সম্প্রতি ঢাকার জুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাওয়ার আন্দোলনে দাবি তুলেছেন- ‘বিষের বদলে পানি চাই, বিষের জন্য বিল নাই।’ তারা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছেন ওয়াসার পানি কী মাত্রায় বিষাক্ত এবং তার জন্য মানুষের দৈনন্দিন জীবন কীভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, অসুখ-বিসুখ বাড়ছে, জীবন বিপন্ন হচ্ছে। বস্তুত এটা শুধু জুরাইনের নয়; ঢাকার প্রায় সব অঞ্চলেই পানি অনিরাপদ। অথচ মানুষ বিল দিচ্ছে বিশুদ্ধ, নিরাপদ পানির জন্য। তাই নিরাপদ পানি না পেলে বিল দেওয়া বন্ধ করা এবং আগের দেওয়া বিলের টাকা ফেরত চাওয়া খুবই যুক্তিযুক্ত। করের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মানুষ সরকারকে কর দেয় কিছু দায়িত্ব পালনের জন্য; কিছু লোকের ফুর্তি-শানশওকত আর বাহাদুরির জন্য নয়। যদি সেসব দায়িত্ব পালনে সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে কর পরিশোধ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তাদের আছে।
সামগ্রিক যে নীতি-কাঠামোর অধীনে গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকার পরিচালিত হচ্ছে, তার মূল কথা হলো- ১. জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব হ্রাস; ২. ক্রমাগত মানুষকে বাজার বা কতিপয় বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে ছেড়ে দেওয়া; ৩. রাষ্ট্রীয় শিল্প-কারখানা, জ্বালানি-বিদ্যুৎ, শিক্ষা-চিকিৎসা এবং সর্বজনের মালিকানাধীন সম্পদ যেমন পানি, বন, খাল-বিল, উন্মুক্ত স্থান ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক তৎপরতার জন্য ব্যক্তিমালিকানায় নিয়ে যাওয়া। একই নীতি-কাঠামোর অংশ হিসেবে বিশ্বের ক্ষমতাবান অর্থনীতির প্রয়োজনে দেশীয় অর্থনীতির শুল্ক্ককাঠামো, আইনকানুন ও নিয়মনীতিকে বিন্যস্ত করাও এর অন্তর্ভুক্ত। এসবের ফলাফল হিসেবে শিক্ষা ও চিকিৎসা দুটিই এখন ব্যয়বহুল; জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত বহুজাতিক পুঁজি এবং দেশীয় কতিপয় গোষ্ঠীর দখলে। এই নীতিগত ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হয়েছে।
সবাই এখন জানেন, ২০১৯-২০ অর্থবছর বা জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত সময়কালে সরকার কীভাবে আয় করবে, কী কী তার অগ্রাধিকার এবং কীভাবে তার ব্যয় হবে, তার সরকারি ভাষ্য। এটাই বাজেট নামে পরিচিত। এই অর্থবছরের বাজেট স্বাভাবিক নিয়মে আগের বছরগুলোর চেয়ে বড়। প্রতি বছরের বাজেট আগের বারের বাজেট ছাড়িয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধি পেয়েছে, জনসংখ্যা বেড়েছে। সংজ্ঞা অনুযায়ী
জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট) মানে এক বছরে।
সারাদেশে উৎপাদন ও পরিসেবার মোট আর্থিক মূল্য। হিসাবের বিদ্যমান বিন্যাসের কারণে জিডিপিতে বাংলাদেশের সব অর্থনৈতিক তৎপরতা অন্তর্ভুক্ত হয় না। বৈধ-অবৈধ সব অর্থনেতিক লেনদেন ও তৎপরতা অন্তর্ভুক্ত হলে জিডিপি আরও বেশি হবে।
অর্থনীতির আকারের তুলনায় টাকার অঙ্কে তাই বাজেট মোটেই বড় নয়। বাংলাদেশের বর্তমান পর্যায়ে উন্নয়ন গতির যে তাগিদ, সেই তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বরাদ্দও অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক বড়, বলা যাবে না। জিডিপির যে প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটাও অর্থনীতির গতি অনুযায়ী অস্বাভাবিক নয়।
প্রচলিত বাজেট আলোচনার একটা বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে আয় ও ব্যয় বরাদ্দের পরিসংখ্যান নিয়েই আটকে থাকা। আলোচনায় সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যানের গতি-প্রকৃতি, তার গুণগত দিক খুব কমই আসে। প্রকৃতপক্ষে বাজেট মানে শুধু টাকা-পয়সার হিসাব নয়। কোথা থেকে সরকার আয় করে, কোথায় সরকার তা ব্যয় করে, তা নির্ভর করে সরকারের উন্নয়ন দর্শনের ওপর; সামাজিক কোন শক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছে সরকার, তার
