কী হবে বাংলাদেশের?

bdআতংকের সমাজ, দখলদার অর্থনীতি, জমিদারী রাজনীতি এটাই বর্তমান সময়ের প্রধান পরিচয়। এর মধ্যেই আমরা ‘আছি’। বর্তমানে সারাদেশে দুর্নীতি দখলদারিত্ব, নানা অগণতান্ত্রিক আইনী বেআইনী তৎপরতা, সন্ত্রাস-টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি বিস্তারের সুবিধাভোগী খুবই নগণ্য। যদি সামনে বিএনপি জামায়াত বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় না থাকতো তাহলে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে তাদের ক্ষোভেই সরকার টালমাটাল হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটাই আত্নরক্ষার প্রধান অবলম্বন। ক্ষুব্ধ সমর্থকদের ধরে রাখায় বিএনপির-জামাতের ভয়, যুদ্ধাপরাধীদের অস্তিত্ব তাদের প্রধান ভরসা। বিএনপি-জামায়াতও এই অস্ত্রই বরাবর কাজে লাগিয়েছে। আওয়ামী আমলের ভীতি প্রচার, কৃত্রিম ভারত বিরোধিতা, ইসলাম ধর্ম বিপন্নতার প্রচারণা তাদের অনেক অপকর্ম জায়েজ করবার প্রধান অবলম্বন। যারা এখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপির পেছনে আছে তাদের অধিকাংশ অপছন্দ নিয়েই আছে, আছে অন্যদলের ভয়ে। অতএব জমিদারী রাজনীতির দুই ধারা পরস্পর পরস্পরের ভরসা, পরস্পর পরস্পরের জন্য অপরিহার্য। ঐক্য ও ধারাবাহিকতারও তাই কোন কমতি নেই।

যে কেউ বর্তমান সরকারের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের অন্যায় নিপীড়ন বা দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ালে সরকারি দল বা কর্তাব্যক্তিদের একটা মোক্ষম ঢাল হল এটা বলা যে, এটা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। শিক্ষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, জমি সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আন্দোলন সবাইকেই এই গালি শুনতে হয়। কিন্তু অস্ত্র হাতে সরকারি পান্ডা, নিয়োগ বাণিজ্যে নিয়োজিত মন্ত্রী এমপি, গুম খুনে সক্রিয় নানা বাহিনী, সরকারী হামলা নির্যাতন দখল, আর অদক্ষ বিচার প্রক্রিয়া থাকতে কি আর কারও চক্রান্ত করবার দরকার হবে? ৪০ বছর ধরে ৭১ এর দুর্বৃত্তদের বিচার আটকে ছিলো। জনগণের একটি বড় অংশ তারেক জিয়ার জমিদারি তান্ডব থেকে বাঁচার জন্য এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশায় আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। সরকারের ভূমিকা থেকে মনে হয় এই সরকার তারেক জিয়াকে মহানায়ক না বানিয়ে, যুদ্ধাপরাধীদের হাতে আত্নরক্ষার আরও পুঁজি সরবরাহ না করে ভুল নীতি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দখলদারিত্বের বর্তমান যথেচ্ছাচার থেকে সরবে না।

দম দেওয়া পুতুলের মতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন। পরিস্থিতি কাল প্রশ্ন কোনকিছুই তাঁর প্রোগ্রাম করা কথা বদলাতে পারে না। একের পর এক খুনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে, খুনি ক্ষমা পায়, তিনি সবসময় বলতে থাকেন ‘অপরাধী যেই হোক তাকে অবশ্যই ধরা হবে’। গুম খুন হাজার ছাড়িয়ে যায়; তিনি বলেন, ‘দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবচাইতে ভালো’। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হতে থাকে। অস্ত্র হাতে সরকারি সংগঠনের কর্মীরা নানাজায়গায় সন্ত্রাস তৈরি করে, দখল চলে। আইনমন্ত্রী গড়গড় করে বলতেই থাকেন, ‘আইন সবার জন্য সমান।’ চাঁদাবাজী শুধু উর্দিছাড়া নয় উর্দিপড়া লোকজনও করতে থাকে। আইনআদালত কী করে, তা নিয়ে তো কথা বলাই নিষেধ। প্রধানমন্ত্রী প্রায় সব সমস্যা সমাধানে নিজেই দায়িত্ব নেন। কিন্তু কোন সমাধান দেখা যায় না। দিনবদলের কথা অর্থহীন।

