা রামদা আর অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাস বিস্তার করছে, তারাও পুরুষ। দুই দলেরই উপদেষ্টা বা নীতিনির্ধারকেরা পুরুষ। পর্দার আড়ালেও বহু পুরুষ নীতিনির্ধারণীতে ভূমিকা পালন করেন। সব লক্ষণই বলছে দুই নেত্রীই তাঁদের আসন নিজ নিজ ছেলের হাতে ছেড়ে দেওয়ার আয়োজন করছেন। তাতে কি পরিস্থিতির উন্নতি হবে? মানুষ তো এই ‘তরুণ’ ও পুরুষ নেতৃত্ব দেখে আরও ভীতসন্ত্রস্ত।
সহিংসতা, খুন, আগুন, আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণে মানুষ দিশেহারা আরও এই কারণে যে এর শেষ কোথায়, তার কোনো কূলকিনারা নেই তাদের সামনে। দিনে দিনে অনেক কিছু জমে এখন ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। বহু আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর–প্রক্রিয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দাঁড়ানোর কথা ছিল, দাঁড়ায়নি। অনেক আগেই যুদ্ধাপরাধের শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত ছিল, তা এখনো শেষ তো হয়ইনি, বরং দেশের রাজনীতিতে একটি বড় বিষফোড়া হয়ে আছে। সামরিক শাসনের প্রশ্রয়ে যুদ্ধাপরাধীরা সংগঠিত হয়েছে। ১৯৯১ থেকে এই দুই নেত্রীর নেতৃত্বাধীন দল দুটি বিভিন্ন সময় তাদের সঙ্গে আঁতাত করায় তাদের বিপদভঞ্জন হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতার অংশীদার করে তাদের আরও শক্তি দান করেছে। এ ছাড়া ধর্মকে বিভিন্ন সময় ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহারের কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ডালপালা ছড়িয়েছে।
যে সময়ে যে রাজনীতির প্রক্রিয়ায় এগুলো ঘটেছে, সেই একই রাজনীতির আধিপত্যের মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছে লুটেরা কোটিপতি, বেড়েছে দুর্নীতি ও সম্পদ পাচার। দখল-লুণ্ঠনে বনজঙ্গল, নদী-খাল উন্মুক্ত জমি সর্বজনের হাতছাড়া হয়েছে। কমিশনভোগীদের দাপটে স্বাক্ষরিত হয়েছে নানা জাতীয় স্বার্থবিরোধী চুক্তি। এগুলোই সম্মিলিতভাবে দেশকে এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তায় নিক্ষেপ করেছে। কোনো প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায়নি, স্বচ্ছতা দাঁড়ায়নি, জবাবদিহির জায়গাও তৈরি হয়নি। সংবিধানের ধারাবলে এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে দেশি ও বিদেশি লুটেরা গোষ্ঠী, জনগণকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, যা খুশি তা-ই করার স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ কারণেই এই কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ধরে রাখা বা তা দখলে নেওয়ায় তৈরি হয়েছে উন্মাদ জনধ্বংসী রাজনীতি।
আসলে হোক নারী বা পুরুষ, এই জনধ্বংসী লুটেরাবান্ধব রাজনীতির ঘোড়ায় যিনি নেতা হিসেবে চড়বেন, তারই ভূমিকা হবে একই রকম। নারী নেতৃত্ব নিয়ে বিষোদ্গার, ব্যক্তি-আলোচনায় গুজব গালগল্প আসর জমাতে পারে, কিন্তু রাজনীতির বিষচক্রের খঁুটি তাতে দুর্বল হবে না। মানুষ যত দিন ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোযোগ ছেড়ে রাজনীতি ও মতাদর্শকে প্রশ্ন না করতে শিখবে, জনপন্থী রাজনীতির শক্তি হিসেবে নিজেরা সরব ভূমিকা নিয়ে দাঁড়াতে না পারবে, তত দিন এই বিষাক্ত বৃত্ত থেকে মুক্তি নেই। হয়তো সব কুৎসিত প্রচারণাকে পরাজিত করে এই জনপন্থী রাজনীতির বিকাশেও নতুন মুক্ত নারী নেতৃত্বই বড় ভূমিকা পালন করবে।
আর বর্তমান অচলাবস্থার কী হবে? কাণ্ডজ্ঞান থেকে বুঝি যে বর্তমান অচলাবস্থা, অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া খুবই সম্ভব। সমাধানের প্রথম আশু পথ: সরকার দমন-পীড়ন বন্ধ করবে, ঘোষিত-অঘোষিত সব অগণতান্ত্রিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করবে। বোমা-সন্ত্রাস, মানুষ হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে বিএনপি জোট অবরোধ-হরতাল প্রত্যাহার করবে, সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করবে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলে এই বছরের মধ্যে স্বচ্ছ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে যুদ্ধাপরাধী, সন্ত্রাসী ও লুটেরা বাদে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে।
কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান থেকে যা বলা যায় তা বাস্তবায়ন হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ রকম আশা করা কঠিন। সমস্যা হলো, যারা এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সমাধান তাদেরই হাতে। তাদের সে পথে যেতে বাধ্য করতে পারলেই কেবল সেটা সম্ভব। বলাবাহুল্য নয় যে সর্বজনের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে আরও অনেক কাজ। তার জন্য জনগণেরই প্রস্তুতি, সংগঠন ও সক্রিয়তা লাগবে।
কৌতুক, সহিংসতা এবং ক্ষমতার রাজনীতি
(১৯ জানুয়ারি ২০১৫ দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)