প্রতিফলন ঘটে বাজেটে। আয়-ব্যয় ঠিকভাবে বিশ্নেষণ করলে তা স্পষ্ট হয়। সে জন্য বাজেট বিশ্নেষণে বরাদ্দের পরিমাণ বিশ্নেষণ যেমন দরকার, পাশাপাশি দরকার এর গুণগত বিশ্নেষণ। বরাদ্দ মানেই তা জনস্বার্থে ব্যয় হচ্ছে- এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
গত কয়েক বছরে সরকার সফলভাবে জনগণের ওপর করজাল বিস্তৃত করেছে। ১০ বছরে কর থেকে আয় ছয় গুণ বাড়াতে পেরেছে। এ বছরও ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণের ওপর বোঝা বাড়িয়েছে। তার পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাজেটে বেশ বড় আকারের ঘাটতি। ঋণের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা। সে জন্য এই বছরে রাজস্ব বা অনুন্নয়ন বাজেট বিবেচনা করলে ঋণের সুদ তালিকায় শীর্ষ সারিতে। ঋণের সুদের এই বোঝা তৈরি হয়েছে অতীতের ঋণের জন্য। এই বছরও ঋণের ওপর যে নির্ভরশীলতা দেখা যায়, তাতে ভবিষ্যতে সুদের পরিমাণ আরও বাড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
রাষ্ট্রীয় বাজেটে ঋণ কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কিন্তু ঋণের টাকা কী কাজে ব্যবহার হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এই টাকা উৎপাদনশীল খাতের সম্প্রসারণ ঘটাবে, না বোঝা তৈরি করবে। যে নীতি-কাঠামো দিয়ে সরকার পরিচালিত হয়েছে, তাতে বিভিন্ন স্তরে উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি ও অপচয়ের বিষয়গুলো সবাই বুঝতে পারেন। যেমন কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে বিদ্যুৎ খাতকে ঋণনির্ভর করা হয়েছে, আর মানুষ এখন ৬ বছর আগের তুলনায় তিন গুণ দামে বিদ্যুৎ কিনছে। বাংলাদেশে সড়ক, সেতুসহ সব নির্মাণকাজই এখন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল। বড় দুর্নীতি কমিশন ছাড়া এর আর কোনো ব্যাখ্যা নেই। ঋণ করে রূপপুর, রামপালের মতো সর্বনাশা প্রকল্পও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সেগুলোর ধারাবাহিকতায় ক্রমান্বয়ে ঋণের বোঝা বেড়েছে। আর ঋণের সুদের বোঝা টানতে জনগণের ওপর আরও করের বোঝা চাপানো হয়েছে।
এবারের বাজেটে ভ্যাটের সম্প্র্রসারণ ঘটানোর ফলে
জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে। কিছুদিন
আগেও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে; সামনে আরও দাম বৃদ্ধির প্রস্তুতি চলছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে
জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তার সিংহভাগ কতিপয় গোষ্ঠীর মুনাফা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নির্ধারিত।
প্রাথমিক শিক্ষাসহ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আগের ধারাবাহিকতায় জিডিপির ২ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। শিক্ষাকে জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সে অনুযায়ী বাজেট পুনর্বিন্যাসের কোনো লক্ষণ এই বাজেটেও নেই। শিক্ষা খাতে ব্যয়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতসীমা হচ্ছে জিডিপির নূ্যনতম ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ এখনও তার তিন ভাগের এক ভাগ ব্যয় করছে। এর ফলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। বেশিরভাগ স্কুলেই ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি নেই; শিক্ষক নেই। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। গত কয়েক দশকে সরকার নির্বিশেষে এই ধারাবাহিক ভূমিকার কারণে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যের সম্প্র্রসারণ ঘটছে। কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট টিউশনি, গাইড বইয়ের বাণিজ্য গ্রাস করছে শিক্ষা খাতকে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ বিভিন্ন ভয়াবহ তৎপরতা বিপর্যস্ত করছে শিক্ষা খাতকে।