যাদের ২৪ ঘন্টা রাষ্ট্রীয় অর্থে প্রতিপালিত নানা বাহিনীর পাহারায় কাটে তারা ছাড়া বাকি কারও তাই আতংক আর কাটে না। নিজের ও স্বজনের জীবন নিয়ে, পথের নিরাপত্তা নিয়ে, জিনিষপত্রের দাম, জীবিকা, ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠা দিনরাত। সবচাইতে বড় ভয়, দিনের পর দিন সবকিছুতে অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা এখন এমনই যে, মানুষের জন্য মানুষের শোক, আতংক কিংবা উদ্বেগ নিয়েও একটু স্থির হয়ে বসা যায় না। নতুন আরেক আঘাত পুরনো শোক বা আতংককে ছাড়িয়ে যায়। টিভি বা সংবাদপত্রেরও ঠাঁই নাই সবগুলোকে জায়গা দেবার, কিংবা লেগে থাকার।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান দুইদলের সংঘাত কখনোই জমিদারী লড়াই এর চরিত্র থেকে বের হতে পারে নাই। যে অংশ ক্ষমতায় থাকে তাদের ইচ্ছা হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেবার। তাই একপর্যায়ে বিরোধ চরমে ওঠে। তখন মাঝেমধ্যে সম্রাটের দূতের মতো যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ এমনকি ভারতের প্রতিনিধিদের সাড়ম্বর আগমন ঘটে। সংঘাতে তাদের কর্তৃত্ব বাড়ে। দুইপক্ষ প্রতিযোগিতা করে প্রভুর জন্য আরও বাড়তি সুবিধা দেবার অঙ্গীকার করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চেষ্টা করে। আফ্রিকার দেশগুলোর মতো এদেশে গোত্র বা এথনিক সংঘাতের অবস্থা নাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপি লড়াই যেনো তার স্থানই পূরণ করতে যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংঘাত নিতে যাচ্ছে ট্রাইবাল সংঘাতের রূপ। সারাদেশ, সকল প্রতিষ্ঠান এই দুইভাগে ভাগ হয়ে আছে। যারা লাভবান হচ্ছে তারা তালিও দিয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে বা গোপনে।

দুই দলের ব্যানার দেখে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না। দেখতে হবে ব্যানারের পেছনে দাঁড়ানো দখলদার কমিশনভোগীদের। দলের ব্যানার আসলে ব্যবহৃত হয় তাদের মুখ ঢাকার জন্য। মানুষ দল দিয়ে বিচার করে, দলের উপর ভরসা করে, দলের উপর বিরক্ত হয়, ক্ষুদ্ধ হয়, ক্ষোভে-দুঃখে চিৎকার করে। দল আসে যায়। কিন্তু কমিশনভোগী, দখলদারদের কোন পরিবর্তন হয় না। তাদের শক্তি ও অবস্থান আরও জোরদার হয়। দুই দলের তীব্র সংঘাত চোখে পড়ে, আড়ালে দখল লুন্ঠন কমিশন সহ নানা তৎপরতায় অংশীদারীত্ব ঠিকই চলে বহাল তবিয়তে। ব্যাংক, শেয়ারবাজার, মুদ্রা পাচার, মিডিয়াসহ নানাজায়গায় তার স্বাক্ষর আছে।

সেজন্য গুম, খুন, ক্রসফায়ার, উর্দিপরা বা উর্দিছাড়া লোকজনদের ডাকাতি চাঁদাবাজী, কৃত্রিম কিংবা উস্কে তোলা রাজনৈতিক উত্তেজনা, হরতাল, বিদ্যুৎ সংকট এই সবকিছু নিয়ে মানুষের অস্থিরতা, উদ্বেগ, অসুস্থতার মধ্যে ঠিকই অনেককিছু হয়ে যেতে থাকে। শতকরা ১ ভাগের হাতে আরও সম্পদ কেন্দ্রীভ’ত হতে কোনো বাধা নেই। পাহাড় নদী বন দখলকাজে কোন সমস্যা নেই। দেশের সমুদ্র, সম্পদ, অর্থনীতিতে দেশি বিদেশি লুটেরাদের আধিপত্য বৃদ্ধির আয়োজনে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। এগুলোতে দুজনের বিরোধ নেই।

এখানে দুই বন্ধু (বা শত্রুর) গল্প বলি। এরা হতে পারে দুজন আমলা, দুজন ঠিকাদার, দুজন কনসাল্ট্যান্ট, দুজন মন্ত্রী এমনকি হতে পারে দুই সময়ের দুই সরকার। গল্পের শুরুরকালে বন্ধু ‘ক’ ও ‘খ’ এর সীমিত আয়, স্বাভাবিক জীবনযাপন। এরমধ্যে একদিন ‘ক’ ‘খ’ এর বাড়িতে গিয়ে হতবাক। ঘরবাড়িতে নতুন বিত্তের চিহ্ন। ‘কোথায় পেলে তুমি এসব?’ বারবার প্রশ্ন করায় এক পর্যায়ে ‘খ’ ‘ক’ কে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে বলে। বাইরে একটা সড়ক ছাড়া আর কিছু নাই। খ বলে ‘এটাই’। দিন মাস বছর যায়। খ যায় ক এর বাড়িতে। ক এর বাড়ির জাকজমক তার চাইতেও বেশি। ‘কীভাবে এত টাকা বানানো সম্ভব?’ ‘ক’ এবার হাসিমুখে খ-কে জানালা দিয়ে তাকাতে বলে। একটা সেতু, দুপাশে ভাঙ্গা, আধাখেচড়া পড়ে আছে। খ বুঝতে পারে। আবার দিনমাস বছর যায়। ক যায় খ এর বাড়িতে, এখন, সেটা অট্টালিকা। বিত্তের আওয়াজ বেড়েছে অনেক গুণ। ক এর মাথায় প্রশ্ন। ‘এত টাকা কীভাবে সম্ভব?’ খ আবার জানালা দিয়ে তাকাতে বলে। বাইরে কোন কিছু নেই। শুধু মাঠ। ক প্রথমে বুঝতে পারে না। খ বলে, ‘এই তো’। প্রথমে কাজ করে লাভ, পরে কিছু কাজ করে পুরো টাকা। পরে কিছুই না করে পুরোটাই মেরে দেয়া।

সেটাই তো হবার কথা। প্রক্রিয়া যদি একই থাকে ক্ষুধা দিন দিন বাড়তে থাকে। পেট তো ভরতে হবে। তাই এইভাবে চলতে চলতে মাঠ, গাছ, বন, জঙ্গল, পাহাড়, নদী, নালা, খালবিল সব হজম হতে থাকে। ক আর খ এর যখন যার সুযোগ আসে। কখনও প্রতিযোগিতা কখনও সহযোগিতা। কখনও ঐক্য কখনও সংঘাত। দখল, কমিশনের উপর দাঁড়ানো বিত্ত বৈভব শানশওকতে শহরের কিছু কিছু স্থান ঝলমল করতে থাকে। অনেকে স্মরণ করতে পারেন সেলিম আল দীনের ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসী’ নাটক। সবকিছুই প্রধান চরিত্র মুনতাসিরের খাদ্য। তার ক্ষুধার কোন শেষ নাই। আমাদের দেশে একের পর এক শাসক গোষ্ঠী একজনের থেকে অন্যজন আরও বেশি মুনতাসির। ক্ষমতাবানরা যখন এভাবে নিজের অর্থনীতি তৈরি করেন তখন রাজনীতি কেন জমিদারী থেকে আলাদা হবে? আমাদেরই বা সদা আতংক ছাড়া আর কী পাবার আছে?

দেশি বিদেশি দখলদারদের জন্য দুই দলের পালাবদল খুবই সুবিধাজনক। এই নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে, সমাজে এই চিন্তা টিকিয়ে রাখতে কারও কারও সক্রিয়তা আছে। এই অবস্থায় তাহলে কী হবে বাংলাদেশের? দুই জমিদার আর দুই ডাইনাস্টির আড়ালে, চোরাই টাকার মালিক সন্ত্রাসী প্রতারক দখলদার কমিশনভোগীদের হাতে, নিজেদের সর্বনাশ দেখতেই থাকবে শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ? তাহলে কী আর কোন উপায় নেই? শক্তিশালী মিডিয়া ও সুশীল সমাজের দরবারে এই বলয়ের বাইরে আলোচনারও সুযোগ কম। ভিন্নস্বর ভিন্নসত্য ভিন্ন সম্ভাবনা নিয়ে মানুষের চিন্তার সুযোগও তাই তৈরি হয় না। ফলে জনগণের মধ্যে এক অসহায়ত্বের বোধ এখন প্রায় স্থায়ীরূপ নিয়েছে।

কিন্তু এই দুই ধারার একটির বদলে অন্যটি আমাদের বর্তমান অবস্থার যে কোন সমাধানই দেবে না তা বোঝার জন্য আর কত পালাবদল দরকার? আর কত ক্ষয় আর কত সর্বনাশ দেখতে হবে আমাদের? এই জমিদারি সংঘাত ও ঐক্য কোথায় নিয়ে যাবে দেশকে, ক্ষমতা তাদেরও হাতে থাকবে কি না, দেশি বিদেশি কারা অপেক্ষমান সবকিছুই এক ভয়ংকর অনিশ্চয়তা। এই বিষচক্র থেকে বাঁচার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সামরিক শাসন যে সমাধান নয় তার প্রমাণ বারবার হয়েছে। বরং এতে এই প্রক্রিয়ারই আরও শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। আর দুইজনের সংলাপ ও ঐক্য? তাতে এই ধারাবাহিকতা ও জনগণের অবস্থার পরিবর্তনের তো কিছু নেই।

সেকারণেই যুদ্ধাপরাধী ও লুটেরাশক্তির, দখলদার ও জমিদারদের রাজনৈতিক মতাদর্শিক প্রভাব অতিক্রম করে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ছাড়া আর কোনই উপায় দেখি না। নিষ্ক্রিয়, আচ্ছন্ন আর সন্ত্রস্ত জনগণের মধ্যে ক্ষমতার বোধ বিকশিত হওয়া ছাড়া এটা সম্ভব নয়। দখলদারদের দাপটে বাংলাদেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখাই এখন অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতার জালের আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হলে, নিজেদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে সক্ষম হলে, জনগণ তার অন্তর্গত বিশাল শক্তিও অনুভব করতে সক্ষম হবে, সক্ষম হবে স্বাধীন পথ গ্রহণ করতে। মানুষ যদি নিজে মুক্ত না হয়, তার মুক্তির কোন সম্ভাবনা তৈরি হয় না।।

(অক্টবর ২৩, ২০১৩ তারিখে আমাদের বুধবার এ প্রকাশিত)