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। স্বাস্থ্য খাতে নিম্নমানের বরাদ্দ দিয়ে পাবলিক বা সর্বজনস্বাস্থ্য অবকাঠামো দুর্বল রাখা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যয়বহুল চিকিৎসা সম্প্রসারণের পথ তৈরি হয়েছে। কৃষি ও পাট বাংলাদেশের বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ধারণ করে। এ দুটি ক্ষেত্রেই বরাবর বরাদ্দ অনেক কম।
বাংলাদেশে চোরাই অর্থনীতির বিপুল সম্প্র্রসারণ হয়েছে গত এক দশকে। যারা বিপুল চোরাই সম্পত্তির মালিক, তারা এখনও কর-কাঠামোর বাইরে। সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবেই এই চোরাই অর্থনীতি জিডিপির কমপক্ষে ৪২ শতাংশ; তা শতকরা ৮৩ ভাগ হতে পারে। শতকরা ৫০ ভাগ ধরলেও এর পরিমাণ ১০ লাখ কোটি টাকার বেশি, যা বর্তমান বাজেটের দ্বিগুণ। এই চোরাই অর্থনীতির যারা মাথা, তারাই দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের কারণেই ব্যাংকগুলোর ফোকলা অবস্থা। এদের তৎপরতাতেই সমাজে সন্ত্রাস, দখল ও লুণ্ঠনের ঘটনা বাড়ছে। দুর্নীতির যে জাল তৈরি হয়েছে, তা ক্রমান্বয়ে আরও সম্প্রসারিত হয়ে জনগণের ওপর চেপে বসেছে।
বাজেট নীতির মাধ্যমে সরকার তার রাজস্ব আয়ের বেশিরভাগ আদায় করছে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু
বরাদ্দে স্বচ্ছতার অভাব, বিভিন্ন প্রকল্প বাছাই ও বাস্তবায়নে সীমাহীন দুর্নীতি, পরিবেশ দূষণসহ দখল-লুণ্ঠনের প্রতি সরকারের বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জনগণের করের টাকা ও তাদের নামে নেওয়া ঋণের টাকার বড় অংশ চলে যাচ্ছে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। এই চোরাই অর্থনীতির
দিকপাল বিপুল সম্পত্তির মালিকদের আয়ের বড় অংশ
কর-কাঠামোর বাইরে।
কৃষকরা দেশের মানুষের খাদ্যশস্য সরবরাহ করছে, গার্মেন্টস শ্রমিকরা এখন বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে, প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে পাঠাচ্ছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। জনগণের বিপুল অংশ কর দিয়ে সরকার চালাচ্ছে। মন্ত্রী, এমপি, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের শানশওকতের প্রতিটি অর্থ প্রকৃতপক্ষে জনগণের রক্ত-ঘাম থেকে আসে। জনগণ কর দিচ্ছে তাদের নিরাপত্তা, শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য; উৎপাদনশীল খাতে সম্প্রসারণের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য। তারপরও তাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন; তাদের কাজ নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান হচ্ছে না। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে জনগণের অর্থে প্রতিপালিত পুলিশ-র্যাব আটক-বাণিজ্য করছে, ক্রসফায়ার বাণিজ্য করছে, অন্যের ভাড়া খেটে খুন করছে। সন্ত্রাস ও সহিংসতায় নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হচ্ছে। কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে প্রণীত নীতি ও প্রকল্প খেয়ে ফেলছে জনগণের অর্থ। আর সেই লুটেরা দখলদারদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ব্যবহূত হচ্ছে প্রশাসন, আইন।
সে জন্য এখন করের বিনিময়ে জনগণ কী পাচ্ছে সরকারের কাছ থেকে- সে প্রশ্ন তোলাই জরুরি। জনগণ তার যা দেওয়ার তা দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সরকারের যা দেওয়ার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে সীমাহীন অনীহা, ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা। জনগণের মধ্য থেকে তাই জোর প্রশ্ন তুলতে হবে- আমাদের শিক্ষা, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, নিরাপদ পানি; আমাদের পাট, রেলওয়ে; আমাদের জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে যদি অর্থ ব্যয় না হয়, তাহলে আমরা কর দেব কেন?
(দৈনিক সমকালে ২১ জুন ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত)